poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
ঝড়ঝঞ্ঝা নিয়ে আছি আমরা সবাই চিরদিন;
কত ঘর প্রায় প্রতি বছর যায় যে উড়ে আর
মাঝে-মাঝে জলোচ্ছ্বাস বসতি নিশ্চিহ্ন করে, মনে
অগণিত নরনারী, শিশু। পশুপাখি, গাছপালা
ধ্বংসের গহ্বরে যায়, এমনকি তৃণমূল মাটি
ছেড়ে শূন্যে ধায় এলোমেলো, অনন্তর মুষলের
বৃষ্টি হয়ে ঝরে অবিরত কত শত নিকেতনে।
চাই না এমন ঝড়, স্বৈরাচারের মাতন আর।বরং আসুক সেই ঝড়, যার মত্ততায় পাকা
ফসলের ক্ষেত নয়, কলরবময় জনপদ,
প্রাণিকুল নয় আর ধ্বংস হোক মৌল দানবের
দাপট সন্ত্রস্ত দেশে দেশে; অবিচার, অনাচার,
সকল অন্যায় নিমেষেই কড়ের কুটোর মতো
ভেসে যাক, লোপ পাক অশুভ শক্তির চণ্ড নীতি। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
বাঁচতে পারবে? কী করে বাঁচবে? চৌদিকে ক্রূর
কী একটা যেন তোমার গন্ধ বেড়াচ্ছে শুঁকে;
বুঝি ছায়াটাও কালো ইস্পাতী নখর-ফলায়
ফেলবে উপড়ে। বাইরে সদাই কতো সুচতুর
ফাঁদ পাতা থাকে, কন্টকময়; সুখে কি অসুখে
নির্বান্ধব, বেখাপ্পা তুমি চলায় বলায়।কাদায় নুড়িতে এবং খোয়ায় নিজের রক্ত
দেখেও তোমার শিরায় গলিতে তুহিন প্রবাহ
বয় না, শুধুই লোহার অনেক হিজিবিজি শিক
চোখে এঁটে দেয় খাঁচার নকশা। আর অলক্ত
ভ্রান্তিবশতঃ মগজের ঝোপে হানে দাবদাহ।
জটিল ধোঁয়াটে স্বপ্নগুহায় ঘোরে বৃশ্চিক।আত্মগোপন করতে কি চাও পাতার লুকোনো
সবুজ দুর্গে? বৃক্ষ মাচায় পাবে আশ্রয়?
সঙ্গ নেবে কি পাতালনিবাসী কাঁকড়া কোনো?
নিসর্গপ্রীতি আর বিপদের বিবাদ চুকোনো
সহজ তো নয়। বস্তুত তুমি খুঁজছো অভয়
তীব্র সত্তা-সঙ্কটে এই বিজনে এখানে।বাদামের খোলে ঢুকেও তোমার নেই নিস্তার।
অলিগলি আর সদর রাস্তা, বাস ডিপো আর
জাহাজঘাটের মাটি ফুঁড়ে ঐ আসছে কেবল
আসছে উড়িয়ে ধুলোবালি ক’রে ত্রাস বিস্তার।
চৌদিক থেকে আসছে নিয়ত রাগী গন্ডার
হাজার হাজার; রৌদ্রে খড়্গ করে ঝলমল।বৃথাই লুকোনো, বরং পাতার দুর্গপ্রাকার
গাছের কোটর কিংবা শুকনো বাদামের খোল
থেকে দ্বিধাহীন বেরিয়ে আসাই শ্রেয় অবশ্য।
গন্ডার শুধু গন্ডারে আজ সব একাকার,
খণ্ডিত তুমি নিরুপায় শোনো ধ্বংসের রোল;
তোমার বিলয়ে ফলবে অন্য কারুর শস্য। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
আচানক মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়। মনে হ’ল,-
কিছু পদধ্বনি যে প্রবেশ করছে
খুব কাছে। চেয়ে দেখি চারটি রুপালি
কঠোর, নিষ্ঠুর পদযুগ। সেগুলোর অধিকারী
রয়েছে তাকিয়ে এই ভ্যাবাচ্যাকা-খাওয়া লোকটির
দিকে, যেন ওরা তাকে এক্ষুনি চিবোবে!বেশ কিছুক্ষণ ওরা ঘরের ভেতরে দাঁড়ানোর পর এই
সন্ত্রস্ত আমাকে বন্দি ক’রে
নিয়ে চলে ঘরের বাইরে বহুদূরে। হঠাৎ বিকট সেই
চারজন তাদের বন্দিকে গাছে বেঁধে মিশে গেল ধোঁয়াশায়।
আকাশে চাঁদের হাসি জেগে উঠতেই খ’সে যায়
বন্দিদশা আর নানা দিকে ফোটে পুষ্পরাজি।
অকস্মাৎ চোখে পড়ে কতিপয় বিদঘুটে জীব
ভয়নক নখ দিয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলছে সকল ফুল আর
বমন ছড়িয়ে দিচ্ছে এদিকে-সেদিকে। কী করে যে
আমার ভেতর এক দূরন্ত বিদ্রোহ জেগে ওঠে
বিদঘুটে জীবদের তাড়াবার- নিজেই বুঝিনি।
চতুর্দিকে অপূর্ব পুষ্পিত ঘ্রাণ আর শোভা জন্ম নেয়।যাব আর কত দূর, কে আমাকে বলে দেবে
এই কণ্ঠকিত পথে? কোথায় পথের হবে শেষ?
এ-পথের শেষ নেই; যতদিন বেঁচে আছি, পথ
ডেকে যাবে আজ একদিকে, কাল অন্য দিকে আর
নিষ্ঠুর নানা দিক থেকে রংবেরঙের খেলা
দেখিয়ে চকিতে কেড়ে নেয় অপরূপ এক মেলা। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
স্বদেশমূলক
|
দেখতে কেমন তুমি? কী রকম পোশাক-আশাক
প'রে করো চলাফেরা? মাথায় আছে কি জটাজাল?
পেছনে দেখাতে পারো জ্যোতিশ্চক্র সন্তের মতন?
টুপিতে পালক গুঁজে অথবা জবরজং, ঢোলা
পাজামা কামিজ গায়ে মগডালে এক শিস দাও
পাখির মতোই; কিংবা চা-খানায় বসো ছায়াচ্ছন্ন?দেখতে কেমন তুমি? অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে
কুলুজি তোমার আঁতিপাঁতি। তোমার সন্ধানে ঘোরে
ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য, পাড়ায় পাড়ায়। তন্ন তন্ন
করে খোঁজে প্রতি ঘর।পারলে নীলিমা চিড়ে বের
করতো তোমাকে ওরা, দিত ডুব গহন পাতালে।
তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছো হাত ধরে পরস্পর।সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ-তাড়ানিয়া :
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার।
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
কাঠ ছুঁয়ে রাখাই ভালো
প্রথমবারের মতো এই বিরতিহীন ষ্ফূরণ
নয় চকমকি ঠোকা প্রজাপতির অনুসরণও নয়
আমার ভেতর থেকে অজস্র পুঁতি আর
হীরের ঠিকরে-পড়া যেন মাটিতে লেগে বৃষ্টির লাফ
তাক-লাগানো রশ্মির বিচ্ছুরণআমি কি রঙিন কোনো ফোয়ারা
দিনরাত্তির জ্যোৎস্নাকণার মতো উৎক্ষিপ্ত
জলধারার উৎস নীল রঙের পাখি
আর জলকপোত চমৎকার স্নাত
সুস্থ সবল যুবক খঞ্জ প্রৌঢ় ঘাটের মড়া সবাই
অঞ্জলি পেতে নিচ্ছে তো নিচ্ছেই
যে দানোর দখলে আমি সে কখন এক ঝটকায়
আমার ঘাড় মটকায়
এই দুর্ভাবনার ফেউ আমার সঙ্গ ছাড়ে না
পবিত্রতার ঝলকময় মৌমাছিদের প্রশ্রয় চারপাশে
চিরন্তনতার মঞ্জীর ঝনঝনিয়ে
আমাকে বানায় ঘূর্ণ্যমান দরবেশ
হাওয়ায় হাত বাড়ালেই পাওয়া
পেয়ে যাই গাছের পাতা ছুঁলে
ঝিলে আলগোছে পা ভিজিয়ে নিলে
নিঃশ্বাস নিলে জানালার দিকে মুখ রেখে
দরজা খুলে দাঁড়ালে তার কথা ভাবলে
ক্যালেন্ডারের দোলখাওয়া পাতা থেকে পেয়ে যাইএ কেমন ষ্ফূরণ তখন
সত্তা থেকে জ্যোতির্ময় নিঃসরণে বিস্মিত
নিজেই পারি না চোখ ফেরাতে
আমার চোখ থেকে দোয়েল পাঁজর থেকে বুলবুল এবং কান থেকে মুঠো মুঠো নক্ষত্র নিঃসৃত
এখন আমি বড়দিনের ঝলমলে গাছ (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
কী-যে হলো, কোলাহল শুনে নিভাঁজ নিভৃতি ছেড়ে
বেরিয়ে পড়েছিলাম খোলা পথে একদা আমিও,
দীর্ঘকাল বিষাদে বাঁশিটি ফেলে রেখে এক কোণে
ঘুরপথে কায়ক্লেশে এসেছি বলে কি প্রত্যাখ্যাত
ফিরে যাব ম্লান মুখে? তাকাবে না পথভ্রষ্ট এই
পথিকের দিকে একবারও? সভাকক্ষে হয়েছেন
জড়ো যাঁরা, তাঁরা সগৌরবে করেছেন নিবেদন
রকমারি জড়োয়া গয়নাগাঁটি, প্রফুল্ল কাতান,
কেউ কেউ শিল্পিত গ্রামীণ কাঁথা তোমার উদ্দেশে,
গ্রহণ করেছ হেসে সেসব প্রসিদ্ধ উপহার।
আজীবন ভীষণ উড়নচণ্ডে আমি, পরিণামে
আমার গচ্ছিত ধন, যা দিয়ে তোমার জন্যে কিছু
উপহার আনব ভেবেছি বহুদিন, বহুরূপী
ছলনায় উড়িয়ে দিয়েছি সব খোলামকুচির
মতো; ফলে আজ শুধু একটি ফুলের মালা নিয়ে
এসেছি তোমার কাছে অবহেলিত বাঁশির সুর
শোনাতে আবার। শুনবে তো? নাকি মুখমণ্ডলীর
গুঞ্জরণে কান পেতে আমাকে নিছক উপেক্ষার
ধূসরতা দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখবে। মাথানত
করে চলে যাব তবে তাচ্ছিল্যের কাঁটাবন থেকে?অবশ্য আমার ধড়াচূড়ো নেই, গায়ে ধুলো, পায়ে
ক্রমাগত ঘুরে বেড়ানোর রক্তিম প্রসূন, ক্ষত।
তোমার অত্যন্ত সমাদৃত অতিথিরা অট্রহাসি
হাসবেন আমার সামান্য বাঁশি দেখে, আর এই
আমাকে ভিখিরি ভেবে তড়িঘড়ি আনবেন ডেকে
যমমুখো সশন্ত্রদ্বারীকে। তবু তুমি গরীয়সী
দয়া করে খানিক সময় দাও আমাকে, যাচাই
করে নাও বাঁশি থেকে সুর মঞ্জুরিত হয় কিনা-
চেয়ে দ্যাখো, আমার সুরের তালে লয়ে সভাঘরে
চলেও আসতে পারে, লতাগুল্ম পাথর, হরিণ। (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
অসুখ আগেও ছিল, কিন্তু আজকাল কষ্ট হয়
খুব, নষ্ট হয় ক্ষয়া শরীরের স্থিতিস্থাপকতা
প্রায়শই। বৃদ্ধ কবিরাজ আয়ুর্বেদীয় ধারায়
ওষুধ দিলেন, যাতে ফুসফুস থাকে ঠিকঠাক।
কৌটো যত্নহীন এক কোণে পুরু ধুলোময়তায়
ঝিমায়, কবিতা আসে অমাবস্যার রাতে, শুষে নেয়
মেদমজ্জা, গড়ে থাকি অবসন্ন; অক্ষয়ের দ্যুতি
পূর্বস্মৃতি হঠাৎ জাগিয়ে তোলে, বাড়ে অসুস্থতা।
নিজের কবিতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে পড়ার সাধ আজ
স্তিমিত, এমনকি বন্ধুর কাছেও পদ্য টদ্য
এগিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা বনবাসে গেছে। যতদিন
আয়ু জ্বলে ধিকি ধিকি, ততদিন অন্তরালে বসে
কবিতার মুখ দেখে নিতে চাই গোধূলি বেলায়,
মধ্যরাতে, সভা সমিতিতে গরহাজির থাকব।
খারাপ ভাবছ বুঝি? এখন কী করি আর? এই
অসুখের ধরণই এমন, করে কর্তব্যবিমুখ। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
সহসা যীশুর হাত আমার উন্মুক্ত জানালায়
বাজে রবাবের মতো। হাতের তালুতে পেরেকের
দাগগুলি সিংহচক্ষু; ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর পতনের
স্মৃতি নিয়ে এ আমার চক্ষুদ্বয় অতি কৃশকায়
সে-হাতে নিবদ্ধ হয়। আমি কেমন অস্থিরতায়
শয্যায় আহত মাছ, শুধু টগবগে আবেগের
খুরধ্বনি শিরাপঞ্জে; নিশীথের মদির মেঘের
ময়ূর মাথায়, স্রোতে যেশাসের গাধা ভেসে যায়।কোনো কিশোরীর উন্নয়শীল স্তনের মতন
অথবা পাছার মতো আমার ভাবনা স্ফীত হতে
থাকে নিদ্রাহীন মধ্যরাতে। হায়, কোন্ মরুপথে
যাবতীয় জরুরি দলিল দস্তাবেজ তাড়াহুড়ো
করে আমি আঁধারে এসেছি ফেলে? মোহান্তের মন
নিয়ে তবু মাংসের স্বপ্নের শালীনতা করি গুঁড়ো। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
দুপুর প্রবেশ করে আমার ভেতরে, কী উদ্দাম
হাওয়া একরাশ বুকে পায় ঠাঁই। সে আছে এখানে
আমার নিকটে বসে, যার কণ্ঠ মৃদু কথা-গানে
পল্লবিত মাঝে মধ্যে এই স্তব্ধতায় ছিমছাম
পরিবেশে, শুধু চেয়ে থাকা কখনো বা, তার নাম
ধূপের মতোন জ্বলে আমার শিরায়। কী যে মানে
অমন দৃষ্টির আজো বুঝতে পারিনি, কিন্তু দানে
দানে ভরিয়েছে সে আমাকে। আগে কী শূন্য ছিলাম।তবু কি শূন্যতা মুছে যায়? তবে কেন রিক্ত সুর
বেজে ওঠে বারংবার? কেন মনে হয়,আমি শুধু
তার রাজধানী থেকে দূরে চলে যাচ্ছি নির্বাসনে
মুকুট বিহীন একা? দেখি পড়ে আছি খুব ধূ ধূ
পাথুরে জমিনে, কণ্টকিত গুল্মে দীর্ণ চোখ, মনে
প্রেত-নৃত্য। সে-ও যেন বিবাগিনী উদাস দুপুর।
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
সুপ্রাচীন পাণ্ডুলিপি গাংচিলের ধরনে আসে
আমার নিকট,
তুলোট কাগজ নয়, ভূর্জপত্র নিশ্বাসে প্রশ্বাসে
মেশায় সুদূর ঘাণ। দু’টি সুডৌল মংগলঘট
জানে দোরগোড়ায় কখনো স্বপ্নে বুঁদ
হলে কারো বাড়া ভাতে ছাই
পড়বে না; স্মৃতির বুদ্বুদ
কেবলি উঠতে থাকে পাণ্ডুলিপি থেকে। যে-শানাই
স্তব্ধ ছিল বুকের ভেতর এতকাল,
স্মরণীয় চোখের মতন অক্ষরের আকর্ষণে
বেজে ওঠে, কবেকার নহবতখানা ভাসমান, বাঘছাল
আর পাণ্ডুলিপি করে গলাগলি মহুয়ার বনে।যদি প্রশ্ন করি,
এই পাণ্ডুলিপি কার, পাবো না উত্তর
কস্মিনকালেও। হতে পারে ভর্তুহরি
কিংবা বানভট্র নিরন্তর
সাধনার পর প্রত্যুষের সিঁথির সিঁদুর আর
অরণ্যের বিবাহ ঘটিয়ে করেছেন যজ্ঞমানি
শাশ্বতের; উড়ন্ত এ ভূর্জপত্রে তার
স্বাক্ষর আঁধারে যেন ফ্রুয়োসেস্ট-বাণী?
সেঁজুতিও বলা যায়। এই পাণ্ডুলিপি
সুধীন্দ্রনাথের সংবর্ত খুলে পেয়েছি কি আমি।
মোদো মধ্যরাতে? নাকি বোতলের ছিপি
ব্যাকুল খুঁজতে গিয়ে গৃহকোণে পেয়েছি? জানেন অন্তর্যামী।দূরাগত পাণ্ডুলিপি দৃষ্টি মেলে, যেমন তাকায়
সদ্যমুক্ত প্রফুল্ল কয়েদী মেঘে মেঘে
ভাসমান পাখিদের প্রতি। খুঁটে খায়
রৌদ্র জ্যোৎস্না, কখনো সুপুরিগাছে লেগে
থাকে যেন কাটা ঘুড়ি। কখনো সে অভিভাবকের
ঢঙে বলে গাঢ় কণ্ঠস্বরে
‘ওহে তোমাদের
এখন কিছুই নেই ঠিক ঠাক। তোমাদের স্নেহ-ছাওয়া ঘরে
দিয়েছে আগুন যারা, তারা
আপাদমস্তক পরে সুহৃদের সাজ,
নকল গৌরবে আত্মহারা
করছে ধ্বংসের কী ব্যাপক ভয়ংকর কারুকাজ’। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
“দেখে নিও আমি মহাপুরুষের ভূমিকায় ঠিক
উৎরে যাবো একদিন। হবো তথাগত কিংবা যীশু,
দগ্ধীভূত আত্মায় ফেলবে ছায়া কোনো বোধিদ্রুম।
ফন্দিবাজ জনরবে কান দিয়ে, জিঘাংসায় মেতে
চেনা দেশে করবো না প্রতারিত শান্তির পাখিকে
চতুর মিলিত ফাঁদে। পথে হাঁটে জীবিত মানুষ,
ভালবাসে পৃথিবীর তাপ, রাত্রিবেলা পুত্র ভয়ে
চেঁচিয়ে উঠলে ঘুমে জোরে বুকে চেপে ধরে তাকে-
ঘৃণার ত্রিশূলে তাকে কী করে বিঁধবো অকাতরে?“হে পিতৃপুরুষবর্গ তোমাদের মিলিত শোণিত
বিষণ্ণ বংশের রক্তে জাগায় প্রতীকী শিহরণ
মতবাদ-পীড়িত যুগের গোধুলিতে। সংবর্ধনা
পায় তারা নষ্ট বাগানের স্তব্ধতায়, বিষাদের
ইন্ধন জোগায় নিত্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত, সময়ের
কাৎরানি মূঢ়তা আর মিথ্যাচার, যা-কিছু নিশ্বাসে
অগোচরে সহজে মিশিয়ে দেয় বিন্দু বিন্দু বিষ।“যে স্মৃতি ভ্রাতৃহননে প্ররোচিত করে বার বার
প্রেতায়িত মন্ত্রণায়, সে-স্মৃতির কর্কশ চিৎকারে
কেঁপে ওঠে গৃহস্থালি ভয়-পাওয়া পায়রার মতো,
বন্ধু হয় জানালা কপাট, তাড়া খেয়ে দিন ঢোকে
রাত্রির গুহায়, অমঙ্গল খিল খুলে আঁধিঝড়ে
সদম্ভে বেরিয়ে পড়ে চৌরাস্তায়-আমি সুনিশ্চিত
দায়ভাগী তার। চিরন্তনী অপচয় আমাদের
সব স্বপ্ন নষ্ট করে, চোখ জুড়ে থাকে কিমাকার
জন্তুর কংকাল কোনো। ধ্বংসস্তূপ ফুলে ঢেকে আমি
বিষাদের গাথা লিখি শ্রীযুক্ত বিষণ্ণ পরিমল।“খাবার টেবিলে বসে মেজাজ খারাপ করে আমি
সান্ত্বনাদায়িনী মাকে বলি শিশু নই, কাঁহাতক
খোকা সেজে থাকা যায় অবিচল স্নেহের নকশায়!
আমার অনেক কাজ। পৃথিবীটা দৃশ্যকাব্য হলে
ছিল না ঝামেলা মোটে, মহিমার শিরস্ত্রাণ পরে
বস্তুপুজ্ঞে দিতাম মিশিয়ে ঢের রহস্যময়তা।““বাচাল প্রিন্টিং প্রেস জয়োল্লাসে দিচ্ছে জন্ম আজ
যে-উচ্ছিষ্ট সভ্যতাকে আমি তার ম্লান, স্বরহীন
ক্রীড়নক হবো শুধু? আমার মগজে সারাক্ষণ
প্রকাণ্ড, উজ্জ্বল এক রাজহাঁস পাখা ঝাপটায়,
কেবলি হোঁচট খায় দেখি স্বপ্নলোকের চৌকাঠে।
ধাতুর চত্বরে বসে অজস্র পেরেক ঠোকে কারা
শক্ত কাঠে সর্বক্ষণ, স্বপ্নে দেখি, নৈরাজ্যে অস্থির
প্রসিদ্ধ গ্রন্থের সব মহান হরফ মুছে যায়,
চতুর্দিকে মুণ্ডহীন মানুষের অখণ্ড স্বরাজ!
ফুটপাথে হন্তারক হাওয়ার শাসানি পরিমল
বোঝেনি বস্তুত তাই যখন পৈশাচী অন্ধকারে
ভায়ের উৎকট গন্ধ নেকড়ের মতো হিংস্রতায়
শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, দৃষ্টি-অন্ধ-করা রক্ত দেখে
থমকে চায়, চোখ জুড়ে থাকে স্থির এক অবিশ্বাস,
(রাজহাঁস মুখ থুবড়ে পড়ে নর্দমায়) পৃথিবীতে
সম্প্রতি কোথাও নেই শ্রীযুক্ত বিষণ্ণ পরিমল! (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
(আবদূর রাজ্জাক খান বন্ধু বরেষু)শেষ-হয়ে-আসা অক্টোবরে
শীতের দুপুরে নিউইয়র্কের অরচার্ড স্ট্রিটে ঘুরে ঘুরে
একটি দোকান দেখি মায়াপুরী, দোকানি ওয়াল্ট ডিজনির
আশ্চর্য ডবল, বলা যায়। দিলেন পরিয়ে গায়ে
স্মিত হেসে সহজ নৈপুণ্যে নীল একটি ব্লেজার। ব্লেজারের
বুকে জাগে অরণ্যের গহন শ্যামলপ্রসূ, সরোবর-উদ্ভুত অমর্ত্য
দূরায়নী তান।
সুনীল ব্লেজার ঝুলে আছে
আলনায়, কাঠের হ্যাংগারে একা আমার পুরানো ম্লান ঘরে
মালার্মের কবিতার স্তবকের মতো নিরিবিলি,
অথচ সংগীতময় সর্বক্ষণ অস্তিত্বের পরতে পরতে।
নানান সামগ্রী ঘরে থরে থরে, কিছু এলোমেলো; সামগ্রীর ভিড়ে
সুনীল ব্লেজার যেন বহু গদ্য-লেখকের মাঝে
বড় একা একজন কবি।
ব্লেজারের দিকে চোখ যায়
যখন তখন, দেখি সে আছে নিভৃত অহংকারে,
থাকার আনন্দে আছে, নিজের মতন
আছে; বলে সান্দ্র স্বরে, ‘এই যে এখানে আছি, এই
থাকা জানি নিজেই তাৎপর্যময় খুব’। এ মুহূর্তে
যদি ছুঁই তাকে, তবে মর্মরিত হবে সে এখন, উঠবে জেগে
স্বপ্ন-সুদূরতা থেকে।কখনো ব্লেজার কৌতূহলে
দ্রুত জেনে নিতে চায় তরুণ রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরী দেবীকে কখনো
তীব্র চুমো খেয়েছেন কিনা জোড়াসাঁকোর ডাগর অভিজাত
পূর্ণিমায়,
নব্য কবিসংঘ কী পুরাণ নিয়ত নির্মাণ করে মেধার কিরণে আর
শীতার্ত পোল্যান্ড আজ ধর্মঘটে রূদ্ধ কিনা কিংবা কোন
জলাভূমিতে গর্জায়
গেরিলার স্টেনগান, হৃদয়ের মগ্নশিলা, আর্ত চাঁদ
ইত্যাদিও জানা চাই তার।ভোরবেলা ঘন
কুয়াশার তাঁবুতে আচ্ছন্ন চোখ কিছুটা আটকে গেলে তার
মনে হয় যেন সে উঠেছে জেগে সুদূর বিদেশে
যেখানে এখন কেউ কারো চেনা নয়, কেউ কারো
ভাষা ব্যবহার আদৌ বোঝে না; দেখে সে
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ,
হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।কোথায় পাগলাঘণ্টি বাজে
ক্রমাগত, এলোমেলো পদধ্বনি সবখানে। হামলাকারীরা
ট্রাম্পেট বাজিয়ে ঘোরে শহরে ও গ্রামে
এবং ক্রন্দনরত পুলিশের গলায় শুকায় বেল ফুল।
দশদিকে কত রকাডেমিতে নিশীথে
গোর-খোদকেরা গর্ত খোঁড়ে অবিরত, মানুষের মুখগুলি
অতি দ্রুত হয়ে যাচ্ছে শিম্পাঞ্জির মুখ।গালিবের জোব্বা,
দিল্লির সূর্যাস্ত যেন, রবীন্দ্রনাথের আলখাল্লা অনুপম,
মৌলানা রুমির খিরকা, বোদলেয়ারের মখমলি
কালো কোট দুলে ওঠে আমার সুনীল ব্লেজারের কাছাকাছি।
কিছু অসন্তোষ গাঁথা সুতোয়, বিশদ কারুকাজে;
ইতিহাসবিদ্বেষী ব্লেজার পুণ্য নীল পদ্ম অকস্মাৎ,
অবাধ স্বাতন্ত্র্য চায় ব্যাপক নির্মুখতায় আজ।নষ্ট হয়ে যাবে
ভেবে মাঝে মাঝে আঁৎকে ওঠে, টুপির মতন ফাঁকা
ভবিষ্যৎ কল্পনায় মূর্ত হয়ে কখনো কখনো,
কবরের অবরুদ্ধ গুহা তাকে চেটেপুটে খাবে
কোনো দিন, ভাবে সে এবং নীল পাখি হয়ে দূর
সিমেট্রির মিশকালো সাইপ্রেস ছেড়ে পলাশের রক্তাভায়
ব’সে গান গায়। (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
বেলাশেষে পড়ছেন তিনি নন্দনতত্ত্বের বই
গভীর অভিনিবেশে। তিনি আইডিয়ার অথই
সমুদ্রে নাবিক সুপ্রাচীন। জানি দেশজোড়া খ্যাতি
তাঁর পাণ্ডিত্যের, মনীষার; আর বন্ধুবর্গ, জ্ঞাতি
সকলেই জানে তাঁর চক্ষুদ্বয় ঘোরে নিরিবিলি
বইয়ের পাতায়, তত্ত্ব ও তথ্যের খুব ঝিলিমিলি
দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে। কদাচিৎ তিনি চোখ তুলে
বই থেকে তাকান আকাশে আর দিব্যি ভুলেথাকেন প্রায়শ নাওয়া খাওয়া। নিজেকে আড়ালে রেখে
ধুন্দুমার হট্ররোল থেকে প্রায় সব কিছু থেকে
নিভৃতে করেন ধ্যান-সুন্দরের। মানে তাঁর ডানে
বামে তাকাবার নেই মহলত। কোনো সুর কানে
ভেসে এলে দূর থেকে হন সচকিত, তারপর
আবার পড়েন ঝুঁকে অগণিত ছাপার অক্ষরে।
বইয়ের পাতায় তিনি সৌন্দর্য খোঁজেন রাত্রিদিন,
দ্যাখেন যাচাই ক’রে কী বলেন রসিক রাসকিন
অথবা কেনেথ ক্লার্ক। অথচ খেয়াল নেই কবে
আড়ালে আত্মঙ্গ তাঁর হলো তম্বী রূপের বৈভবে! (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
আমার চোখের আলো এখনো তো নয় খুব ক্ষীণ-
ঘরবাড়ি, গাছপালা, নদী, খোলা পথ, বন্ধ দ্বার,
নানা জীবজন্তু দেখি, পাথরের নিচে লোকটার
গেরস্থালি, তা-ও দেখি, দৃশ্যাবলী দেখি প্রতিদিন।
যদিও বয়স ত্বকে ধুলোরাশি ছড়াচ্ছে মলিন,
তবু ও শ্রবণশক্তি অতিশয় প্রখর আমার,
এখনো জিভের কাজ চলে নিয়মিত, এই ঘাড়
পাহাড়ের মতো, আজো কণ্ঠস্বর তেজী, ক্ষমাহীন।তবে কেন বারংবার দেখেও অনেককিছু আজ
না দেখার করি ভান? কেন সাজি বিহ্বল বধির?
কেন কণ্ঠস্বর রাখি চেপে সর্বক্ষণ? আর আমি
বোবা-কালা সেজে থাকবো না-এ স্বরের কারুকাজ
পৌঁছে দেবো মেঘনা নদীর নিচে ব্যাকুল অধীর
পাহাড়ে পাহাড়ে-কন্ঠস্বর হবেই সর্বত্রগামী। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
একটি দ্বীপের অধিবাসী অষ্টপ্রহর
অন্ধকারে ডুবে থাকে। যায় না দেখা কোনও কালে
তাদের কিংবা অন্য কারও দেহের ছায়া।
ভুলেও কেউ আসে না সেই দ্বীপের তীরে।মাঝে-মধ্যে দ্বীপবাসীরা
হাওয়ার ছন্দে নেচে ওঠে, ওদের গানের তালে তালে
ফুলের, ফলের গাছেরা সব দুলতে থাকে-
যেন ভীষণ মাতাল ওরা, লুটবে ধুলোয়।দ্বীপবাসীদের মধ্যে ক’জন ছিলো বটে
খুব আলাদা। অন্যেরা সব নেশায় ডুবে থাকলে ওরা
থাকতো দ্বীপের বাইরে কোনও আলোকিত দ্বীপের খোঁজে
যাবার জন্যে নৌকো তৈরি ক’রে কোথাও পৌঁছে যেতে।ভাবলো ওরা তারা যদি আলসেমিকে
আঁকড়ে থাকে, তাহ’লে আর মুক্তি ওদের হবে নাকো
কোনও কালে। ক’দিন পরে নৌকো বাগে পেয়ে গেলে
আলাদা সেই দ্বীপবাসীরা ডিঙি ভাসায় সমুদ্দুরে।চলন্ত সেই নৌকো থেকে
ভিন্ন ধাতের ক’জন দ্যাখে, অবাক, একি! ওই তো দূরের
আকাশ থেকে ঝরছে আলো একটি দ্বীপে!
আঁধার-ভরা দ্বীপের ক’জন হাসলো শেষে।আলোকিত দ্বীপে সবাই
নাও ভিড়ালো, নামলো তীরে, বাঁধলো ডেরা
নতুন ছাঁদে। আলোর চুমোয় ওরা সবাই
হলো বিভোর। ভিন্ন জীবন উঠলো নেচে। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
সূর্যাস্তে পাখির ডানা ক্লীর ছবি, দু’চারটে গাছ
অশ্রুপাত করে, কালো মখমলী নিঃসঙ্গ বেড়াল
কুড়ায় আলস্যকণা। নিরালা চায়ের শূন্য কাপ
টেবিলের অত্যন্ত নেতানো তাপ নেয়, এলোমেলো
খাতার পাতায় দীর্ঘশ্বাস; হাওয়া বয়, বল পেন
মৃতের মতোই চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, বুকে বোবা
বহুক্ষণ, চক্ষু স্থির, যেন আমি দেখি না কিছুই
কিছুই যায় না শোনা। সন্ধ্যায় বস্তুত আমার
কোথাও যাবার নেই। ব্যথিত দোয়েল ফিরে গেছে,
কালপুরুষের প্রত্যাখ্যান বেজে ওঠে স্তব্ধতায়।
কোথাও যাবার নেই, একটি অচিন পাখি খুব
আসে আর যায়, তার ছায়া যেন ফিসফিসে স্বরে
দেয়ালকে কিছু বলে। তারপর আমার উপর
মধ্যরাতে ঝুঁকে থাকে সমিধলোলুপ নীরবতা। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
হে পিতৃপুরুষবর্গ তোমরা মহৎ ছিলে জানি,
রূপদক্ষ কীর্তির প্রভাবে আজো পাতঃস্মরণীয়,
সে কথা বিশ্বাস করি। যে-প্রাসাদ করেছো নির্মাণ
প্রজ্ঞায় অক্লান্ত শ্রমে, জোগায় তা কতো ভ্রাম্যমাণ
চোখের আনন্দ নিত্যঃ অতীতের ডালপালা এসে
চোখে-মুখে লাগে আর ফুটে ওঠে সৃষ্টির বিস্ময়।আরো গাঢ় অন্ধকারে ভিজিয়ে শরীর পেঁচা, কাক
অথবা বাদুড় আসে শূন্য কক্ষে বিশাল প্রাসাদে
উত্তরাধিকারী খোঁজে, কিন্তু কিছুতেই কোনোখানে
মানবের কণ্ঠস্বর হয় না ধ্বনিত। অলিন্দের
অন্ধকারে ওড়ে শুধু কয়েকটি দারুণ অস্থির
চামচিকে। লেপ্টে থাকে দুর্বোধ আতঙ্ক স্তব্ধতায়।দূরত্ব বজায় রেখে দেখে সব খিলান, গম্বুজ
ইত্যাদিতে জমেছে শ্যাওলা আর সিংহ দরজায়
হিংসুক সময় তার বসিয়েছে থাবা। প্রশংসিত
কীর্তিস্তম্ভে ঝরে যাচ্ছে বহু প্রতিবিম্ব পুরাণেরঃ
বিধ্বস্ত ভাঁড়ার ঘরে অতীতের সারসত্য, সব
ভাবনাকে আনায়াসে খুঁটে খায় ইঁদুর, আরশোলা।হে পিতৃপুরুষবর্গ আমাকে ভেবো না দোষী যদি
এ প্রাসাদ বসবাসযোগ্য মনে না-হয় আমার,-
কেন না এ-সৌধ আর মরচে-পড়া তালার বাহার
করে না বহন কোনো অর্থ অন্তত আমার কাছে।
তোমাদের কারুকাজে শ্রদ্ধা অবিচল, কিন্তু বলো-
কী করে পিতার শব কাঁধে বয়ে বেড়াই সর্বদা?আমাকে জড়ায় সত্য, অর্ধসত্য কিংবা প্রবচন,
তবু জানি কিছুতে মজে না মন বাতিল পরাণে। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
ভক্তিমূলক
|
এই যে এখন বসে পুরনো চেয়ারে
এবং ঈষৎ ঝুঁকে টেবিলে লিখতে শুরু ক’রে
মনে গাছপালা, নদী, জ্যোৎস্নাস্নাত ক্ষেত
জেগে ওঠে বয়েসী আমার কিয়দ্দূরে। মাঝে মাঝে
পাখি গান গেয়ে ওঠে, জ্যোৎস্না নৃত্যপরায়ণ হয়।
এমন সময়ে মনে পড়লো তোমার কথা হে বন্ধু, যে-তুমি
সুদূর বিদেশে একা শীতার্ত রাত্তিরে
পড়ছো জরুরি বই অথবা লিখছো স্বদেশের
পত্রিকার প্রয়োজনে নিয়মিত তুখোড় কলাম,
যেগুলোর সাড়া দ্রুত পড়ছে পাঠক-পাঠিকার মজলিশে।হে বন্ধু, তোমার কখনও কি মধ্যরাতে অনুতাপ
জেগে ওঠে সাহিত্য-রচনা অবহেলিত হয়েছে
বড় বেশি ব’লে? না কি নিজেকে প্রবোধ দাও কাগজে কলম
ছোঁয়াবার কালে দেশবাসীদের জাগাবার কাজ
অবহেলা করা অনুচিত ভেবে লিখছো নিয়ত?শোনো বন্ধু, যে যাই বলুক, রাশি রাশি
লেখক বিস্মৃত হবে ভাবী কালে, অথচ তোমার নাম নিশ্চিত ঘুরবে
গুণীজন আর জনতার মুখে যুগে যুগে। এই সত্য
উজ্জ্বল তোমার কাছে, বুঝি তাই তুমি প্রায়শই
চালাও কলম সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে।জানি বন্ধু, বাংলার মানুষ চিরকাল স্মৃতিপটে
রাখবে সাজিয়ে ভালোবেসে, শ্রদ্ধাভরে
তোমার অক্ষয় নাম, গাইবে তোমার গান যুগ-যুগান্তর-
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি?’ বন্ধু, তোমাকেও
ভুলবে না প্রকৃত বাঙালি কোনও কালে। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
চকচকে তেজী এক ঘোড়ার মতোন রেনেসাঁস
প্রবল ঝলসে ওঠে চেতনায়। ক্ষিপ্ত তরবারি,
রৌদ্রস্নাত রণতরী, তরঙ্গে তরঙ্গে নৃত্যপর,
জ্বলন্ত গমের ক্ষেত, আদিগন্ত কালো মহামারী,
অলিন্দে রহস্যময়ী কেউ, দিকে দিকে প্রতিদিন
ভ্রাম্যমাণ অশ্বরোহী, মাঝিমাল্লা স্মৃতিতে ভাস্বর।
জেল্লাদার ট্রফি, অসিচালনা অথবা বল্লমের
খেলা-কোনো কিছু নয়, সেকালে মেধার উল্লাসএখনো আমাকে টানে। তোমার উদ্দেশে কতিপয়
চতুর্দশপদী লিখে, নিশীথের শেষ প্রহরের
ক্ষয়িষ্ণু বাতির দিকে চোখ রেখে শুভ্র সূর্যোদয়
আকণ্ঠ করবো পান, মড়কের প্রতি উদাসীন
অশ্বারূঢ় নাইটের মতো যাবো। সভ্যতার বিভা
উঠবে চমকে জ্যোৎস্নালোকে, জ্বলবে ঘোড়ার গ্রীবা। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
কী তবে আমার কাজ? কেউ বলে, ময়দানে গিয়ে
স্টেজে উঠে আগুন-ঝরানো,
জনতা-জাগানো বক্তৃতায় মেতে ওঠো। কেউ
বলে, যত পারো লিফলেট লিখে সর্বত্র ছড়াও।এইসব পরামর্শ শুনে শুনে দু’বেলা কানের
পর্দা ফেটে যেতে চায়! উত্তেজক মিছিলে প্রায়শ
সোৎসাহে সামিল হয়ে স্লোগান ছড়ালে
হবে কি সার্থক এই মানব জীবন শান্তশিষ্ট এ বান্দার?বস্তুত এসব কাজে দক্ষতা দেখানো,
বাহবা কুড়ানো ক্ষণে ক্ষণে সাধ্যাতীত
আমার, বরং এর চেয়ে ঢের ভালো নিজ ঘরে বসে কোনও
কবিতার ধ্যানে কিছু সময় কাটিয়ে লিখে ওঠা।
সে-কবিতা যদি মানুষকে দিন বদলের কাজে
প্রেরণা জোগায় বহুবার,
তাহ’লে জীবন এই নগণ্য আমার
সার্থকতা পেয়ে যাবে, অন্তরালে ধন্য হবে কবি। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
নীলিমা-মনস্ক ঈগল কি কাঁদে পাহাড় চূড়ায়
শ্বাসরোধকারী একাকিত্বে কোনোদিন? এখন তো
খাচ্ছে সে ছোবল বয়সের; বুকের ভিতরে ঝড়,
হুহু ঝড়, অবসাদ নেশার মতন সঞ্চারিত
সমস্ত অস্তিত্বে তার। মাঝে-মাঝে আশেপাশে খোঁজে
সঙ্গিনীকে ভ্রান্তিবশে। শ্রান্তি চোখে তন্দ্রা হয় আর
পাহাড় চূড়ায় বাজে শূন্যতার গূঢ় টিটকিরি,
পালক পাপড়ির মতো উম্মীলিত মেঘছোঁয়া দুরন্ত হাওয়ায়।স্মৃতিকে ঠুকরে তার দিন যায় কখনো কখনো
তন্ময় তাকিয়ে শূন্যতায়; কখনো বা ভয় পায়
ভবিষ্যের কথা ভেবে দুঃস্বপ্নের জালে বন্দি হয়ে
ভাবে সে পর্বতে নেই আর। শত জয়চিহ্নময় ঊর্ধ্বগামী
পাখা তার দ্যুতিহীন, ভীষণ বিবশ পড়ে আছে বড়ো একা
গলির ধুলায় খাদ্যহীন, পিপাসার্ত, কী অক্ষম।ভাবে সে গলির মোড়ে খর্বকায় কেউ তার প্রতি
ধারে-কেনা সিগারেট, আধপোড়া, দ্যায় ছুঁড়ে কিংবা
কেউ খেলাচ্ছলে নিচ্ছে তুলে নিজস্ব পালক তার
অত্যন্ত রক্তাক্ত ক’রে তাকে অথবা বালক কেউ
কৌতূহলী জং-ধরা খাঁচায় পুরতে চায় তাকে।
কেউ কেউ তুড়ি মারে কালক্লিষ্ট মুখচ্ছিরি দেখে।
তবু কী যে হয়, আকাশের দিকে মেঘ উড়ে
যেতে দেখলেই তার পাখায় চাঞ্চল্য তরঙ্গিত,
সুদূরের ঘ্রাণে তাজু ক’রে একবিংশ শতাব্দীর
দিকে অহংকারীর মুগ্ধ চোখ রেখে সে আবার তার
পালকের গুচ্ছ থেকে অবসাদ ঝেড়ে ফেলে দূর নীলিমায়
তুমুল তরঙ্গে ভেসে দ্যুতিময় প্রকৃত বিহঙ্গ হতে চায়। (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
সিকি শতাব্দী আগের কথা, খুব সকালবেলা
ঘুম ভাঙলো আমার, দেখি
সূর্য রূপদক্ষ রঙরেজের মতো
রোদের পোঁচড়ায় রাঙিয়ে দিচ্ছে দশদিক,
আর সদ্য-হাঁটতে-শেখা আমার ছেলে মাতালের ধরনে
এগিয়ে যাচ্ছে দেওয়ালের দিকে। ওর ছোট্র ছায়া
পড়েছে দেওয়ালে আর দৃষ্টিতে
রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে সে দেখছে নিজের ছায়াটিকে।সেই মুহূর্তে কী ভাবছিলো সেই শিশু,
আমার সন্তান? ভাবছিলো কি ওর জন্যে নতুন ধরনের
একটা খেলনা টানানো রয়েছে দেওয়ালে?
হয়তো খেলনা মনে করেই
সে তার দশটি ব্যগ্র আঙ্গুল দিয়ে
ছুঁতে চাইছিলো নিজস্ব ছায়া।
শেষ অব্দি
ছায়া খুটে বস্তুত কিছুই পাওয়া যায় না,
এই সামান্য কথাটা বোঝার জন্যে
ওকে দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়েছে।বর্তমানে আমার ছেলের বয়স পঁচিশ। এখন সে
অনেক কিছুর সঙ্গেই
দিব্যি বোঝাপড়া করে নিতে পারে,
শৈশবে যা ছিল ওর সাধ্যাতীত। কেউ কেউ বলে,
কোনো কোনো ব্যাপারে
আমার সঙ্গে ওর নাকি প্রচুর মিল।
ঝাঁকড়া চুল আঁচড়াবার সময়
ওর মুখে যে ভঙ্গি ফোটে
তা হুবহু আমার মুখভঙ্গি। টেলিফোনে
ওর গলা শুনে অনেকে
আমার কণ্ঠস্বর বলে ভুল করে এবং
মাঝে-মধ্যে ওর মা বলেন, ‘ও যখন কাছে আসে,
তখন আমি তোমার অস্তিত্বের ঘ্রাণ পাই।‘
সর্বোপরি আমার পুত্র
আমার মতই ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত
এবং কিছুটা উড়নচণ্ডী।
কী জানেন, আমাদের দু’জনের মধ্যে
অমিল ও নেহাত কম নয়। আমি বেড়াল পছন্দ করি,
সে পুষতে চায় কুকুর;
আমি একদিন অন্তর ক্লান শেভ করি আর সে
গজিয়েছে স্তালিনের মতো গোঁফ;
অবিশ্বাসের আদিগন্ত অমাবস্যায়
আমি এক বিভ্রান্ত পর্যটক,
তার আঁজলায় টলটলে জলের মতো
বিশ্বাসের আলো। আমি ছায়াবিলাসী
আর সে নিজেরই ছায়া দেখে চমকে ওঠে যখন তখন। (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
অক্ষর সাজিয়ে আমি অক্ষরের রূপে মজে আছি
সারা দিনমান আজো, কত নিদ্রাহীন রাত কাটে
প্রতিমা বানিয়ে অক্ষরের। ক্যালেন্ডারময় শাদা
দেয়ালের মুখোমুখি বসে থাকি প্রহরে প্রহরে।
কখনো হঠাৎ, যেন বিদ্যুতের স্পর্শে বিচলিত,
দাঁড়াই সটান ঘুরে। দেখেছি কি হরিণের লাফ,
অথবা চিতার দৌড় নাকি বলেভিয়ার জঙ্গলে
যে গুয়েভারার কাদামাখা হাত, অস্ত্রহীন, একা,
চির অস্তাচলে! বুঝি তাই বহু দেশে এখনো তো
হয়নি প্রকৃত সুর্যোদয়; স্বাধীনতা ফাঁসিকাঠে
ঝোলে দিকে দিএক, পিঠে চাবুকের কালশিটে
দাগ নিয়ে কুঁজো হয়ে পথ হাঁটে আহত বিবেক।অক্ষর সাজিয়ে আমি, মনে হয়, রৌদেজ্যোৎস্নাময়
স্বাস্থ্যনিবাসের মতো কি একটা স্থাপন করেছি
আমার নিজের বাম পাশে। যে যাই বলুক আজ
এমন কন্টকময় পথে সোজা শিরদাঁড়া আর
যিশুর চোখের মতো গৌরবের আভাই সম্বল
আমার এবং দ্রুত শ্মশানের আগুন নেভাই।অনেক সুন্দর নৌকো গহীন নদীর চোরা টানে
দূর নিরুদ্দেশে ভেসে যায়, দেখেছি কি দেয়ালের
শূন্য বুকে? মাঝে-মধ্যে নাগলতা আমাকে জড়িয়ে
ধরে আর অন্ধকারে স্বপ্নের মতই নিরিবিলি
আলখাল্লা কম্পমান। ‘আয় তুই আমার হৃদয়ে’
ব’লে গাঢ় কণ্ঠস্বর আমাকে স্বপ্নের শুভ্রতায়
ডাকেন মৌলানা রুমি নাকি হো চি মিন, বোঝা দায়;
স্বপ্নে কিছু স্পষ্ট কিছু অত্যন্ত অস্পষ্ট থেকে যায়। (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
শাশ্বতীর আঁচল মুঠোয় আনার ব্যাকুলতা নিজিনস্কি-নাচ
আকাশ কালপুরুষ আর মাটি
গাছপালা নদীনালা পালতোলা নৌকা
আলোজ্বলা ফ্ল্যাট ক্ষয় রোগীর পাঁজরবৎ
পুরানো বাড়ি শ্যামা পাখি বিখ্যাত গ্রন্থমালা কবিতা
এবং কয়েকটি প্রিয় মুখ আমার নিজস্ব জগৎআমার হাত আর শাশ্বতীর আঁচলের মাঝে
আছে-কি নেই সেতু কম্পমান ঝালর
আকাশ বলে এমন একদিন আসবে
আমি তোমার থাকবো না
তলোয়ার-উঁচানো কালপুরুষ বলে মুছে যাবো
তোমার দৃষ্টি থেকেগাছ-গাছালি নদীর ঢেউ নৌকার দোলা
পুরানো বাড়ির খিলান শ্যামা পাখির গান
গ্রন্থরাজি আর কবিতার কোরাস
রঙিন বুদ্বুদের উপর দাঁড়িয়ে
আমার কানে ঢালে প্রত্যাখ্যানের
উচ্ছের রসের মতো সুরএমন দিন আসবে যেসব মুখ
এক মুহুর্ত না দেখলে
আমার বুক ভ্রুকম্পন
এমন দিন আসবে সেদিন আমার চিরন্তন অন্ধতা
এবং তাদের উপস্থিতির মধ্যে
অস্তহীন বিচ্ছেদ
মাটির মাতৃত্বময় মেঘমেদুর উচ্চারণ
আমার গভীর তোমার নাড়ি
তোমার জন্য আমার বুক প্রতীক্ষার ঘর
অথচ শাশ্বতীর ছলনার শাড়ির দিকে
পৌষ সংক্রান্তির দিনে কাটা ঘুড়ি ধরতে যাওয়া বালকের হাতের
মতো বাড়ানো আমার ব্যাকুলতা (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
ক্রূর ঝড় থেমে গ্যাছে, এখন আকাশ বড়ো নীল-
গাছের সবুজ পাতা কেঁপে কেঁপে অত্যন্ত সুষম
বিন্যাসে আবার স্থির। খরগোশের চঞ্চল উদ্যম
আশপাশে, বাজপাখি উঁচু চূড়া থেকে অনাবিল
আনন্দে তাকায় চতুর্দিকে, কোনো নিষ্ঠুর দুঃশীল
চিন্তা নেই আপাতত, বিস্তর বয়স, চোখে কম
দ্যাখে, নখ উদ্যমরহিত, বুকে গোপন জখম,
তবুও ডরায় তাকে নিম্নচারী পাখির মিছিল।পাহাড়ে পড়েছে তার ছায়া কতদিন, মাঝ-মাঝে
এখনো সে করে যাত্রা মেঘলোকে, যখন হাঁপায়
অন্তরালে গুটিয়ে ঘর্মাক্ত ক্লান্ত ডানা, চোখ বুজে-
দুঃস্বপ্ন দখল করে তাকে, শোকাবহ সুর বাজে
বুকের ভেতরে, কিন্তু নিমেষেই চৈত্র পূর্ণিমায়
চোখ তার ভাবময়, ডাকে তাকে কে যেন গম্বুজে। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
তোমার চুলের রাত্রি, শিখা-জিত আমাকে জড়ায়
গনগনে দ্বিপ্রহরে। তোমার ব্যাকুল বাহুদ্বয়
আমার বন্দর হয়, কী নিঃশব্দ, দীপ্র গীতময়
হয়ে ওঠে নিমেষেই কম্পমান তোমার অধর
আমার তৃষিত ওষ্ঠে আর ছোট ছায়াচ্ছন্ন ঘর
রূপান্তরে ছলোচ্ছল জলপুরী, থর থর তুমি
তরঙ্গিত নদী, কখনো বা গাঢ় বেদনার ভুমি,
তোমার চোখের জল আমার আত্মায় ঝরে যায়।চুম্বনের পূর্ণতায় সত্তাময় বিষাদের সুর
বুনে দাও নিরুপায়, তুমি হয়ে যাও কী সুদূর।
আমার প্রেমের মধ্যদিনে তোমার চোখের জল
নিবিড় আষাঢ় আনে সত্তায় খরায়, অবিরল
হাওয়া বয় হৃদয়ের ঝোপেঝাড়ে। থামে সব কথা,
তোমার অধর থেকে আমাকেই ছোঁয় অমরতা। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
ঘুটঘুটে এক গলির মোড়ে
এলাম যেন কিসের ঘোরে।
ডানে বামে বন্ধ দোরে
পড়ছে ধাক্কা বেজায় জোরে-
শুনছি শুধু অবাক হয়ে শুনছি।একলা আমি আঁধার ঘরে
বসছি বটে নড়ে চড়ে।
হঠাৎ এ কি ভীষণ ঝড়ে
বসত বাড়ি বেজায় নড়ে-
শুনছি শুধু অবাক হয়ে শুনছি।জানলা ধরে দাঁড়াই একা,
কারও সঙ্গে হবেই দেখা।
পছন্দ যার আমার লেখা,
তার জন্যেই আঁকছি রেখা-
আঁকছি শুধু, মগ্ন হয়ে আঁকছি।২
কখন যে ঘরে ঢুকে বিছানায় ঘুমে
ঢুলে পড়েছিলাম ক্লান্তির কুয়াশায়,
মনেই পড়ে না। জানালার বাইরে চাঁদের
ক্ষয়া মুখ চোখে পড়তেই মনে পড়ে
অসমাপ্ত একটি কবিতা তিন দিন ধরে মাথা
চাপড়াচ্ছে, অথচ এখনও আমি খাচ্ছি, দাচ্ছি,
দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি, চায়ের
দোকানে নির্দিষ্ট কোণে ব’সে আড্ডা দিচ্ছি;
ঝাঁ ঝাঁ তর্কে নিয়ত উঠছি মেতে রাজনীতি আর
মিছিল, উত্তর-আধুনিক কবিতা ইত্যাদি নিয়ে।
‘নেই, তোমার মুক্তি নেই কিছুতেই’,
কে যেন প্রগাঢ় কণ্ঠস্বরে বলে গেলো।
মুখচ্ছবি তার শত চেষ্টাতেও পড়লো না ধরা।
দৃষ্টিতে আমার পড়ে তিনজন রূপবতী দূরে
একটি হ্রদের তীরে এসে বসে, তাদের পেলব
গানের সুষমা হৃদয়ের তন্ত্রীকে স্বর্গীয় করে।৩
অবশেষে বৃক্ষতলে এসে বসি, এখন আমার
পাশে বসে নেই কোনও পুরুষ কি নারী।
অকস্মাৎ প্রায় মাথা ঘেঁসে কালো এক পাখি
উড়ে যায়। অগণিত বুটের আওয়াজে
শান্তিপ্রিয় জনসাধারণদের মগজ ভীষণ
আলোড়িত, কেমন কুঞ্চিত হতে থাকে। রাইফেল
গর্জন করেনি, তবু লেফ্ট রাইট,
লেফ্ট রাইট ধ্বনি এক ঝাঁক পায়রা এবং
অজস্র রঙিন হাঁস দূরবর্তী মেঘমালা ছুঁয়ে
দূরে, বহুদূরে উড়ে চলে যায়। বারুদের গন্ধে
কী ভীষণ ভারী হতে থাকে
চতুর্দিক। মানবিক আর্তনাদ ক্রমাগত প্রসারিত হয়। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
আদিগন্ত প্রসারিত মাঠ,
উদার আকাশ
আর হৃদয়ের সন্দীপণ
আমাকে দিয়েছে পাঠ স্বপ্ন থেকে স্বপ্নে গমনের,
মহানুভবের স্পর্শে মহাশ্মশানেও
বসন্তের বৃক্ষরোপণের।পূণ্যলোভীদের ক্রূর চিৎকার, ধ্বংসের
বীভৎস উৎসব পণ্ড করে
সৌন্দর্যের মহিমার দীপ্র সম্মিলন
এবং জখম করে কবিতার গ্রীবা
দিবানিশি। সর্বত্র মানুষ আজ ভয়ানক ভীত,
হঠাৎ আগুন-লাগা উড়োজাহাজের যাত্রী যেন। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
শহরে হৈ হল্লা দৈনন্দিন, যানবাহনের ঢল
পথে পথে, দিকে দিকে ফুৎকার, চিৎকার, চলে স্মার্ট
নাটক শিল্পিত স্টেজে, হোটেলে স্বপ্নিল কনসার্ট;
মেলায় নাগরদোলা, ডুগডুগি, বানরের দল।
হঠাৎ এলেন ভিনদেশী মল্লবীর, দৃপ্তবল;
সমস্ত শহর ঘোরে তার পায়ে পায়ে সারাক্ষণ,
পুষ্পবৃষ্টি চতুর্দিকে; মন্ত্রমুগ্ধ জনসাধারণ।
নতুন সার্কাস পার্টি ফেলে তাঁবু, নগর চঞ্চল।বস্তুত চৌদিকে লাফালাফি, লোফালুফি, ক্ষিপ্র
কেনাবেচা; ম্যাজিক ম্যাজিক বলে কেউ পোড়া ঘাসে
বেজায় লুটিয়ে পড়ে, কারো কণ্ঠে ফানুস ফানুস
ধ্বনি বাজে। চলেছেন একজন একলা মানুষ
সবার অলক্ষ্যে জনাকীর্ণ পথে আস্তে সুস্থে দীপ্র
শব্দের গুঞ্জনে পূর্ণ যেন বা হাঁটেন পরবাসে। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
যখন আমার কাছ থেকে চলে যাও তুমি হায়,
আমার হৃদয়ে ক্রূদ্ধ বাজ পাখি সুতীক্ষ্ম চিৎকারে
দীর্ণ করে দশদিক, নখের আঁচড়ে বারে বারে
কুটি কুটি ছেঁড়ে শিরাপুঞ্জ, কী ব্যাপক তমসায়
অন্তর্গত পুষ্পাকুল উদ্যান ভীষণ ডুবে যায়।
যখন আমার কাছ থেকে সরে যাও, বন্ধ দ্বারে
মাথা কোটে একজন অন্ধলোক, খাদের কিনারে
অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে হাঁটে একা, অসহায়।তবু তুমি চলে যাও দূরে তোমাকে যেতেই হয়,
যেমন আকাশ ছেড়ে পাখি প্রত্যাবর্তনের সুর
উন্মুক্ত ডানায় নিয়ে। আমার তো সর্বক্ষণ ভয়-
কখন হারিয়ে ফেলি অকস্মাৎ তোমার মধুর
স্পর্শ, কণ্ঠস্বর, তুমি আসবে না, তবু এ হৃদয়
তোমাকেই ডেকে যায়, ডেকে যাবে বিষণ্ণ দুপুর। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
এ শহরে এক কোণে নিরিবিলি করে বসবাস
একজন লোক, প্রায়শই কী জানি কীসের ঝোঁকে
শব্দ দিয়ে ভরে খাতা, ফলে কবি তাকে বলে লোকে।
কেউ কেউ আসে তার কাছে নিতে মনের সুবাস
নিজেরই অজ্ঞাতে আর সুন্দরের, শিবের আভাস
পেয়ে যায়। লোকটা কখনো কারো খোলা পথে কাঁটা
বিছায় নি, অমঙ্গল করে নি কামনা কারো, ঝাঁটা
মারে নি কাউকে ক্রোধে, চিত্ত তার সুনীল আকাশ।তবু তাকে গঞ্জনা সইতে হয়, শজারু খোঁচায়
যখন তখন, ঠাট্রা-তামাশার উৎস হয় কোনো
কোনো আড্ডা, গুলজার চায়ের আসরে। লোকটার
কসুর সে দিনরাত সুরছুট পরিবেশে, হায়,
সুরের সাধনা করে! বিপক্ষের শত উপেক্ষার
হিমে স্থির আর দিশেহারা নয় তারিফে কখনো। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
রাত্রির তৃতীয় যামে জ্যোৎস্নাধোয়া মসজিদে মৌলবী ঘুমায়।
এখন সে জলচর পাখির মতন
ঘুমের ডহরে ভাসে একা, অচেতন। হাত দুটি
যেনবা নিস্পন্দ মাছ নদীতীরে; মাঝে মাঝে নড়ে
ওঠে ঠোঁট হয়তোবা ঘোর
নিদ্রাতুর বিরানায় করছে আবৃত্তি
অমল আয়াত।
রাত্রির তৃতীয় যামে জ্যোৎস্নাধোয়া মসজিদে মৌলবী ঘুমায়।রাত্রির তৃতীয় যামে স্বপ্নের ভেতরে
দেখে সে নির্জন স্থানে দাঁড়ানো। অনেক
দূরে খুব উঁচু মিনারের মতো কিছু ঘন নীল
কুয়াশায় মোড়া।
হঠাৎ একটি ঘোড়া তাকে ঘিরে খায় তিন পাক, অনন্তর
চোরাবালি বাদামি ঘোড়াকে করে গ্রাস।
স্বপ্নের ভেতরে
দেয় সে কাটিয়ে নিরিবিলি কিছুক্ষণ
সিঁড়ির ওপরে ব’সে শুনে
ঘাসের নিবিড় গাথা। কণ্ঠে তার যুগ-যুগান্তের
তিমির আছে কি মজা? নইলে কেন এত
শুকনো গলা আজ? তবে কি সে দীর্ঘকাল ঝরনা,
পুকুর, ইঁদারা কিংবা সরোবর থেকে
করেনি ব্যাকুল পান আজঁলায় নিয়ে
এক ফোঁটা পানি?
রাত্রির তৃতীয় যামে জ্যোৎস্নাধোয়া মসজিদে মৌলবী ঘুমায়।স্বপ্নের ভেতরে তার দেখে না সে কোনো
লম্বাটে রঙিন কাচে ফোভ ছবি, গম্ভীর দেয়ালে
কখনো করে না পাঠ স্বীকারোক্তি। তার
স্বপ্নের জমিনে ভ্যানগঘী সাইপ্রেস
কখনো ফেলে না ছায়া কিংবা তাহিতির
অজর রমণী কোনো ফলময় থালা হাতে দাঁড়ায় না এসে
ক্ষণকাল। মাঝে-মাঝে ধু-ধু
বিবাহ, মরণময় কতিপয় ছবি দুলে ওঠে
রাত্রির তৃতীয় যামে। স্বপ্নের ভেতরে তার, স্নিগ্ধ মৌলবীর,
মনে হয়, কথা ছিল পুণ্য সুরে দশদিকে যে-ডাক দেবার
বারংবার প্রকৃত সে-ডাক মানবিকএখনও হয়নি মূর্ত কণ্ঠে তার। দিকভ্রষ্ট কোনো
করুণ পাখির মতো যেন সে নিয়ত
ডেকে যায়, অথচ ঘুমের
ভেতরে গোঙানি শুধু, কণ্ঠস্বর রুক্ষ মরুভূমিতে হারায়।
রাত্রির তৃতীয় যামে জ্যোৎস্নাধোয়া মসজিদে মৌলবী ঘুমায়।
আলখাল্লা ফুটফুটে স্বপ্নের মতোই
লেপ্টে আছে গায়ে, খোলা মুখ যেন গায়েবী জানালা,
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে
রাত্রির শূন্যতা নিচ্ছে টেনে
নিজের ভেতরে অস্তিত্বের গ্রন্থিমূলে এক নিঝুম মৌলবী। (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙে, চেনা পৃথিবীর
রূপ ভেসে ওঠে পুনরায়, দেখি কিছু পাখি
জমায় সুরেলা আড্ডা, একজন বেড়াল একাকী
উঠোন পেরিয়ে যায়- ভোরের সৌন্দর্য কী নিবিড়
মনে হয়। দুপুর কাচের মতে চকচকে, ভিড়
বাড়ে জনপথে, চিল সুনীল চক্কর কাটে, ডাকি
মনে-মনে তাকে, যার জন্যে সদা প্রতীক্ষায় থাকি,
বিকেলও মধুর আর অপরূপ সন্ধ্যার শিশির।প্রসিদ্ধ দিনের শোভা, তবু আমি গাঢ় নিশীথের
গান গাই, এবং অপেক্ষা করি সেই প্রহরের
যখন গভীর হয় রাত, নিদ্রার গহন চোখ
বুজে আসে, কেননা তখনই শ্রান্ত সত্তায় আমার
ঘুমের পাপড়ি জ্বলে, স্বপ্ন দেখি ভুলে দুঃখ শোক;
সে স্বপ্নে তুমিই দীপ এবং মদির দীপাধার। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
মৃতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেলে ভাবনার
স্বরূপ বদলে যায়? চোখে সম্মুখে বনভূমি,
কাঁটাবন, শীর্ণ নদী, সন্তের ঔদাস্যময় ছিন্ন
আলখাল্লা, এক পাটি জীর্ণ জুতো, দূরবর্তী লাল
টিলা বেয়ে নেমে আসা কেউটে, গহ্বর ভয়ংকর,
অবেলায় ঘরে ফেরা জেগে ওঠে। চৌদিকে বিপুল
বৃষ্টিধারা, ভেসে যায় শিকড় নিরুদ্দেশে,
কে যেন একাকী দাঁড় টেনে চলে গহন নদীতে।মৃতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে কিছু গূঢ় কথা
জিগ্যেস করতে সাধ হয়, কিন্তু ভুলে যাই সব।
কেমনে অমন পড়ে থাকে একা এমন অচিন,
শূন্য খাঁচা স্তব্ধতায় কম্পমান, হায়, গানহীন।
মৃতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে দুঃখের ভিতরে
বসে থাকি কিছুক্ষণ খুব একা, মেঘ হয়ে যাই। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
দৈবাৎ এক রাতে ভুলক্রমে তোমার সঙ্গে আমার
অদৃশ্য যোগাযোগ। এমনই আকস্মিক
সেই ঘটনা, আজো কেমন ধন্দ লাগে। বস্তুত
মধুর এক ধাক্কা খেয়ে পথচলা
মেঘের আলপথে।
একটি ভুলের কুঁড়ি বিকাশের বাঁশির তানে
চমৎকার এক ফুল হয়ে
দুলে উঠবে সত্যের মুখোমুখি, কে জানতো?কে তুমি? কী তোমার প্রকৃত নাম ধাম, বয়সই বা কতো?
কাদের ঘরের বউ? না-কি অনূঢ়া? তোমাকে দেখতে
কী রকম, কিছুই জানতে পারি নি।
কথা হয়েছিল সামান্যই, খুচরা পয়সার মতো।
আমাদের সংক্ষিপ্ত, আবছা কথোপকথনের বিষয় ছিল
কবিতা, সেই মোহন অমৃত-গরল যা হামেশা
খলখলিয়ে ওঠে আমার রক্তের ভেতরে।
ফলে, মারাত্মক অসুখেও
হাসপাতালের বেডে অপ্রতিরোধ্য
শব্দগুচ্ছ দ্রাক্ষাপুঞ্জের মতো
ঝুলে থাকে সিলিন্ডারে।
স্যালাইনের বদলে
আকণ্ঠ পান করি প্রহরে-প্রহরে
প্রাণ নিঙড়ানো শব্দরস।প্রথমবারের মতো আমাদের দেখা হলো
প্রতিশ্রুত রেস্তোরাঁয়; তখনো শুধু তোমার কণ্ঠস্বর
ছাড়া আর কিছুই পরিচিত নয় আমার। তোমার
চমক-লাগানো উপস্থিতি আমাকে নিয়ে গেল
সেই উপত্যকায়, যেখানে ভাসমান মেঘের মতো
মেষপাল চরে বেড়ায়, গাছের ছায়ায় নিরিবিলি
শুয়ে থাকে নিতম্বিনী গয়লানী, সুকান্ত মেষপালক তার
বাঁশিতে তোলে বঞ্চনা ও ছলনা-ভোলানো তান,
শিশুরা জড়ো হয় চারপাশে,
অশ্বশাবক ছুটে বেড়ায় ইতস্তত,
হাওয়ায় দোলে
গুচ্ছ গুচ্ছ আপেল, গমের শীষ।তোমার বিষয়ে কিছু না জেনেই যাকে বলে
প্রথম দৃষ্টিতে প্রেমে-পড়া, সেই আশ্চর্য
ঘটে গেল আমার অজান্তেই। তোমার সুন্দর
চকচকে দু’টি চোখ আমার ভাবান্তরের প্রতি
সমর্থন জোগালো খঞ্জনা হয়ে। নীলিমায় আমার ওড়া-উড়ি।
সেই মুহূর্তেই আমার স্বপ্নিল আকাঙ্ক্ষাগুলি
জড়িয়ে গেল তোমার সিল্কমসৃণ চুলে,
তোমার চোখের উজ্জ্বলতায়
পরিশুদ্ধ হলো আমার বিবর্ণ ব্যর্থতা,
সাফল্যকে কলাপ
মেলতে দেখলাম তোমার
হাতের নড়ায়। সময় বেশি না গড়াতেই
যে কথা বলতে চেয়েছি এবং চাইনি,
কখন যে হঠাৎ বলা হয়ে গেল
তোমার কানে কানে,
অথবা যা’ অব্যক্ত থেকে যাবে আমৃত্যু। এবং
আমার স্পর্শের স্মৃতি তুমি সানন্দে
সঞ্চয় করেছো, মেঘ যেমন বিদ্যুল্লতা।
তোমার আমার মধ্যে যখন তৈরি হলো পরিচয়ের
সেই বাগান, যেখানে দাঁড়ালে মনে হয়
মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই
বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না আমাদের, এখনই
ঝাঁকুনি খেয়ে বুঝলাম, বাগান তছনছ করার
আয়োজনকে মুকুট পরানোর বিষয়ী লোকজনের
কমতি নেই। কিন্তু তোমার এতো কাছাকাছি
এসে গেছি, যে আমারও তো উপায় নেই
ফেরার। আর ওরা কি জানে না আমি
সেই পাখির মতো যে উজাড় বাগানকেও
নিজের অবলম্বন বলে গ্রহণে সক্ষম,
যার ঠোঁটে রাংঝাল চাপিয়ে দিলেও
থামে না গান, যার বাসনার ডালগুলো
মুচড়ে দিলেও সেখানে ফুলের উৎসব দিনভর রাতভর।অবিশ্যি সুন্দরী তুমি, কেবল আমার চোখেই নয়,
সবার কাছ থেকেই তোমার সুন্দর্য উঁচুদরের
নর্তকীর নাচের মতো
কিংবা সঙ্গীতসিদ্ধ গুণীর তানের মতো
আদায় করে নেবে স্তুতির স্তবক।
অথচ এ-ও তো সত্য তোমার মতো অথবা
তোমার চেয়েও অধিক সুন্দরী আছেন
এই শহরেই। আমি কি তোমার
রূপের সরোবরে ডুব দিয়েই
একে ভালোবাসা বলে শনাক্ত করেছি?তোমার মদির চোখ, গোধূলি-রঙিন গ্রীবা,
জীবন স্পন্দিত টসটসে ঠোঁট অর্থাৎ
তোমার সৌন্দর্যে সচকিত হয়েও
শুধু সেজন্যেই আমার অনুরাগের আংটি
পরিয়ে দিই নি তোমার আঙুলে।
তোমার হাসি, যা হতাশাকে করে তোলে দীপান্বিতা,
আমাকে নিয়ে গ্যাছে সেই ঘাটে,
যেখানে ফোটে মনোজ কহলার।
না, কেবলমাত্র সেজন্যেও
ভালোবাসি না তোমাকে।
কেন তোমাকে ভালোবাসি, এ প্রশ্নের
মিলবে না কোনো সদুত্তর। একটা ঝাপ্সা জবাব
ত্বরিত-গতি তলোয়ার মাছের ধরনে
আমার আশেপাশে সাঁতার কাটে, কিন্তু আমার
করায়ত্ত নয় এমন কোনো জাল যা দিয়ে
আটকে ফেলা যায় তাকে।
ততোদিন তাকিয়ে থাকতে হবে
ওর আসা-যাওয়ার দিকে,
যতোদিন না মৃত্যু এসে
বুজিয়ে দেয় আমার দু’চোখ! (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
কখনও কখনও আমি একান্তে নিজেকে
বিশ্লেষণ করার ইচ্ছায় গৃহকোণে
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসি,
আকাশ-পাতাল ভাবি, এলোমেলো অনেক ভাবনা
আমাকে বিব্রত করে। বুকশেলফ থেকে
বই টেনে নিই দুশ্চিন্তার মাকড়সা-জাল থেকে মুক্তি পেতে।তবুও নিস্তার নেই যেন, আচমকা ভাবনার
খোলা পথে দেশের দশের ছায়াছবি
রূপায়িত হয়ে
কোন সে পাতালে ঠেলে দেয়, হাবুডুবু
খেতে থাকি। কারও সাতে-পাঁচে নেই, তবু
কেন ঘোর অমাবস্যা ভাবনার মূর্ণিমাকে দ্রুত গ্রাস করে?কী এক আজব খেলা চলছে স্বদেশে ইদানীং,
বুঝেও বুঝি না যেন! আমরা কি
সবাই এখন উলটো পায়ে হাঁটছি কেবল? ব্যতিক্রম কিছু
আছে বটে, তবে তারা এক কোণে ব’সে
থিসিসের মায়াজালে বন্দি হয়ে ক্লান্তির বিস্তীর্ণ কুয়াশায়
পথ, বিপথের ফারাক না বুঝে ঘুরছেন, শুধু ঘুরছেন।
কালেভদ্রে কিছু কলরব শ্রুত হয় পাড়ায় পাড়ায় আর
জাগৃতির ঢেউ দ্রুত বুদ্বুদের মতো
মিশে যায়। এই কি নিয়তি সকলের? ‘নয়, নয়
কখনও তা নয় ধ্বনি জেগে ওঠে দূর দিগন্তের বুক চিরে। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
এদেশে হায়েনা, নেকড়ের পাল,
গোখরো, শকুন, জিন কি বেতাল
জটলা পাকায় রাস্তার ধারে।
জ্যান্ত মানুষ ঘুমায় ভাগাড়ে।অথচ তোমার চুল খুলে দাও তুমি।
এদেশে কতো যে ফাঁকির আছিলা,
কালোবাজারের অপরূপ লীলা।
আত্মহত্যা গুম খুন আর
ফটকা বাজার-সব একাকার।এখনও খোঁপায় ফুল গুঁড়ে দাও তুমি।মড়ক-মারির কান্নার রোল
সারা দেশটার পাল্টায় ভোল।
হা-ভাতে ছোঁড়ারা হুজুরের দোরে
সোনালি আমের মরশুমে ঘোরে।
এখনও তোমার বাহু মেলে দাও তুমি।এদেশে আ’মরি যখন-তখন
বারো ভূতে খায় বেশ্যার ধন।
পান নাকো হুঁকো জ্ঞানীণ্ডণীজন,
প্রভুরা রাখেন ঠগেদের মন।
এখনও গানের সুরে ভেসে যাও তুমি।এদেশে নেতারা হাওদায় চ’ড়ে
শিকার গাঁথেন বাক্যের শরে,
আসলের চেয়ে মেকিটাই দামি।
বিচিত্র দেশ, কৃতজ্ঞ আমিএখনও যে মেয়ে হাসি জ্বেলে দাও তুমি। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
প্রভু, শোনো, এই অধমকে যদি ধরাধামে পাঠালেই,
তবে কেন হায় করলে না তুমি তোতাপাখি আমাকেই?
দাঁড়ে বসে-বসে বিজ্ঞের মতো নাড়তাম লেজখানি,
তীক্ষ্ণ আদুরে ঠোঁট দিয়ে বেশ খুঁটতাম দানাপানি।
মিলতো সুযোগ বন্ধ খাঁচায় বাঁধা বুলি কুড়োবার,
বইতে হতো না নিজস্ব কথা বলবার গুরুভার। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
সে কবে আমার ঘরে এসেছিলো তুমি হে প্রতিমা
শুন্যতায় তুলে ঢেউ? বসেছিলে মুখোমুখি; চোখে
বসন্ত-বিস্ময় ছিলো, শরীরে স্বপ্নের মধুরিমা।
টেবিলে তোমার হাত, যেন সে মাছ, রহস্যলোকে
সমর্পিত; দেখলাম নড়ে চড়ে বসলে আবার।
ইচ্ছে হলো তুলে নিই হাতে সেই মাছ অলৌকিক,
হয়নি সাহস; যেন আমি দীন কুষ্ঠরোগী, যার
সৌন্দর্যকে ছুতে ভয়। বলো, হবো কি করে অভীক?হে বন্ধু তাহলে আসি, বলে চলে গেলে কী সহজে
আমাকে একাকী ফেলে আর আমি যেন স্বপ্ন থেকে
চক্ষুদ্বয় কচলাতে কচলাতে জেগে উঠলাম
অকস্মাৎ; সত্যি তুমি এসেছিলে? নাকি এ মগজে
মায়াবী একাটি হাত আগোচরে দিয়েছিলো এঁকে
জীবন-স্পন্দিত চিত্র? জাগুক সে চিত্র অবিরাম। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
তোমাকে ভাবছি আমি, যেমন আঁধার কুঠুরিতে
ফাঁসির কয়েদি ভাবে সকালের আরক্ত প্রতিমা
অত্যন্ত একাকী বসে উৎকন্ঠিত অন্তিম নিশীথে।
এখন কোথায় তুমি? এখন তুমি কি মধুরিমা
ছড়িয়ে তোমার আশপাশে আছো শবগন্ধময়
কোনো বন্ধ ঘরে কিংবা কান পেতে শুনছো কেবলই
কবর খোঁড়ার শব্দ? ভাবছি তোমার চক্ষুদ্বয়,
কেশপাশ, স্তনচূড়া, স্মৃতিজ্বলা সুগন্ধি ত্রিবলী।তোমার হাতের দিকে আমার দুবাহু ছুটে যায়।
তোমার চোখের দিকে আমার দুচোখ উন্মীলিত,
তোমার ওষ্ঠের প্রতি আমার তৃষিত ওষ্ঠধায়
সারাক্ষণ, আমার হৃদয় শোনে প্রহরে প্রহরে
তোমারই নিভৃত পদধ্বনি। আর আমি সদা ভীত,
কেননা চৌদিকে হিংস্রজিহ্বা শিকারী কুকুর ঘোরে। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
বয়স কম তো নয়, উড়ছে মাথায়
এখনও সফেদ চুল, কোনও
কোনও দাঁত নড়বড়ে। তদুপরি কফের ধমকে হামেশাই
বুক ফেটে যেতে চায়। তবুও কলম তার প্রায়শ চঞ্চল।
আজকাল কখনও কখনও বটগাছ থেকে নেমে
একজন অতিশয় বেঁকে-যাওয়া বুড়ো,
অনন্ত কালের মতো বুড়ো,
কবির বিনীত দোরে কড়া নেড়ে অপেক্ষা করেন।খানিক পরেই কবি দোর খুলে দাঁড়ান, তাকান
অতিশয় নুয়ে-পড়া প্রবীণের দিকে। অনন্ত কালের মতো
যিনি তাঁর কণ্ঠ ধীরে করে উচ্চারণ-
‘তোমার লেখার ধার অস্তগামী, অবিলম্বে থামাও লেখনী।
নয়তো বুকের রক্ত ঝরিয়ে হলেও
খাতার পাতায় ফের সাজাও সতেজ প্রাণ বেগ, সৃষ্টি করো
পুষ্পদল। নয়তো কী লাভ বলো নিজেকেই
নিজেরই ডোবায় নিত্য নাকানি চুবানি খেতে দেয়া?ক্ষণকাল পরে সেই অতিশয় প্রবীণ মানব
হাওয়ায় মিলিয়ে গেলে বয়স্ক কবির
মনে ভাবনার ঢেউ খেলে যায় বারবার; আখেরে চকিতে
কবিতার খাতা খুলে তিনি
রচনা করেন এক নতুন কবিতা, রূপ যার
আকাশের তারার মতোই জ্বলজ্বলে,-হাসি ফোটে
কবিতার খাতায়, এমন হাসি আর
ঝরায়নি ঝর্নাধারা কোনও কবিতার পঙ্ক্তিমালা। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
কতকাল পরে কণ্ঠে তোমার মেয়ে
বইয়ে দিয়েছ চকিতে ঝরনাধারা,
যেন শীতার্ত প্রহরে পেয়েছে ফিরে
প্রাণের শিহর মৃত পুষ্পের চারা।কী করে তোমার রূপ বর্ণনা করি?
তোমার দু’চোখ কী-যে সুন্দর, ভাবি।
স্তনের ডৌল স্বর্গেয় উদ্ভাস,
সোনালি চূড়ায় আমার কি আছে দাবি?ক্রমে যাবে বেড়ে অন্যের প্রাণবীজ
হয়তো আচরে তোমার গর্ভাশয়ে।
বন্ধ্যা সময়ে তুমি বসন্ত-ফুল,
আমার জীবন চিহ্নিত শুধু ক্ষয়ে।
আমার বাগান মুমূর্ষ ইদানীং
কর্কশ সব ঘাতকের তাণ্ডবে;
সত্তায় বয়ে দুঃস্বপ্নের ছায়াবড় এক ঘুরি শহুরে এ রৌরবে।
শ্বেত সন্ত্রাস ঘরে ঘরে দেয় হানা,
রঙিন পুতুল ভেঙে যায় পদাঘাতে।
শুভ অশুভের দ্বন্দ্ব প্রবল আজ,
শত কংকাল হত্যাযজ্ঞে মাতে।তুমি নেই পাশে, শূন্য এ ঘর মরু,
হৃদয় আমার শোকের অমিতাচার।
তোমার চোখের পাতায়, উষ্ণ ঠোঁটে
অশরীরী হয়ে চুমো দিই বারবার।আমি যে রকম তোমার জন্যে আজও
করি ছটফট কৈ মাছটির মতো,
আমার জন্যে তুমি কি তেমন হও?
হও না বলেই আমি যে ভাগ্যহত।বলো এ কেমন যুগ-সংকটে হলো
তোমার আমার অস্ফুট পরিচয়।
অতীতের শত স্বৈরাচারীর প্রেত
বর্তমানের শিরায় ছড়ায় ভয়।আমাদের এই প্রেমের মধ্যদিনে
নামে প্রত্যহ মেশিনগানের ছায়া;
কাঁদানে গ্যাসের ব্যাপক ধূম্রজালে
কোথায় উধাও আয়ত চোখের মায়া!একনায়কের বুটের তলায় পড়ে
থেঁতলে যাচ্ছে ক্রমশ স্বপ্নগুলি,
তার বোম্বেটে সহচর কতিপয়
ছুড়ে দেয় দূরে শূন্যে মড়ার খুলি।চৌদিক আজ কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা,
বর্বরদল ঘুরছে সগৌরবে;
অন্য কোথাও আশ্রয় খোঁজা বৃথা,
তোমাকে না দেখে আমার মৃত্যু হবে? (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
আর কী রয়েছে বাকি? সবি তৈরী, গোটা মঞ্চটাই
সুসজ্জিত নানা ছাঁদে। ইতিমধ্যে মাইক লাগানো
হয়ে গেছে আর সামনে শ্রোতাদের চেয়ার সাজানো
সারি সারি, বস্তুত কোথাও নেই তিলমাত্র ঠাঁই।
মঞ্চে বক্তা দু’চার কদম হেঁটে দিচ্ছেন মহড়া
নির্ধারিত বক্তৃতার, বাছা-বাছা বাক্যের শায়ক
অস্থির স্মৃতির তূণে, কিন্তু তবু সভার নায়ক,
পাদপ্রদীপের আলো, মনে হয় সবই মনগড়া!
প্রস্তুত প্রধান বক্তা, সাড়স্বরে সভা উদ্বোধন
করা গেলো যথারীতি, কিন্তু একি শ্রোতারা কোথায়?
তারা তো আসেনি কেউ, স্বস্তি কই এমন সভাতে
যেখানে বক্তার হাঁকডাক সবই অরণ্যে রোদন!
আমরা সবাই সেই বক্তার মতোই শূন্যতায়
কেবলি চলেছি হেঁকে প্রাণপণে মালাহীন হাতে। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
স্বদেশমূলক
|
না, আমি মিনারবাসী নই কস্মিনকালেও, তবু
এই ডামাডোল, হট্রগোল, এই ঝগড়া ফ্যাসাদে
বড় বেশি বীতশ্রদ্ধ হয়ে
ঘন ঘন চুল ছিঁড়ি উত্তপ্ত মাথার।কখনও কখনও ভারি ইচ্ছে হয় এই জমিনের
ধুলোবালি থেকে দূরে, বহুদূরে
উড়ে যাই। না, কোনও বিমানে
চেপে কিংবা ট্রেনের টিকিট কেটে নয়,
দূরগামী পাখির মতই মেঘ চিরে,আকাশের নীলে উড়ে উড়ে, নক্ষত্র-পল্লীর খুব
কাছাকাছি চলে গিয়ে জমাই জম্পেশ আড্ডা আর
চুমো খাই চাঁদের অধরে।আমি তো যেতেই পারি উড়ে বহুদূরে অন্বিষ্ট কোথাও;
আমার ঘরের কোণে অপরূপ দুটি ডানা আছে,
এক্ষুণি দেখাচ্ছি ব’লে গৃহকোণে যাই। হা কপাল,
কোথায় গায়েব হল ওরা? কোন্ সে রহস্যপুরী,
কোন্ সে কবন্ধ আস্তানায়,
হায়, লুপ্ত হল অনুপম ডানা দু’টি?
পাখা মেলে আর
মেঘে মেঘে দূরে
অনেক অনেক
দূরে পারব না
কোনও দিন যেতে
তারার মেলায়।খেদ নেই, পারব তো হেঁটে হেঁটে যেতে বাংলার
পাড়াগাঁর, শহরের ঢের ঢের লুণ্ঠিত জনের
এবং ধর্ষিতা মা-বোনের খুব কাছে
দাঁড়াতে, জ্বালাতে দীপ ঘন অন্ধকারে।ভাসমান মেঘ আর নক্ষত্রের রূপালি আসর,
চাঁদের বাসর থাক মানবের কাছ থেকে দূরে
অনেক অনেক দূরে। নাইবা গেলাম
সেখানে কখনও, এই আমি এখানেই
স্বদেশের সোঁদা মাটি আর
ঘাসের সুঘ্রাণ নিয়ে থাকি যেন আমরণ প্রিয় স্বদেশেই। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
ছড়া
|
আমার খোকন গাঢ় দুপুরে ঘুমাত, ঘুমাবার
করত ভান আমার বালিশে, বুকে আর
‘গল্প বলো…কড়ির পাহাড়, শঙ্খমালা’, বলত গ্রীষ্মের দুপুরে
কাঁচা আম কত জলছবি হাতে, জাহাজের বাঁশি বাজাত নকল সুরে।
ওঁর চশমা চোখে টুপি পরে দেখা দিত মস্ত সং
আমার হেঁশেলে, লাল টুকটুকে কচি মুখে বুজরুকি ঢং
মাটিতে লুটাতে হেসে আর যারা দেখত পাঁচজন,
বলত, কী-যে কাণ্ড করে একরত্তি তোমার খোকন।এখন সে স্থূলোদর, প্রশস্ত কপাল, পাতলা চুল
ঢাকে না মাথার টাক, স্লেট হাতে যায় না ইস্কুল।
আজ দেখি স্বাস্থ্যান্বেষী সে-ও ছড়ি হাতে
পার্কে কিংবা নদীতীরে (যদি কমে বাড়তি মেদ, বাড়ে
খুদেটুকু) ঘরে ফেলে সিঁড়ি হাতড়িয়ে অন্ধকারে।
বেড়েছে রক্তের চাপ, দাগ মেপে ঠিকঠাক ঘুমহীন রাতে
কেবলি ওষুধ খায়, ডেন্টিস্টের কাছে যায় যখন-তখন
আমার খোকন। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
প্রায় সারাদিন ঘুরে ঘুরে বিকেলের ঠাণ্ডা রোদে
ঘরের বাইরে রাখা চৌকিতে একটি
লাশ দেখে থমকে দাঁড়াই। এই লাশ
অন্য কারও নয়, এতো স্বয়ং আমার।বাড়ির সবাই শোকাহত বড়, কারও কারও চোখ
অশ্রুময়। ঘরের ভেতর থেকে ক্রন্দনের রোল
ভেসে এসে লাশটিকে ছুঁয়ে যায়,
লাশ সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন ভীষণ।আমাকে দেখেও কেউ বলে না কিছুই। যেন আমি
অবয়বহীন কেউ চলাফেরা করছে এখানে
সারাক্ষণ আমি ডাকাডাকি করলেও
কারও কিছু এসে যায় না। তবে কি মৃত আমি?গোসলের শেষে লাশটিকে কাফন পরিয়ে খাটে
শুইয়ে সবাই নিয়ে যায় গোরস্তানে। দেখি আমি
যাচ্ছি ঢুকে কবরের ভেতরে এবং
আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই
দোয়া দরুদের আভা দেয় মেখে লাশের অস্তিত্বে,
সবাই বিদায়্য নেয় আমি রয়ে যাই অন্ধকারে।বাসগৃহে মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি পাশে
ঘুমিয়ে আছেন সুখে জীবন-সঙ্গিনী;তবু আমি
একা, বড় একা বোধ করি আর যেন
নাকে লাগে ভেজা মাটির ঘ্রাণের নগ্ন ছোঁয়া! (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
এই যে খোলা উঠোন জুড়ে
চলছে নৃত্য, গানের সুরে দুলছে সত্যি
গেরস্তদের বসতবাড়ি। নাচ জমেছে
ডানে বামে। কাছের, দূরের সবার প্রাণে।হঠাৎ কিছু মন্দ লোকের অত্যাচারে
নৃত্য-গানের আসর ভাঙে।
লাঠির বাড়ি মাথায় পড়ে শিল্পীজনের।
নারী, পুরুষ প্রাণের ভয়ে কাঁপতে থাকে।কিন্তু ক’জন তরুণ রুখে দাঁড়ায় এবং
তাদের রণমূর্তি দেখে গুণ্ডারা সব
লেজ গুটিয়ে পালায় দূরে। খানিক পরে
বসলো হেসে গানের আসর, নাচের পালা।সেখানে কেউ কখনও আর
নাটক কিংবা গানের আসর পণ্ড করে
দেয়ার খায়েশ নিয়ে লাঠি হাতে আসেনি।
নৃত্য-গীতের আসর জমে, জিন্দাবাদ। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
ভরাট চাঁদের সঙ্গে করোটি বদল করে প্রবীণ চণ্ডাল
পোয়াতির উদরের মতো
মাটির কলসে দ্যায় তবলার চাঁটি ক্রমাগত;
এক ঝাঁক পাগলা কুকুর, চন্দ্রাহত, নেচে ওঠে,
খাবলে খুবলে নেয় তুলে
দেবতার বায়বীয় শরীরের খাল!
চিতার ধোঁয়ায়
পূর্বমেঘ ভাসে, নদীবক্ষে গ্রিনবোটে
দুলে দুলে
কতিপয় ছায়া জামাজুতো ফেলে পপ গান গায়।
স্বপ্নেরা আলতো মাথা রাখে ঢুলঢুলু
চণ্ডালের কাঁধে,
শেয়ালের দুরাগত উলু
শুনে দিকগুলি চমকিত, কে যেন ফুঁপিয়ে কাঁদে
বিষকাটালির ঝোপে, সম্প্রতি বিধবা
যুবতী আঁধারে একাকিনী
ঘোরে কোনো উনিশ শতকী নায়িকার
মতো রক্তজবা
নিয়ে তার সধূম হৃদয়ে। চণ্ডালের স্বাধিকার-
প্রমত্ত শোণিতে কী প্রবল বৈদ্যুতিক রিনিঝিনি।চুপিসারে এল একজন, যেন ঝানু গুপ্তচর,
পরনে জীনস্ তার, সমস্ত শরীরে
চরসের গন্ধ সাঁটা, সাত ঘাটে জল-খাওয়া, চালচুলো ঘর-
দোর নেই, ঘুরেছে সে দীর্ঘ কাল হাভতের ভিড়ে
চেনে বারবনিতার কোঠা, ড্রাগ, বোতলের ছিপি;
জলপিপি, সোমত্ত সারস, নদীতরবর্তী কাশ,-
সবকিছু সহচর এবং সাইডব্যাগে তার
ঝোলে টগবগে পাণ্ডুলিপি;
ডিজেলের ধোঁয়ায় এবং গলি ঘুপচিতে, নর্দমার
ধার কী সহজে ভাসে, যেন অমলিন রাজহাঁস।উড়ুক্কু শরীর তার চণ্ডালের দেহে লীন, ঘটে
উল্টে পড়ে আছে ভাঙা নৌকা, ভেজা ডাঙায় কোমল পদচ্ছাপ;
সে, চণ্ডাল, পদচ্ছাপ খুঁজে হাঁটে,
তার বর্তমান চূর্ণ কলসের মতো, মনস্তাপ
তোলে মাথা অন্তর্গত দ্রাবিড় গোধূলি
আর্তনাদে প্রতিধ্বনিময়
এবং ঠুনকো স্বপ্নগুলি
ঘাসফড়িং-এর মতো উড়ে উড়ে শুধু গুঁড়ো হয়,
মোদো চোখ মেলে বসে থাকে উন্মাতাল
বিংশ আর একবিংশ শতাব্দীর মধ্যিখানে প্রবীণ চণ্ডাল। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
পায়ের তলায় মাটি আজকাল বড় জাহাঁবাজ,
হিংস্র হয়ে উঠেছে, আকাশ
যখন তখন চোখ রাঙায় এবং মনে হয় এ রকম
ভয়াবহ অন্ধকার নামেনি কখনও চারদিক
লুপ্ত ক’রে রক্ত-পানি-করা হিম অর্থহীনতায় আর। মানবের,
মানবীর মুখচ্ছদ এইমতো নির্বিকার পাথর-স্বরূপ
দেখিনি কখনও আগে। হাটে, মাঠে, ঘাটে
হেঁটে যায় ওরা, যেন পুতুলের নিষ্প্রাণ মিছিল!এ কি আমাদের দেশ, যে-দেশে একদা
জনসাধারণ শহরে ও গ্রামে শান্তির ছায়ায় বসবাস
করেছে, দেখেছে রূপের স্বপ্ন নির্বিঘ্ন নিদ্রার অপরূপ
কোমল উদ্যানে? এ কি সেই বাংলাদেশ, কণ্ঠে যার
দুলেছে গৌরবদৃপ্ত বিজয়ের মালা
মুক্তিযোদ্ধা, ত্যাগী নেতা, সাধারণ মানুষের অনন্য সাধনে।শোণিত-সাগর থেকে জেগে-ওঠা স্বাধীনতা-পদ্মটিকে যারা
ছিঁড়ে-খুঁড়ে লাঞ্ছিত করার
খায়েশে মেতেছে ঠারে ঠোরে এমন কি
মাঝে মাঝে স্পষ্টতই, তাদের তোয়াজে মেতে থাকে
নানান পাড়ার নানা মোড়ল এখন। ফন্দি আঁটে ছদ্মবেশী
অস্ত্রাঘাতে প্রগতির তেজী ঘোড়াটিকে খোঁড়া ক’রে দেয়ার খায়েশে।
আমাদের কত না নিঝুম স্বপ্ন থেঁত্লে যাচ্ছে বুটের তলায়,
কত যে পদ্যের পঙক্তি বেঘোরে গুমরে মরে কবির খাতায়
প্রখর দুপুরে আর নিশীথের বিরান প্রহরে। শব্দমালা
কখনও করুণ ফোঁপানিতে কম্পমান, কখনও-বা নজরুলী
দুলে-ওঠা বাবরির ধরনে রাগী, আগুনের আলিঙ্গনে রাঙা।
আগুনের তাপ কমে এলে স্বদেশের বেদনার্ত মুখ ভেসে ওঠে।যেন স্বপ্নে আমার চকিতে মনে হ’ল- দিব্যি পূর্ব ও পশ্চিম,
উত্তর দক্ষিণ, ডান-বাম সব দিকে উচ্চারিত
প্রগতির জয়বার্তা, ঐ তো ওড়ে আসমানে কল্যাণের প্রশান্ত পতাকা-
চারদিক থেকে নর-নারী,
শিশু ছুটে আসছে সবাই। দীর্ঘস্থায়ী অমাবস্যা পলাতক,
কোনও গ্রীক দেবীর মুখের মতো চাঁদ হাসে আকাশের নীলে। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
ভক্তিমূলক
|
যেদিন শ্রীরামপুরে পা রেখেছিলাম, হাওয়া এসে
চৌদিকে রটিয়ে দিলো সগৌরবে আপনার নাম।
আমি সেই নাম চেতনায় বয়ে অতীতের দিকে
চলে যাই। দেখি, একজন প্রকৃত মানুষ হেঁটে
যাচ্ছেন একাকী কায়ক্লেশ তুচ্ছ করে লোকদের
শোনাতে সুসমাচার। কখনো অধিক রাত অব্দি
জেগে করছেন অনুবাদ বাইবেল বাংলা ভাষা
ভালোবেসে; বাংলা গদ্য করে যাত্রা আধুনিক পথে।আপনার ছিল টান গাছপালা, ফুল ফল আর
ফসল-ফলানো উদ্যমের প্রতি, শেষ বয়সেও দিতেন
প্রসন্ন দৃষ্টি মেলে স্বরচিত প্রিয় সেই
উদ্যানের দিকে; জ্ঞান আর মানব প্রেমের বসে
আপনি স্বদেশ ছেড়ে এসেছিলেন বাংলায়, তাই
বাঙালি কবির মনে আপনার স্মৃতি দ্যুতিময়। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
কোনো লুকোছাপা নয়, এর দরকার
আছে বলে মনে করি না।
শব্দ নিয়ে ছ্যাবলামি আমার
ধাতে নেই,-এই শাদা কথাটা আমাকে
সরাসরি বলতেই হচ্ছে। না বললেও চলে বটে,
যা ঘটে ঘটুক, বলে ফেলাটাই ভালো।
আত্মহত্যার বদলে খুদকুশি শব্দটি যদি
বসিয়ে দিই কিংবা বৈমাত্রেয় ভ্রাতা না বলে
বলি সওতেলা ভাই, তাহ’লে কি
আমাকে কেউ দিনদুপুরে হাতকড়া পরিয়ে দেবে?কারগারের পরিবর্তে জিন্দানখানা
অথবা পরম বান্ধবের জায়গায় জিগরি দোস্ত
ব্যবহার করি, তবে কি
বঙ্গীয় শব্দকোষ মানহানি-মামলা করবে আমার বিরুদ্ধে?কখনো যদি মহাফেজখানায় বসে
খোদার বদলে ঈশ্বর এবং পানির বদলে
জল উচ্চরণ করি, তাহলে কি বাজ পড়বে
কারো মাথায়? যদি মুখ থেকে আধা ডজন পুষ্পার্ঘ্য
আর এক ডজন প্রণাম অথবা নমস্কার
বেরিয়ে পড়ে তবে কি নাকে খৎ দিতে হবে সাতবার?আপাতত কিছু শব্দ প্রজাপতির মতো
উড়ে এসে বসছে আমার নাকে, কানে,
ওষ্ঠে আর খোলা বুকের পশমে; আমার
চোখ মুদে আসছে। প্রজাপতিগুলো এক ফাঁকে
ভ্রমর হ’য়ে গুঞ্জরণে
আমার অবসরকে বানিয়ে তুলছে
এক চমৎকার খেলা এবং কনকনে হাওয়ায়
স্পন্দিত ফুল ফোটার বেলা। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
সন্ত্রাসে বসন্ত কম্পমান; হনুমান লম্ফ ঝম্প দিয়ে
নিমেষে বাগান লন্ড ভন্ড করে, সন্ত ভীত, ম্ফীত
অন্ডকোষে পড়ে চাপ। প্রাণ যায়, মুত্রাশয় ফেটে
যাবে বুঝি পাইপের মতো; আকাঙ্খারা ছাই হ’য়ে
ওড়ে চতুর্দিকে, পুনরায় জড়ো করা অসম্ভব।
এখন কবন্ধদের গুঁতো খেতে খেতে কাঁটাবনে
হাঁটা ছাড়া উপায় কি আর? অন্ধকার দশদিক,
হাড়মাস গলে, চঞ্চু-নখরের ঘায়ে জব্দ চোখ।স্ববশে কিছুই নেই। নিয়ন্ত্রণ, শুধু নিয়ন্ত্রণ
যত্রতত্র, বাল্যকাল, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব কন্টকিত
নিয়ন্ত্রণে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করা, মুখ খুলে, হায়,
স্পর্ধিত এগিয়ে যাওয়া প্রবল বারণ। জিভ টেনে
ছিঁড়ে ফেলে দেয়ার উদ্দেশ্যে কত সান্ত্রী মোতায়েন।
নিয়ন্ত্রিত কত কিছু, এমনকি স্বপ্নও নিয়ন্ত্রিত। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
কিছুতে আসে না ঘুম। রাত,
কালো পাথরের মতো বুকে চেপে আছে
সারাক্ষণ; কান পেতে থাকি
কখন শুনবো তেজী মোরগের ডাক।
যদি ভোর ব্যালে নর্তকীর মতো আসে,
ছড়ায় শিল্পিত আভা আমার খাতায়,
তবে আমি শক্রকেও হেসে, হাত ধরে
নিয়ে যাবো আতিথ্যের ঘাটে, দ্বিগ্রহরে
তার সঙ্গে ভাগ করে খাবো
শাকান্ন এবং ফলমূল! ঘুম নেই
চোখে, বারবার শুধু সাততাড়াতাড়ি
ছেড়ে-আসা ঘরটির কথা মনে পড়ে।সেসব সতেজ চারা গাছ,
যারা উঠেছিল বেড়ে আমার নিবিষ্ট
আদরের মধুর রোদ্দুরে,
সেসব গোলাপ-কুঁড়ি, যারা
আমার স্বপ্নের মতো ছিল স্ফুটোন্মুখ,
তারা কি এখনো বাঁচে
উঠোনের কোণে কোনো কল্যাণী স্পর্শের প্রত্যাশায়?
এখন বাসিন্দা যারা ওরা কি শেকড়ে ঢালে জল?
পাতা ছেঁটে দেয়? যত্ন নেয়
গোলাপ গাছের? ওরা ভোরে
অথবা বিকেলে
গম খেতে দেয় বুনো কবুতদের? মনে সুর্যোদয় নিয়ে
তিনটি তরুণী
এখনো কি সূর্যাস্তের দিকে
মুখ রেখে দাঁড়ায় প্রত্যহ ত্রিবন্দনা হয়ে খোলা
ছাদের হাওয়ায়? ওরা থাকুক শান্তিতে। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
এই যে প্রায়শ রাত্রির ঘুম মাটি করে বসে
কবিতা লেখার সাধনা করছি টেবিলে ঝুঁকে,
পরিণামে তার কী ফল জুটবে ভাবি মাঝে মাঝে;
তবে শেষ তক ভুলে গিয়ে সব সৃষ্টির মোহে বন্দি থাকি।অনেক খাতার শূন্য পাতায় শব্দ-মিছিল
সাজিয়ে চলেছি বহুকাল ধরে। মাথার কালো
চুল সবগুলো শুভ্র হয়েছে অনেক আগেই। এখন ফেরার
পথ খোলা নেই, পথে যত কাঁটা থাকুক, তবুও এগোতে হবে।আমার শরীরে দগদগে ক্ষত হয়েছে অনেক,
হঠাৎ কখনও হিংস্র ঈগল হামলা করে।
শরীরের তিন টুকরো মাংস ঈগলের ঠোঁটে
ঝুলতে ঝুলতে কখন কোথায় পড়ে যায় দূরে, পাই না টের।
ঈগল আমাকে নিয়েছে কি ভেবে আসমানচারী
জাঁহাবাজ আর হিংসুটে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী?
নইলে কেন সে ডানা ঝাপ্টিয়ে আসছে আমার
দিকে পুনরায়? জানে নাকি পাখি সকল ক্ষেত্রে ব্যর্থ আমি? (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
তোমার গোলাপগুলি আমাকে দেখছে অপলক
অনুরাগে ফুলদানি থেকে। বুঝি ওরা প্রতিনিধি
তোমার; ফলত প্রতিক্ষণ অমন তাকিয়ে থাকে
কেবলি আমার দিকে। লক্ষ করে এই ঘরে বসে
কী করছি আমি, কোন্ বই পড়ি, কিছু লিখি কিনা,
বুঝে নিতে চায় আমি তোমার স্মরণে কতটুকু
মগ্ন আছি, তোমার সুন্দর মুখ আমার দু’ চোখে
পরিস্ফুট কতখানি, দেখে নেয় দর্জির দৃষ্টিতে।যখন ফিরবে তুমি ভ্রমণের শেষে এ শহরে,
তখন গোলাপগুলি থাকবে না। ওরা মরে যাবে,
ঝরে যাবে; সৌন্দর্য বড়োই ক্ষণজীবী, আমি এই
ক’টি দিন সুপ্রিয় তোমাকে ভুলে ছিলাম অথবা
ব্যাকুল ছিলাম খুব তোমার জন্যেই। তার কোনো
বিবরণ কখনো পাবে না তুমি প্রতিনিধিহীনা! (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
সজীব আঠারোতেই রুক্ষ, তামসিক
প্রতিক্রিয়াশীলতার ব্যাকুল খাদেম,
প্রট্রোডলারের
ঝলকানি-লাগা
খালিশ, নিরেট
ভোগবাদী নেতাদের বাক্চমকে আবিষ্ট,
নাৎসী-আনুগত্যে নতজানু সর্বক্ষণ।
তার করোটিতে
বৃষ্টিপাত-পরবর্তী রামধনু নেই,
জ্যোৎস্নাবিহ্বলতা নেই। সুদূর, গুমোট
আইয়ামে জাহেলিয়াতের
অন্ধকার মাথায় ঘা-ভর্তি
গ্রীষ্মের কুকুর যেন, জিভ বের ক’রে
হাঁপায় কেবল।
সূর্যোদায়-রহিত মনের আস্ফালনে
ধুন্ধুমার ফুঁ দিয়ে নেভায়
মঙ্গল প্রদীপগুলি যখন তখন আর প্রগতির ঋদ্ধ গ্রন্থমালা
আগুনের বুকে ছুঁড়ে ফেলে
হাত সেঁকে নেয় ঘটা ক’রে
উঠতে বসতে করে কার্ল মার্কস-এর মুণ্ডপাত।শহরের ঠেঙাডে প্রহরে গর্দানের রোঁয়া-খাড়া
নেকড়ের মতো ঘোরে রাস্তায় রাস্তায়,
মারণাস্ত্র হাতে মধ্যরাতে দমাদম
লাথি মারে শ্রীমন্ত শুভ-র শান্তিখচিত দরজায়। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
সাঁওতাল রমণীর মতো যে অন্ধকার
দিগন্তে স্তব্ধ,
তা’ এখন শহরের ওপর খুব নীচু হ’য়ে
ঝুঁকে পড়েছে; ওর নিঃশ্বাস
অনুভব করি ত্বকে। থমথমে গুমোট-ছেঁড়া
হাওয়ায় ঈষৎ শৈত্য; শহরের চোখের পলক
না পড়তেই বাতাসের
প্রচণ্ড মাতলামি, নিমেষে হাজার হাজার
দরজা জানালা বন্ধ। আকাশ ফুটো করে
বৃষ্টি এল অগণিত ঘোড়সওয়ারের মতো আওয়াজে।
মেঘের বুকে বিদ্যুৎ-তরবারির
ঝলসানি, কানফাটানো বাজের শব্দ!একটানা বৃষ্টির সুর ঝরে শিশুপল্লীর ছাদে,
গোশালার টিনে, রাধাচূড়া গাছের পাতায়,
নিঝুম বৃষ্টির সুর ঝরে
হতশ্রী বস্তির খোলার ঘরে আর
শহরের উঁচকপালে এলাকায়,
ঘুমের ভেতরে, অবচেতন মনের খনিতে।
বৃষ্টির সুর ঝরে আমাদের ভালোবাসার ওপর,
আমাদের মিলন এবং হু হু বিচ্ছেদের ওপর।আমাদের স্বপ্নেরা বৃষ্টির জালে আট্কা পড়ে
ছটফট করে চকচকে রূপালি মাছের মতো।
আমি আমার ছোট ঘরে বসে আছি
একা এবং নিশ্চুপ-
আমার মাথায় বৃষ্টির শব্দময় শব্দহীনতা আর
একটি হয়ে-উঠতে-চাওয়া কবিতার
অস্পষ্ট মেঘমল্লার এবং
তোমার স্মৃতির মোহন কম্পন।তুমি অন্ধকার বারান্দায় একাকিনী বসে দেখছো
বৃষ্টি কোমল চুমো খাচ্ছে আম গাছের পাতার ঠোঁটে।
তোমার নিঃসঙ্গতাকে স্পর্শ করে
নিঝুম বৃষ্টির সুর। আমার শূন্য বিছানা
ভেলার মতো ভাসমান অথৈ বেদনায়।
তোমার এবং আমার
হাতে মাঝখানে জলজ দেয়াল। কে যেন
বাইরে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত পান করে চলেছে শ্রাবণের আরক।যখন বৃষ্টি দেখি, তোমার প্রগাঢ় চোখের অশ্রুজল
মনে পড়ে আর তোমার চোখের জলে শ্রাবণধারা খুঁজে পাই। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
আকাশ যেন আজ ঠান্ডা ভারী কাঁথা,
ময়লা ফুটো দিয়ে মারছে উঁকি তারা;
পায় না মনে ঠাঁই ঘরে ফেরার টান,
কলিংবেল দিলো ঝাঁকুনি সন্ধ্যাকে।
পাশের ঘরে এই কবিকে তাড়াতাড়ি
লুকিয়ে রেখে তুমি বিদায় চেয়ে নিলে।
তোমার ব্যবহারে কেমন মায়া ছিলো,
নিষ্ঠুরতা বলে তাকে পারিনি ধরে নিতে।বুকের ঝাড়বাতি নিভিয়ে এক ফুয়ে
আমাকে ফেলে তুমি ক্ষিপ্র চলে গেলে।
আমার স্বপ্নের পাপড়ি সমুদয়
ছিড়েছো কুটি কুটি, হুতুশে তাই মন।
অথচ কিছু আগে দুজনে হাতে হাত
রেখেছি অনুরাগে, ওষ্ঠে নিয়ে ঠোঁট
ভুলেছি লহমায় জগৎ সংসার।
কার সে ঝট্কায় গিয়েছো দূরে সরে।তখন কাছ থেকে বুকের ওঠা নামা,
ঠোঁটের নড়া আর চোখের ঝলকানি
দেখেছি তন্ময় এবং তোমাকেই
ব্যাকুল পান করে কেটেছে সারা বেলা।আমাকে রেখে গেছো এ শীতে অসহায়,
একলা বসে দেখি অস্তাগামী চাঁদ,
আড়ালে শুনি মৃদু পাখির ডানা ঝাড়া।
হৃদয়ে ধূলিঝড় প্রহর গুণি শুধু।কখন তুমি ফিরে আসবে জানি না তা।
কোথায় বসে আছো কেমন হুল্লোড়ে?
কথার হাইফেনে, বিদ্রূপের তোড়ে
পড়ে কি মনে তাকে, এসেছো ফেলে যাকে?তোমার সত্তায় পূর্ণ অধিকার
প্রতিষ্ঠিত হায় হলো না প্রিয়তমা।
তোমার বরতনু আমার খর তাপে
মাখন হয়ে আজো গলেনি একবারও।
যখনই কাছে আসো, আলিঙ্গনে বাঁধো,
হঠাৎ জেগে ওঠে তীব্র কোলাহল।
নিষাদ তীর ছোঁড়ে আমার দিকে, তুমি
আমাকে বারবার আড়াল করে রাখো।কিন্তু কতকাল থাকবে আবডাল?
আমি কি তস্কর অথবা আততায়ী?
নিজেকে মিছেমিছি অন্তরালে ঢাকি,
হৃদয় ঘায়ে ঘায়ে রক্তজবা হয়।যখন পুনরায় আসবে তুমি আর
আমার চোখে মুখে নামবে নিরিবিলি
তোমার মসৃণ চুলের কালো ঢল,
বক্ষে নেবো টেনে, কখনো ছাড়বো না।হন্তারক এই যুগের তমসায়
আমাকে একা ফেলে যেও না তুমি ফের;
না দাও যদি তুলে প্রেমের হাতে ফল,
ইহজীবনে আর ছোঁবো না তণ্ডুল।(হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
চেতনায় ঝরে ঝরে সুর থেমে গেলো অকস্মাৎ।
জানাজানি হবার মতন কিন্তু কিছুই ঘটেনি,
দূর থেকে আসা সে সুরের দাম ক’পেনি
করিনি যাচাই, শুধু এক জ্বলজ্বলে অভিঘাত
স্মৃতিস্রোতে নিয়ে ঘুরি মনুষ্য সমাজে। দিনরাত
কেটে যায় যথারীতি আহারে বিহারে কি নিদ্রায়,
মাঝে-মাঝে সেই সুর চেতনায় ডানা ঝাপটায়
এবং অব্যক্ত কবিতার মতো করে অশ্রুপাত।হে পাখি শহুরে পাখি, তুমিও করেছো বড়ো ভুল-
এর কোনো ছিলো না দরকার, সাদামাটা শত কাজে
ছিলাম জড়িয়ে নিত্য; তুমিও পল্লবে, দূর নীলে
অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন ছিলে। তোমার এ সুর কী ব্যাকুল
করেছে আমাকে আজ। যদি সুর থেমে যাবে সাঁঝে,
তবে কেন হৃদয়ে আমার তুমি ডেকে উঠেছিলে? (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
১
জংধরা তোরঙের ঢোস্কা জঠর থেকে বের করে নেড়ে-চড়ে উল্টে-পাল্টে
দেখি ওদের। চমৎকার ঝনৎকাররহিত, উজ্জ্বলতা গানের, বহুকাল এক বিঘৎ
ডোবায় কচুরিপানার জটলায় ছিল মশক-ডিম্বের সংশ্রমে। রোদ্রে শুকিয়ে, ঘষে
ঘষে অনেক আগেকার রূপোর টাকার মতো বাজিয়ে দেখি, বোবা। শোভা না
ল্যক, ধ্বনির ও ধাত্রী নয়, এ তো ভারী মুশকিল। ঢিল ছুঁড়ি অন্ধকার রাত্রির
ঝিলে, কম্পন তোলে নিমজ্জিত নুড়ি। দৈবের উপহারের আশায় উপবিষ্ট,
তীর্থের কাক; খনি ভেবে নিজেকেই খুঁড়ি, মনে পড়ে আগুন-চুরির পরান। কী
দণ্ড শেষতক লভ্য? খণ্ড খণ্ড হবে হৃৎপিণ্ড, পুড়তে থাকব অষ্টপ্রহরাদ্রোহের
উপঢোকন। বাতাস ভূমিহীন চাষির দীর্ঘশ্বাস, পায়ের তলায় হিংস্র ঘাস;
মড়াখেকোদের নাকী চিৎকারে অস্তিত্বের ভিত কাঁপে গেরস্তের। মর্চেধরা
শব্দগুলো সাফ সুফ করে ওদের জংকৃত করার প্রয়াস গুলীবিদ্ধ বেলে হাঁস, চরে
মুখ থুবড়ে পড়ে। যা বলাতেই চাই ওদের দিয়ে, সাধ্যি নেই বলার। এই সময়ের
ছটফটানি, ধুকপুকানি, তর্জন গর্জন ধরাণের শক্তি ওদের লাপাত্তা। “এই
পেয়েছি” বলে ধরতে চাই কোনও শব্দকে, কিন্তু প্রতিবার যায় পিছলে, ভেজা
সাবান। প্রাণপণ খুঁজি যোগ্য শব্দ ভাসমান ঝাঁকে। খুঁজতে খুঁজতে সব
পুঁজিপাটা খুইয়ে দেখি সারা জীবনই গোধূলি-আকাশ।২
যাবতীয় স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ নিয়ে বসি নিভৃত প্রহরে, যেমন মেলায়
নিক্রেতা রকমারি খেলনা সাজিয়ে অপেক্ষমান। দাঁড়ানো সারে সারে, কখনও
ওলটপালট, সে এক যজ্ঞ। শালপাতা সামনে, বলা কওয়া নেই, অ-আ, ক-খ
বসে যায় পঙ্ক্তি ভোজনে। পেট পুরে খেয়ে দেয়ে প্রশ্ন করে, ‘বলো, কী বর
চাও?’ ওদের ঢেকুর, হাই, খুনসুটি আর রঙিন তামাশার ঝাঁকুনিতে আমার
চাওয়ার আইটাই। রাত নির্ঘুম? স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণের কোরিওগ্রাফ। রক্তচোষা
বাদুড় দূর থেকে লক্ষ করে আমাকে, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অকস্মাৎ বাজায়
এই বিনিদ্রকে শিকার। অক্ষরমালা ওর সহযোগী, অথচ আমারও উদ্ধার। দুপুর
রাতে তরবারির ঝলসানি ওরা, চোখে চমক। অক্ষর নিমেষে জোনাকি, নেভে
আমার মুঠোয়। মুঠো খুললেই জ্বলে ওঠা পুনরায়, আলোবিন্দুসমুদয় খুব চেনা
একজন, যাকে বারবার স্পর্শ করার আকাঙ্ক্ষা ছলাৎছল নদী। তার মুখ নেমে
আসে আমার উৎসুক মুখে ঘুমের আগে, ওর প্রেমার্দ্র ঠোঁট আমার ওষ্ঠে
মেঘনিবিড় ছায়া মাখে জাগরণের মুহূর্তে। রক্তচোষা বাদুড় অপসৃত।৩
যেখানে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো, সেখানেই দখলি। আমার কান ঘেঁষে যাওয়া
পরিযায়ী পাখি এক লহমায় ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান। চুলে নক্ষত্রের নাচ,
জ্যামিতিক গাছ ধারণ করে কোজাগরী জ্যোৎস্না, গলে গলে পড়ে সাধুর্য।
কয়েক ঘণ্টা পরে উঠবে টকটকে সূর্য, শিরায় টগবগানি। এক খণ্ড বড়সড়
পোয়াতি জমি অচিরে করবে প্রসব। ধান, পাট, গম, যব, ভুট্রা, আলু, আদা,
সর্ষে-কোনো ফসলসম্ভার নেবে সূর্যের চুম্বন, হাওয়ার আলিঙ্গন? সে জমি
আমার লক্ষ্যবস্তু বহু প্রহরের, তাকে দেখি জ্যোতির্বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে। নিয়মিত
নিড়াই, আগাছাগুলো মৃত সৈনিক। পানি গড়ায়, স্ফীতি-মৃত্তিকা-যোনি; হঠাৎ
জমির ওপর ধর্ষিতা নারীর ছিন্নদেহ, উনিশ শ’ একাত্তরটি সূঁচ-বসানো স্তন,
বৃদ্ধের বুলেটে ঝাঁঝরা বুক, বন্দুকের বাঁটে শিশুর থ্যাঁতলানো মুখ, গেরিলার
উত্তোলিত বাহু আর ফাঁকে ফাঁকে শৌর্যের সূর্যমুখী।৪
ওর টিমটিমে জীবনে চন্দ্রোদয় সেই তন্বী। লাগাতার খরার পর জলাধারের
পাড়-ভাঙা উচ্ছ্বাস, অজস্র ফুলের রঙবেরঙের চাউনি। সারাক্ষণ মুখিয়ে থাকা
লোকজনের হট্ররোলে দু’জনের একান্ত ছাউনি, দোয়েল শ্যামার সুরে ঘেরা,
তারার ঝিলিকে ভরপুর। কখনও হৃদয় উপচেপড়া আনন্দ জোয়ার, কখনও
সত্তা-খাককরা যন্ত্রণার দাউ দাহ। সব ছেড়েছুড়ে ওরা এখন ভবিতব্যের
সাম্পানে সওয়ার। তরুণী ওকে হৃদয়ের রক্তোৎপল উপহার দিয়ে বলে, ‘এ
আমার বহু যুগের উত্তরাধিকার, গ্রহণ করো। তুমি কি জানো কেন তোমাকে
ভালোবাসি?’ লোকটার কথা, ‘কী করে জানবো? আগাগোড়া ব্যাপারটাই
রহস্যে-পোরা এক উদ্ভিন্ন তোড়া। ‘ঠিক তা’ নয়, তুমি স্বদেশের মাটিতে
ছড়িয়ে দিতে পারো তোমার সবগুলো হাড়, এ জন্যেই আমার এই
ভালোবাসা। তখন দিগন্ত ছোঁয়া খোলা পথে ঘরহারা, ছন্নছাড়া বাউলের গলা
থেকে ঝরতে থাকে উদাস দেহতত্ত্বের শিশির ফোঁটা।৫
জীবনের গাঁটছড়া বাঁধা ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে। তপ্ত, শীতল, শুষ্ক, দ্রবীভূত।
কখনও আকাশ-ফাড়ানো তোলপাড়, কখনও বা দুধের শরবত স্তব্ধতা। মাঝে
মাঝে আলোর ঝকমকানি আর সাবেকি অন্ধকার পাশাপাশি। রাতবিরেতে
সাপের ফোঁসফোঁসানি, ডাকসাইটে মস্তানের অশ্লীল চিৎকার, ছোরা বসানো,
হাঁকডাক আর সাহিত্যিক পিম্পের নষ্টামির ভেতর দিয়ে আমার হাঁটা।
সদ্যোজাত আতঙ্কের কানাগলিতে আমি একা, হকচকানো; মেরুদণ্ডে
আলাস্কার ঈষৎ গলিত বরফ জলের চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া। বিশ্রাম আমাকে শাদা
অ্যাপ্রন পরা সেবিকার যত্নে শুইয়ে দেয় শয্যায়, অথচ অন্তর্গত গোঙানি ক্ষয়ে
যাওয়া রেকর্ডের একই রেখায় ঘূর্ণমান। বিছানায় বিষ পিঁপড়ে, কাঁকড়া বিছে,
শুঁড় দোলানো আরশোলা আর টিকটিকির ভিড়। চোখের পলকে খাট ছোঁয়
কড়িকাঠ, পলেস্তারা চেপে ধরে আমাকে, গনগনে আংটায় আটকানো গলা,
কণ্ঠস্বরে কখনো গ্যালাক্সির নিস্তব্ধতা কখনো আদিম মানবের বিনিদ্র গোঙানি।
ঘর আমাকে গিলতে আসে ডানাসরের আক্রোশে। কালো পাখি ঠোকর মারে
বারবার, দু’হাতে মুখ ঢাকি। কী করে এ ঘরে এতকাল আমার বসবাস?
আকাশ মুঠো মুঠো ঘাস, ঘাসে লেপ্টে থাকা নীরবতা। সহজিয়া শ্রমে ঘস্ ঘস্
কাটছে ঘাস বিদ্যুৎ রঙের কৃষক।৬
‘কবিতা শুনব’, একটি ফুটফুটে শিশুর ঝলমলে আব্দার বিস্ময়ের
ঢেউগড়ায় সত্তায় ওর মন ভোলানোর আশায় হাতে তুলে দিলাম লাল বল,
চিত্তহারী বল দ্রুত সোফার তলায়। পথ চলতি বানরঅলার সাত তালিমারা
ঝোলা আর ডুগডুগির প্রতি ওকে মনোযোগ করার চেষ্টাতেও নাকাল। ভাবি,আমি কি নক্ষত্রের ঝাড়, জ্যোৎস্নার ঝালর আর মেঘের মেদুরতা দিয়ে মেটাবো
শিশুর দাবি? নাছোড় সে, কবিতা শোনায় ইচ্ছা বুলবুলির অবিরাম শিস।
আখেরে আমার অসমাপ্ত কবিতা আড়ালে রেখে শিশুটিকে খুব কাছে ডেকে ওর
চাঞ্চল্যের রঙিন পথে একটা শাদা কাগজ দোলনার মতো দোলাতে থাকি।৭
হাওয়ায় আমার আজন্ম অধিকার, কিন্তু ফুসফুস টেনে নিতে ব্যর্থ
প্রয়োজনীয় অক্সিজেন। ধাত্রীর হাতে নাড়ি কাটার দিন থেকেই এই খুঁত। শ্বাস
হারানোর শঙ্কায় সকাল-সন্ধ্যা ছটফটে মুহূর্তগুলো কোনওমতে জড়ো করে
বাঁচা। কলকব্জায় রঙচটা খাঁচা, লোহা-লক্কড়, বসন্তকে নীরব করে দেয়া
কীটনাশক, লজ্ঝড় বাস-ট্রাকের পোড়া ডিজেলের অবিরত বমি; ব্যাপক
দূষণে প্রকৃতি সূতিকাগ্রস্ত, শোচনীয় নারী। ঘোর অমাবস্যায় মোগল বেগম
সাহেবাদের হাম্মামে ভীষণ হানিকর, উৎকট, পূতিগন্ধময় চটচটে নর্দমার
পানি, দ্রাবিড় যুগ থেকে ছুটে আসা। অগুনতি মুমূর্ষু মাছ আর পাখির ঝাঁক
স্তূপীকৃত। আমার আক্রান্ত ফুসফুস হাওয়া টানতে গিয়ে অপদস্থ, ফুলে ফুলে
ওঠে, জীর্ণ হাঁপর। কাপড় চোপড় ঠিকঠাক, মানানসই, অথচ অস্তিত্বের
কাকতাড়ুয়ার রং ঢং। অতিকায় মাকড়সার জালে আমি চিৎপটাং।
সাহসিকতার কোনও ভড়ং ছিল না, অথচ কতিপয় চামচিকা চক্কর কাটে
চতুর্দিকে, আঁটে লাথি মারার ফন্দি। এই বন্দিত্ব থেকে পরিত্রাণ পাব কবে?
স্বর্গীয় এক পাখি কানে কানে বলে, ‘ঝট্কা মেরে জাল ছিঁড়ে উঠে দাঁড়াও
সটান; এক্ষুণি তোমার অভিষেক। ফাঁকা পথে, সাক্ষী অন্তর্যামী, আমাকে
মৃদঙ্গের সুরে ক্রমাগত ডেকেই চলেছে আগামী। দোমড়ানো, মোচড়ানো
ফুসফুস এগোতে দিলেই হয়। যতদিন না কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস জরুরি, ততদিন
আমার ছুটে যাওয়া ম্যারাথন দৌড়বাজের ধরনে। বহুদূরে বিরাট দ্বীপাধার
প্রজ্বলনের আকাঙ্ক্ষায় আমার অপেক্ষায়। মশাল নিতে পারব কি ততদূর?৮
হাতকড়া একজোড়া হাতকড়া ঝন্ঝনিয়ে বেজে ওঠে, পক্ষীর ক্রেঙ্কার।
নাছোড় হাতকড়া ঝোলে, দোলে সারাক্ষণ, স্বপ্নের ভেতরেও। প্রতিবেশীরা
সবাই কম বেশি দ্যাখে এই দৃশ্য-আমার চক্ষুদ্বয় অপ্রকৃতিস্থ দ্যুতি নিয়ে নিবদ্ধ
সম্মুখে, নড়বে না এক চুলও, আর দু’টি অদৃশ্য বেখাপ্পা আলঙ্কার। আমার
হাতের কবজি প্রসারিত স্বেচ্ছাসেবকের ভঙ্গিতে যেন হাতকড়ায় স্থাপিত
সেবাশ্রম। হাতকড়া অতিকায় করোটির ফাঁকা অক্ষি কোটরের মতো নেচে
বেড়ায় এখানে সেখানে। আমি, অচিকিৎস্য স্বপ্নচর, ধ্বংস আর সৃজনের মধ্য
দিয়ে হেঁটে যাই ষড়ঋতুতে। সঙ্গে সঙ্গে যায় এক জোড়া হাতকড়া।৯
রাজকীয় বেলেল্লাপনা, হট্রগোল, সংশয়ের ফণা, বিশ্বাসের অট্রালিকায়
ভয়ঙ্কর সব ফাটল, যে-কোনও মুহূর্তে ধস কিংবা সংহারী ঢল নামতে পারে,
নেমেই গ্যাছে, শহরবাহারী পশুদের উল্লাস। নিজেরাও যাবে তলিয়ে, জানে
না। প্রাক্তন বিশ্বাস আঁকড়ে ধরি যখন তখন, যদিও এই প্রায় প্রলয়তুল্য
ভাঙচুরের মত্ততায় নিঃশ্বাস নেয়া অসাধ্য। যত তাণ্ডবই চলুক, তেড়ে আসুক
পিশাচের দল, এখুনি ভদ্রাসন ছেড়ে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। দুর্বহ
নিঃসঙ্গতা একশ’ আট ডিগ্রি রৌদ্রে পড়ে থাকা শবের ফাটা ত্বকের মতো
চড়চড় করছে। নিজের সঙ্গেই কথা বলা জোরে জোরে, মাথা ঘোরে, মগজের
ভেতরে হঠাৎ হঠাৎ করে অমানিশা। বেদিশা ঘুরি আলোছুট ঘরে; বাঁচার কী
সার্থকতা? আমি কি লাগছি কারও কোনও কাজে? কলিংবেল বাজে দরজা খুলে
দেখি, শূন্যতার ছায়া। স্যুইচ জমাট, স্পর্শহীন। অদূরে এক চিলতে জনশূন্য,
প্যাচপেচে মাঠ। গেটে ড্রাইভারহীন বেবি ট্যাক্সি ধুঁকছে, কোথাও যাবার কেউ
নেই। ম্যাক্সিপরা কে একজন ছায়ায় বিলীন, এই দিন মেফিস্টোফিলিসের মতো
মুখোশধারী, আত্মাচোর। ইশ্ ব্যাটাচ্ছেলে মরেও না, শক্রদের আক্ষেপ
দিনভর, রাতভর। লেপ মুড়ি দিয়ে শোয়া, বেসিনে হাতমুখ ধোয়া, পাতাল
থেকে অবিশ্বাস্য কবিতার পঙ্ক্তি ছেঁকে তোলা, পরবাস্তবতার ভাষ্য রচনা,
মাঝে-মধ্যে উপহাস্য হওয়া, রাত্রির পর রাত্রি জাগা, দূরের যাত্রী হওয়া
কখনও, এই বেঁচে থাকা কী জন্যে? কার জন্যে? আবছা স্মৃতিকে অনুসরণ করে
দিন যায়। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
তোমার ঘুমানো, জেগে-থাকা, হঠাৎ বেরিয়ে যাওয়া
ঘর ছেড়ে কিংবা শীর্ণ ভিখারীর ক্ষয়া হলদে দাঁতে
চোখ রাখা, কাজান্তজাকিস পড়া, স্তব্ধ মধ্যরাতে
সুদূর গ্রীসের কথা ভাবা, ছিপছিপে নৌকো বাওয়া
স্বপ্নের অসীম ঝিলে বুকে নিয়ে স্মৃতিময় হাওয়া,
মরণ আবৃত্তিকারী এক ঝাঁক লাল-নীল বুড়ো
কাকাতুয়া দেখা, চোখে অতিদূর পূর্ণিমার গুঁড়ো,
বেডশীট আঁকড়েধর- সবই কে ধরনের পাওয়া।ধরা যাক অর্থহীন সকল কিছুই, তবু তুমি
সযত্নে এসব কোনোদিন হয়তো করবে অনুবাদ।
শহুরে প্রচ্ছন্ন গলি, সবুজ পুকুর মহল্লায়
প্রত্যহ ভ্রমণকারী জন্মান্ধ কুকুর, বধ্যভূমি,
গোধূলিতে বেশ্যার মতন রাঙা, মৃত মুখ, খাদ-
এ-ও কি তোমার হাতে দীপ্র অনূদিত হতে চায়? (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
আমার নির্মাণ আজ আমাকেই বড়ো ব্যঙ্গ করে।
যা-কিছু গড়েছি এতদিন বেলা অবেলায় প্রায়
প্রত্যহ নির্মম শ্রমে, সেসবই কি তবে, হায়,
খড়ের কুটোর মতো পরিণামহীন জলে-ঝড়ে?
আমিতো দিয়েছি ডুব বারংবার, পাতালের ঘরে
দানবের মুখোমুখি নিয়ত থেকেছি বসে আর
পর্বতচূড়ায় অনাহারে কাটিয়েছি দিন হাড়
কালি ক’রে; জঙ্গলের জটাজালে আছি হেলাভরেএখনো প্রত্যাশাময়। রক্ত দিয়ে লিখি রাত্রিদিন
শূন্যের দেয়ালে কত পংক্তিমালা, সবই কি অসার?
এই যে স্বপ্নের মতো অনুপম ঘরগেরস্থালি,
অথবা নিঝুম বনস্থলী, হ্রদ, চকচকে মীন
জেগে ওঠে শূন্যতায় অকস্মাৎ-এ-ও কি নচ্ছার
কারুর জঠরে যাবে? আমার নির্মাণ ধুলো-বালি? (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
ঘুড়ি বসবাস করে নিরিবিলি বিনীত দোকানে,
গৃহকোণে, খাটের নিভৃত নিচে, কিংবা খোলা ছাদে
চুপচাপ বালকের স্বপ্নের মতন নির্বিবাদে।
খয়েরী, সবুজ, হলদে, নীল ঘুড়ি সবখানে,
মানে শহরে ও গ্রামে মিশে রয় স্তব্ধতার গানে।
মাছ কিংবা পরীর মতন চোখ কী ফুল্ল আহ্লাদে
জেগে থাকে সর্বক্ষণ, নাকি অত্যন্ত নিঃশব্দ কাঁদে,
যখন মাটিতে থাকে। সর্বদা নীলিমা তাকে টানে।বস্তুত মাটিতে নয় সে প্রকৃত ঘুড়ি; অতিদূরে
নীলিমায় হাওয়ায় হাওয়ায় যখন সে ওঠে দুলে,
আকাশের ঠোঁটে চুমো খায়, তখনই সৌন্দর্য তার
লীলায়িত খুব স্মরণীয়ভাবে, নকশা তার সুর
হয়, সুর নকশা, আর হোক যত দূরেই বিস্তার
স্পন্দিত বর্ণের, সুতো যেন থাকে সর্বদা আঙুলে। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
নিজের সঙ্গেই আজ সারাদিন খেলি কানামাছি
কী জানি কিসের ঘোরে। মাঝে-মধ্যে কেমন অদ্ভুত
মনে হয় নিজেকে নিজেরই কাছে। কী ক’রে যে আছি
ভুল ইতিহাস শুনে, মূঢ়দের প্রগতির দূতভেবে নিয়ে; ঐ তো ওরা সর্বক্ষণ পেছনের দিকে
টেনে নিতে চায়, মনে ছড়ায় আঁধার মুঠো মুঠো।
এসব মুখের কোনো বাস্তবতা নেই, ওরা টিকে
আছে মিথ্যা পুঁজি ক’রে কুড়িয়ে ভ্রান্তির খড়কুটো।কোথায় উদ্ধার ব’লে এমনকি ঘুমের ভেতরে
ভীষণ চিৎকার ক’রে জেগে উঠি, প’রে নিই ঠুলি
দু’চোখে আবার। শুনি কারা প্রকাশ্যে আমারই ঘরে
অস্ত্রে দিচ্ছে শান জোরে; আমার গলায় অত্রগুলি
নির্ঘাত বসাবে কোনোদিন নীল নক্শা অনুসারে,
আমরা ক’জন শুধু গেয়ে চলি তারে নারে নারে। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
দাঁড়াও এখনই তাকে সাজানো মঞ্চের মাঝখান
থেকে দূরে সরিয়ে দিও না। আরো কিছুকাল তার
পার্ট বলে যেতে দাও। খানিক থমকে যাওয়া মানে
বেবাক বিস্মৃতি নয়, যদি তুমি লোভী বেড়ালের
মতো এরকম ঘুর ঘুর করো সারাক্ষণ, তবে
কীভাবে সে সামলে সুমলে নিয়ে আবার বাগানে
যাবে স্মিত ভোরবেলা, চারা গাছটাকে মমতায়
ঈষৎ নাড়িয়ে দেবে? দেখে নেবে রাঙা পাখিটাকে
এক ফাঁকে? এখনো কাপড়ে তার গোলাপ তোলার
কিছু কাজ বাকি, নাতনির সঙ্গে খেলবার
সাধ নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে। দূরে স’রে
দাঁড়াও, ফেলো না তার বুকে মুখে শীতল নিঃশ্বাস। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
১
কোনও কোনও কবিতা দূরে দাঁড়িয়ে থাকে; রুখু লালচে চুল, নীল চোখ,
গালে আপেলের রক্তিমাভা; ক্ষুৎ-পিপাসা, বুলেট এবং বোমা থেকে পালিয়ে
বেড়ানো উদ্বাস্তু ইরাকী বালিকা। হাত নেড়ে ডাকি, রুটি, কোকাকোলা আর
লজেন্সের প্রতিশ্রুতি দিই, তবু সে অনড়। যেন আমার চারপাশে অদৃশ্য
কাঁটাতারের বেড়া, টপকিয়ে আসার আগ্রহ নেই ওর। আমাকে উঠে দাঁড়াতে
দেখে এক দৌড়ে বালিকা-কবিতা শূন্যতায়। মেঘ নেমে আসে বুকের ভেতর।
ক’দিন পর রিকশায় যেতে যেতে ওর মতোই কাউকে দেখি আগুনের হল্কা-
ছড়ানো চৈত্রের রাস্তায়, রিকশাচালককে থামতে বলে পেছনে ফিরে তাকাই;
বাসস্ট্যান্ডে ব্যস্ত যাত্রীর ঠেলাঠেলি, ক’জন ভিখারী-সেই ভিড়ে তাকে খুঁজে
পেলাম না। রোদে-পুড়ে-যাওয়া নির্বাক কাক খুঁজছে গাছ, হয়তো কোনও
ডোবায় সেরে নেবে ত্বরিত স্নান। কোন্ মজা খালে বইবে আমার ভাবনার
স্রোত? এমনও তো হতে পারে, কোনও রাতে পালিয়ে-বেড়ানো সেই কবিতা
জ্যোৎস্নার ছোঁয়া লাগা আমার জানালায় বসে পা দোলাবে আর আমি ঘুমে
কাদা, অথচ কত রাত আমার নিদ্রাহীনতায় মরুভূমির মতো ধু ধু। আবার
কোনও দুপুরে আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়াবে, পেলব হাত রাখবে
কপালে; তখন ঝাঁ ঝাঁ জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে আমার গা, চোখ খুলে কোনও কিছু
দেখার শক্তি পর্যন্ত গায়েব। হায়, উদ্বাস্তু ইরাকী বালিকা ও তোমার কেমন
ধরন? তুমি কি আমাকে নিয়ে যেতে চাও এই শ্যামলিমা থেকে ইরাকের
পাথুরে জমিনে, যেখানে ব্যাণ্ডেজ-বাঁধা পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটবো, ক্ষুৎ-
পিপাসায় কাতর? আর তুমি ‘কেমন মজা’ বলে ছুটবে আমার আগে আগে এক
নির্দয় কৌতুক।২
আজ অব্দি, হ্যাঁ, এতদিন পরেও কিছুতেই তোমাকে বোঝানো গেল না
আমার নিঃসীম ব্যাকুলতা। কতবার চোখে সেই ভাষা এনে তাকিয়েছি তোমার
দিকে যা নিভৃততম উপলব্ধিকেও টেনে তোলে প্রত্যক্ষে, যেমন গহন ডুবুরি
সমুদ্রগর্ভ থেকে বয়ে আনে মূল্যবান, গুপ্ত সামগ্রী। আমার আঙুলগুলো কি
বাঙ্ময় হয়ে ওঠেনি কখনও? আমার ওষ্ঠে অনুরাগের ঢেউ আছড়ে পড়েনি
বারবার, এ আমি স্বীকার করি কীভাবে? আমার দিনরাত্রি নিবেদিত তোমার
উদ্দেশে, আমার সকল কাজে তোমারই ছায়া খেলা করে-এই সত্যের নগ্নতা
তোমার দৃষ্টিতে দেখতে পাওয়ার আশাকে দাফন করেছি। কালেভদ্রে আমাদের
দেখা, মাঝে-মাঝে টেলিফোনে দ্বিধাজড়িত, সংক্ষিপ্ত আলাপ। বাজে,
এলোমেলো কথার ঝোপঝাড়ে কঞ্চির বাড়ি পড়ে, সবচেয়ে জরুরি কথাই
উচ্চারণের পরপারে থেকে যায়। কী করে সেসব কথা পৌঁছে দেব তোমার
কাছে। যদি বারান্দায় এসে দাঁড়াও অন্যমনস্কভাবে, তাকাও ভেসে-বেড়ানো
মেঘের দিকে, দেখবে সেখানে লেখা আছে আমার সেই কথাগুচ্ছ, যা
এতদিনেও বলা হয়নি তোমাকে; তুমি পড়ে নিও যদি ইচ্ছে হয়। যখন তুমি
দরজা খুলে বেরুবে কোথাও বেড়ানোর জন্যে তখন লক্ষ করলে দেখতে পাবে,
কাঠ কিংবা লোহা থেকে ঝুরঝুর ঝরছে আমার আকাঙ্ক্ষার অনূদিত ভাষা।
কখনও তোমাকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না সময়ের পায়ে বেলাগাম বুনো
ঘোড়ার ক্ষুর। আমাদের প্রেম একটি অসমাপ্ত কবিতার মতো, তুমি কি জান?৩
অন্ধকারে এ কার হাত ছুঁল আমাকে? হতেই পারে না, দুপুর রাতে তুমি
এসে ঘুম ভাঙালে আমার। কে আমাকে একবার স্পর্শ করে চলে গেল? আমার
শরীর ছাড়া কোনও আলোড়ন নেই ঘরের কোনওখানে। তোমার নিদ্রার
উদ্যানে যাওয়া হবে না আমার; এই মুহূর্তে তোমার শয্যার পাশে গিয়ে বসব,
তোমার চুল নিয়ে খেলব কিছুক্ষণ, নিদ্রিত স্তনকে জাগিয়ে তুলব চুমোয়, এমন
সাধ্য আমার নেই। আমার হৃৎপিণ্ড এখন তোমার নামের ধ্বনি জড়িয়ে বেজে
চলেছে দ্রুত, তুমি শুনতে পাবে না। তোমাদের রাস্তায় এখন হয়ত জিনস্ পরা
কোনও মাতাল যুবক গালি ছুঁড়ছে ল্যাম্পপোস্ট তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে
বলে। হয়ত গত রাতে ওর পিতার মৃত্যু হয়েচেহ প্রবল স্ট্রোকে; মাথায় একটা
গোটা সংসার নিয়ে মাতলামো করা পলায়বৃত্তিকেই এক ধরনের আস্কারা।
তোমার চুলের ঘ্রাণ, স্তনের গোলাপি চাউনি, আঙুলের চঞ্চল শোভা নিয়ে আজ
মধ্যরাতে আমিও বড় মাতাল। আমার নিঝুম ছোট ঘর দুলছে, যেন বুড়িগঙ্গায়
বজরা; লেখার টেবিল, বুক শেলফ, টেলিভিশন সেট জুড়ে দিয়েছে জিপসি-
নাচ। বোদলেয়ারের অমোঘ বিধান মেনে নেয়া ছাড়া আর উপায় কী? আমার
এই মাতলামো কারও কাছে শুদ্ধ শিল্প আখ্যা পাক, চাই না। তোমরা কেউ
কবিকে খুঁজো না তার রঙিন মওতায়, মানুষটিকে তুলে নাও বুকে।৪
খট্রাশ সমাজের গালে জোরসে কয়েকটা চড় কষিয়ে দিলেই তো পার।
তোমার কি কখনও ইচ্ছে করে না আমার হাত ধরে খোলা রাস্তায় হেঁটে যেতে
ভ্রূক্ষেপহীন? রোজ তোমার ত্রিভুবন-ভোলানো চুম্বনের ঘ্রাণে বুঁদ হয়ে থাকি,
এ-ও কি তোমার ইচ্ছার পরিপন্থী? তোমার বাক্যসমূহে ‘নায়ের আধিক্য
আমাকে পীড়িত করে। হঠাৎ কোনওদিন আমি বৃষ্টিতে ভিজে এলে তুমি আঁচল
দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে আমার মাথাটা বুকে চেপে ধরবে, এরকম আশা
নিশ্চয় আকাশছোঁয়া নয়। অনিয়মের চৌখুপি চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে আসার
আগ্রহ আহত চিলের মতো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে এক কোণে। নির্ভুল
সামাজিকতা তোমার নখদর্পণে, আমি অবাক হয়ে দেখি। তুমি নির্ভর আমার
স্বপ্নগুলো গ্রীষ্মের কুকুরের জিভের মতো লক লক করুক, এই কি তোমার
প্রত্যাশা? তুমি কি চাও আমার শেষ পারানি কড়ি, ভালোবাসা, ভিক্ষুকের
ভঙ্গিতে সর্বদা হাত পেতে থাক? তাহলে সাফ সাফ বলে দাও, আমি আমার
প্রিয় বাসনাসমূহকে ফাঁসিতে লটকিয়ে কিংবা দাউ দাউ চিতায় তুলে দিয়ে
দশদিক কাঁপিয়ে হো-হো হেসে উঠি। অনন্তর এপিটাফ লিখে তোমাকে
শোনাতে আসব না।৫
অনেকক্ষণ ক্ষেতের আল-পথে হেঁটে আমি কি কখনও কোনও তরুণীকে
শেষরাতে আলুঘাটায় নৌকায় তুলে দিয়েছিলাম? স্তব্ধতা-চেরা বৈঠার শব্দে
চমকে উঠেছিলাম? জানি না কেন এই প্রশ্ন আজ হঠাৎ তোমাকে ভরদুপুরে
রিকশায় তুলে দিতে গিয়ে মনের গহন স্তরে ঝিকিয়ে উঠল! তোমার শাড়ির
আঁচল আটকে গিয়েছিল ত্রিচক্রযানের কোনও অংশে, আমি আলগোছে
ছাড়িয়ে দেয়ার সময় লক্ষ করি, তোমার মুখাবয়বে লজ্জার ঈষৎ রঙধনু।
তোমাকে নিয়ে রিকশা সদর রাস্তায়। ফিরে আসি ঘরে, পল এলুয়ারের
কবিতায় মন বসে না। আমার হৃদয় জুড়ে সারা দুপুর তুমি, বিকেলে তুমি
রাত্রিতেও তুমি। সন্জীদা খাতুনের ‘গীতাঞ্জলি’ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে
টেলিভিশন বন্ধ করে দিই। কিন্তু মনের পর্দার আলো কী করে নিভিয়ে দেব,
যেখানে তুমি বসে আছ, নিজস্ব পরিবেশের সম্রাজ্ঞী, চুল খোলা, ঈষৎ ভেজা
ঠোঁটে প্রজাপতির মতো উড়ছে কবিতার পঙ্ক্তি? তোমার রিকশা চলেছে
কালপুরুষের পাশ দিয়ে। তোমার মাথায় নক্ষত্রের মুকুট; তোমাকে শুভেচ্ছা
জানায় স্বাতী এবং অরুন্ধতী।৬
ভৌতিক জ্যোৎস্নায় ঘণ্টাধ্বনি শুনি; আমার যাবার সময় হয়ে এল।
মুগ্ধতাবোধ আছে, অথচ কোকিলের ডাক শুনি না বহুদিন। সুন্দরের মুখে
জলবসন্তের দাগ। কিছু কিছু কাজ অর্ধসমাপ্ত, অনেক কিছুই অসমাপ্ত, তবু চলে
যেতে হবে অনিবার্যভাবে, ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে যাবে একলা, ফাঁকা
নৌকা; অনিশ্চয়তার মুখে ক্রূর হাসি। কবিতার খাতার অনেকগুলো পাতা
শাদা, ডুকরে ডুকরে কাঁদবে নাকি? টেবিলে প্রুফের তাড়া পড়ে আছে
সংশোধনের অপেক্ষায়। তোমার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলা হয়ে ওঠনি। কী
করছ তুমি এই রাতে ভৌতিক জ্যোৎস্নায়? গভীর রাতে সফল সঙ্গম শেষে তুমি
কি তৃপ্তিকর ঘুমের মসলিনে আবৃতা। না কি বাথরুমে ঢোকার আগে বুক চিরে
বেরুল দীর্ঘশ্বাস অতীতের চৌকাঠে ঠোকর খেয়ে? কামকলার সাময়িক
অবসানে ভাবছ আধুনিক শিল্পকলার অগ্রযাত্রার কথা। আমি আকাশের দিকে
তাকিয়ে আছি; দেখছি নক্ষত্রের অস্পষ্ট উদ্যান; প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ছায়াপ্রতিম
ট্রেন, আবছা গার্ড বাজাচ্ছেন অস্পষ্টশ্রুত হুইসেল। অকস্মাৎ মনে পড়ে,
পাস্তারনাকের কাব্যগ্রন্থের নিচে ইলেকট্রিক বিল সেই কবে থেকে চাপা পড়ে আছে। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
কোত্থেকে এলেন তিনি? কন্টকিত দুঃস্বপ্ন-দুনিয়া
থেকে না কি? যেন এ শহরে প্রবেশের ছাড়পত্র
পান নি এখনো কিংবা পেলেও জরুরি সে দলিল
হাতছাড়া হয়ে গেছে। খুঁজছেন শ্যামা ও মুনিয়া,
খুঁজছেন খরগোশ ফের কি সব দু’চার ছত্র
আওড়ান, বোঝা দায়। কখনো-বা ইতস্তত ঢিল
দেন ছুঁড়ে, গায়ে তাঁর শতচ্ছিন্ন অদ্ভুত পিরান,
পদযুগ নগ্ন ধূলিম্লান। পিরানের ভাঁজে ভাঁজে,দ্যাখে পুরবাসী, ঝলসিত কী যে নক্ষত্রের মতো
সর্বক্ষণ। গাত্রাবাস আমোদিত অনেক বিরান
প্রান্তর এবং জলাভূমির প্রাচীন গন্ধে। বাজে
শরীর বীণার মতো; মুকুট শোভিত সমুন্নত
মাথা তাঁর। ব্যবসায়ী, ফড়ে, হা-ঘরে, চাকুরে
লোলুপ তাকিয়ে থাকে; উদাসীন তিনি যান দূরে। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
তোমরা কারা ভিড় জমিয়েছো
এই আগুনের ফুল্কি-ঝরানো দুপুরে? তোমাদের
চেহারা দেখে কেমন যেন ভড়কে যেতে হয়। বিশ্বাস
করো, শত চেষ্টাতেও এমন
মনোভাবকে তাড়ানো যায় না ,
বুক ধক্ ধক্ করতেই থাকে। বড় শীতল হয়ে পড়ি।তোমরা যারা প্রকৃতই বাইরে এবং ভেতরে
সত্যি-সত্যি সুশীল, যাদের দৃষ্টিতে কোমলতা এবং
আচরণে বিচ্ছুরিত সভ্যতার আভা, তাদের
দীর্ঘায়ু এবং কল্যাণ কামনা করি সর্বদা,
তোমাদের চরিত্রের আলোয়
উদ্ভাসিত হোক বন্ধু-বান্ধবের, সমাজের আসর।এখনও তোমাদের পায়ের সঙ্গে
পা মিলিয়ে এগিয়ে যেতে চাই পুবের সূর্যোদয়ের
দিকে। শরীরে যতই ধুলোর পলেস্তারা লাগুক,
আমার এই চলা থামাবো না।
ঝড় যত তাণ্ডবই ছুড়ে দিক আমার দিকে,
এই যাত্রা অবিচল থাকবে পুরোদমে।আমার শরীরের ক্ষতের দিকে তাকিয়ে কাউকে
করুণাময় বাক্য উচ্চারণের সুযোগই দেবো না। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
আমার নামধাম তোমার জানার দরকার নেই, কালো মেয়ে।
আমি শাদা কি কালো, হলদে কি বাদামি,
সবুজ কি বেগুনি
তাতে কী এসে যায়? ধ’রে নাও, আমার কোনো বর্ণ
নেই, আমি গোত্রহীন। বলা যায়, আমি শুধু
একটি কণ্ঠস্বর, যা মিশে থাকে ঘন কালো অরণ্যের
লতাপাতায়, ঝিলের টোল-খাওয়া পানিতে
হরিণের মুখ রাখার ভঙ্গিমায়,
উটের গলার ঘণ্টধ্বনিতে। এই কণ্ঠস্বর
বয়ে যায় বিষুব রেখায়, উত্তর মেরুতে, বঙ্গোপসাগরের
তরঙ্গে তরঙ্গে আর আফ্রিকার
অজস্র জেব্রার কুরধ্বনিময় প্রান্তরে।কালো মেয়ে, তুমি যতই কালো হও,
তোমার সত্তায় আমি দেখেছি গীর্জার মোমবাতির
আলোর মতো আভা, সে আভাকে
প্রণতি জানায় এই কণ্ঠস্বর।তুমি যখন প্রথম চোখ মেলেছিলে, কালো মেয়ে,
স্বল্পালোকিত কাঠের কেবিনে,
তখন তোমার মুখের দিকে ঝুঁকেছিল একটি কালো মুখ।
যে-স্তন তোমার শিরায় শিরায় বইয়ে দিয়েছিল
জীবনের ধারা, কালো সেই স্তন।
তোমার দোলনা দুলিয়েছিল যে-হাত
সে-হাত কালো,
তোমার জন্যে রুটি বানিয়েছিল যে-হাত,
সে-হাত কালো,
তোমার হাতে প্রথম কাঠের পুতুল
তুলে দিয়েছিল যে-হাত
বড় স্নেহার্দ্র, বড় কালো সে হাত।কালো মেয়ে, তুমি দারিদ্র্যের গহ্বরে
হামাগুড়ি দিয়ে
মিথ্যার মতো শাদার উৎপীড়নে ধুঁকে ধুঁকে
লাঞ্ছনার অট্রহাসি শুনে বঞ্চনার শত খানাখন্দ
পেরিয়ে গায়ে উপহাসের কাদা মেখে,
পা ঝাড়া দিয়ে জ্যোৎস্নার চন্দনলিপ্ত হরিণীর মতো
এসে দাঁড়িয়েছো যৌবনের চূড়ায়। তোমার বরকে ওরা
ঘরচাড়া করেছে, ওর কালো মথমলের মতো কণ্ঠস্বর
ওরা স্তব্ধ করে দিয়েছে, তোমার কানে কোনোদিন আর গুঞ্জরিত
হবে না তার তারা-ঝলসিত গান। কিন্তু, কালো মেয়ে,
তরমুজের মতো তোমার উদরে
মাসের পর মাস বেড়ে উঠছে ওর সন্তান।যেদিন তোমাদের দু’জনের সন্তান ওর অস্তিত্ব ঘোষণা করবে
প্রথমবার, সেদিন
সূর্যোদয় গালিচা বিছিয়ে দেবে তার উদ্দেশে,
গান গেয়ে উঠবে রঙ-বেরুঙের পাখি,
গাছপালা করতালিতে
মুখর ক’রে তুলবে দশদিক।তোমার কোল-আলো-করা ছেলে বেড়ে উঠবে
শক্রর বন্দুকের ছায়ায়
বছরের পর বছর, রাত গভীর হ’লে
স্বাধীনতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে
সাক্সফোনে সে তুলবে তোমার পূর্ব পুরুষদের যন্ত্রণার সুর,
জীবনকে মৃত্যুর দেশ থেকে ছিনিয়ে আনার সুর;
তোমার ক্রুশবিদ্ধ মর্যাদার ক্ষতগুলো ধুয়ে
সেখানে ফোটাবে সে প্রসন্ন অর্কিড,
সে তার জোরালো কালো হাতে মুছিয়ে দেবে আফ্রিকার
কালো হীরের মতো চোখ থেকে গড়িয়ে-পড়া অশ্রুজল। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
লেখার কাগজ ক্রমে ক্রয় ক্ষমতার সীমা থেকে
খুব দূরে সরে যাচ্ছে; অথচ আমার রোজই চাই
কিছু শাদা কাগজ, কেননা আমি, বলা যায়, প্রায়
প্রত্যহ কিছু-না কিছু লিখি। উপরন্তু ভালো কাগজের
প্রতি, মানে সুশোভন কাগজের প্রতি বড় বেশি
আকর্ষণ বোধ করি। কাগজ কিনতে গিয়ে আমি
বেশ কিছু সময় কাটাই, উল্টে-পাল্টে বারবার
দেখি রাইটিং প্যাড, সযত্নে পরখ করে নিই।আমাকে ছিটেল বলে ব্যঙ্গ করা অত্যন্ত সহজ;
কিন্তু আমি যা বলি স্পষ্টই বলি; সত্যি, ঢাক-ঢাক
গুড়-গুড় আমার স্বভাবে নেই। যদি কোনোদিন
কাগজ বাজার থেকে কর্পূরের মতো উবে যায়,
নিরুপায় আমি অনন্তকে শ্লথগতি কচ্ছপের
ছায়া ভেবে লিখে যাবো ধূলো আর গাছের পাতায়। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
ছুটছি, ছুটছি,
প্রাণপণে দৌড়ে যাচ্ছি জানি না কোথায়।
গন্তব্য যে খুঁজে নেবো সুস্থির মাথায়
তেমন সুযোগ নেই এবড়ো এই পথে।আমাকে পালাতে
হবে, শুধু এইটুকু জানি। পায়ে যত
কাঁটাই বিঁধুক জাঁহাবাজ লোকদের
পাশব পাঞ্জার চাপ থেকে দ্রুত চলে যেতে হবে।এইটুকু জানি
আমি একা নই, আরও আরও অনেকেই
আছে নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
আমার মতোই ওরা অন্ধকারে আলো দিতে চায়।কেউ কেউ আজ
জালিমের কণ্টকিত জালে মৃতপ্রায়।
অনেকে আমার মতো বনবাদাড়ের
ঝোপঝাড়ে, পতিত গুহায় ফলমূল খেয়ে থাকে।মাথাভরা দীর্ঘ
বুনো চুল, বেয়াড়া সুদীর্ঘ দাড়ি মুখে
আমাকে কিম্ভূতকিমাকার বানিয়েছে।
জ্বালাতে মুক্তির আলো এই মতো জীবন আমার। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
শুধু প্রশ্নে আমি, উড্ডীন যে-প্লেন কোনো দিন
পারে না নামতে নিচে এরোড্রমে, ঘোরে দিগ্ধিদিক,
গুঁড়ো হয় বিস্ফোরণে, অথবা নিখোঁজ তারই মতো
উত্তর দেয় না ধরা মননের মায়াবী গণ্ডিতে।
বরং ঘোরায় নিত্য কত ছলে, পড়ি খানা-খন্দে,
আবর্তে তলিয়ে যাই, মাথা ঠুকি পাথুরে গুহায়।গাছ কি শিউরে ওঠে ঠাণ্ডা ভয়ে যখন শরীর
থেকে তার পাতাগুলি ঝরে যায় অথবা আনন্দে
উল্লসিত পাখির চোখে সোনালি শস্যের মাঠ কোনো
কখনো ওঠে কি জ্ব’লে স্বপ্নের মোহন আমন্ত্রণে?
মাছ কি বিতৃষ্ণ হয়ে মগ্ন হয় আত্মনিপীড়নে
কোনো ক্ষণে জলের বাগানে চায় পাখির কোরাস?
নিজেকে নিঃসঙ্গ ভেবে পথের কুকুর ফুটপাতে
রাত্রির নেশায় মত্ত খোঁজে কোন একান্ত সুহৃদ?সন্দেহ ক্রমশ কেন হতাশায় হয়ে যায় লীন
বুদ্ধির জটিল চৌমাথায়? অনিদ্রার আক্রমণে
বেসিনে আরশোলা দেখে আঁতকে কেন উঠি মধ্যরাতে
মুখ ধুতে গিয়ে, কেন ভাবি কাফ্কার নায়কের
পরিণা, বিপন্ন অস্তিত্ব যার বুকে হেঁটে হেঁটে
শুনতে চেয়েছে জ্যোৎস্না-চমকিত বেহালার সুর,
চেয়েছে খুঁজতে সম্পর্কের অবলুপ্ত তন্তুজাল।শুধু প্রশ্নে বিদ্ধ আমি আজীবন, উত্তরের প্লেন
নামে না ঘাঁটিতে কোনো, থামে না তর্কের কোলাহল। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
বাঁচার আনন্দে আমি চেতনার তটে
প্রত্যহ ফোটাই ফুল, জ্বালি দীপাবলি
ধ্যানী অন্ধকারে। আর মৃত্যুকে অমোঘ
জেনেও স্বপ্নের পথে, জেনেও আমার
পৃথিবীতে খুঁজি
জীবনের দান গানে গানে, প্রাণলোকে
খুঁজি ফিরি উপসৃত সুন্দরের স্মৃতি।অভ্যাসের বিবর্ণ দৃষ্টিতে নয়, সৃষ্টির আবেশে
সপ্রেম তাকাই চতুর্দিকে
এই চরাচরে উন্মীলিত
বৈশাখী রৌদ্রের উজ্জীবনে,
উধাও মাঠের প্রান্তে ধ্যানী ঐ গাছের ছায়ায়
আর বনে বনে মর্মরিত খোলা ঊর্মিল হাওয়ায়
নীলিমায় দিই মেলে মানসমরাল।
ব্যাপ্ত এই চরাচরে পতঙ্গ অথবা
নিবিড় গোলাপ-সবি মনে হয় অরূপ রতন।এখনও সূর্যের আলো পৃথিবীরে আসে
যথারীতি, ঝরনার মতন ঝরে সম্পন্ন গৃহীর
নিকানো উঠোনে আর কবরের পুরানো ফাটলে।
প্রদীপ্ত সূর্যের রং লাগে যুবতীর
সলজ্জ রক্তিম গালে, আর
আলো ঝরে নিদ্রাহীন রোগীর শয্যায়।পিচ্ছিল শবের ভোজে মত্ত কৃমি অথবা আজানে
উচ্চকিত সবচেয়ে উঁচু কোনো উজ্জ্বল মিনার-
সবাই অলক্ষ্যে পায় সূর্যের প্রসাদ
সমপরিমাণে;এবং উদার সূর্য উপমা তোমার।
প্রকৃতির টোলে আমি কখনো নিইনি পাঠ, তবু
ঋতুতে ঋতুতে
আমার সত্তার স্বরগ্রাম
কেবলি ধ্বনিত হয়, অবিরাম প্রহরে প্রহরে
এখনও যে ক্লান্ত হলে নিসর্গের কাছে
আশ্চর্যের গ্লাস হাতে যাই,
অবসন্ন চেতনার গোধূলিতে শুনি
সান্ত্বনার ভাষা এখনও রবীন্দ্রনাথ,
সে তোমারি দান।
আমাকে দিয়েছ ভাষা, তার ধ্বনি, প্রতীকী হিল্লোল
অস্তিত্বের তটে আনে কত
ঐশ্বর্যের তরী-পাল-তোলা তরঙ্গের স্মৃতিস্রোত
দীপ্ত জলযান।আমাকে দিয়েছ ভাষা, সে-ভাষা আমার
হৃদয়ের একান্ত স্পন্দনে
প্রাণের নিভৃত উচ্চারণে
শিখা হয়ে জেগে রয় জীবনের মুক্ত দীপাধারে।
এবং নিশ্চিত জানি তোমার বাণীর
দীপ থেকে অন্য এক ভাষার প্রদীপ
জ্বালাব অযুত প্রাণে, জ্বলবে তখন
কত না হীরক সম্ভাবনা সময়ের
বিমূর্ত সন্ধ্যায়।তুমি নও সীমিত শুধুই কোনো পঁচিশে বৈশাখে।
তোমার নামের ঢেউ একটি দিনের
সংকীর্ণ পরিধি ছিঁড়ে পড়েছে ছড়িয়ে
রূপনারানের কূলে, বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘে
অনন্তের শুভ্রতায় তুমি নও সীমিত শুধুই
পঁচিশে বৈশাখে।যেমন রৌদ্রের তাপ জ্যোৎস্নার মদির মায়ালোকে
হাওয়ার নির্ঝরে
অথবা শ্রাবণে
অক্লান্ত বর্ষণে বেঁচে থাকি মাঝে-মাঝে
নিজেরই অজ্ঞাতে,
তেমনি তোমার
কবিতায়, গানে প্রতিধ্বনি হয়ে জাগে
আমাদের সত্তার আকাশ।জীবন যখন ক্রমে কেবলি শুকিয়ে যায়, ডোবে
পাঁকের আবর্তে আর বর্বরের বাচাল আক্রোশে
অবলুপ্ত জ্ঞানীর সুভাষ,
জেনেছি তখন
অলৌকিক পদ্মের মতন
তোমার স্বরণ
উন্মোচিত হয়,
হয় উদ্ভাসিত
অসংখ্য প্রাণের তীর্থে এবং তোমার
গানে গানে মৃত্যুর তুহিন শীতে ফোটে
ফোটে অবিরত
জীবনের পরাক্রান্ত ফুল। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
মধ্যযুগের পুরু মৃত্তিকা ফুঁড়ে
হঠাৎ এসেছো, শরীর বীরের ঢং।
পাথুরে জমিতে আলোর ফুলকি ওড়ে,
বর্ম তোমার অনেক জবরজং।ঘোড়ার খুরের শব্দে চমক লাগে,
নগরবাসীর জিজ্ঞাসু চোখ জ্বলেঃ
“অবেলায় এলো এ কোন্ অশ্বারোহী”
প্রাক্তন ঘোড়া ভড়কালো কোলাহলে।কারুকাজময় গবাক্ষে হাত রেখে
দয়িতা তোমার দাঁড়াবে না ব্রীড়াভরে,
দেখাবে না পথ ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে;
এখন সে লোটে নিয়ন-দীপ্ত ঘরে।জয়ের নেশায় রক্তগোলাপ দেখে
তুমি বিবিক্ষু একেলে বিসংবাদে?
স্বেদাক্ত ঘোড়া দ্বিধায় দুলকি চলে,
অজানা পথের চিহ্ন বুঝতে বাধে।তুমি কি বোঝো না ডুয়েলের দিন গত?
তবে কেন বৃথা উঁচিয়ে নগ্ন অসি
তেড়ে আসো আজো একালের পোড়ো মাঠে?
প্রাচীন জরিতে ছড়ায় কালের মসী।ড্রাগন হননে সুবেশ অশ্বরোহী
এসেছো উড়িয়ে অনেক যুগের ধুলি?
তোমার সুনীল ঘোড়ার খুরের ঘায়ে
পালকের মতো উড়ছে মড়ার খুলি!ড্রাগনের দিন হয়নিকো অবসিত,
কিন্তু তোমার বর্শা অকেজো আজ।
দ্যাখো ভীষণের নৃত্যনাট্য দ্যাখো,
দ্যাখো জনপথে জন্তুরা জাঁহাবাজ।তোমার বর্ম অথবা অশ্ব দেখে
উঠবো কি মেতে অর্বাচীনের মতো?
ভুলিনি ভীষণ রক্তবমন আজো,
এখনো কাঁদায় মহাসমরের ক্ষত।
লুপ্তি ঘনায় সব দিগন্ত জুড়ে,
পাঁজর-খাঁচায় পিশাচের তাল গুণি।
কার নিঃশ্বাসে ফুলেরা ভস্মীভূত?
নিরুপায় শুধু ধ্বংসের কাল শুনি।এ যুগের আঁধি রুখবে কি দিয়ে বলো?
লুকা ও বরং অতীতের কোনো গড়ে।
বল্লম আর সাধের শিরস্ত্রাণ
শোভা পাক আজ ঘুমন্ত যাদুঘরে। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে
কয়েকটি চারাগাছের দিকে তাকিয়ে তার
স্বপ্নের কথা বলছিল, ‘যদি কোনো দিন
আমার নিজের বাড়ি হয়, তাহ’লে আমার
শোবার ঘরের জানালার
কিছু দূরে থাকবে হাস্নাহেনার গাছ,
ড্রইং রুমের দেয়াল ঘেঁষে
বেড়ে উঠতে দেবো বেলি ফুলের ঝাড়
আর গেটের সামনে
ফুল ফোটাবে একটি বকুল গাছ’।অথচ ঘুণাক্ষরে তার মনেই হয় নি যে,
সে নিজেই একটি বাগান। দেখি,
ওর স্বপ্নের ওপর শুধু
চিক চিক করছে দুপুরের রোদ। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
সংকীর্ণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কৃপণ আকাশের দিকে
তাকিয়ে কী যেন দেখতে পেয়ে ঢ্যাঙা যুবক চমকে
উঠলো তার অস্তিত্বের ঝাঁকুনিতে। ভীষণ কুৎসিত জন্তু এক
লাফাতে লাফাতে চৌদিকে বিদ্ঘুটে গন্ধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে
মিশে যায় মেঘমালায়। খানিক পরেই সেটা মেঘ ফুঁড়ে
সেই যুবাকে অধিকতর ভড়কে দিয়ে উগরে ফেলে কয়েকটি করোটি এবং হাড়ের ভগ্নাংশ। হঠাৎ যুবার পা টলতে থাকে, বুঝি-বা
ভয়ঙ্কর তেজী ভূমিকম্প ওকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে প্রতিশ্রুতি
নির্বিকার আজরাইলের কাছে। কয়েকটি শতচ্ছিন্ন কামিজ,
ট্রাউজার ঝুলছে ফাঁসির লাশের মতো।ঢ্যাঙা, আতঙ্কিত যুবক নিজেকেও লাশ ঠাউরে কাঠের
পুতুলের মতো পড়ে থাকে নিস্পন্দ এক কোণে। আলো,
আঁধার অথবা ধুলো কিংবা বৃষ্টি-কিছুই ফেরাতে পারে না তার
এক রত্তি কবোষ্ণ বোধ। বিধ্বস্ত বারান্দা, ঘরদোর, করুণ,
রক্ত-রঞ্জিত আসবাব, অভাবিত লাশের স্তূপের বড় নিঃশব্দ
আহাজারি, মুষ্টিমেয় জীবিতের পাথুরের স্তব্ধতার একঘেয়ে
বোবা আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়েছে অলিতে, গলিতে, বাজারে, বন্দরে;
ভাঙাচোরা, বিকৃত মামুলি পাড়ায়, অভিজাত আকাশ-ছোঁয়া
প্রাসাদোপম ফ্ল্যাটের সারির হু হু হাহাকার, ধ্বংসের স্মৃতি
বয়ে বেড়ানো কী ক’রে সইবে পুরোনো বসতি? (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
ভীষণ ঘুরছে মাথা, হাত-পা টলছে, যেন ঢেউয়ে
নৌকা, তবু দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, উদ্যম হারালে
চলবে না। আমাদের চোখের সামনে চাঁদটিকে
গিলে খাচ্ছে দুরন্ত খবিশ, শহরের
সবগুলো বাগিচার নানাবিধ ফুল
কীটের সন্ত্রাসের নিমেষেই ঝরে পড়ছে লোলুপ মৃত্তিকায়।যে-ভাবে কাঁপছে জমি, মনে হয়, নিমেষেই দরদালানের
কাতার পড়বে ধসে তাসের ধরনে। চেয়ে দ্যাখো,
কেমন নড়ছে সব-গাছ গাছড়া এবং খসে
পড়বে পাখির নীড়। অথচ অদূরে মেতে আছে বেপরোয়া
ক’জন জুয়াড়ি তিন তাসের খেলায়। কালবেলা
কী দ্রুত আসছে ধেয়ে বারবার, তবুও টনক নড়ছে না।
অতিদূর কোথাও কে যেন অতিশয়
নিবিড় করুণ সুর তুলছে বাঁশিতে, সেই সুরে
ভবিষ্যৎ কালের ধ্বংসের পূর্বাভাস সদ্য-বিধবার কান্না
হয়ে ঝরে যাচ্ছে অতিরত। পদতলে বারবার
মাটি কম্পমান আর কোন্ দিক থেকে যেন ঘন
ঘন ভেঙে-পড়া ফ্ল্যাটদের আর্তনাদ ভেসে আসে।বিপদের কালো মেঘে ছেয়ে যাবে আমাদের সুনীল আকাশ-
কোনও কোনও জ্ঞানী বলেছিলেন আগেই,-
প্রাসাদ, কুটির সবই ভূগর্ভে বিলীন হবে, যদি না মানব
আগে ভাগে সুন্দর, কল্যাণ-প্রদর্শিত পথে হেঁটে
মহত্ত্বের সাধনায় মনে প্রাণে সদা
ব্রতী হয়। হিংসা, দ্বেষ ঘৃণা সৃষ্টি নয় ধ্বংসকেই দ্রুত ডেকে আনে।‘পাগলের প্রলাপ এসব,’ ব’লে হো-হো হেসে ওঠে
জুয়াড়ির ঝাঁক আর মদিরার স্রোতে ভেসে কোমর দুলিয়ে
রাস্তা সাম্ভা নেচে নিজেদের সমাজ সংসার মিছে সব ভেবে,
আপদ বিপদ ভুলে বস্তুত আপনকার পকেট হাতড়ে
শূন্যতাকে পেয়ে দিব্যি ঢলে পড়ে ইয়ারের কাঁধে আর হিন্দি
ফিল্মের চটুল সুর টেনে আনে জিভের ডগায়।
ওদিকে ক্ষুধার্ত জমি ‘খাদ্য চাই’ ব’লে ভায়ানক গর্জে ওঠে
চৌদিকে, পাখিরা নীড় ছেড়ে অতিদূর আসমানে উড়ে যায়। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
আজ আমি কোনও কাজ করব না। আজ সকাল-সন্ধ্যা আমি
আমার ব্যক্তিগত হরতাল ঘোষণা করেছি। আমি নিঃসঙ্গ, সমিতিছুট;
পিকেটিং চালাবার মতো দলবল আমার নেই। যা কিছু করবার একা
আমাকেই করতে হবে। ভোরবেলার প্রথম আলো যখন গাছের
সবুজ ঠোঁটে চুমো খাবে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখব না।
অন্ধকার ঘরেই শুয়ে থাকব কিছুক্ষণ, জ্বালব না আলো শেষরাতের
স্পর্শলাগা জনহীন গলির সৌন্দর্য উপভোগ করতে জানালার কাছে গিয়ে
দাঁড়াব না। বেলা বাড়তেই কয়েকটি প্রজাপতি উড়ে আসবে আমার ঘরের
ভেতর। ওদের দেখে মুখ ফিরিয়ে নেব, আগেকার মতো জিগ্যেশ করব না
ওদের কুশল। খবরের কাগজ পড়ে থাকবে এক পাশে, চোখ পর্যন্ত বুলাব না
পাতায়। স্নানাহার থেকে বিরত থাকব আজ। দু’দিনের না-কামানো
দাড়িকে আরও একদিন বাড়তে দেব। বাংলা একাডেমীর সাহিত্য সভায় অথবা
আজিজ সুপার মার্কেটে আজ আমাকে দেখবে না কেউ। কোনও বই কিংবা লিটল
ম্যাগাজিন কেনার তাগিদ অনুভব করব না আমি। আজ কোনও কোনও আড্ডা হবে না
আমার ঘরে। না, ডাকঘরেও যাব না পোস্টকার্ড কিংবা এনভেলাপ কেনার জন্যে।
কোনও বই ছুঁয়ে দেখব না, বলে দিচ্ছি। আমার ব্যক্তিগত হরতাল পুরোদমে
সফল হবে। সে আজ থেকে ক’দিন আমার এই জন্মশহরে তার অনুপস্থিতির ঘোর
অমাবস্যা ছড়িয়ে রাখবে। এই অসহনীয় অমাবস্যার প্রতিবাদে সকল কাজে
তালা ঝুলিয়ে দিয়েছি।হঠাৎ কবিতা সব কাঁটাতারের ব্যারিকেড ভেঙেচুরে আমার মগজের কোষে
কোষে গায় বীজবপনের সোনালি গান। কবিতা ধর্মঘটী কলমকে তুলে দিল
আমার হাতে। শুধু গৌরীর না-থাকার বেদনাকে আমার ভেতরে দ্বিগুণ করে
কবিতা ফুটতে থাকে নীলাক্ষরে শাদা পাতায়। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
হয়তো হবে না দেখা আমাদের কোনোদিন আর,
কোনোদিন শুনবো না রাত্রিময় ঝর্নার মতন
কণ্ঠস্বর তার রাখবো না হাতে হাত, শুধু মন
প্রখর থাকবে চেয়ে তারই দিকে, যে আমার
উদ্যান বিরান করে চলে গ্যাছে; স্নিগ্ধ মল্লিকার
বাহার এখানে নেই, গাছের কংকাল সারাক্ষণ
ভীষণ কঠোর দৃষ্টি হানে, এ কেমন নির্বাসন
ব’লে পাখি হয়ে যায় এক রাশ মৃত শাদা হাড়।এখনো দরজা খুলে প্রতিদিন ঘরে ঢুকি, রাখি
স্যুইচ আঙুল, আলো ফেটে পড়ে, শুই; বিছানায়
কারো ছায়া কাঁপে যেন। ক্লান্ত মনে কখনো আলাপ
জুড়ি দেয়ালের সঙ্গে, কখনো বা দান্তে কী একাকী
হেঁটে যান আমার নিবাস ছুঁয়ে শ্রাবণ ধারায়,
এবং বৃষ্টিতে ডোবে গলি, ঘর, কত পদচ্ছাপ। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
ছিলাম নিশ্চুপ ব’সে বিকেলে ঘরের এককোণে,
হাতে ছিল আধ-পড়া বই।
হঠাৎ পাশের পুরো খোলা দরজার
নগ্নতাকে যেন চুমো খেয়ে অন্দরে প্রবেশ করে
তিনটি শকুন। কখন যে হাত থেকে
আধ-পড়া বইটি মেঝেতে পড়ে গেলো
জানতে পারিনি; শকুনোর, কী অবাক কাণ্ড, ছিল
বেজায় নিশ্চুপ।অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি অযাচিত
আগত শকুনদের দিকে।
বিস্মিত আমাকে ওরা চকিতে বাংলায়
করে সম্ভাষণ,বলে কিছু ভালো কথা
যা আমি কখনও আগে শুনিনি এবং আরও বেশি
বিস্ময়ের আবর্তে ভীষণ ঘুরপাক খেতে থাকি।আমাকে বেজায় বিহ্বল, হতবাক হ’তে দেখে
তিনটি শকুন
একে অপরের কালো শরীরে লুটিয়ে প’ড়ে দিব্যি
জোরে হেসে হেসে ঘর প্রবল কাঁপিয়ে।
আমাকে হঠাৎ ভীত দেখে ওরা তিন পাখি
নিমেষে অদৃশ্য হয়, আসমানে চাঁদ জেগে ওঠে।কিছুক্ষণ ব’সে আরও ভাবনার মায়াজালে দূরে
কোথায় যে ভ্রমণ করতে থাকি,-বুঝি কি বুঝি না, অকস্মাৎ-
হাতে উঠে আসে প্রিয়সঙ্গী বলপেন। পাশে-রাখা
প্যাডের উন্মুক্ত বুকে ফোটে বুনো ফুল! (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
কত আর কেটে ছেঁটে রাখব নিজেকে প্রতিদিন
অন্যদের পছন্দমাফিক? নিষেধের কাঁটাতারে
ঘেরা এ জীবন কাতরায় আর নির্দয় প্রহারে
বিবেক আমাকে মোড়ে মোড়ে খুব করেছে মলিন।যদি হতে পারতাম শুধু শিশ্নোদরপরায়ণ
এক জীব কিংবা কোনো বিবাগী সন্ন্যাসী বনচারী,
তাহলে হৃদয় আজ হতো না এমন হঠকারী,
অবিরত করতাম না তালাশ তৃতীয় নয়ন।অচেনা অপর কেউ নয়, যারা আমার আপন
পরিবার পরিজন, তারা চায় আমি পড়ে থাকি
গৃহকোণে, ডানাছাঁটা পাখি নিরন্তর এঁদো ডোবা
আমাকে করুক গ্রাস, ছাঁচে-গড়া জীবন, যাপন
যেন করি আগাগোড়া। তবু প্রতিক্ষণ মনে রাখি-
আমাকে দিয়েছে গৌরী নীলাকাশ, সমুদ্রের শোভা। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
স্বদেশে এসেছি ফিরে অবসন্ন আট দিন পর
আপন শহরে আজ। যতটা আনন্দ পাবো বলে
সম্যক ধারণা ছিল, বিমান বন্দর থেকে দলে
বলে স্মিত বেরিয়ে এসেই মন লাশকাটা ঘর!
এ কেমন শহর দেখছি অপরাহ্নে? যেন ঝড়
মুড়িয়ে ফেলেছে একে, রেখে গ্যাছে ধ্বংস চিহ্নগুলি
ইতস্তত। নিসর্গ বিষাদগ্রস্ত; শ্যামা, বুলবুলি
কারো কণ্ঠে গান নেই, ফুটপাথ বিমর্ষ, ধূসর।ফের গৃহপ্রবেশের পরেও খুশির কোনো ঢেউ
হৃদয়ে করে না খেলা। সব কিছু ছায়াচ্ছন্ন লাগে,
রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা মাংস, সব্জির ঘ্রাণ
আকর্ষণহীন আর বই, কবিতার খাতা, কেউ
টানে না তেমন, কাকে যেন খুঁজি ক্ষুব্ধ অনুরাগে
চৌদিকে; কুয়াশা ঘন হয়, অশ্রুপাত করে প্রাণ। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
আমিতো স্বর্গের দীপ্ত দোরগাড়া থেকে ফিরে যাই,
ফিরে যাই বারবার এবং আমার পুণ্যফল
শূন্য বলে চতুর্দিক থেকে ক্ষিপ্ত প্রেতের দঙ্গল
তেড়ে আসে হৈ-হৈ, বলে সমস্বরে, তোর নেই ঠাঁই
অমরায়, তুই যা গন্ধুকে, আগুনের বাজখাই
আঁচ তোকে নিত্য দগ্ধ করুক, তুই যা। বেদখল
হয়েছে আমার মরুদ্যান আর এখন সম্বল
শুধু আত্মাভস্মকারী তৃষ্ণা, প্রতারক রোশনাই।হাঁটছি তামাটে পথে, পথ দীর্ঘ মনে হয়,
মনে হয় মাঝে-মাঝে বৃষ্টি নামে, শুষ্ক ওষ্ঠে ঝরে
উৎফুল্ল স্বেহার্দ্রে বিন্দু, পর মুহূর্তেই পথময়
রৌদ্রের বৃশ্চিক ক্রীড়াপরায়ণ, ধু ধু অন্ধকার
দেখি চরাচরে, দেখি কোথাও দরজা নেই, তার
অমন পুষ্পিত অবয়ব চলে যায় অগোচরে। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রকৃতিমূলক
|
যিনি ওই পোড়াবাড়িটায়
থাকতেন নিরিবিলি কোনো কোনো দিন
রোদে পিঠ দিয়ে আর শ্রাবণের ধারাজ্বলে ঠায়
সারাদিনমান সঙ্গীহীন
কাটাতেন গোলকচাঁপার নিচে, চোখ-ছলছল
তিনি ভাবতেন তার চুল
ঘাসের সবুজ শিখা, হাত অবিকল
মৃন্ময় গাছের ডাল, চোখ ফাল্গুনের কোনো ফুল,
ঠোঁটের কিনারে কালো শ্রাবণের মসৃণ লবণ
(ভাবতেন তিনি) আছে লেগে সারাক্ষণ।
কখনো কোটর থেকে কাঠবিড়ালিটা নেমে এলে
পাতাঝরা তন্ময় বিকেলে
দিতেন মাথাটা তার আদরে বুলিয়ে,
এবং ভুলিয়ে
রাখতেন ওকে ঘাসে বাদামের কৌতুকী খেলায়
গরুর খুরের রাঙা ধূলিওড়া নিমগ্ন বেলায়।চুপচাপ সে অস্তিত্ব রোজনামচায় চিরন্তন
সুখে রাখতেন টুকে অভ্রের গুঁড়োর মতো মৌমাছি-গুঞ্জন,
বসন্তের বর্ণালি বর্ষার ভরা রাত্রির ক্রন্দন
সূর্যোদয় সূর্যাস্তের সূক্ষ্ম রসায়ন
কুয়াশায় পতঙ্গের জীবন বয়ন।
পাখির নীরব মৃত্যু, প্রতিটি ফুলের জন্মমুহূর্ত এবং
ফড়িঙের চঞ্চলতা, আকাশের সবগুলো রং
সবই তো পড়েছে ধরা চেতন-ঊষার মতো প্রাণে,
জার্নালের পাতায় যেখানে প্রাত্যহিক ঐকতানে
লিপিবদ্ধ আরো কিছু-গভীর গ্রন্থের নয়-জীবনের ভাষা
“হে সবুজ গাছ, হে আমার প্রিয় বন্ধু, মেঘেভাসা
পাখির মতোই চাই আজও তোমার ছায়ায় চাই কিছুক্ষণ
পূর্ণতায় নানান লতাগুল্মের প্রাণের রণন।যেদিন গেলেন তিনি কে যেন বলল নিচু স্বরে,
“আমাদের রৌদ্রছায়াময় এ প্রান্তরে কখন গেছেন ঝ’র
একটি বয়েসী বৃক্ষ। অন্য কোন বোকা প্রতিবেশী
আওড়ালো শোকের চলতি শ্লোক ক’টি বড় বেশি।রোদের ছুরির ঘায়ে, বৃষ্টির ধারালো নখে, হলুদ পাতায়
ওই পোড়াবাড়িটার স্মৃতি
হ’ল বাতাসের সহচরী শূন্যতায়,নির্বিকার রইলেন শুধু, শুধু শ্রীমতী প্রকৃতি। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
ঘুম থেকে জেগে দেখি টেবিলে সাজানো কিছু ফুল,
যে-ফুল দেখেছি স্বপ্নে অচিন উপত্যকার গাছে।
জানি, সে নীরবে রেখে গ্যাছে ফুল হৃদয়ের কাছে
অগোচরে, ফুলগুচ্ছ ঘিরে গীত হয় বুলবুল
ক্ষণে ক্ষণে কে জানে কী সুখে! পৃথিবীতে কোনো ভুল
কোথাও হয়নি যেন আজ; হতাশ মুমূর্ষ বাঁচে,
এমনকী ধূমায়িত আমারও সত্তায় আলো নাচে
অমেয় সৌরভে; এই জানলায় ওড়ে কার চুল?মহান আলিগিয়েরি দান্তের উদ্দেশে কোনো নারী
দূর ফ্লোরেন্সের বাগিচায় একা, করি অনুমান,
চয়ন করেছে ফুল একদা সপ্রেম; হয়তো-বা
কবির অমর কাব্যে সে-পুষ্পের অপরূপ শোভা
নিভৃতে পেয়েছে ঠাঁই। যে-ফুলে আমার এই বাড়ি
হেসে ওঠে, তার কিছু ঘ্রাণ পাবে কি আমার গান? (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
এখনো উনিশ বিশ বছর আগের দ্বিপ্রহর
স্মৃতির উদাস পথে ডেকে যায় সেলুলয়েডের
মমতায়; দৃষ্টিপথে একটি প্রকৃত গ্রাম হয়
আমার নিজস্ব চেনা আরেক পল্লীর সহোদর।
সেই কবেকার উপন্যাস ভিন্ন মাত্রা পায়, দেখি
গ্রামেপথে ওরা দুটি বালক বালিকা ছোটাছুটি
করে, ঘোরে কাশবনে, গহন বর্ষার ভেজে আর
শ্যামল মাটিতে কান পেতে শোনে ট্রেনের আওয়াজ।খদ্ধ সেলুলয়েডের সীমানা পেরিয়ে দুর্গা, অপু
খেলা করে চেতনার নীলিমায়। মিষ্টি-অলা, ভেপু
এবং পুঁতির মালা, মাটির দেয়ালে দিদিমার
রূপকথা-বলা ছায়া কী প্রগাঢ় সত্যজিৎ রূপে
মনের নানান স্তরে জেগে থাকে। ধন্যবাদ তাঁকে,
এখনো শোনান যিনি নান্দনিক সত্যের পাঁচালি। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
কী জন্যে এই গ্রীষ্মকাতর অন্ধকারে
মধ্যরাতে জেগে থাকা?
কি জন্যে আজ আকণ্ঠ এক তৃষ্ণা কেবল
বুকের মধ্যে জাগিয়ে রাখা?মাঝে-মধ্যে বাইরে তাকাই, দূর আকাশে
যায় না দেখা জাগর তারা;
গাছগাছালি নিথর নিঝুম বন্য ঘ্রাণে
পাচ্ছি গতকালের সাড়া।রাতদুপুরে পড়ছে মনে শীত দুপুরের
একলা শঙ্খচিলের ওড়া,
পড়ছে মনে অনেক আগের সাগর পারের স্বেদ ঝরানো
তেজি তরুণ সফেদ ঘোড়া।অন্ধকারে মাঠের ভেতর আমরা দু’জন
ছিলাম প্রেমে পুলকিত-
প্রবেশ করে উষ্ণ মাংসে হীরের ছুরি, মদির চাপে
নীল ফোয়ারা উচ্ছুসিত।রাত্রি আমার চোখে মুখে নিশাস্ ফ্যালে
রমণরত প্রাণীর মতো;
স্মৃতির ঝাঁঝে হঠাৎ আমি হয়ে পড়ি
কেমন যেন অসংযত।কী জন্যে এই গ্রীষ্মকাতর মধ্যরাতে
আজকে আমি নিদ্রাহারা?
অস্থিরতা পোকার মতো ঘুরছে মনে,
সত্তাজোড়া কিসের তাড়া?
চমকপ্রদ কত কিছুই ঘটে আমার চিত্তপুরে,
নেইকো কোনো লেখাজোখা।
রহস্যময় শব্দবলি জ্বলে নেভে
যেন নিশুত জোনাক পোকা।আমি কি এই মধ্যরাতে শ্মশানচারী
পদ্য লেখার আকর্ষণে?
ভবিষ্যতের কোন্ দেয়ালি মরীচিকা
দুলিয়ে দিলো দগ্ধ মনে?কৃষ্ণচূড়া গাছের মতো জ্বলছি একা
চৈতন্যের চৌরাহাতে,
নাম-না জানা তীব্র দহন সইছি কিসের
আবছা মোহন প্রত্যাশাতে? (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
শুনি অপরাহ্নে অর্ফিয়ূস বাজায় মোহন বাঁশি-
ভাঙাচোরা পৌর পথ, মায় ঘরদোর, শীর্ণ গাছ
কেমন বদলে যায় নিমেষেই আর জোড়ে নাচ
বস্তুপুজ্ঞ দশদিকে। ভালোবাসি, আমি ভালোবাসি
উচ্চারণ ক’রে যেন স্বপ্নময় মেঘলোকে ভাসি;
ভালোবাসি, ভালোবাসি। সে ভালোবাসুক আর না-ই
বাসুক আমাকে, পুরোপুরি না হোক আমার, গাই
তবু তারই গান, আপাতত নই কিছুরই প্রত্যাশী।এই কি যথেষ্ট নয় এই ভালোবাসা, যা শিরায়
শিরায় ঝংকার তোলে, যার টানে আনন্দিত পথ
হাঁটি, কথা বলি পশু পাখি, বৃক্ষলতা পাথরের
সঙ্গে, না চাইতে শক্রূকেও করি ক্ষমা, পক্ষীবৎ
উড়ে যাই, গায়ে মাখি ঘ্রাণ স্মৃতির মরূদ্যানের
এবং নিজেই হই অর্ফিয়ূস দীপ্র নিরালায়? (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
সারা দিন গেল, ইঁদুরমুখো বাদুড়
সন্ধ্যাকে ডেকে আনে ডানার হাওয়ায়, আজকে
রাতও বুঝি যায়। এখনো তুমি পা রাখলে না
এই প্রিয়তম শহরে আমার। দু’সপ্তাহ তোমাকে
না দেখে কোনো মতে দিন যাপন করেছি। অথচ আজ
প্রতিটি মুহূর্তকে মনে হচ্ছে শতাব্দী। আজ তুমি এলেও
তোমাকে দেখতে পাবো না, পরের তিনটি দিনও
আমাদের সম্ভাব্য সাক্ষাতের মাঝখানে অলঙ্ঘ্য প্রাচীর।হায়, যদি কবিতা লিখতে না পারতাম, তাহলে
কী করে কাটতো তুমিহীন আমার শূন্য প্রহরগুলি?
আমার এখনকার কবিতায় সকল চরণ কেবল তোমাকেই
স্মরণ করে সারাবেলা। তোমার অনুপস্থিতির বেদনা ওরা মুছে ফেলতে
ব্যর্থ, তবু জানি তুমি শহরে এলে পর ওরাই তোমার
মুখ চুম্বন করবে বারংবার, তোমাকে ঘিরে বসাবে নক্ষত্রের মেলা। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
যাদের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয় তারা কেউই আর
ফিরে আসে না আমার কাছে। আমার বাবা, কোনও
কোনও ভাই, বোন, এক ছেলে-যারাই আমাকে ছেড়ে
গ্যাছে তারা কেউই ফিরে আসেনি। এই তো ক’মাস হলো
আম্মা গেলেন, তিনি প্রত্যাবর্তন করে মমতামগ্ন হাত
রাখেন নি আমার শাদা চুলময় মাথায়। আমি দেয়ালে
মাথা খুঁড়ে মরলেও তিনি আসবেন না আর। আমার কোনও
কোনও বন্ধু নিজেদেরই অপরাধে আমার কাছ থেকে দূরে
সরে গেছেন। তাদের সঙ্গে মামুলি কুশল বিনিময় তো দূরের
কথা, সুখদর্শনও নাস্তি। ওরা কেউ কেউ দুয়ো দেয়, কেউ
কেউ সাধে শক্রতা।অথচ আমার বারান্দায় ভোরবেলা টাটকা মাখন-রোদ
গায়ে নিয়ে খেলতে আসে তিন-চারটি আদরণীয় অতিথি
চড়ুই। আমার ঘরে কখনও কখনও দুপুর কিংবা বিকেলে
ভ্রমর যায় গুনগুনিয়ে। দোয়েল আমার হাঁটুর ওপর বসে,
কাঁধে ঠাঁই নেয় চঞ্চল প্রজাপতি। পায়ের কাছে পায়ের কাছে পায়রা-যুগল
সাবলীল প্রেম করে। বিরলদৃষ্ট যে কোকিল সে-ও সামনে
হাজির হয়ে প্রায়শ আমাকে অন্তরঙ্গ গান শুনিয়ে যায়। আর
আমার এই ছোট ঘরে মাঝে মাঝে দেখা দেয় এক মানবী
সত্তায় অনুপম বসন্তের বর্ণচ্ছটা নিয়ে। কথা এবং আচরণের
রোদ-জ্যোৎস্নাধারায় আমার খরাগ্রস্ত জীবনকে স্নিগ্ধ স্নান
করায়। আমরা দুজন গড়েছি এক প্রণম্য মনোজ বসতি। যদি
সে কোনও দিন আমাকে ছেড়ে ঠাঁই-নাড়া হয়, তাহলে দুনিয়া
আমার অ্যান্ধার, যেমন কবিতা আমাকে ত্যাগ করলে।২
কক্সবাজারের সমুদ্রতীরে জলবালিতে নয়, ইটখোলার ইটের
টুকরোটাকরা অথবা আমাদের এই গলির ধুলোকাঁকরেও
নয়, মাঝে মাঝে সকাল-দুপুর, গোধূলি-সন্ধ্যা কিংবা মধ্যরাতে
ঘরের মেঝে আর বিছানায় কোথাকার পাথরের নুড়ির ওপর
গড়াগড়ি দিই। আজকাল রাতে ঘুম প্রায়শই লাপাত্তা। জানি,
চিকিৎসাশাস্ত্রের বরাত দিয়ে লোকে ইনসমনিয়া বলে এই উপসর্গকে।
নির্ঘুম রাতে আমার কণ্ঠনালী দিয়ে জঠরে ঢুকে যায় বালিকণা,
বেবি ট্যাক্সি, ট্রাক-বাসের কালো ধোঁয়া, ইটের ভগ্নাংশ, মরা পাতা,
বাতিল বিয়ার ক্যানের খণ্ড, পুরনো টুথব্রাশ, কাঁকর, ছেঁড়া
চিঠি, বাৎস্যায়ন ঋষির ‘কামসূত্রে’র একটি মলিন পাতা, আর
পাথরের অনেকগুলো নুড়ি। কখনও কখনও কয়েক দিন পর,
আবার হয়ত সে-রাতেই আমার ভীষণ বিবমিষা হয় আর
আমি বমন করি পূর্বাষাঢ়া, রেবতী, বিশাখা, স্বাতী,
শতভিষা, জোহরা সিতারা, সপ্তর্ষি মণ্ডল আর কিছু অচেনা
মণিমুক্তো। সংবিং ফিরে এল আমি বিস্মিত-থরথর হাতে
সেগুলো কুড়াতে থাকি। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
ছড়া
|
ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই ?একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের ওপর বাজনা বাজে
ঝন ঝনাঝন ঝন।দেশ-বিদেশে বেড়ায় ঘুরে
নেইকো ঘোরার শেষ।
ইচ্ছে হলেই বাজায় বাঁশি,
দিন কেটে যায় বেশ।থামবে হঠাৎ মজার গাড়ি
একটু কেশে খক।
আমায় নিয়ে ছুটবে আবার
ঝক ঝকাঝক ঝক।
|
শামসুর রাহমান
|
ছড়া
|
ছড়া
|
শামসুর রাহমান
|
ছড়া
|
ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই ?একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের ওপর বাজনা বাজে
ঝন ঝনাঝন ঝন।দেশ-বিদেশে বেড়ায় ঘুরে
নেইকো ঘোরার শেষ।
ইচ্ছে হলেই বাজায় বাঁশি,
দিন কেটে যায় বেশ।থামবে হঠাৎ মজার গাড়ি
একটু কেশে খক।
আমায় নিয়ে ছুটবে আবার
ঝক ঝকাঝক ঝক।
|
শামসুর রাহমান
|
ছড়া
|
https://www.bangla-kobita.com/shamsurrahman/trent/
2020-06-01T20:23:03.049074
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
গলায় জড়ানো তাঁর শাপলা রঙের মাফলার, কষ্ট পান
প্রায়শই বাতে, কফ নিত্যসঙ্গী, কখনো হাঁপান
সিঁড়ি ভেঙে। এ কেমন একাকিত্ব এলো ব্যেপে
অস্তিত্বের উড়ানির চরে? প্রহরে-প্রহরে শুধু দাগ মেপে
নানান ওষুধ খেয়ে ধুধু সময়ের খালে
লগি ঠেলা নক্ষত্রবিহীন এ গোধূলি কালে।আপাতত কিছুতেই নেই মন, শিশু বৈকালী সাহিত্য সভা,
জয়নুলী চিত্রকলা, ইতল-বিতল, রক্তজবা,
দূর থেকে-আসা কবিয়াল, কিংবা বিশ্বের খবর-
কিছুই টানে না তাঁকে। মাঝে-মধ্যে নিষ্প্রদীপ দাদির কবর
ভেসে ওঠে, ভেসে ওঠে ছায়াবৃত মাঠ, খাল, বিল,
কবেকার বিশুদ্ধ কোকিল।
তাকান কখনও ভেজা চোখে
শিল্পিত শীতলপাটি শোভিত দেয়ালে। ঘরে ঢোকে
অকস্মাৎ চড়ুই দম্পতি, চঞ্চলতা
ছড়ায় ড্রইংরুমে। খয়েরি শালের খুঁট মেঝেতে গড়ায়, নীবরতা
হীরের মতন জ্বলে, একটি অনুপস্থিতি ঝুঁকে
থাকে তাঁর বিমর্ষ শিশিরময় বুকে।কোথাও নিঝুম হ্রদে লাল পদ্ম ফুটে আছে আজ,
হঠাৎ ভাবেন তিনি। খ্যাতির আওয়াজ
অন্ধকারে খড়মের শব্দ যেন এবং জীবন
যুগপৎ অর্থময়, অর্থহীন, বেদেনীর শাড়ি মতন
ভাসমান গহীন গাঙের জলে। ঠোঁটে
বর্তমান, ভূত, ভবিষ্যৎ-সংকলিত হাসি ফোটে।‘আমাকে নিও না তুমি’, কবিতা আবৃত্তি করবার
ধরনে বলেন যাকে, তার
হাত জানালার গ্রিলে, হাতে কালো পাখি ডেকে যায়
শব্দহীন অবিরত। আদিগন্ত ঘন কুয়াশায়
শূন্য নাও ভাসে,
চেয়ার অর্পিত শ্লথ হাতে অস্তরাগ নেমে আসে।
করোটিতে ছিলো তাঁর কী ব্যাপক চর-থরথর
কাইজার চিত্রনাট্য, গাথার ছন্দের মতো সোনার গতর
গ্রাম্য যুবতীর, মাছলোভী মাছরাঙা, সারিগান।
স্বপ্ন-কণা-ধান
ঝরেছে করোটি জুড়ে, ডানা-অলা বাইসাইকেলে
চেপে কোন্ শাশ্বতের বনে গেলেন পেছনে ফেলে
সব কিছু? তাঁর সে চাকার কিছু নাক্ষত্রিক ধূলো
কেমন রাঙিয়ে দেয় আমার চোখের পাতা আর চুলগুলো। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
মুহূর্তে মুহূর্তে ভীতি, বদ্ধ কালা চার দেয়ালের
আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মগজের কোষে। এমন কি
মস্তিষ্কে দেয়াল গেঁথে হো-হো হেসে ওঠে বহু লোক,
কোপন স্বভাবী লোক। “কী দরকার দেয়াল-পেরুনো
দৃষ্টির দিব্যতা দিয়ে” বলে তারা অভ্যাসের বশে
সত্তার চৌদিকে তোলে পাথুরে দেয়াল ঝোড়ো হাতে।যতই নিরেট হোক, দেয়ালটা থাকুক আমাকে
ঘিরে পাহারায়,
দৃষ্টি তবু যায় দূরে, দরজা-জানালা
থাকে পড়ে। পা’দুটো কী করে ব্যস্ততায় খোঁজে পথ
গর্তের ভিতর, যাকে বলি ঘর। ডুসেলডর্ফের
পোড়-খাওয়া পথপ্রান্তে যেতে চাই, অস্ট্রিয়ান বাড়ির বাগানে
যে তরুণী ফুল তোলে, নোয়ায় কম্পিত ডাল, যার
স্তনভারে সূর্যগন্ধী ফলের সোনালি-অন্য মনে
গভীর গোলাপটিকে হাওয়ায় দুলিয়ে জীবনের
মানে বলে বাক্যের অতীত- তারই কাছে সারাবেলা
কেবলি পৌঁছুতে চাই।কায়রোর কফির দোকানে
এক কোণে বসে বসে দৃশ্য গাঁথি, মিনারের মতো প্রবীণ যে ভদ্রলোক
খাচ্ছেন সুগন্ধ কফি, ইচ্ছে হয় বলি তাঁকে, “কেমন আছেন?”
ন্যুইয়র্কে যে বালক বল নিয়ে লাফাতে লাফাতে
ঘোরানো সিঁড়িতে ওঠে, ছায়া দেখে ভয় পায়, তাকে বুকে নিয়ে
হরবোলা সেজে জেনে নিতে চাই কী যে তার নাম। ক্যাথিড্রাল
বড়ো রাস্তাটার ডান দিকে রেখে ইচ্ছে হয় গ্র্যাণ্ড ক্যানালের
গণ্ডোলায় দুলি কিছুক্ষণ, দু’দণ্ড বিশ্রাম নিই
প্যারিসের বুলেভারে কিংবা বুদোয়ারে। হাঙ্গেরির
শাদা বাড়িটার
সুদৃশ্য কার্ণিশ ঘেঁষে ভোরের আলোয় মাখা যে পায়রাগুলো
উড়ে যায়, শূন্যতাকে চেয়ে বার বার,
মাদ্রিদের লিরিক জ্যোৎস্নায় আধ-পাগলা যে লোকটা
গত শতকের ঢের কুহক সঞ্চারী শোকগাথা করছে রচনা আর
গীটার ধ্বনিতে এলদেরাদোর ছবি চৈতন্যে জাগায়,
ছন্নছাড়া তাকে, সেই পায়রাগুলোকে
চোখ ভরে দেখবার, সবখানে পৌঁছুবার, রেড স্কোয়ারের
মিশ্র ভিড়ে, পিকিং-এর প্রাণের মেলায়, সবখানে
পৌঁছবার খোলা রাস্তা চাই।টপকে প্রাক্তনী চোরাবালি হঠকারী যে মদ্যপ
অমিত্রাক্ষরের মায়ামন্ত্রে সেই ঊনিশ শতকে
সমুদ্রে ভাসালো পোত, আমি তার উত্তরাধিকারী-
শিরায় শব্দের ঝোড়ো গান, চৈতন্যের নীলিমায়
সারসের পক্ষধ্বনি শুনি, কী আবেগে অকস্মাৎ
দেয়াল চাহিদ হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
ভাবতেই পারিনি, এমন গুছিয়ে-গাছিয়ে
বলতে পারবেন তিনি
এত কথা, যেন হাতের চেটোয়
মেহেদীর নক্শা। আমার বিষয়ে যা-যা
বলেছেন তাতে মনে হ’তে পারে
আমি প্রায় ফেরেশ্তা আর
যে-সারল্য আরোপ করা হ’য়েছে এই
বান্দার ওপর তা-ও
ষোলআনা ঠিক নয়। যুগ-সংকটের
জটিলতা আমার দোসর।কোনো কিছু লেখার সময, গদ্য পদ্য যাই হোক,
আমি বার বার কাগজ দলামোচা ক’রে
ছুঁড়ে ফেলি বাজে কাগজের
ঝুড়িতে, তিনি বলেছেন। কী ক’রে অস্বীকার
করি, বলুন? কিন্তু এটাই
সব নয়, এ খবর যদি তিনি রাখতেন। তখন,
মানে, যখন টেবিলে ঝুঁকে
লিখি, আমার ভেতরে কত হাওয়াই সেতু
গুঁড়িয়ে যায়, টগবগানো লাভা
ক্রমাগত পোড়াতে থাকে আমাকে,
কেউ এই হতচ্ছাড়াকেই ব্যর্থ কাগজের মতো
দলামোচা করে প্রহরে প্রহরে।আমার গৃহিণীর কি কখনো মনে হয় যে,
রতিবিহারের কালে ওর মুখে
অন্য কারো মুখ স্থাপন ক’রে সুখের সরোবরে
ডুবে যাই? না, ফেরেশতা টেরেশতা
আমি নই, পাক্কা শয়তানের শিরোপাও
আমার লভ্যনয়।
আমি নিজের মধ্যে এক দাউ দাউ মশাল
ব’য়ে বেড়াচ্ছি দিনরাত্রি, এ-ও
তার অজানা। জায়নামাজে ব’সে তিনি আমার
মঙ্গল কামনা করেন প্রত্যহ দু’হাত তুলে,
তখন ওর কাপড়-ঢাকা মাথা
নীলিমাকে স্পর্শ করার স্পর্ধা রাখে। আমি কি
তার এই নিষ্কলুষ ভঙ্গির যোগ্য? তিনি
প্রকৃত আমাকে পুরোপুরি চেনেন না আজো।
আমাকে নিয়ে নানা মুনির নানা মত,
কত জল্পনা কল্পনা। ওদের
প্রত্যেকের বলাবলি উপেক্ষা ক’রে, ব্যাঙআচিদের
অগুণতি লাথি অগ্রাহ্য ক’রে
আমার অস্তিত্ব বিদ্যমান হাই-রাইজ
দালানের ধরনে। সবার আন্দাজের বাইরে আমি।এতকাল অন্তর্গত দ্রোহ, ক্ষোভ, বিষাদ,
আনন্দ আর ভালোবাসার
সান্নিধ্যে বেঁচে-বর্তে আছি গেরিলার মতো,
অথচ নিজেই সবচেয়ে কম জানি নিজেকে। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
‘কখনো নদীর স্রোতে মৃত গাধা
ভেসে যেতে দেখেছি সন্ধ্যায়,
দেখেছি একদা যারা হৈচৈ করে যুদ্ধে
গেছে তাদের ক’জন
মহৎ স্বপ্নের শব কাঁধে নিয়ে হেঁটে-হেঁটে
ক্লান্ত হয়ে ফের
স্বগৃহে এসেছে ফিরে। গোবিন্দলালের পিস্তলের
ধোঁয়ায় রোহিনী আর একটি যুগের অস্তরাগ
মিশে যেতে দেখেছি আমরা’-বলে
পিতা থামলেন কিছুক্ষণ।তিনি ভোরে খাচ্ছিলেন রুটি আর স্মৃতির তিতির
পুরানো চেয়ারে ব’সে। রোদ্দুরের অরেঞ্জ স্কোয়াশে
ভিজিয়ে প্রবীণ কণ্ঠ বল্লেন জনক
“আমি তো বেঁচেছি ঢের খেয়ে-দেয়ে
ভালো থেকে অশেষ কৃপায়
তাঁর, কত বছরের রৌদ্রজলে ক্ষ’য়ে গেছে
অস্তিত্বের ধার
আর কে না জানে প্রকৃত দীর্ঘায়ু যিনি
অনেক বিচ্ছেদ মৃত্যু তার মনে প্রেতের ছায়ার
মতো ঝুলে থাকে আজীবন। শৈশবের
অশেষ সন্ধান তাকে টেনে আনে জনশূন্যতার
নেউল-ধূসর তীর্থে, যেখানে কুয়োর জলে
সত্যের নিটোল মুখ দেখার আশায়
যেতে হয়-যেখানে দরোজা বন্ধ, বারান্দায়
পাখির কংকাল,
গোলাপের ছাই প’ড়ে আছে
একটি বাতিল জুতো বিকেলের রোদের আদরে
হেসে উঠে বলের মতন নেচে নেচে নিরিবিলি
ফুলের জগতে চলে যায়
এবং একটি ঘোড়া চমকিত বালকের আকাঙ্ক্ষার ঘ্রাণে
মত্ত হয়ে ছুটে যায় দলছাড়া মেঘের তল্লাশে,
সহসা খিঁচিয়ে মুখ ছিঁড়ে নেয় অস্তগামী
সূর্যটির মাংস একতাল।
বেঁচে আছি বহুদিন তবু পৃথিবীকে
এখনও রহস্যময় মনে হয়… আর শোনো
ভাবতে পারি না
কোনো দিন থাকব না এখানে, চেয়ারে ব’সে
ঝিমাব না
ভোরের রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে কোনো দিন।‘তখন থাকবে তুমি আমার সন্তান
-দীর্ঘজীবী হও তুমি,
তোমার কর্মঠ আঙুলের উষ্ণ রক্তে ঘন ঘন
আমার অপূর্ণ ইচ্ছাগুলি
এক ঝাঁক হাসের মতোই জানি
নিপুণ সাঁতার কেটে তোমাকে জোগাবে স্বপ্ন অনিদ্রার রাতে-‘
-বলে তিনি মুগ্ধ চোখে ফেরালেন মুখ
অতীতের দিকে,
তখন রাসেল রিলকে বুদ্ধ পিকাসোর
নাম জানেন না ভেবে
পারিনি করুণা করতে বয়েসী পিতাকে। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
শরীরে আমার সারদ জ্যোৎস্না বুনেছে কী মায়া
ভরা আঠারোয়া। শরীর আমার বসন্ত রাগ,
এখনো সজীব হৃদয়ের ফুলে কোনো কালো নাগ
দেয়নি ছড়িয়ে কৃষ্ণ জহর। তবে কিছু ছায়া,
অশুভই বটে, চেনা মানুষের ছন্দিত কায়া
ধ’রে ঘোরে এই আঁধার দুর্গে? রক্তের দাগ
দুর্গ প্রাকারে বেঁধেছে জমাট। তুমিও বেহাগ
গাইছো কুমার, আমি নিরুপায় অসিদ্ধ জায়া!কোথায় উধাও মেঘ-টলোটলো স্নিগ্ধ শ্রাবণ?
উটের পিঠের মতন দূরের মেঘতরঙ্গে
বাজে না তো আর জলতরঙ্গ। বলো, এ কেমন
ব্যাভার তোমার? ভুল হত্যার দূর নিশিডাক
তোমাকে ঘোরায় পথে-প্রান্তরে; স্বপ্নভঙ্গে
দেখি উড়ে আসে জলজ কবরে দোয়েলের ঝাঁক। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
প’ড়ে যাচ্ছি, প’ড়ে যাচ্ছি, দ্রুত
প’ড়ে যাচ্ছি। প’ড়ে যেতে-যেতে
ভাবছি কেন যে অকস্মাৎ এ-পতন
আমার? করেছি কোন গূঢ় অপরাধ?কিছুক্ষণ পর দেখি ঝুলছি গাছের
ডালে আর শরীর আমার বড় বেশি
কাঁটাবিদ্ধ। ঝুলতে ঝুলতে ডালে প্রায়
অজ্ঞান হওয়ার পথে কাতরাতে থাকি।বড় বেশি জনহীন অন্ধকার পথে
প’ড়ে গিয়ে চিৎকার করার চেষ্টায়, মনে নেই
কী হ’ল আমার। বেশ কিছুক্ষণ পর
দেখি এক জীব দ্রুত চাটছে আমার আর্ত্মুখ।কিছুক্ষণ পর বহু কষ্টে মুখ পশুর লোভের
গর্ত থেকে ফেরিয়ে সহজ,
বিশুদ্ধ পথের দিকে নিয়ে আসি। ফলে
দুর্গন্ধের জিহ্বার সান্নিধ্য থেকে মুক্তি পাওয়া গেল।একটি সফেদ ঢের রূপময় পাখি, ডানা যার
ঢেকে ফ্যালে উৎসুক যাত্রীকে, অকস্মাৎ
আমাকে আরোহীরূপে নিয়ে ওড়ে মেঘ থেকে
মেঘান্তরে, আমি তার প্রসাদের দান করি সানন্দে গ্রহণ। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.