label
stringclasses
16 values
text
stringlengths
3.73k
6k
is_valid
bool
1 class
shunil_gongopaddhay
তার জন্য টাকা চেয়ে চিঠি পাঠাই। টাকা না পেলে দশ দিনের মধ্যে মেরে ফেলা হবে, তা জানিয়ে দিই। সেই ভয়ে তারা টাকা দিয়ে দেয়। তোমাকে যে ধরে আনা হয়েছে, তা এ-লাইনের অনেকেই জেনে যাবে। তোমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিলে সবাই ভাববে, আমরা নরম হয়ে গেছি। আর আমাদের ভয় পাবে না। সেইজন্যই তোমার মুণ্ডুটা কেটে জঙ্গলের বাইরে ফেলে রাখতে হবে। কাকাবাবু বললেন, তোমরা শুধু চন্দনগাছ কাটো না, মানুষ গুম করাও তোমাদের ব্যবসা? ভুড়ু বলল, এটা আমাদের সাইড ব্যবসা। আমরা নিজেরা মানুষ ধরে আনি, অন্যরা ধরে এনে আমাদের কাছে কম দামে বিক্রি করে দেয়, আমরা বেশি টাকা আদায় করি, আমাদের খরচও তো কম নয়, গ্রামের লোকদের টাকা দিতে হয়, যাতে পুলিশ আসবার আগেই তারা আমাদের খবর দিয়ে দেয়। কাকাবাবু বললেন, টাকা পাওয়া যায়নি, এজন্য আগে কারও মুণ্ডু কেটেছ? ভুড়ু বলল, হ্যাঁ। তিনজনের মুণ্ডু কাটা গেছে। কাকাবাবু বললেন, আমার জন্যও টাকা পাওয়ার কোনও আশাই নেই। সুতরাং আমারও মুণ্ডুটা কাটতেই হবে? ভুড়ু হাসতে হাসতে বলল, উপায় কী বলো, ব্যবসার খাতিরে কাটতেই হচ্ছে। তুমি নিজে না লিখতে চাও, আমরাই সরকারের কাছে পঞ্চাশ লাখ টাকা চেয়ে চিঠি পাঠাচ্ছি। দশ দিনের মধ্যে টাকাটা না এলে— কাকাবাবু হঠাৎ বজ্রমুষ্টিতে ভুড়ুর ঘাড়টা চেপে ধরে বেঁকিয়ে দিলেন। যে যন্ত্রণায় আঁ আঁ করে উঠল। কাকাবাবু বললেন, তুমি হাসতে হাসতে মানুষের মুণ্ডু কাটার কথা বলছ। নিজের মুণ্ডুটা কাটা গেলে কেমন লাগে তা ভাবো না? এক্ষুনি আমি তোমার ঘাড় মটকে দিতে পারি। বিক্রম ওসমান রেগে ওঠার বদলে মহাবিস্ময়ে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হেসে উঠল বাতাস কাঁপিয়ে। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে এমন হাসতে লাগল যে, মনে হল যেন দোলনা থেকে পড়েই যাবে। কাকাবাবু ভুড়ুর গলাটা ছেড়ে দিয়ে দুহাত ঝাড়লেন। ভুড়ু কাকাবাবুর বদলে ওসমানের দিকে হতভম্বের মতন তাকিয়ে রইল। হাসি থামিয়ে ওসমান বলল, আরে ভুডিয়া, তোর মুখোনা কী মজার দেখাচ্ছিল! হাসি সামলাতে পারিনি। তারপর কাকাবাবুকে বলল, শাবাশ বাবুজি! আমার সামনে আমার কোনও শাগরেদের গায়ে কেউ হাত তোলে, এ আমি আগে কখনও দেখিনি। তুমি এত সাহস দেখালে কী করে? আমি যদি সঙ্গে সঙ্গে তোমায় গুলি করতাম? কাকাবাবু হালকাভাবে বললেন, গুলি খেলেও আমি মরি না। আমি গুলি হজম করে ফেলতে পারি। ওসমান বলল, পরখ করে দেখব নাকি? দেখি তো কেমন গুলি হজম করতে পারো। ওসমান কোমর থেকে রিভলভার বার করতেই কাকাবাবু একটা ক্রাচ তুলে বিদ্যুতের মতন বেগে সেই হাতটার ওপর মারলেন। রিভলভারটা ছিটকে দূরে পড়ে গেল। ওসমান এবারও রাগ না করে ভুরু তুলে বলল, হ্যাঁ বাবুজি, তোমার খুব এলেম আছে। কিন্তু এই করেও তো তুমি বাঁচতে পারবে না। তুমি খোঁড়া মানুষ, দৌড়বার ক্ষমতা নেই। আমি হাঁক দিলে দশজন লোক ছুটে আসবে, তোমাকে শেষ করে দেবে। তুমি এখান থেকে পালাতে পারবে না। কাকাবাবু বললেন, আমি পালাতে চাইলে দৌড়বার দরকার হয় না। তোমরা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করলে আমার এখন পালাবার ইচ্ছেও নেই। মাটিতে পড়ে-থাকা রিভলভারটা তুলে নিয়ে সেটা দোলাতে দোলাতে কাকাবাবু বললেন, এটা যদি আমি এখন তোমার বুকের ওপর চেপে ধরি, তা হলে তোমার দশজন লোক ছুটে এসেও কি আমার গায়ে হাত দিতে সাহস করবে? ওসমান বলল, হ্যাঁ। তাতেও তোমার কোনও লাভ হবে না। আমি জানের পরোয়া করি না। আমার পরে কে সর্দার হবে, তা ঠিক করাই আছে। আমার হুকুম দেওয়া আছে, আমাকে যদি কেউ কখনও ধরেও ফেলে, তা হলেও ওরা গুলি চালাবে। আমাকে বাঁচাবার জন্য দলের ক্ষতি করা যাবে না! কাকাবাবু রিভলভারটা লক করে ওসমানের কোলের ওপর ছুড়ে দিয়ে বলল, এই নাও, আমি শুধু শুধু কাউকে ভয় দেখাই না। তবে, আমার হাতে রিভলভার থাকলে দশজন লোকও আমাকে আটকাতে পারবে না। আমি দৌড়তে পারি না, কিন্তু ঘোড়া চালাতে জানি। রিভলভারটা হাতে নিয়ে ওসমান কাকাবাবুর দিকে একটুক্ষণ বিস্মিত ভাবে চেয়ে রইল। তারপর বলল, তুমি একটা অদ্ভুত মানুষ বটে। পিস্তলটা পেয়েও ফেরত দিলে? এরকম আগে দেখিনি। কিন্তু বাবুজি, ভুড়ু কিছু ভুল বলেনি। আমরা এমনি এমনি কাউকে ছেড়ে দিই না। তুমি সরকারকে চিঠি লিখে দেখেই না, টাকাটা দিয়ে দিতেও পারে। কাকাবাবু বললেন, না। আমি নিজের জন্য কারও কাছেই টাকা চাইব না। ওসমান বলল, ঠিক আছে, আমরাই চিঠি পাঠাচ্ছি। দশ দিনের মধ্যে টাকা না পেলে তখন একটা কিছু ব্যবস্থা নিতেই হবে। এই দশ দিন তোমার ছুটি। খাও দাও, মজা করো। তুমি দাবা খেলতে জানো? কাকাবাবু বললেন, তা বেশ ভালই জানি। ওসমান বলল, ঠিক আছে, পরে তোমার সঙ্গে দাবা খেলব। ভুড়ু এতক্ষণ গলায় হাত বুলোতে বুলাতে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। এবারে সে বলল, ওসমানজি, এই রায়চৌধুরীকে বাঁচিয়ে রাখার একটাই উপায় আছে। ও আমাদের দলে যোগ দিক। লোকটার বুদ্ধিও আছে, গায়ের জোরও আছে। দলের অনেক কাজে লাগবে। কী রায়চৌধুরী, তুমি থাকবে এই দলে? কাকাবাবু বললেন, ভুড়ু, তুমি আমাকে পুরোপুরি চিনতে পারোনি। এখনও অনেক বাকি আছে। চালাঘরটায় ফিরে এসে কাকাবাবু দেখলেন, সন্তু আর জোজো বসে বসে একবাটি করে ক্ষীর খাচ্ছে। কাকাবাবু বললেন, এ আবার কোথায় পেলি? জোজো বলল, কুলসম দিয়ে গেল। খুব ভাল মেয়ে। আপনার জন্যও নিয়ে আসবে। কাকাবাবু বললেন, কুলসুমকে আমিও দেখেছি। দেখলেই মনে হয়, মেয়েটির বেশ দয়ামায়া আছে। হাঁ রে সন্তু, তোদের
false
shordindu
আর কখনও ফিরিবি না।” ডা-গামা উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল, কহিল, “মূর, তুই অতি নির্বোধ! আমি শপথ করিব না, আমাকে বধ কর। আমার রক্তে কলিকটের মাটি ভিজিলে হিন্দে ইম্যানুয়েলের জয়ধ্বজা সহজে রোপিত হইবে।” মির্জা দাউদ হাস্য করিয়া কহিলেন, ‘এতদিনে নিজ মুখে নিজের অভিপ্ৰায় ব্যক্তি করিলি! কিন্তু তাহা হইতে দিব না। ইম্যানুয়েলের জয়ধ্বজ কালিকটে রোপিত হইবে না। কালিকট চিরদিন পৃথিবীর সমস্ত জাতির মিলনক্ষেত্ৰ হইয়া থাকিবে। প্রতিজ্ঞা কর, নচেৎ—— ডা-গামা ভ্রূকুটি করিয়া কহিল, নচেৎ? “নচেৎ পোর্তুগালে ফিরিয়া যাইতে একটি প্রাণীও জীবিত রাখিব না। তোদের জাহাজ পুড়াইয়া এই একশত ত্ৰিশ জন লোককে কাটিয়া সমুদ্রের জলে ভাসাইয়া দিব।” ডা-গামা স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কোনও উত্তর দিল না। মির্জা দাউদ পুনশ্চ কহিলেন, “ডা-গামা, এখনও শপথ করা—তোর ধর্মের উপর বিশ্বাস করিয়া ছাড়িয়া দিব। —ভাবিয়া দেখ, তোরা মরিলে কে তোর দেশবাসী ভিক্ষুকদের পথ দেখাইয়া লইয়া আসিবে?” ডা-গামা অবরুদ্ধ কণ্ঠে কহিল, “শপথ করিতেছি—” মির্জা দাউদ কহিলেন, “তোদের যেশুর জননী মেরীর নামে শপথ কর।” ডা-গামা তখন কম্পিত ক্ৰোধ-জর্জরিত কণ্ঠে শপথ করিল যে, সপ্তাহমধ্যে এদেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে এবং আর কখনও ভারতভুমির উপর পদার্পণ করিবে না। ডা-গামাকে ছাড়িয়া দিয়া মির্জা দাউদ ও আরও প্রধান প্রধান নাগরিকগণ সামরীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। সমস্ত বিবরণ আদ্যোপান্ত শুনিয়া সামরী কহিলেন, “যত দিন উহারা আমার রাজ্যের কোনও প্রকাশ্য অনিষ্ট না করিতেছে, ততদিন শুধু সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া আমি উহাদিগকে রাজ্য হইতে বিতাড়িত করিতে পারি না। তবে কেহ যদি তোমাদের ব্যক্তিগত অনিষ্ট করিয়া থাকে, তোমরা প্ৰতিশোধ লইতে পার, আমি বাধা দিব না।” সকলে সামরীকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন যে, ইহারা অত্যন্ত কূটবুদ্ধি ও যুদ্ধনিপুণ, তাহাদের কামান, বন্দুক, গোলাগুলি আছে; সুযোগ পাইলেই তাহারা বাহুবলে এই সোনার রাজ্য অপূর্ব অমরাবতী গ্ৰাস করিবে। সামরী হাসিয়া উত্তর করিলেন, “আমার সৈন্যবল নাই সত্য, কিন্তু সামরীবংশ পঞ্চদশ শতাব্দী ধরিয়া এই মসলিন্দে রাজত্ব করিতেছে—কেহ তাহাকে রাজ্যভ্ৰষ্ট করে নাই। আমার সিংহাসন সুশাসন ও জনপ্রিয়তার উপর প্রতিষ্ঠিত। উহারা আমার কি করিতে পারে?” সকলে নিরাশ হইয়া ফিরিয়া গেলেন। সপ্তাহ পরে স্বর্ণপত্রে লিখিত সামারীর সন্ধি লিপি মস্তকে ধারণা করিয়া ভাস্কো-ডা-গামা অনুচরসহ জাহাজে উঠিল। মির্জা দাউদ বন্দর হইতে ডাকিয়া বলিলেন, “ডা-গামা, শপথ স্মরণ রাখিও।” একটা ক্রুর হাস্য ডা-গামার মুখের উপর খেলিয়া গেল, মির্জা দাউদের প্রতি স্থিরদৃষ্টি রাখিয়া সে বলিল, “মির্জা দাউদ, আবার আমাদের সাক্ষাৎ হইবে।” মির্জা দাউদ হাসিয়া উত্তর দিলেন, “সম্ভব নয়। আমি মুসলমান—বেহেস্তে যাইব।” ডা-গামা দুই চক্ষুতে অগ্নিবর্ষণ করিয়া কহিল, “ইহজন্মেই আবার আমাদের সাক্ষাৎ হইবে।” তারপর ধীরে ধীরে তাহার তিনটি জাহাজ বন্দরের বাহির হইয়া গেল। চারি বৎসর অতীত হইয়াছে। এই চারি বৎসরে যাহা যাহা ঘটিয়াছে, তাহা এই কাহিনীর অন্তর্গত না হইলেও সংক্ষেপে বৰ্ণিত হইল। ভাস্কো-ডা-গামা কালিকট ত্যাগ করিবার দুই বৎসর পরে আবার পোর্তুগীজ জাহাজ ভারতবর্ষে আসিল। এবার পোর্তুগীজদের অধিনায়ক আলভারেজ কেবলার নামক একজন পাদ্রী এবং তাঁহার অধীনে নয়খনি জাহাজ। পাদ্রী আলভারেজ কালিকট বন্দরে প্রবেশ করিয়াই জাহাজ হইতে নগরের উপর গোলাবর্ষণ আরম্ভ করিলেন। ফলে বহু নাগরিকের প্রাণনাশ হইল, অনেকে আহত হইল এবং কয়েকটি অট্টালিকা চূৰ্ণ হইয়া গেল। এইরূপে রাজা-প্রজার মনে ভীতি ও কর্তব্যজ্ঞান সঞ্চারিত করিয়া পোর্তুগীজরা আবার ভারতভূমিতে পদার্পণ করিল। রাজা সামরী আগস্তুকদিগকে সম্মান দেখাইলেন ও তাহাদের বাসের জন্য নগরের বাহিরে ভূমিদান করিয়া কুঠি-নিমাণের অনুমতি দিলেন। কিন্তু পোর্তুগীজদিগের এই অহেতুক জিঘাংসা ও নিষ্ঠুরতায় কালিকটের জনসাধারণের মন তাহাদের বিরুদ্ধে ঘূণা ও বিদ্বেষে পূর্ণ হইয়া উঠিল। তারপর কলহ বাধিতে বিলম্ব হইল না। দাম্ভিক বিদেশীদের প্রতি যাহাঁদের ব্যক্তিগত বিদ্বেষ জন্মিয়ছিল, তাহারা ঝগড়া বাধাইয়া রক্তপাত করিতে লাগিল। পোর্তুগীজরাও জবাব দিল। ক্ৰমে ভিতরে বাহিরে আগুন জুলিয়া উঠিল। একদিন নাগরিকগণ পোর্তুগীজদের কুঠিতে অগ্নিসংযোগ করিয়া সত্তর জন্য ফিরিঙ্গীকে হত্যা করিল। অবশিষ্ট পলাইয়া জাহাজে উঠিল এবং হাজ হইতে গোলা মারিয়া নগরের এক অংশে আগুন লাগাইয়া দিল। তারপর সেই যে হারা কালিকট ছাড়িয়া গেল, দুই বৎসরের মধ্যে আর ফিরিয়া আসিল না। কালিকটের রাজা-প্রজা নিশ্বাস ফেলিয়া ভাবিল—আপদ দূর হইয়াছে, আর ফিরিবে না। শেষোক্ত ঘটনার বৎসরেক পরে মির্জা দাউদ স্ত্রী-কন্যা লইয়া তাঁহার জন্মভূমি মরক্কো দেশে গেলেন। সেখানে কিছু দিন অবস্থানের পর বৃদ্ধ পিতাকে সঙ্গে লইয়া মক্কাশরীফ দর্শন করিলেন। তারপর তীর্থ-দৰ্শন শেষ করিয়া সকলে মিলিয়া কালিকটে প্রত্যাবর্তন করিতেছিলেন। কথা ছিল, মক্কাশরীফ হইতে মির্জা দাউদ কালিকটে আসিবেন, তাঁহার পিতা মরক্কো দেশে ফিরিয়া যাইবেন। কিন্তু পিতা স্থবির ও জরাগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছেন—অধিক দিন পরমায়ু নাই। পুনরায় মরক্কো যাইবার সুযোগ হয়তো শীঘ্ৰ হইবে না, ততদিন পিতা বাঁচবেন কি না, এই সকল বিবেচনা করিয়া মির্জা দাউদ তাঁহাকে ছাড়িলেন না, নিজের সঙ্গে কালিকাটে লইয়া চলিলেন। বৃদ্ধও ঈদের চাঁদের মতো সুন্দর ক্ষুদ্র নাতিনীটিকে দেখিয়া ভুলিয়াছিলেন——তিনিও বিশেষ আপত্তি করিলেন না। মক্কাশরীফ দর্শনের সময় কালিকাটের কয়েকজন সম্রান্ত ব্যক্তির সহিত মির্জা দাউদের সাক্ষাৎ হইয়াছিল। তিনি তাঁহাদের বলিলেন, ‘আপনারাও কালিকটে ফিরিতেছেন—আমার জাহাজেই চলুন।’ তাঁহারা আনন্দিত হইয়া সপরিবারে মির্জা দাউদের জাহাজে আশ্রয় লইলেন। মক্কা হইতে কালিকট তিন মাসের পথ। জাহাজ যথাসময়ে আরব উপকূল ছাড়িয়া লোহিত সাগর পার হইল। ক্রমে পারস্য উপসাগর উত্তীর্ণ হইয়া ভারত সমুদ্রে আসিয়া পড়িল। মহাসাগরের বুকের উপর বায়ু-বর্তুলিত পালের ভরে মির্জা দাউদের তরণী দক্ষিণাভিমুখে চলিয়াছে। চারিদিকে অতল জল দুলিতেছে, ফুলিতেছে—লক্ষকোটিখণ্ডে বিচূৰ্ণিত দর্পণের মতো রবিকরে প্রতিফলিত হইতেছে। পূর্ণ দিগন্তরেখা অখণ্ডভাবে তরুণীকে চারিদিকে বেষ্টন করিয়া আছে। কেবল বহুদূরে পূর্বচক্রবালে মেঘের মতো কচ্ছভূমির তাঁটবনানী ঈষন্মাত্র
false
robindronath
মারিয়া লইবার জন্য মনটার ভিতরে ধড়্‌ফড়্‌ করিতেছে–কিন্তু মুখ ফুটিয়া না চাহিলে আমি দিব না, কখনো দিব না, দেখি কত ক্ষণ পণ রাখিতে পার।” এমন সময় উমা একটা সাবানের বাক্সে দড়ি বাঁধিয়া টানিয়া আনিয়া কহিল, “মাসি, গ-গ।” কমলা তাড়াতাড়ি উমিকে কোলে তুলিয়া বারংবার চুমো খাইতে খাইতে শোবার ঘরে লইয়া গেল। উমি তাহার শকটচালনায় অকসমাৎ বাধাপ্রাপ্ত হইয়া চিৎকার করিতে লাগিল, কিন্তু কমলা কোনোমতেই ছাড়িল না-তাহাকে ঘরের মধ্যে লইয়া গিয়া নানাপ্রকার প্রলাপবাক্যে তাহার মনোরঞ্জন-চেষ্টায় প্রবলবেগে প্রবৃত্ত হইল। শৈল আসিয়া কহিল, “হার মানিলাম, তোরই জিত–আমি তো পারিতাম না। ধন্যি মেয়ে! এই নে ভাই, কেন মিছে অভিশাপ কুড়াইব?” এই বলিয়া বিছানার উপরে চিঠিখানা ফেলিয়া উমিকে কমলার হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়া লইয়া চলিয়া গেল। লেফাফাটা লইয়া একটুখানি নাড়াচাড়া করিয়া কমলা চিঠিখানা খুলিল; প্রথম দুই-চারি লাইনের উপরে দৃষ্টিপাত করিয়াই তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিল। লজ্জায় সে চিঠিখানা একবার ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল। প্রথম ধাক্কার এই প্রবল বিতৃষ্ণার আক্ষেপ সামলাইয়া লইয়া আবার সেই চিঠি মাটি হইতে তুলিয়া সমস্তটা সে পড়িল। সমস্তটা সে ভালো করিয়া বুঝিল কি না বুঝিল জানি না; কিন্তু তার মনে হইল যেন সে হাতে করিয়া একটা পঙ্কিল পদার্থ নাড়িতেছে। চিঠিখানা আবার সে ফেলিয়া দিল। যে ব্যক্তি তাহার স্বামী নহে তাহারই ঘর করিতে হইবে, এইজন্য এই আহ্বান! রমেশ জানিয়া শুনিয়া এতদিন পরে তাহাকে এই অপমান করিল! গাজিপুরে আসিয়া রমেশের দিকে কমলা যে তাহার হৃদয় অগ্রসর করিয়া দিয়াছিল, সে কি রমেশ বলিয়া না তাহার স্বামী বলিয়া? রমেশ তাহাই লক্ষ্য করিয়াছিল, সেইজন্যেই অনাথার প্রতি দয়া করিয়া তাহাকে আজ এই ভালোবাসার চিঠি লিখিয়াছে। মিক্রমে রমেশের কাছে যেটুকু প্রকাশ পাইয়াছিল সেটুকু কমলা আজ কেমন করিয়া ফিরাইয়া লইবে–কেমন করিয়া! এমন লজ্জা, এমন ঘৃণা কমলার অদৃষ্টে কেন ঘটিল! সে জন্মগ্রহণ করিয়া কাহার কাছে কী অপরাধ করিয়াছে? এবারে ‘ঘর’ বলিয়া একটা বীভৎস জিনিস কমলাকে গ্রাস করিতে আসিতেছে, কমলা কেমন করিয়া রক্ষা পাইবে! রমেশ যে তাহার কাছে এতবড়ো বিভীষিকা হইয়া উঠিবে, দুই দিন আগে তাহা কি কমলা স্বপ্নেও কল্পনা করিতে পারিত? ইতিমধ্যে দ্বারের কাছে উমেশ আসিয়া একটুখানি কাসিল। কমলার কাছে কোনো সাড়া না পাইয়া সে আস্তে আস্তে ডাকিল, “মা!” কমলা দ্বারের কাছে আসিল, উমেশ মাথা চুলকাইয়া বলিল, “মা, আজ সিধুবাবুরা মেয়ের বিবাহে কলিকাতা হইতে একটা যাত্রার দল আনাইয়াছেন।” কমলা কহিল, “বেশ তো উমেশ, তুই যাত্রা শুনতে যাস।” উমেশ। কাল সকালে কি ফুল তুলিয়া আনিয়া দিতে হইবে? কমলা। না না, ফুলের দরকার নেই। উমেশ যখন চলিয়া যাইতেছিল হঠাৎ কমলা তাহাকে ফিরিয়া ডাকিল; কহিল, “ও উমেশ, তুই যাত্রা শুনিতে যাইতেছিস, এই নে, পাঁচটা টাকা নে।” উমেশ আশ্চর্য হইয়া গেল। যাত্রা শুনিবার সঙ্গে পাঁচটা টাকার কী যোগ তাহা সে কিছুই বুঝিতে পারিল না। কহিল, “মা, শহর হইতে কি তোমার জন্য কিছু কিনিয়া আনিতে হইবে?” কমলা। না না, আমার কিছুই চাই নে। তুই রাখিয়া দে, তোর কাজে লাগিবে। হতবুদ্ধি উমেশ চলিয়া যাইবার উপক্রম করিলে কমলা আবার তাহাকে ডাকিয়া কহিল, “উমেশ, তুই এই কাপড় পরিয়া যাত্রা শুনিতে যাইবি নাকি, তোকে লোকে বলিবে কী?” লোকে যে উমেশের নিকট সাজসজ্জা সম্বন্ধে অত্যন্ত বেশি প্রত্যাশা করে এবং ত্রুটি দেখিলে আলোচনা করিয়া থাকে, উমেশের এরূপ ধারণা ছিল না–এই কারণে ধুতির শুতি ও উত্তরচ্ছদের একান্ত অভাব সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল। কমলার প্রশ্ন শুনিয়া উমেশ কিছু না বলিয়া একটুখানি হাসিল। কমলা তাহার দুই জোড়া শাড়ি বাহির করিয়া উমেশের কাছে ফেলিয়া দিয়া কহিল, “এই নে, যা, পরিস।” শাড়ির চওড়া বাহারে পাড় দেখিয়া উমেশ অত্যন্ত উৎফুল্ল হইয়া উঠিল, কমলার পায়ের কাছে পড়িয়া ঢিপ করিয়া প্রণাম করিল, এবং হাস্যদমনের বৃথা চেষ্টায় সমস্ত মুখখানাকে বিকৃত করিয়া চলিয়া গেল। উমেশ চলিয়া গেলে কমলা দুই ফোঁটা চোখের জল মুছিয়া জানালার কাছে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। শৈল ঘরে প্রবেশ করিয়া কহিল, “ভাই কমল, আমাকে তোর চিঠি দেখাবি নে?” কমলার কাছে শৈলর তো কিছুই গোপন ছিল না, তাই শৈল এতদিন পরে সুযোগ পাইয়া এই দাবি করিল। কমলা কহিল, “ওই-যে দিদি, দেখো-না।” বলিয়া, মেজের উপরে চিঠি পড়িয়া ছিল, দেখাইয়া দিল। শৈল আশ্চর্য হইয়া ভাবিল, ‘বাস্‌ রে, এখনো রাগ যায় নাই!’ মাটি হইতে শৈল চিঠি তুলিয়া লইয়া সমস্তটা পড়িল। চিঠিতে ভালোবাসার কথা যথেষ্ট আছে বটে, কিন্তু তবু এ কেমনতরো চিঠি! মানুষ আপনার স্ত্রীকে এমনি করিয়া চিঠি লেখে! এ যেন কী-এক-রকম! শৈল জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা ভাই, তোমার স্বামী কি নভেল লেখেন?” “স্বামী” শব্দটা শুনিয়া চকিতের মধ্যে কমলার দেহমন যেন সংকুচিত হইয়া গেল। সে কহিল, “জানি না।” শৈল কহিল, “তা হলে আজ তুমি বাংলাতেই যাইবে?” কমলা মাথা নাড়িয়া জানাইল যে, যাইবে। শৈল কহিল, “আমিও আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত তোমার সঙ্গে থাকিতে পারিতাম, কিন্তু জান তো ভাই, আজ নরসিংবাবুর বউ আসিবে। মা বরঞ্চ তোমার সঙ্গে যান।” কমলা ব্যস্ত হইয়া কহিল, “না না, মা গিয়া কী করিবেন? সেখানে তো চাকর আছে।” শৈল হাসিয়া কহিল, “আর তোমার বাহন উমেশ আছে, তোমার ভয় কী?” উমা তখন কাহার একটা পেনসিল সংগ্রহ করিয়া যেখানে-সেখানে আঁচড় কাটিতেছিল এবং চিৎকার করিয়া অব্যক্ত ভাষা উচ্চারণ করিতেছিল, মনে করিতেছিল ‘পড়িতেছি।’ শৈল তাহার এই সাহিত্যরচনা হইতে তাহাকে বলপূর্বক কাড়িয়া লইল; সে যখন প্রবল তারস্বরে আপত্তিপ্রকাশ করিল, কমলা বলিল, “একটা
false
humayun_ahmed
করবেন। কেউ তোমাকে নিয়ে ঠাট্টা করলে আমার ভাল লাগে না। আসিফ বলল, তোমার প্লেন তো সেই রাতে। সারাদিন তোমার মার বাসায় কি করবে? তার চেয়ে চল, ঐ ব্রিটিশ মহিলা কি বলেন শুনি। অনেক শেখার ব্যাপার থাকতে পারে। শেখার ব্যাপার থাকলে তুমি শেখ। আমার আর কিছু শিখতে ইচ্ছা করছে না। আসিফ ইতস্তত করে বলল, তোমার সঙ্গে টাকা-পয়সা বিশেষ কিছু দিতে পারলাম না। কিছু মনে কর না লীনা। যা দরকার লাগে, তুমি তোমার দুলাভাইয়ের কাছ থেকে নিও, আমি পরে ব্যবস্থা করব। লীনা বলল, সঙ্গে যা আছে, যথেষ্টই আছে। ঐ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার জন্যে কি আনব বল। একটা কাজ করা পাঞ্জাবি আর জয়পুরী স্যান্ডেল। আর কিছু? আর কিছু না। নাটকের ওপর বইপত্র যদি কিছু পাই, আনব না? অবশ্যই আনবে। লীনা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। আসিফ বলল, হাসছ কেন? এমনি হাসছি। এটা যদি অভিনয়ের দৃশ্য হত, তাহলে বোধহয় হাসাটা ঠিক হত না। তাই না? কি বলছ তুমি বুঝতে পারছি না। আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। আজ ভোর থেকে মাথার মধ্যে শুধু আবোল-তবোেল চিন্তা ঢুকছে। দেশের বাইরে যাচ্ছি, সে জন্যেই বোধ হয়। দেশের বাইরে তো কখনো যাইনি। তোমার শরীর ঠিক আছে তো? শরীর ঠিক আছে? তুমি কেন জানি আজ অতিরিক্ত রকমের গম্ভীর হয়ে আছে। কী ব্যাপার লীনা? লীনা বলল, একটু অপেক্ষা কর। ব্যাগটা গুছিয়ে নিই, তারপর হাসি মুখে তোমার সঙ্গে গল্প করব। তুমি চাইলে জানালা বন্ধ করে, দরজার পর্দা ফেলে ঘর একটু আঁধার করে নেব। তারপর দুজনে মুখোমুখি, গভীর দুঃখে দুঃখি, আঁধারে ঢাকিয়া গেছে আর সব। আসিফ তাকিয়ে আছে। লীনা হাসছে তরল ভঙ্গিতে। ব্রিটিশ মহিলার বক্তৃতা আসিফের মোটেই ভাল লাগল না। প্রথমত কথা বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে প্রতিটি শব্দ তিনি খানিকক্ষণ চিবিয়ে ছোবড়া বানিয়ে বলছেন। যা বলছেন, তার সঙ্গে অভিনয়ের যোগ তেমন নেই বলেই আসিফের ধারণা। ভদ্রমহিলা বলছেন সেন্টজের ব্যাকগ্রাউন্ডের আলো এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিকের সমন্বয় বিষয়ে। সবটাই মনে হচ্ছে কচকচানি থিওরি। সিমিট্রি রেখে কি করে সিমিট্রি ভাঙতে হবে, এই সব বিষয়। ডায়নামিক ড্রামা এবং স্ট্যাটিক ড্রামার সঙ্গে আলো এবং শব্দের সম্পর্ক। এক পর্যায়ে ভদ্রমহিলা ব্ল্যাকবোর্ডে হাবিজাবি ইকোয়েশন লিখতে শুরু করলেন। আসিফের পাশে লিটল ঢাকা গ্রুপের মন্তাজ, সাহেব বসেছিলেন। তিনি নিতান্ত বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে বললেন, এই হারামজাদী তো মনে হচ্ছে বিরাট ফাজিল। এ তো দেখি অংক করছে! আসিফের কাছেও সমস্ত ব্যাপারটা বোগাস বলেই মনে হচ্ছে। উঠে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। সে বসেছে মাঝামাঝি জায়গায়, এখান থেকে চলে যাওয়া মুশকিল। একজন উঠে দাঁড়িয়েছিল, ভদ্রমহিলা তার দিকে তাকিয়ে খড়খড়ে গলায় বললেন, আমি কী আমার কথায় আপনাকে আকৃষ্ট করতে পারছি না? কথায় না পারলেও রূপে তো আপনাকে আটকে ফেলার কথা। আমি কি যথেষ্ট রূপবতী নই? চারদিকে তুমুল হাসির মধ্যে ভদ্রলোককে মুখ কাচুমাচু করে বসে পড়তে হল। এ রকম অবস্থায় হলঘর ছেড়ে উঠে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ভদ্রমহিলার বক্তৃতার প্রথম পর্ব শেষ হল এক ঘণ্টা পর। আসিফের কাছে মনে হল, সে অনন্তকাল ধরে এই চেয়ারে বসে আছে। বক্তৃতার দ্বিতীয় পৰ্ব শোনার মত মনের জোর পাচ্ছে না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, দ্বিতীয় পর্ব হল অসাধারণ। ভদ্রমহিলা কিছু ছবি বানিয়ে নিয়ে এসেছেন। অভিনয় অংশ প্রতিটিতেই এক। হুঁবহু এক, কিন্তু আলো এবং শব্দের মিশ্রণ একেকটা একেক রকম। শুধু এই কারণে কেমন বদলে যাচ্ছে–অর্থ অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। এই ব্যাপারটা ছবি দেখাতে দেখাতে ভদ্রমহিলা ব্যাখ্যা করছেন। দেখুন, নাটক শুরু হয় গীর্জায়। ধর্মযাজকরা গীর্জায় নাটকের মাধ্যমে লোকদের ধর্ম শিক্ষা দিতেন। তার মানে এই নয় যে, নাটক ব্যাপারটায় ঐশ্বরিক কিছু আছে। কিছুই নেই। নাটকের মাধ্যমে আমরা মানুষের মনে আবেগ তৈরি করি। নাটকের গবেষকরা এখন কাজ করছেন আবেগ তৈরির মেকানিজম নিয়ে। নাটক তার রহস্যময়ত হারাতে বসেছে। এখন আমরা আবেগের ব্যাপারটা বিজ্ঞানের চোখে দেখতে শুরু করেছি। বিজ্ঞানের কাছে হৃদয় কিন্তু একটা রক্ত পাম্প করার যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। আসিফ মুগ্ধ হয়ে গেল। বারবার মনে হল, লীনা পাশে থাকলে চমৎকার হত। একটা চমৎকার জিনিস বেচারি মিস করল। আসিফের খুব ইচ্ছা করছিল ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করে … আধুনিক কালের নাটকে কী অভিনেতা-অভিনেত্রীর গুরুত্ব কমে আসবে? গুছিয়ে ইংরেজিটা তৈরি করতে পারল না বলে জিজ্ঞেস করতে পারল না। লিটল ঢাকার মন্তাজ সাহেব বলতে বাধ্য হলেন, শালী জানে ভালই! শেষ দৃশ্যে এসে শালী জমিয়ে দিয়েছে। কি বলেন আসিফ সাহেব? আসিফ কিছু বলল না। তার মনে এক ধরনের মুগ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কথা বলে এই মুগ্ধতা সে নষ্ট করতে চায় না। সারাদিনেও তার মুগ্ধতা কাটল না। কানে বাজতে লাগল রূপবতী মহিলার চমৎকার ব্যাখ্যা। একের পর এক যুক্তির ইট বিছিয়ে বিশাল ইমারত তৈরি করা। অবশ্যি মাঝে মাঝে এইসব যুক্তিতে ভুল-থাকে। ভুল যুক্তির ইটে বিশাল ইমরাতও তৈরি হয়। এক সময় সেই ভুল ধরা পড়ে। সুবিশাল প্রাসাদ মুহূর্তে ধসে যায়। আসিফের সারাদিন কিছুই করার ছিল না। অনেক দিন পর দুপুরে টানা ঘুম দিল। ঘুম থেকে জেগে৷ উঠে মনে হল। লীনার সঙ্গে শেষবারের মত দেখা করে এলে কেমন হয়। এই চিন্তাও দীর্ঘস্থায়ী হল না। লীনার কাছে যাওয়া মানেই এমন অনেকের সঙ্গে দেখা হওয়া, যাদের সঙ্গে তার ভাল লাগে না। তারচে লীনা নেই, এই ধরনের বিরহ ভাল
false
toslima_nasrin
বেগমরে বাড়িত তুলে, তাইলে তো আর কারও না হোক, মেয়েদুইটার কষ্ট হবে! নানির বাড়িতে যাওয়ার আসার পথে দেখি আজিজ প্রিন্টাসর্ নামে একটি ছাপাখানা।রিক্সা থামিয়ে সেই ছাপখানায় নেমে ডিমাই সাইজ প্রতি ফর্মা ছাপতে খর্চা কত জেনে আসি। এরপর দাদার কাছে টাকা চেয়ে কাগজ কিনে ছাপাখানায় দিয়ে ওখানে বসেই সেঁজুতির দ্বিতীয় সংখ্যার প্রুফ দেখি। মোহাম্মদ আজিজ নামের লোকটি ছাপাখানার মালিক, দাদা চেনেন তাঁকে, দাদাও মাঝে মাঝে দেখে আসেন ছাপা কদ্দুর। একদিন ছাপার বাকি খরচ দিয়ে বাড়িতে সেঁজুতি নিয়ে আসেন। সেঁজুতি এবার শাদা কাগজে, দাদা একটি কপি হাতে নিয়ে বললেন, নাহ, ছাপা ভাল হয় নাই। এরপর থেইকা জমানে ছাপাইস। জমান হইল সবচেয়ে ভাল প্রেস। পাতা পত্রিকা ত জমান থেইকাই ছাপতাম। দাদা যখন তাঁর এককালের পাতার কথা স্মরণ করেন, তাঁর চোখ থেকে ঝিলমিল আনন্দ ঝরে। পাতা নামে দাদা আর তাঁর বন্ধুরা মিলে যে সাহিত্যের কাগজ প্রকাশ করতেন, তা আসলেই খুব সুন্দর ছিল। পাতার চিঠি লেখার কাগজ, এমনকি সদস্য হওয়ার কাগজ, সদস্যচাঁদা নেওয়ার রশিদ এসবও ছাপা ছিল চমৎকার জলছাপঅলা, দাদা এখনও স্মৃতি হিসেবে পাতার কাগজপত্র রেখে দিয়েছেন কাছে। মাঝে মাঝে বের করে ধুলো ঝেড়ে হাত বুলোন আর বলেন, দেখিস পাতা আমরা আবার ছাপাইয়াম। যে তিনজন পাতা ছাপতেন তার মধ্যে একজন শীলার ভাই, শীলার সঙ্গে দাদার প্রেম হওয়াতে চিকন ফরহাদ দাদার মখু দর্শন করা বন্ধ করে দিয়েছেন, আরেকজন মাহবুব, ও ছেলে পাগল হয়ে এখন মানসিক রোগীর হাসপাতালে শেকল দিয়ে বাধাঁ। দাদা একটি কেন দশটি সাহিত্যপত্রিকা ছাপতে পারেন ইচ্ছে করলে কিন্তু পাতা নামটি ব্যবহার করতে পারবেন না। পাতা দাদার একার সম্পত্তি নয়। দাদা ছিলেন যগু ্ম সম্পাদক, আসল সম্পাদক ছিলেন ফরহাদ। দাদা বলেন, ফরহাদ আর কি করত, সব ত আমিই করতাম! তা বলে স্বস্তি জোটে অবশ্য, কিন্তু কোনও পত্রিকার নাম পাতা দেওয়ার অধিকার জোটে না। দাদা আবার পত্রিকা বের করতে চান পাতা নামে, খবরটি শুনে ফরহাদ জানিয়ে দিয়েছেন, দাদার বিরুদ্ধে তিনি মামলা করবেন। আমি যখন সেঁজুতিতে ডুবে আছি, একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে বাড়িতে। ইয়াসমিনের পিঠে ছোট্ট একটি পাখা গজায়। পাখা গজানোটি ভয়ঙ্কর নয়, পাখা গজানোর কারণে যেটি ঘটে, সেটি ভয়ঙ্কর। ইয়াসমিনের এই পাখি হওয়ার ইচ্ছে কোনও ভারত বাংলাদেশ সীমানা অতিক্রম করার জন্য নয়, তার নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে একদিন খুব গোপনে উড়ে যাওয়ার জন্য। পাড়ার ফুটফুটে ছেলে বাদল, ইয়াসমিনেরই সমবয়সী, দাঁড়িয়ে থাকত রাস্তায় ইয়াসমিন যখন ইশকুলে যেত, একদিন সাহস করে এগিয়ে এসে কথা বলেছে। রাস্তায় কথা বললে আবার কে না কে দেখে ফেলে কি না কি কাণ্ড ঘটায়, তাই পরদিন সে ইয়াসমিনকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যেতে বলে। গণ্ডি থেকে বেরোবার এমন তীব্র আকর্ষণ ইয়াসমিনের, সে ইশকুল শেষে একটি রিক্সা নিয়ে সোজা সেই গার্ডেনে যায়। বাদল গিয়েছিল তার এক কাকাকে নিয়ে। সেই কাকা বাদল আর ইয়াসমিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, গাছপালা দেখছে, বাগান জুড়ে ফুটে থাকা নানা রঙের ফুল দেখছে, নদী দেখছে, কিন্তু দেখছে না ওদের দেখে পাড়ার একটি ছেলের বাবাকে খবর দেওয়ার জন্য দৌড়ে যাওয়া। খবর পেয়ে বাবা এক মুহূতর্ দেরি না করে সেই গার্ডেনে নিজে গিয়ে ধরে আনেন ওদের। বাদলকে চুলের মুঠি ধরে বাড়িতে এনে হাত পা শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে বারান্দার ঘরে সারা বিকেল চাবকেছেন বাবা। বাদলের আর্তনাদে সারা পাড়া কেঁপেছে, বাবা পরোয়া করেননি। অর্ধমৃত বাদলকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বাড়ির বের করেন, তাও আবার পুলিশের হাতে দিতে। মেয়ে-কিডন্যাপের মামলা ঠোকেন সেদিনই, বাদলকে কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। জেল থেকে ছেলে ফিরে এলে এ পাড়া ছেড়ে বাদলের বাবা সমীরণ দত্ত চলে যান। কেবল বাদলকেই নয়, ইয়াসমিনকে ঘরের দরজা বন্ধ করে বাবা মেরেছেন একই চাবুকে।ওর শরীরের একটি ইঞ্চিও বাদ ছিল না কালসিটে দাগ থেকে। হু হু করে জ্বর আসে ওর, মাথার ঘন কালো চুল মুঠো মুঠো উঠে আসতে থাকে। এই ঘটনার পর ইয়াসমিন প্রায়ই ইশকুল থেকে ফিরে মন খারাপ করে বসে থাকে। ইশকুলে ওর ক্লাসের মেয়েরা বলতে শুরু করেছে, তুই নাকি কোন ছেড়ার সাথে ভাইগ্যা গেছিলি গা? ময়মনসিংহকে খুব বড় শহর বলে মনে হয়, কিন্তু লোকে যখন রসের গল্প বলতে গিয়ে, রজব আলীর ছোট মেয়ে একটা ছেলের সাথে ভাইগ্যা গেছিল, হাহা হিহি বলে আর এসব আমার কানেও যখন আসে, বুঝি শহরটি বড় ছোট। মানুষের মনও বড় ছোট। বাবা যদি সেদিন ওই ঘটনাটি না ঘটাতেন, ইয়াসমিন ওই গার্ডেন থেকে ফিরে আসত বাড়িতে, দেরি হইছে কেন ইশকুল থেইকা ফিরতে জিজ্ঞেস করলে হয়ত বলত, রিংকুর বাসায় গেছিলাম। ওর বান্ধবী রিংকু ইশকুল শেষ হলে রিংকুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসা এমন কোনও অপরাধ নয়। সেদিন ইয়াসমিনের কৌতূহল বাদলের জন্য যত ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল গার্ডেনের জন্য। সেই গার্ডেন একবার দেখা হয়ে যাওয়ার পর ওর গার্ডেনের শখ হয়তো মিটত, গোপনে গোপনে গণ্ডির বাইরে যাওয়ার আনন্দ ও পুষে রাখত নিজের ভেতর। কেউই ইয়াসমিনের দিকে ছুঁড়ে দিত না কোনও ছেড়ার সাথে ভাইগ্যা যাওয়ার জন্য ঘণৃা। ইয়াসমিন নিজেকে এমন অপরাধী ভাবত না, সকলের চক্ষু থেকে এমন প্রাণপণে লুকোতে চাইত না নিজেকে। গীতা টুলুকে কিছু দিয়েছে, বস্তায় করে। ছোট্ট খবর। এই খবরটি বাবার কানে পৌঁছয়। বাবা দাপাদাপি করেন ঘরে। ফিসফিস কণ্ঠ, কি দিছে রে কি দিছে? কি
false
shomresh
যে তিনি একানে একজন সাজেন্টকে পাঠিয়েছেন তা ইতিমধ্যে ম্যাডাম জেনে গেছেন। ভার্গিস ধীরে ধীরে বাংলোর সামনে জিপটা রাখতেই ম্যাডামকে দেখতে পেলেন। ওপাশে একটা বেতের চেয়ারে বসে আছেন টেবিলে দুই পা তুলে। চোখে বড় সানগ্লাস। গাড়ির শব্দে চোখ ফেরালেন না। ভার্গিস জানেন ম্যাডাম এখানে একা আসেনি। ওঁর দেহরক্ষী কাম ড্রাইভার নিশ্চয়ই ধারে কাছে আছে। ভার্গিস জিপ থেকে নেমে কাছে এগিয়ে গেলেন, গুড আফটারনুন ম্যাডাম। ম্যাডামের মাথা ঈষৎ নড়ল। পা না সরিয়ে তিনি বললেন, বসন্তলালের পছন্দ ছিল। জায়গাটা দারুণ! ভার্গিস কি বলবেন ভেবে পেলেন না। এই সময়ে জায়গার তারিফ করা কেন? তিনি মুখ ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন চারপাশ। সার্জেন্ট কিংবা চৌকিদারটাকে দেখা যাচ্ছে না। ম্যাডাম কি বাংলোর ভেতরে ঢুকছেন? বারান্দার ওপাশে দরজাগুলো এখন বন্ধ। আপনি অবশ্য এসব কোনও দিন বুঝলেন না। ম্যাডাম পা নামালেন। চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললেন, মিস্টার ভার্গিস, আপনার জীবনে শুনেছি কখনই রোমান্স আসেনি? ভার্গিসের গলা বুজে, এল, আসলে, ম্যাডাম, সার্ভিসে ঢুকেছিলাম অল্প বয়সে। এটাই মন দিয়ে করতে কখন যে বয়স হয়ে গেল তা বুঝতে পারিনি। কত বয়স অ্যাপনার? ফিফটি ফোর। বোম্বেতে শুনেছি। ওই বয়সের অভিনেতা নায়ক হয়। আপনি শোনেননি? আমি মানে, ফিল্ম সম্পর্কে কিছুই জানি না। ভার্গিস স্বীকার করলেন। আকাশলালকে ওরা কবর থেকে তুলে কিভাবে সরাল? হঠাৎই ম্যাডাম কাজের কথায় চলে আসায় ভার্গিস সোজা হলেন, আমরা সন্দেহ করেছিলাম অ্যামুলেন্স নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কারফিউ-এর সময় অন্য গাড়িকে রাস্তায় অ্যালাউ করা হয় না। শহরে যে-কটা অ্যাম্বুলেন্স আছে খোঁজ নিয়েছেন? হ্যাঁ। যে অ্যাম্বুলেন্সটিকে আটকানো হয়েছিল সেটা নাকি লেডি প্রধানের কল পেয়ে গিয়েছিল। ভদ্রমহিলা খুবই অসুস্থ। লেডি অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে যাবেন, এটা ভাবতে পারেন? না ম্যাডাম। কিন্তু লেডির সঙ্গে কথা বলা যাবে না এখন। ওঁর বাড়ির লোকদের জেরা করার অর্ডার দিয়ে এসেছি। গুড। লোকটাকে এনেছেন? হ্যাঁ। আমার জিপে আছে। নিয়ে আসুন এখানে। ভার্গিস ফিরে গেলেন জিপের পাশে। ডেভিডকে হুকুম করলেন নেমে আসতে। ডেভিড ভদ্রমহিলাকে লক্ষ করছিল। এখানে তাকে কেন নিয়ে আসা হয়েছে তা সে বুঝতে পারছিল না। ডেভিড কাছে যেতেই ম্যাডাম উঠে দাঁড়ালেন, হ্যালো! আপনি ডেভিড? হ্যাঁ। বসুন। মিস্টার ভার্গিস, আমরা কি কথা বলতে পারি? অ্যাঁ? ভার্গিস প্রথমে বুঝতে পারেননি। আমরা একটু কথা বলতে চাই। আপনি ততক্ষণে জায়গাটাকে দেখুন। বলা যায় না। এই ফিফটি ফোরেও নতুন করে সব কিছু শুরু করতে পারেন। ম্যাডাম শব্দ করে হাসলেন। অর্থাৎ ওঁকে সরে যেতে বলা হচ্ছে। এটা বেআইনি। ম্যাডাম সরকারের কেউ নন। তাঁর সঙ্গে এত বড় অপরাধীকে একা রেখে যাওয়ার জন্য তাকে জবাবদিহি হতে পারে। কিন্তু একথাও ঠিক, ম্যাডাম ছাড়া তার কোনও অবলম্বন নেই। ভার্গিসের মনে হল তার সমনে একটা সুযোগ এসেছে। হাতকড়া থাকায় ডেভিডের পক্ষে পালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু তিনি এই ফাঁকে বাংলোটাকে সার্ভে করে নিতে পারেন। যদি সার্জেন্ট চৌকিদারকে নিয়ে এর ভেতরে লুকিয়ে থাকে তাহলে তাদের সরাবার ব্যবস্থা করতে পারবেন। ভার্গিস হাঁটতে শুরু করলে ম্যাডাম বললেন, আপনাকে বসতে বলেছি। ডেভিড বসল। এতক্ষণে সে ভদ্র মহিলাকে চিনতে পেরেছে। এই রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাবতী মহিলা। এর আঙুলের ইশারায় সব কিছু হতে পারে। ম্যাডাম চেয়ারে বসে বললেন, আকাশলালকে নিয়ে গিয়ে কি করবেন? আমি জানি না। তার মানে? কোনও মৃত মানুষকে নতুন করে কবর দেবার জন্যে কেউ এমন ঝুঁকি নেয় না। আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না। ঠিক আছে, আপনি চাইলে আমি বুঝিয়ে দেব। তার আগে বলুন আমাদের মধ্যে কি ধরনের সম্পর্কে হবে? আপনি আমার বন্ধুত্ব চান? ঠোঁটের কোণে মদির ভাঁজ ফেললেন ম্যাডাম। ধরা পড়ার পর থেকে এতক্ষণ যেভাবে কেটেছে, এই মুহূর্তটি তার সম্পূর্ণ বিপরীত। ওই হাসিটি ডেভিডকে বেশ নাড়া দিল। তবু সে বলল, বন্ধুত্ব সমানে সমানে হয়। ঠিক কথা। আর হয় নারী এবং পুরুষে। তাই না? এবার হাসিটা আরও একটু জোরে। এত হাসি ও রকম একটা দেশদ্রোহীর সঙ্গে কিভাবে হাসছে? মানুষ হাসি শুনেই পেটের সব কথা উগরে দিত। তাহলে টর্চার-শেল তুলে দিতে হত বাহিনী থেকে। ভাঙা কাচের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন ভার্গিস। চাপ দিলেন। কিন্তু ওটা খুলল না। অতএব ভাঙা জায়গা দিয়ে হাত ঢোকাতে ছিটিকিনি পেয়ে গেলেন। যে কেউ বাইরে এসে এইভাবে দরজা বন্ধ করে চলে যেতে পারে। ভার্গিস ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। লনের দুটো মানুষ এখন নিজেদের কথা নিয়ে ব্যস্ত। তিনি দরজাটা ভেতরে ঢুকেই বন্ধ করে দিলেন। বাইরে তবু হাওয়ার শ্বদ ছিল, ভেতরে কোনও আওয়াজ নেই। ভার্গিস জানেন ওরা এখানেই লুকিয়ে আছে। হয়তো ম্যাডাম এসেছেন বলেই সামনে আসতে পারছে না। তিনি চাপা গলায় ডাকলেন, অফিসার কেউ সাড়া দিল না। ভার্গিস ধীরে ধীরে ঘরটি অতিক্রম করলেন। জানলাগুলোর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তার চোখ বাইরে লক্ষ করছিল। ম্যাডাম এবং ডেভিড কথা বলছে। ভার্গিস হাসলেন। ম্যাডামের শরীরে এখনও ওই কিসব বলে, সেসব আছে। কিন্তু লনের চেয়ারে বসে কথা বললে ডেভিড কতটা কাত হবে? দ্বিতীয় ঘরটি ডাইনিং কাম স্টোর রুম। লুকোবার জায়গা নেই। তৃতীয় ঘরটিতে একটা নাড়া তোশক রয়েছে খাটের ওপরে। ঘরটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। অ্যাসট্রেতে প্রচুর সন্তার সিগারেটের অবশিষ্ট। ঘরের একপাশে টেবিল চেয়ার। ভার্গিস টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন। কয়েকটা পেপারওয়েট আর একটা কলমদানি ছাড়া টেবিলে কিছু নেই। লোক দুটো গেল কোথায়? ম্যাডামকে দেখে জঙ্গলে পালিয়ে যায়নি তো? যেতে পারত যদি সার্জেন্ট একা
false
humayun_ahmed
দিয়ে আপনার প্রয়োজন কি? ধরে নিন আমি মন্ত্রী মহোদয়ের পি এস। আপনার নাম বলেন। আপনাকে নাম বলতে যাব কেন? বদরুলের কথা শুনে সেই লোক চায়ের কাপ মেঝেতে রেখে শান্ত ভঙ্গিতে উঠে এল। বদরুল কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রচণ্ড শব্দে চড় বসালো। বদরুল ছিটকে পেছনের বেঞ্চে পড়ে গেল। বসে থাকা সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। বডি বিল্ডার টাইপ লোকটা বলল, এখন প্রশ্ন করলে জবাব দিবে। তেড়িবেড়ি করবে না। তোর নাম কি? বদরুলের কপাল ফেটে গেছে। টপটপ করে রক্ত পড়ছে। সে কপালের রক্ত মুছে হতভম্ব গলায় বলল, এইসব কি? আপনারা সবাই আন্ডার এ্যারেস্ট। এক্ষুনি রেল পুলিশ আসবে। সবাইকে ডিটেনশনে যেতে হবে। এই হারামীর পুত যা জিজ্ঞেস করব জবাব দিবি তোর নাম কি? বদরুল। তুই করস কি? আমি ভিডিওম্যান। ভিডিও করি। সবুরের ভিডিও তুই করেছিস? এইবার তোর ভিডিও করা হবে। এই তোমরা হারামীর বাচ্চাটার জামা কাপড় খুলে ফেলে একে নেংটা করে ফেল। নেংটা ভিডিও হবে। বদরুল চেঁচিয়ে বলল, কি বলেন। এরে পুরো নেংটা করে ফিরত পাঠাও। তারা বুঝুক ঘটনা কি। বদরুল বলল, আমি মন্ত্রী মহোদয়ের লোক। রাখ ব্যাটা মন্ত্রী মহোদয়। তোর মন্ত্রীর পাছায় এখন বাঁশ। সে আর মন্ত্রী নাই। তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। তোকে নেংটা অবস্থায় ছাড়বো। তুই তোর মন্ত্রীকে বলবি সবুরকে যে কানে ধরে উঠবোস করিয়েছে তাকেও কানে ধরে উঠবোস করতে হবে। তোকে নেংটো অবস্থায় দেখলে তারা বুঝবে খবর ভালো না। আমরা মানুষ খারাপ। বদরুল বুঝতেই পারেনি যে তাকে সত্যি সত্যি নগ্ন করে ফেলা হবে। সে হা হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে থাকবি না যা। মন্ত্রী মহোদয় তোকে যেন ঠিকমতো দেখতে পায় সে জন্যে কিছুক্ষণের জন্যে সেলুন কারে কারেন্ট দেয়া হবে। এই তুই রওনা হ। নেংটো, হাত দিয়ে ঢাকাঢাকি করার চেষ্টা করবি না। চেষ্টা করলে হাত কেটে ফেলে দিব। বদরুল কাতর গলায় বলল, আমি এইভাবে যেতে পারব না। ভাই আমি আপনাদের পায়ে ধরি। পায়ে ধরে লাভ নেই। তুই এখন রওনা দে। এখন রওনা না দিলে তোকে কি করা হবে সেটা তোর কানে কানে বলব, তুই সঙ্গে সঙ্গে রওনা হবি। দৌড়ায়া যাবি। হা হা হা। সবাই হাসছে। বদরুল আতংকে জমে গেল। ব্যাপারটা সত্যি ঘটেছে নাকি এটা কোনো ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন তা সে বুঝতে পারছে না। বডি বিল্ডার উঁচু গলায় বলল, সেলুন কারে কারেন্ট দাও। একজন কি একটা হাতলে চাপ দিল। সেলুন কারে বাতি জ্বলে উঠেছে। এক সঙ্গে সবাই হৈ হৈ করে উঠল। যমুনা হাত তালি দিচ্ছে। যমুনার দেখাদেখি অন্যরাও হাত তালি দিচ্ছে। ব্যান্ডের একজন অতি দ্রুত ড্রামে কয়েকটা বাড়ি দিল। বিপুল হাত তালির ভেতর বদরুল ঢুকল। সেলুন কারে হঠাৎ যেন বজ্রপাত হল। আশহাব মার পাশে বসে আছে। সাজেদা শান্ত। দেখে বুঝার উপায় নেই যে কিছুক্ষণ আগেও কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। তিনি হট পট খুলে খাবার বের করেছেন। পেপার প্লেট, নেপকিন বের হয়েছে। আচারের কৌটা, কাচামরিচ। আয়োজনে কোনো খুঁত নেই। একটা কাসুন্দির শিশিও দেখা যাচ্ছে। সাজেদা বললেন, বৌমা আবার কোথায় গেল। ঘরের বউ হুট হাট করে বেড়াতে বের হওয়া আমার পছন্দ নয়। বৌমাকে ডেকে আন। আশহাব বলল, মা তুমি বৌমা পেলে কোথায়? চিত্রা এই ট্রেনের একজন যাত্রী। কিছুক্ষণ আগে তার সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে। আমার সঙ্গে ফাজলামী করবি না। তোকে যা বলেছি কর। বৌমাকে ডেকে নিয়ে আয়। মা তুমি কি সত্যি ভাবছ সে তোমার বৌমা? না-কি ইচ্ছা করে একটা নাটক করছ? সাজেদা বললেন, তোর এতবড় সাহস? তুই এইভাবে আমার সঙ্গে কথা বলছিস? আমি আমার বৌমাকে চিনব না। মা তোমাকে দুটা ট্যাবলেট দিচ্ছি। ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়। তোমার ঘুম দরকার। আমার সঙ্গে ডাক্তারী ফলাচ্ছিস? ফেল করা ডাক্তার। ফেল করা ডাক্তার মানে? নকল করে ধরা পড়লি মনে নাই। প্রিন্সিপ্যাল তোকে বের করে দিল। মা তুমি এসব কি বলছ? তুই আমাকে দিয়ে প্রিন্সিপ্যালের পায়ে ধরালি। একজন মানুষের সামনে কতটা নিচু তুই আমাকে করলি। বদমাশ ছেলে। মা তোমার অবস্থাতো খুবই কাহিল। কি গল্প ফাঁদছ। এরকম গল্প তোমার মাথায় আসছে কেন? আমি দুটা সাবজেক্টে হাইয়েস্ট পাওয়া। গোল্ড মেডেল তোমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলাম। মনে নাই? মনে আছে। তাহলে এইসব কি বলছ? আর বলব না। মাথা কি ঠিক হয়েছে? হুঁ। হা কর মুখে ভাত দিয়ে দেই। আশহাব হা করল। সাজেদা ছেলের মুখে ভাত তুলে দিতে দিতে বললেন, আজ তুই আমার হাতে খাবি। তোর হাত নোংরা করার দরকার নেই। আশহাব কিছু বলল না। সাজেদা বললেন, তুই মাঝে মাঝে এমন গাধার মতো কাজ করিস। গাধার মতো কাজ কি করলাম? বৌমাকে নিয়ে প্রথম যাচ্ছিস তোরা দুজন যাবি এক কামরায় আমি যাব আলাদা। তা-না তিনজন এক সঙ্গে যাচ্ছি। বেচারী মনটাতো এই জন্যেই খারাপ করেছে। একটু পর পর তোর খুঁজে যাচ্ছে। ওর মনের ভাব আমি পরিস্কার বুঝতে পারছি। বুঝতে পারলে তো ভালো। মা আমাকে আর খাইয়ে দিতে হবে না। যথেষ্ট হয়েছে। এখন তুমি খাও। তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল। বৌমাকে রেখে আমি খেয়ে ফেললে সে কি মনে করবে। বাপ নেই, মা নেই একটা মেয়ে। স্নেহের কাঙ্গাল। আশহাব বিড় বিড় করে বলল, মহা বিপদ। সাজেদা বললেন, খাওয়া শেষ করে তুই বৌমাকে খুঁজে আনবি। আমি কামরা ছেড়ে দেব তোরা দুই
false
shunil_gongopaddhay
লঞ্চ সুন্দরবনে এসে ভিড়েছে, সে-কথা তুমি শোনোনি? কই না তো! কলকাতার এক ব্যবসাদার তার টাকাগুলো এখানকার এক ভেড়িতে আমায় পৌঁছে দিতে বলেছিল, তাই টাকাগুলো আমি সাবধানে লুকিয়ে নিয়ে আসছিলুম। আর আপনারা ভাবলেন আমি চোরাই জিনিসের কারবার করি! রণবীর ভট্টাচাৰ্য অট্টহাসি করে উঠলেন। তারপর মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এবারে বলুন তো, কাকাবাবু, আপনি এদিকে কেন এলেন। হঠাৎ? এইসব চোর-ডাকাত আর স্মাগলাররা তো নিছক চুনোপুটি, এদের ধরবার জন্য নিশ্চয়ই আপনি আসেননি। কাকাবাবু বললেন, না, আমি এসেছি। ঐ লঞ্চটা একবার নিজের চোখে দেখতে। আচ্ছ, সুন্দরবনে ঐ লঞ্চটাকে প্রথম কে দেখতে পায় বলো তো? রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, সেটা আকবর সাহেবই ভাল বলতে পারবেন। আকবর খান বললেন, আমরা প্ৰথমে খবর পাই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কাছ থেকে। দত্ত ফরেস্টের এক রেঞ্জার হরিণভাঙা নদীতে গিয়েছিল টহল দিতে, তখন এক জেলেনৌকো তাকে খবর দেয় যে, খাঁড়ির মুখে একটা লঞ্চ ভাসছে, ভেতরে কোনও মানুষজন নেই। সেই রেঞ্জারের নাম সুখেন্দু বিশ্বাস, সে-ই প্রথম লঞ্চটার কাছে যায়। রেঞ্জার প্রথমে লঞ্চের মধ্যে মানুষজনের গলার আওয়াজ শুনতে পায়। কেউ যেন বিদেশি ভাষায় কথা বলছে। একটু পরে সে বুঝতে পারে, ওটা আসলে রেডিও। কী ভাষায় রেডিওর প্রোগ্রাম চলছিল, তা রেঞ্জারবাবু বলেছে? না। সে বুঝতে পারেনি কোন ভাষা। লঞ্চের ভেতরের আর-সব জিনিসপত্র লুটপাট হয়ে গেল, কিন্তু রেডিওটা কেউ নিল না কেন? সেটা একটা কথা বটে! একটা বিদেশি রেডিও-র দাম তো নেহাত কম হবে না? রেঞ্জার লঞ্চটা দেখার পর কী করল? রেঞ্জার বুদ্ধিমানের মতোই কাজ করেছে। লঞ্চটা যেখানে ভাসছিল, সেখানে জল বেশি গভীর নয়। রেঞ্জার লঞ্চটাকে সেখান থেকে না সরিয়ে সেখানেই নোঙর ফেলে দেয়। তারপর খবর দেয় থানায়। এর মধ্যে আমি আর প্রশান্ত গিয়ে দেখে এসেছি লঞ্চটা। আজ সেটাকে গোসাবায় নিয়ে আসার কথা আছে। রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, এই সাধুজিকে একটা কেবিনে ভরে রাখো। এসো, গোসাবা পৌঁছনো পর্যন্ত আমরা একটু তাস খেলি। কাকাবাবু, খেলবেন নাকি? কাকাবাবু বললেন, না, তোমরা খেলো। আমি বরং ওপরে গিয়ে নদীর দৃশ্য দেখি। অনেকদিন এদিকে আসিনি। বিমান আর সন্তুও কাকাবাবুর সঙ্গে উঠে গেল ওপরের ডেকে। গোসাবা থানার দারোগা বললেন যে, প্রথমে দুজন লোককে পাঠানো হয়েছিল লঞ্চটা চালিয়ে নিয়ে আসবার জন্য। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। সেই লঞ্চটার ইঞ্জিনের কিছু কিছু অংশও নিশ্চয়ই চুরি গেছে। তারপর আর একটা লঞ্চ পাঠানো হল সেটাকে টেনে আনবার জন্য। কিন্তু সেই দ্বিতীয় লঞ্চটাও চড়ায় আটকে গেছে, তারা ওয়ারলেসে খবর পাঠিয়েছে। এখন জোয়ার এলে লঞ্চটা যদি জলে ভাসে তো ভালই, নইলে সেটাকে টানবার জন্য আবার একটা লঞ্চ পাঠাতে হবে! প্ৰশান্ত দত্ত রেগেমেগে বলল, যাঃ! এখানকার লোকদের দিয়ে কোনও কোজই ঠিকমতন হয় না! এখন উপায়? স্যার, আপনারা এতদূর এলেন— রণবীর ভট্টাচাৰ্য কিন্তু একটুও উত্তেজিত হলেন না। তিনি বললেন, দাঁড়াও, খিদে পেয়েছে, আগে খেয়ে নিই। দ্যাখো তো, যে-পার্শে মাছগুলো কেন হল, তার ঝোল রান্না হয়েছে কি না? লঞ্চে বসেই খাওয়া-দাওয়া সেরে নেওয়া হল। ভাত, ডাল, আলুসেদ্ধ, বেগুনভাজা আর মাছের ঝোল। খালাসিরা দারুণ রান্না করে। বিমান বলল, এমন টাটকা মাছের স্বাদই আলাদা। আমি আগে কোনওদিন এত ভাল মাছের ঝোল খাইনি। খাওয়ার পর একটা পান মুখে দিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে চিবোতে চিবোতে রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, এখন তা হলে কী করা যায়? ওহে প্ৰশান্ত গোসাবার টাইগার প্রজেক্টের একটা স্পিডবোট থাকে না? সেটা পাওয়া যাবে? দ্যাখো না, খোঁজ নিয়ে? গোসাবা থানার দারোগা বললেন, হ্যাঁ স্যার, পাওয়া যাবে। স্পিডবোটটা আজ সকালেই এসেছে রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, তবে এক কাজ করা যাক। আমি কাকাবাবু আর এদের নিয়ে স্পিডবোটটায় করে বিদেশি লঞ্চটা দেখে আসি। সেটা এখানে কতদিনে পৌঁছবে কে জানে! আমি সেটা ইনন্সপেকশান করতেই এসেছি। আকবর আর প্রশান্ত, তোমরা এখানে থেকে যাও! একটু গলা নামিয়ে তিনি আবার আকবর আর প্রশান্তকে বললেন, তোমরা এখানে থেকে যতগুলো পারো চোর-ডাকাত আর স্মাগলারদের রাউণ্ড আপ, করো। ঐ বিদেশি লঞ্চ থেকে যে-সব জিনিসপত্র খোয়া গেছে, তার দুএকটা অন্তত উদ্ধার করা চাই। নইলে লঞ্চের মালিক কে ছিল কিংবা কোন দেশের, তা বার করা শক্ত হবে। এই সাধুবাবাকে একটু চাপ দাও, ও নিশ্চয়ই চোরাই মালের সন্ধান দিতে পারবে। স্পিডবোটটায় চালক ছাড়া আর তিনজনের জায়গা আছে। রণবীর, কাকাবাবু, বিমান আর সন্তু তার মধ্যে এঁটে গেল কোনওক্রমে। কিন্তু রণবীর ভট্টাচার্যের সঙ্গে সব সময় দুজন সাদা পোশাকের বডিগার্ড থাকে। তাদের কিছুতেই জায়গা হবে না। রণবীর ভটাচার্য বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে বডিগার্ড দরকার নেই। ওরা এখানেই থাক। আমাদের আর কতক্ষণই বা লাগবে, স্পিডবোটে বড় জোর যাতায়াতে ঘন্টাতিনেক। নাও, এবার চালাও! স্পিডবোটটা স্টার্ট নিতে না নিতেই রকেটের মতন একেবারে সাঁ করে বেরিয়ে গেল। রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, সন্তু, শক্ত করে ধরে থেকে। একবার উল্টে জলে পড়ে গেলে আর রক্ষে নেই! বলতে বলতে ঝাঁকুনির চোটে তিনি নিজেই উল্টে পড়ে যাচ্ছিলেন, কাকাবাবু তাঁর কাঁধটা। চট করে ধরে ফেললেন। রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, আমি অবশ্য পড়ে গেলেও ক্ষতি ছিল না, আমি ভাল সাঁতার জানি। কিন্তু সন্তু সাঁতার জানো তো? সন্তু বেশ জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ! কাকাবাবু বললেন, সন্তুও সাঁতার জানে, বিমানও সাঁতার জানে। কিন্তু মুশকিল তো আমাকে নিয়েই। খোঁড়া পায়ে আমি তো আজকাল আর ভাল সাঁতার দিতে পারি না! আমি পাহাড়ে উঠতে পারি, কিন্তু জলে পড়ে গেলেই কাবু
false
shomresh
সঙ্গে প্রকাশ্যে তুই তোকারি করে নিজের মতামত জানিয়ে দেওয়া-ও যেন পঞ্চাশ দশকের বাঙালি মেয়ে নয়। মায়া বলছিল, আমাদের দেশের মেয়ের এককালে স্বাধীনতা সংগ্ৰাম করেছে। মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদার, এমন কত মহিলা। কিন্তু এখন চারপাশে তাকালে কেউ কি সেকথা বিশ্বাস করবে? দীপা জবাব দিয়েছিল, যেসব ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা মারে, মেয়েদের সিটি দেয়, যেসব লোক ব্যাগ হাতে করে অফিসে কেরানিগিরি করতে যায় অথবা যে বাঙালিরা টাকা রোজগারের ধাক্কায় ছুটে বেড়াচ্ছে তাদের দেখে কেউ কি বলবে। একজন সুভাষচন্দ্র এদের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছিলেন? ওয়েল সেইড। মায়া ওর হাত চেপে ধরেছিল, আমি একচোখা হয়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা দীপা, তোমার এদেশের রাজনীতি সম্পর্কে কি ধারণা। কোন ধারণা নেই। তুমি কম্যুনিজম নিয়ে পড়াশুনা করেছ। কখনও? না। সেই সুযোগ পাইনি পড়তে চাও? আপত্তি নেই। আমি তোমাকে পড়তে দেব। আমি বিশ্বাস করি ভারতবর্ষের মানুষের স্বাধীনতা উনিশ শো সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্ট হয়নি। একমাত্র কম্যুনিজমের আদর্শ এদেশে প্রতিষ্ঠা হলেই মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা আসবে। কম্যুনিস্টরা দেশকে স্বাধীন করবে? মানুষকে। তুমি আমাদের ইউনিয়ন অফিসে এসো না। না মায়া, আমি রাজনীতিতে জড়াতে চাই না। কিন্তু রাজনীতি ছাড়া কোন আধুনিক মানুষ বাঁচতে পারে না। ধব, তুমি কোন সৃষ্টি করতে চলেছ এবং তার জন্যে তোমার একটা অনুকুল পরিবেশ পাওয়া দরকার। স্বাথাম্বেষী কোন দল ক্ষমতায় থেকে সেই পরিবেশ তৈরী হতে দিচ্ছে না। তোমার সক্রিয় সমর্থনে কম্যুনিজম সেই পরিবেশ এনে দিতে পারে। অথাৎ মানুষ তার অধিকার অর্জন করতে পারে কম্যুনিজমের মাধ্যমেই। এ নিয়ে তর্ক করা যায়। আমি কম্যুনিজমরিরোধী নই। তবে এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেছিল মহাত্মা গান্ধীকে। কারণ কম্যুনিজমে বিশ্বাসীরা এদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে তেমন অংশ নেয়নি। কংগ্রেস খারাপ ভাবলে মানুষ তখন তার ডাকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসত না। মানুষ ভেবেছিল তাদের মুক্তি আসবে কংগ্রেসের মাধ্যমেই। রাজনীতি বড় গোলমেলে জিনিস, আমার এনিয়ে ভাবতে ভাল লাগে না। বরং মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলেই আমার অনেক কিছু নিয়ে ভাবার আছে। যেমন? মায়া উৎসুক হল। আমরা এমন কিছু সংস্কার বা ধারণা নিয়ে যুগ যুগ ধরে জীবনযাপন করছি। যার পেছনে কোন যুক্তি নেই। আমি মফস্বলের মেয়ে সেখানকার পরিবেশে অনেক কিছু করা এখনও সম্ভব নয়। কিন্তু কলকাতার মত বড় শহরে সেটা কেন মানা হবে? এখানে তো কেউ কাউকে চেনে না, তাহলে লোকলজ্জা বাধা হয়ে দাঁড়াবে কেন? তুমি কি ব্যাপারে কথা বলছি দীপাবলী? মেয়েদের জীবনযাত্ৰা নিয়ে। কয়েকজন অভিভাবক প্ৰিন্সিপ্যালের কাছে অভিযোগ করলেন তাঁদের মেয়েদের বিরক্ত করা হয়েছে। প্ৰিন্সিপ্যাল সেই মেয়েদের ডেকে জানতে চাইলেন না কেন? তোমরা আবার সেইসব মেয়ের খোঁজ করতে এলে ইউনিয়ন থেকে। আর সব কিছুর ফল হল কয়েকজনের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ে যেমন হল তেমনি কয়েকজন অভিভাবক ছাড়াই কলেজে আসার স্বাধীনতা পেল! পেল না? ইউনিয়ন থেকে আমরা কি করতে পারতাম? কিছু না। অবহেলা করতে পারতে। কলেজে ছেলেমেয়েরা যে বেলোপ্লাপনা করতে আসে না, একটা ছেলের সঙ্গে দুটো কথা বললে যে চরিত্র নষ্ট হয়ে যায় না। এই বোধ অভিভাবকদের মনে সঞ্চারিত হবার আগে মেয়েদের মনে সেটা ঢোকানো উচিত। জানো, আমার রুমমেট গ্লোরিযা জাম্বিয়ার মেয়ে– গ্লোরিয়াকে আমি চিনি। কলেজ স্পোর্টসে নাম দিয়েছে। আমাদের জীবনের এইসব গল্প আর সমস্যা শুনে ও হতভম্ব হয়ে যায়। ব্যাপারটা যেন ওর মাথায় ঢুকতেই চায় না। কেউ এসে যদি আমাদের বলে সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। তাহলে তাকে যা মনে হবে ওরও যেন এইসব কথা শুনে তাই মনে হচ্ছে। অথচ জাম্বিয়া মোটেই উন্নত দেশ নয়। বিলেত ফ্রান্স নয়। ওদের দেশেও গরীব মানুষের সংখ্যা খুব বেশী। কিন্তু মোটা দাগের কতগুলো ব্যাপার ওরা ঝেড়ে ফেলেছে অনেক দিন। মায়া চুপচাপ দীপার কথা শুনছিল এবার সে ঘড়ি দেখল, তুমি এখন কি করছ। হোস্টেলে ফিরে যাব, কিছু তো করার নেই। তাহলে আমার সঙ্গে চল। আটটার মধ্যে ফিরে আসবে। রাজনীতির মধ্যে আমাকে টানবে না। আর না না। আমি তোমাকে বুঝে গিয়েছি। দীপা হেসে ফেলল। সে নিজেকেই এখনও বুঝতে পারল না। আর মায়া তাকে এত অল্প দেখে বুঝে গেল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। হেদুয়ার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উল্টো ফুট থেকে ডাক ভেসে এল, এই মায়া। দীপা দেখল দুজন দাঁড়িয়ে আছে। একজনের পবনে পাজামা পাঞ্জাবি, গালে দাড়ি, কাঁধে কাপড়েব ব্যাগ। মায়া ওকে ইশারা করে রাস্তা পাব হল। কি ব্যাপার? তুমি এখানে? দাড়িওযাল ছেলেটি বলল, সুজয়েব কাছে এসেছিলাম। চা খাবে? না। এর নাম দীপাবলী, আমাদের কলেজে এসেছে জলপাইগুড়ি থেকে, ওকে নিয়ে একবার বাড়িতে যাব। দীপা, আলাপ করিয়ে দিচ্ছি, শমিত, মণি কলেজে পড়ে। দাকণ নাটক করে। আমাদের একটা গ্রুপ আছে, মানে গুপটা নতুন ফর্ম করেছি, সুজয়ের লেখা নাটক শমিত পরিচালনা করছে। সুজয় ছেলেটি ছিমছাম, বলল, একটু ভুল হল, আমি একটি বিদেশী নাটকের ভাবানুবাদ করেছিলাম, শমিত মেঝে ঘষে তার চেহারা পাল্টে দিয়েছে। শমিত একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দীপার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, একদিন আসুন না, আমাদের গ্রুপে। বুড়ো হাবড়া কেউ নেই, ভাল লাগবে। দীপা হাসল শুধু। এরই মধ্যে পথচারিরা ঘুরে ঘুরে তাদের দেখে যাচ্ছে। মায়া ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু করল। দীপা জিজ্ঞাসা করল, তুমি ছেলেদের সঙ্গে নাটক করা নাকি? হ্যাঁ। নাটক আমার সেকেন্ড লাভ। ফার্স্ট লাভ অবশ্যই রাজনীতি। বাড়িতে কিছু বলে না? কে বলবে? মা আর আমি, মা আমার বন্ধু।
false
humayun_ahmed
না। নিমেষের মধ্যে বরফ কেটে গাড়ি বের করে ফেলত। তারপর ছোটাছুটি শুরু করত বরফের উপর। তুষার বল বানিয়ে চেঁচাত—মারব তোমার গায়ে বাবা? দেখবে আমার হাতের টিপ? মেয়েটা একেবারে ছেলেমানুষ রয়ে গেল। না, কথাটা ঠিক হল না। রুনকি এখন আর ছেলেমানুষ নয়। আমিন সাহেব বিশ্রাম নেবার জন্যে গ্যারাজের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। তখনই চোখে পড়ল, রাহেলা দোতলার বারান্দায় একটা সাদা চাদর গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাণ্ডায় এমন পাতলা একটা চাদর গায়ে দিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে? নিউমোনিয়া বাধাবে নাকি? রাহেলা উপর থেকে ডাকলেন, চা খেয়ে যাও। চা খেয়ে আমিন সাহেবের মনে হল তাঁর শরীর ভালো লাগছে না। নিঃশ্বাস নিতে একটু যেন কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। রাহেলা বললেন, আজকের এই দিনটি একটি বিশেষ দিন। তোমার মনে আছে? না। আজ রুনকির জন্মদিন। আমিন সাহেব বড়োই অবাক হলেন। এত বড়ো একটা ব্যাপার তিনি ভুলেই বসে আছেন। উফ, কী ঝামেলাই না হয়েছিল। বরফে চারদিক ঢাকা। বেশির ভাগ ফ্লাস্তিাঘাটই বন্ধ। এর মধ্যে রাহেলার ব্যথা শুরু হল! এ্যাম্বুলেন্সে খবর দিলেই হত, তা না, তিনি গাড়ি নিয়ে বের হলেন। ফিফটিস্থ স্ট্রীট থেকে উঠিয়ে নিলেন নিশানাথ বাবুকে। কী দুরবস্থা ভদ্রলোকের। ব্যাপার-ট্যাপার দেখে আনিস বলল সেই ঠাণ্ডাতেও তাঁর কপাল দিয়ে টপ-টপ করে ঘােম পড়ছে। রাহেলা এক বার বললেন, আমার মনে হচ্ছে গাড়িতেই কিছু একটা হয়ে যাবে। নিশানাথ বাবু বললেন, মা কালীর নাম নেন, চেঁচামেচি করবেন না। রাহেলা ধমকে উঠলেন, মা কালীর নাম নেব কেন, মা কালী আমার কে? এই সময় গাড়ি স্কিড করে খাদে পড়ে গেল। উহ, কী ভয়াবহ সময়ই না গিয়েছে! আমিন সাহেব বললেন, আমাকে আরেক কাপ চা দাও। তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? তুমি ঘামছ। না, শরীর ঠিক আছে। রাহেলা বললেন, আমি রুনকির জন্মদিন উপলক্ষে ছোট্ট একটা কেকের অর্ডার দিতে চাই। আমিন সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন। রাহেলা চোখ নিচু করে বললেন, আমি, তুমি আর নিশানাথ বাবু! বেশ তো। রাহেলা মৃদু স্বরে বললেন, রুনকির প্রতি আমি অবিচার করেছি। আমিন সাহেব জবাব দিলেন না। রাহেলা বললেন, নিজেদের মতো ওকে আমরা বড়ো করেছি। ক্যাম্পিং-এ যেতে দিই নি। ডেট করতে দিইনি। বাদ দাও ওসব। আমেরিকায় থাকব, অথচ বাংলাদেশী সাজাব–সেটা হয় নাকি বল? আমিন সাহেব জবাব দিলেন না। রাহেলা বললেন, কাল রাত্রে আমি রুনকিকে স্বপ্নে দেখেছি। যেন ছোটখালার বাসায় ওকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছি। ছোটখালা বলছেন-রাহেলা তোর মেয়ে তো পরিষ্কার বাংলা বলছে। আর তুই বললি-ও বাংলা জানে না। ছোটখালাকে মনে আছে তোমার? না। আমাদের বিয়েতে তোমাকে মুক্তা বসান আংটি দিয়েছিলেন। সেই আংটি তোমার হাতে বড়ো হয়েছে শুনে ছোটখালা দুঃখে কেঁদে ফেলেছিলেন। মনে পড়েছে। খুব মোটাসোটা মহিলা, তাই না? হ্যাঁ। কী যে ভালোবাসতেন আমাকে! এখন তাঁর শুনেছি খুব দুঃসময়। ছেলেদের সংসারে থাকেন। ছেলেরা দু চক্ষে দেখতে পারে না। অসুখবিসুখে চিকিৎসা করায় না। আমি ছোটখালার নামে কিছু টাকা পাঠাতে চাই। বেশ তো! ভালো এ্যামাউন্টের টাকা। ছোটখালা নিশ্চয়ই খুব খুশি হবেন। তা হবেন। আমি পাঁচ শ ডলার পাঠাতে চাই। আমিন সাহেব বললেন, আমি একটা ব্যাঙ্ক ড্রাফট করে আনব। রাহেলার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। কাঁদছ কেন? কই, কাঁদছি না তো। রাহেলা মৃদু স্বরে বলল, তোমাকে একটা কথা বলি নি। গত মাসে রুনকি এসেছিল। আমিন সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। রাহেলা বলল, রুনকির বাচ্চা হবে। ও বলেছে তোমাকে? হ্যাঁ। টম কি আছে এখনো তার সঙ্গে? আছে। রুনকি কী জন্যে এসেছিল? ওর বাচ্চার জন্যে দুটি নাম চায়। একটি ছেলের নাম, অন্যটি মেয়ের। আমিন সাহেব দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বললেন, মেয়ে হলে ওর নাম রাখব বিপাশা। বিপাশা? হ্যাঁ, পাঞ্জাবের একটা নদীর নাম। পাঞ্জাবে ওরা বলে বিয়াস। তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে, তুমি খুব ঘামছ। আমিন সাহেব ক্লান্ত স্বরে বললেন, আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। গাড়ি বের করার দরকার নেই। তুমি শুয়ে থাক। আর নিশানাথ বাবুকে টেলিফোন করে দাও, সন্ধ্যাবেলা যেন আসেন আমাদের এখানে, খাবেন। আমিন সাহেব নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। তাঁর শরীর বেশ খারাপ লাগছে। এই বয়সে বরফ না কাটাই ভালো। বড়ো বেশি চাপ পড়ে। শরীর দুর্বল হয়েছে, এখন আর আগের মতো চাপ সহ্য করতে পারেন না। পরীক্ষা করলে হয়তো দেখা যাবে সুগার আছে। নিশানাথ বাবুকে টেলিফোন করবার আগে কী মনে করে যেন দরজা বন্ধ করে দিলেন। নিশানাথ বাবুঘরেই ছিলেন। নিশানাথ বাবু, আমি আমিন। বুঝতে পারছি। আপনার কি শরীর খারাপ? এভাবে কথা বলছেন কেন? আমার শরীর ভালো না। আপনাকে একটি জরুরী ব্যাপারে টেলিফোন করছি। বলুন। আপনি তো জানেন, আমার এই বাড়ি এবং টাকা-পয়সা সব আমি আমার মেয়ের নামে উইল করে রেখেছি। আপনি এক জন উইটনেস। আমি জানি। নিশানাথ বাবু, নানান কারণে আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার মনের মিল হয় নি! এই বয়সে সেটা তোলার কোনো যুক্তি নেই, আমিন সাহেব। আমিন সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে থেমে থেমে বললেন, আমি আমার স্ত্রীর উপর একটা বড়ো অন্যায় করেছি নিশানাথ বাবু। আজ আমি যদি মারা যাই, সে পথের ভিখিরি হবে। আমিন সাহেব, আপনার শরীর কি বেশি খারাপ? হ্যাঁ। আপনি কি একটু আসবেন, আমি নতুন করে উইল করতে চাই। আমি এক্ষুণি আসছি। সব কাগজপত্র নিয়ে আসব। নিশানাথ বাবু। বলুন। আজ রুনকির জন্মদিন। আমি জানি। সকালেই
false
shunil_gongopaddhay
জনতাকে বললেন, এখানে সবাই মিলে দাঁড়িয়ে হল্লা করার দরকার নেই। এখনই দারোগাবাবু আসছেন আরও পুলিশ নিয়ে। তারা পাহারা দেবে। আপনারা ভয় পাবেন না, বাড়ি যান। সামান্য একটা বাঘ, কালকেই আমরা ওকে ধরে ফেলব। কাকাবাবুদের কাছে ফিরে এসে তিনি বললেন, পৃথিবীতে কত আশ্চর্য ব্যাপারইনা ঘটে। মাণ্ডুতে বাঘ?বুঝলেন, কর্নেল, আমি আগে বিশ্বাসই করিনি। আমার তো এখানে থাকার কথা নয়। আমি গতকালই এসেছি এক আত্মীয়র বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে। একজন যে-ই খবর দিল, অমনই আমি নিজের চোখে দেখার জন্য তাড়াতাড়ি ছুটে এলাম। এসব ব্যাপার নিয়ে তো আমার মাথা ঘামাবার কথা নয়। স্থানীয় পুলিশ ভার নেবে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকদের ডাকতে হবে। আমি এসেছি শুধু নিজের কৌতূহলে। কর্নেল বললেন, এটা টুরিস্ট সিজন। বাঘের ভয়ে যদি সব টুরিস্ট পালিয়ে যায়, তা হলে কিন্তু লোকজনদের খুব ক্ষতি হবে। বাঘটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধরে ফেলা দরকার। সুলতান বললেন, ধরে ফেলাটা সহজ নয়। বরং মেরে ফেলা সহজ। কিন্তু বাঘ মারা যে এখন নিষেধ? আগে ধরারই চেষ্টা করতে হবে। সেটা বনবিভাগের দায়িত্ব। কর্নেল বললেন, এ ব্যাপারে আমি বনবিভাগকে কিছুটা সাহায্য করতে পারি বোধহয়। সুলতান বললেন, মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনার সঙ্গে যখন দেখাই হয়ে গেল, চলুন না, কোথাও বসে গল্প করি। এই কর্নেলের বাড়িতেই যাওয়া যেতে পারে। উনি খুব ভাল রান্না করেন, চটপট অনেক কিছু বানিয়ে ফেলতে পারেন। আপনার সঙ্গের ছেলে দুটিকে বরং ঘরে ফিরে যেতে বলুন। ওরা যদি ভয় পায়, আমার বডিগার্ড সঙ্গে যেতে পারে। কাকাবাবু বললেন, ওরা ভয় পাওয়ার ছেলে নয়। আপনারাই বরং আমাদের গেস্টহাউসে চলুন। আমি অন্য কোথাও গেলে আমাকে তো আবার পৌঁছে দিতে আসতে হবে কাউকে। একটু পরে সবাই চলে এলেন গেস্টহাউসে। বসা হল ডাইনিং রুমের একটা টেবিলে। বাইরেটা আজও অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধু শোনা যাচ্ছে ঝরনার জলের শব্দ। সুলতান আলম কাকাবাবুকে বললেন, আপনাকে এই ছোট্ট জায়গায় দেখতে পাব, এটা আশাই করিনি। এখানেও কি কোনও রহস্যের সন্ধানে এসেছেন নাকি? খুব পুরনো জায়গা, কোথাও কোনও গুপ্তধন টুপ্তধন থাকতেও পারে। কাকাবাবু বললেন, না, না, ওসব কিছুনা। আমি এসেছিলাম উজ্জয়িনীতে একটা কাজে। আমার ভাইপো সন্তু আর তার বন্ধু জোজো আমার সঙ্গে অনেক জায়গায় যায়। তাই ভাবলাম, ওদের এই মাণ্ডু জায়গাটাও দেখিয়ে নিয়ে যাই। কয়েকদিন থাকার পক্ষে তো এটা খুব সুন্দর জায়গা। সুলতান বললেন, তা ঠিক। উজ্জয়িনীতে আপনার কী কাজ ছিল? কাকাবাবু বললেন, সেটাও ঠিক কাজ বলা যায় না। আসল কারণটা শুনলে আপনারা হাসবেন। সন্তু আর জোজোর মুখে এর মধ্যেই হাসি ফুটে উঠেছে। কর্নেল বললেন, শুনি, শুনি, আসল কারণটা শুনি। কাকাবাবুবললেন, উজ্জয়িনীতে আমার এক পিসিমা থাকেন। পিসেমশাই হাইকোর্টের জজ ছিলেন, মারা গিয়েছেন অনেক দিন। আর পিসিমাও ছিলেন এক কলেজের অধ্যক্ষা, তাও রিটায়ার করেছেন বহু বছর আগে, এখনও নানারকম কাজটাজ করেন। সুলতান জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম আপনার পিসিমার? কাকাবাবু বললেন, সুপ্রভা রায়। চেনেন? সুলতান ভুরু উঁচিয়ে বললেন, কী বলছেন আপনি? সুপ্রভা রায়কে এ তল্লাটে কে না চেনে? সবাই তাঁকে ডাকে বড়কাদিদি। গরিব মানুষদের জন্য অনেক কিছু করেন, বস্তির ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখান। কত বয়স হবে এখন, এইট্টি ফাইভ? তবু সারাদিন ব্যস্ত। তবে মহিলার খুব কড়া মেজাজ। একবার আমাকেও ডেকে খুব ধমকে ছিলেন। কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমার পিসিমা খুব মেজাজি মানুষ। তিনি একটা টেলিগ্রাম পাঠালেন, আমি আর কতদিন বাঁচব ঠিক নেই। রাজা, তোকে একবার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, তুই শিগগিরই এখানে চলে আয়। তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথাও আছে। সেই টেলিগ্রাম পেয়ে আমি ভাবলাম, সত্যিই তো পিসির অনেক বয়স হয়েছে, কখন কী হয় ঠিক নেই। একবার দেখা করাই উচিত। তাই চলে এলাম। সুলতান বললেন, কিন্তু সুপ্রভা রায়ের তো কোনও অসুখবিসুখ করেনি? তিনদিন আগেও আমি দেখেছি, একটা বস্তির মধ্যে হেঁটে-হেঁটে ওষুধ বিলি করছেন। কাকাবাবু বললেন, আমিও এসে দেখলাম, পিসিমার স্বাস্থ্য বেশ ভালই আছে। এই বয়সেও যথেষ্ট পরিশ্রম করতে পারেন। যাই হোক, তবু দেখা হয়ে গেল। এমনিতে তো আর এদিকে আসা হয় না। সন্তুদের এখন কলেজ ছুটি, ওরাও কোথাও বেড়াতে যেতে চাইছিল। কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, উনি আপনাকে জরুরি কথা কী বললেন? কাকাবাবু হেসে বললেন, সেটাও এমন কিছু জরুরি নয়। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হারে রাজা, তুই কি আর বিয়ে করবি না? আমি বললাম, না পিসিমা, আমারও তো যথেষ্ট বয়স হয়ে গিয়েছে, আর আমি বিয়ের ঝঞ্ঝাটের মধ্যে যাব না! তা শুনে পিসিমা বকুনি দিয়ে বললেন, ঝঞ্ঝাট আবার কী? বিয়ে মানে কী ঝঞ্ঝাট! এই বয়সেও অনেকের বিয়ে হয়। সুলতান বললেন, ঠিকই তো বলেছেন বড়কাদিদি। আপনার বয়সে অনেক মানুষের বিয়ে হয়। বলুন, পাত্রী দেখব নাকি? কাকাবাবু বললেন, মাথা খারাপ! ওসবের আর প্রশ্নই ওঠে না। যাই হোক, খানিকক্ষণ বকাঝকার পর পিসিমা বললেন, শোন, আমার এই যে বাড়ি, বাগান, ব্যাঙ্কের সব টাকাপয়সা, এই সব আমি রামকৃষ্ণ মিশনের নামে উইল করে দিয়েছি। আমার ছেলেমেয়ে নেই, তোদেরও এ নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। কিন্তু কয়েকজনের নামে কয়েকটা জিনিস আমার কাছে আছে। যেমন, আমার শাশুড়িমা একটা খুব দামি হিরের আংটি আমাকে দিয়ে বলেছিলেন, এটা রাজার বিয়ের সময় তার বউকে দিবি। সেই আংটিটা আমার কাছে রয়ে গিয়েছে। তুই বিয়ে করলি না, এখন সেই আংটি নিয়ে আমি কী করব? সেটা তোকে নিতে হবে। আমি বললাম, পিসি,
false
shomresh
ভয় পাচ্ছ, ওরা তোমার ক্ষতি করবে? যা সত্যি তাই আমাকে মানতে হবেই। বাঃ! খুব ভাল। আজ ভোরে জলপাইগুড়ি রোডে ট্রেন ডাকাতি করে যে জিনিসগুলো তোমরা পেয়েছ সেগুলো কোথায় রেখেছ? আপনি, আপনি কী করে জানলেন? সেটা তোমার না জানলেও চলবে। কত পেয়েছ আজকের কাজের জন্যে? এখনও পাইনি। জিনিসগুলো বিক্রি হয়ে গেলে পাব। তার মানে তুমি স্বীকার করছ–! আপনি যখন সব খবর জানেন—? তোমার নাম কী? অসিত। অসিত, এবার বলো হারাধন কোথায়? সত্যি বলছি আমি জানি না। মানাভাই কী বলল তোমাদের? অসিত তাকাল। বোঝা যাচ্ছিল সে খুব অবাক হয়ে গেছে। হঠাৎ গলার স্বর বদলে গেল ওর, আপনি আমাকে পুলিশে দেবো না তো? আপাতত না। অবশ্য তুমি যদি সহযোগিতা করো। কী চান আপনি? তোমাদের বস-এর কাছে যেতে চাই। বসকে আমি কখনও দেখিনি। কোথায় থাকেন তিনি? তাও জানি না। যা কিছু খবর মানাভাই দেয়। দ্যাখো অসিত, এখন পর্যন্ত তুমি সত্যি কথা বলছ বলেই মনে হচ্ছে। তোমার সঙ্গী সিনক্লেয়ার হোটেলের সামনে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে কেন? প্রশ্নটা করেই অর্জুন শুনতে পেল, অনেক বলেছি, আর বলা উচিত হবে না। অর্জুন বলল, অনেক যখন বলতে বাধ্য হয়েছ তখন–। আপনি কি ভগবান? কথা থামিয়ে দিল অসিত। সে কী? না হলে আমি যা ভাবছি তা বুঝে ফেলছেন কী করে? কেউ কেউ চিন্তা পড়তে পারে। শোনোনি? বেশ। আমরা পাঙ্খাবাড়ি যাচ্ছি। পাঙ্খাবাড়ির কোথায়? জানি না, ওখানে গিয়ে গুরুংয়ের দোকানে দেখা করতে বলা হয়েছে। তুমি কোথায় থাকো? প্রশ্নটা শুনে মুখ ফেরাল অসিত। অর্জুন বলল, চুপ করে থেকে কোনও লাভ নেই। তুমি তো জানো আমি তোমার মনের কথা বুঝতে পারি। ফাটাপুকুরে। ঠিক আছে। তুমি গিয়ে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করো। আমি এখানে নামব। আপনি আমার ক্ষতি করবেন না তো? ক্ষতি করতে চাইলে তো প্রথমেই পাবলিককে দিয়ে মার খাওয়াতাম। রিকশাওয়ালাকে থামতে বলে নেমে পড়ল অর্জুন। রাস্তার একপাশে তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাস। বেশ ভিড়। চিৎকার চেঁচামেচি লেগেই আছে। অর্জুন একটা এসটিডি বুথে ঢুকে পড়ল। একবারেই লাইন পেয়ে গেল সে, সুদর্শনই ফোন ধরলেন। আরে! আপনি কোথায়? শিলিগুড়িতে। মানাভাই-এর সন্ধান পেয়েছি। বাঃ। কিন্তু শিলিগুড়ি তো আমার এলাকা নয়। এদিকে যে পাঁচজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তার চারজনই মারা গেছে। যে এখনও আছে সে কতক্ষণ থাকবে বলা যাচ্ছে না। আমি এখন বস-এর সন্ধানে যাচ্ছি। হারাধন এবং বিশ্বনাথকে পাওয়া যাচ্ছে। সম্ভবত ওদের জীবন বিপন্ন। অর্জুন জানাল। আপনি এক কাজ করুন। শিলিগুড়ির কোন জায়গায় রয়েছেন এখন? তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাস। দশ মিনিট অপেক্ষা করুন। শিলিগুড়ির ওসির সঙ্গে কথা বলছি। ওখানে থাপা আছে। খুব ভাল লোক। এসটিডি বুথের নাম কী? বাইরে বসা লোকটিকে জিজ্ঞেস করে নাম বলে দিল অর্জুন। বাইশ টাকা মিটারে উঠেছে। অর্জুন সেটা মিটিয়ে দিয়ে বলল, একটু বসতে পারি ভাই? লোকটি বলল, বসুন। চেয়ারে বসে রাস্তার দিকে তাকাল সে। লোকটা জিজ্ঞেস করল, কোথাও যাওয়ার থাকলে বলুন টিকিট আনিয়ে দিচ্ছি। সে মাথা নাড়ল, না। কোথাও যাচ্ছি না। এই জায়গাটা সবসময় এমন জমজমাট থাকে? কত বাস যাচ্ছে আসছে! সবসময়। সবরকম ধান্দা এখান থেকে হয়। আপনি কি আবার ফোন করবেন? হ্যাঁ। দশ মিনিট পরে। কিন্তু ন মিনিটের মাথায় পুলিশের জিপটা সামনে এসে দাঁড়াল। মিষ্টি চেহারার এক ভদ্রলোক জিপ থেকে লাফিয়ে নামলেন। তাঁর পরনে জিন্স আর হাওয়াই শার্ট। সোজা এসটিডি বুথে ঢুকে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, অর্জুন? অর্জুন উঠে দাঁড়াল, মিস্টার থাপা? ইয়েস। আমাকে কে খবর দিয়েছে বলুন তো? সুদর্শনবাবু। সঙ্গে সঙ্গে হাত মেলালেন ভদ্রলোক। ততক্ষণে পেছনের লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছে, আসুন সার, আসুন সার। কোল্ড ড্রিঙ্ক না চা, কী বলব? হাত নেড়ে না বলে থাপা অর্জুনকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। চারপাশে তাকিয়ে বললেন, জলপাইগুড়ির ওসি আমাকে রিকোয়েস্ট করেছেন আপনাকে সাহায্য করতে। আপনার কথা আমি আগেই শুনেছি, আলাপ করতে পেরে খুশি হলাম। এবার বলুন, কী ধরনের সাহায্য চাই। আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন আজও ট্রেনে ডাকাতি হয়েছে এবং তিনজন যাত্রী ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন। আমার অনুমান ভুল হতে পারে কিন্তু ভুল না হলে ওই দলের পাণ্ড এখন পাঙ্খাবাড়িতে আছেন। অর্জুন বলল। পাঙ্খাবাড়ি? ওটা অবশ্য শিলিগুড়ি থানার মধ্যে পড়ে না, তবে আমার যেতে আপত্তি নেই। লেটুস গো। যেতে যেতে প্রধান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমস্ত ব্যাপার জেনে নিলেন। অর্জুন সব বলল, শুধু রুদ্রাক্ষের মালাপ্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল। থাপা অবাক হয়ে বললেন, বাঃ। আপনি তা হলে থটরিডার, আমি কী ভাবছি তা বলতে পারবেন? চেষ্টা করব। অর্জুন সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেল, ভারতবর্ষে এখনও জেমস বন্ড জন্মায়নি। থাপা জিজ্ঞেস করল, বলুন তো, আমি কী ভাবলাম? অর্জুন বলল, ভারতবর্ষের কথা ভাবছেন কেন? পৃথিবীতেই কোনও জেমস বন্ড জন্মাবে না। কারণ ওর জন্ম উপন্যাসের পাতায়। প্রচণ্ড জোরে হাত চেপে ধরে থাপা চেঁচিয়ে উঠলেন, কী অদ্ভুত ব্যাপার। আপনি তো অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। পেছনে বসা সেপাইরা মজা পেয়ে গেল। তারাও অর্জুনকে পরীক্ষা করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দুজনকে সন্তুষ্ট করে অর্জুন অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। জিপ শিলিগুড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর দার্জিলিং-এর রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে ঢুকে পড়েছিল। এবার আবার ডান দিকে বাঁক নিয়ে পাহাড়ের দিকে ছুটছে। সবাই চুপ করে গেলে অর্জুন অসিতের কথা নিয়ে ভাবতে লাগল। ছেলেটা থাকে ফাটা করে। এই জায়গাটাও শিলিগুড়ি থেকে
false
manik_bandhopaddhay
আছে। হোসেন মিয়া যার মুরুব্বি, কীসের অভাব তার? বঙ্কু পাঁচকুড়ি টাকা পণ দিবে কুবেরকে, গোপিকে গহনা দিবে তিনকুড়ি টাকার, আর একদিন জেলেপাড়ার সকলকে দিবে ভোজ। এ কথা জানিতে কুবেরের বাকি নাই যে বিবাহের পর নবদম্পতিকে হোসেন ময়নাদ্বীপে লইয়া যাইবে, কিন্তু জানিয়া কী লাভ? হোসেন মিয়ার অবাধ্য কুবের কেমন করিয়া হইবে? তা ছাড়া পাঁচকুড়ি টাকার মায়া ত্যাগ করিবাব সাধ্য কুবেবের নাই। বিবাহ দিলে মেয়ে পরের ঘরে যায়, কাছে অথবা দূরে। গোপি না হয় যাইবে দূরে–অনেক দূরের ময়নাদ্বীপে। হয়তো কখনও একটু মন কেমন করিবে কুবেরের, কিন্তু তার প্ৰতিকার কী? মন তো অনেক কারণেই কেমন করে মানুষের। খবর শনিয়া রাসু গালাগালি করিয়া গিয়াছে। বলিয়াছে, কথা দিয়া কথা রাখিল না কুবের, কুবেরের সে সর্বনাশ করিয়া ছাড়িবে। যুগীকে গিয়া রাসু বুঝি ধরিয়াছে, তারপর একদিন শীতল আসিয়া রাসুর সপক্ষে খানিকক্ষণ ওকালতি করিয়া গিয়াছে কুবেরের কাছে। বলিয়াছে টাকা যদি বেশি চায় কুবের, সে তা বলে না কেন? সোনাখালির পাত্র যত টাকা দিতে চায তাই দিবে রাসু। গ্রামে রাসুর মতো পাত্র থাকিতে দূর দেশে মেযেকে কুবের পাঠাঁইবে কেন? কেন? এ কেনর জবাব দিবার ক্ষমতা নাই কুবেরের! ময়নাদ্বীপে গিয়া গোপিকে বাস করিতে হইবে ভাবিলে জালে আবদ্ধ ইলিশ মাছের মতো মাঝে মাঝে তারও মনটা কি ছটফট করে না? তবু তাকে এ সব বলা মিছে। একদিন গোয়ালন্দে অধরের সঙ্গে কুবেরের দেখা হইয়া গেল। অধর বলিল, কয়েকদিন আগে কপিলা চরডাঙায় আসিয়াছে, কিছুদিন থাকিবে। বাড়ি ফিরিয়া কুবের সেদিন মালাকে বড়ো দবদ দেখায়। বলে, মালা কতকাল বাপের বাড়ি যায় নাই, ইচ্ছা করে না যাইতে? ইচ্ছা যদি হয় তবে না হয় চলুক মালা কাল, দু-চারদিন থাকিয়া আসিবে। মালা বলে, না, বাপের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা তাহার নাই। বাপ কি যাইতে বলিয়াছে তাকে? এতকাল সে যে যায় নাই, একবার কি দেখিতে আসিয়াছে তাকে? মালা কাঁদো কাঁদো হইয়া যায়। বলে, তার মনটা শুধু পোড়ায় বাপভাইয়ের কথা ভাবিয়া, তার জন্য ওদের কারও দরদ নাই। কেন সে যাইবে বাপের বাড়ি যাচিয়া? কুবের বিপন্ন হইয়া বলে, গেলে দোষই বা কী? বাপের বাড়ি তো বটে, যাচিয়া বাপের বাড়ি যাইতে কারও লজ্জা নাই। কালই চলুক মালা, দু-দিন একদিন পরেই ফিরিয়া আসিবে? এবার মালা সন্দিগ্ধ হইয়া বলে, যাওনের লাইগা জিদ কর ক্যান মাঝি? জিদ কিবা? দরদ কইরা কইলাম, জিদ! মালার উপর রাগের সীমা থাকে না কুবেরের। চরডাঙা যাওয়ার আর তো কোনো ছুতা তাহার নাই! জামাই অকারণে শ্বশুরবাড়ি গেলে দোষ অবশ্য কিছুই হয় না, কিন্তু এখন কপিলা ওখানে আছে, হঠাৎ কুবেরের আবির্ভাব ঘটিলে কে জানে কে কী ভাবিয়া বসিবে। বসিয়া বসিয়া কুবের উপায় চিত্ত করে আর কুদ্ধ চোখে মালার দিকে থাকিয়া থাকিয়া তাকায়। হ, আজ বসন্তের আদর্শ আবহাওয়া আসিয়াছে কেতুপুপে, দোলের উৎসব হইবে কাল, লখা ও চণ্ডী আবিব কিনিয়া আনিয়া আজই অঙ্গনে খানিক ছড়াইয়াছে। বিকালে পদ্মার ঘাটে নৌকার তদবির করিতে গিয়া কুবেরের আরও মন-কেমন করিতে থাকে। কাব্যের মসৃণ মার্জিত মন-কেমন করা নয়, তার ভীরু প্রকৃতির সঙ্গে যতখানি খাপ খায় ততখানি দুরন্ত মানসিক অস্থিরতা। পেট ভরিয়া খাইতে পাইয়া শরীরটা কুবেরের ভালো হইয়াছে—খাদ্য যতটুকু শক্তি দিত আগে ব্যয় করিতে হইত তার দশগুণ, এখন সেটা শুধু বন্ধ হয় নাই, বিশ্রামও জুটিয়াছে অনেক। মনেরও যেন তাতে ব্যাকুল হওয়ার ক্ষমতা বাড়িয়াছে এবং কমিয়া গিয়াছে দুর্বল অভিমান, সিদ্ধি বা আপিমের নেশার মতো আগে যা কুবেরের মনকে অনেকটা শান্ত করিয়া রাখিত। নৌকায় বসিয়া কুবের যেন ভুলিয়া যায় যত নিষ্ঠুরতা করিয়াছে কপিলা, যত দুর্বোধ্য নির্মম খেলা সে খেলিযাছে তার সঙ্গে। মনে পড়ে শুধু কপিলাকে, কপিলার লীলা-চাপলা, কপিলার হাসি ও ইঙ্গিত, তেলে ভেজা চুল ও কপাল আর বেগুনি রঙের শাড়িখানি। আর মনে পড়ে শ্যামাদাসের উঠানে ভোরবেলা গোবব লেপায় রত কপিলাকে, মালাকে বলিবার অনুরোধ মেশানো তার শেষ সকাতর কথাগুলি। ক্যান আইছিলা মাঝি, জিজ্ঞাসা করিয়াছিল না কপিলা? হ, ও জিজ্ঞাসার মানে কুবের বোঝে। আবার তাই যাইতে চায় কুবের কপিলার কাছে, এখনই যাইতে চায় শস্যহীন শুকনো মাঠগুলি ঊর্ধ্বশ্বাসে পার হইয়া চরডাঙ্গায়, কপিলা যেখানে চুল বাঁধিতেছে।—কুবেরকে দেখিয়া তার বোতলটি কাত করিয়া আরও খানিকটা তেল মাথায় ঢালিবে কপিলা : তার উত্তোলিত দুটি বাহু, মুখের ছলনাভরা হাসি, বসিবার দুর্বিনীত ভঙ্গি সব পাগল করিয়া দিবে কুবেরকে। ঘাটে আরও নৌকা আছে, মাঝি আছে। এখানে থাকিতে ভালো লাগে না কুবেরের, বাড়ি ফিরিতেও ইচ্ছা হয় না। নদীর ধারে ধারে সে হাঁটিতে আরম্ভ করে, ভাঙিয়া পড়ার জন্য প্রস্তুত তীরের ফাটলধরা অংশগুলির উপর দিয়া। চলিতে চলিতে এক সময় দশ-বারোহাত ডাঙা তাকে সঙ্গে করিয়া ধসিয়া পড়ে নীচে, শীতের পদ্মার জল যেখান হইতে হাত পনেরো পিছাইয়া গিয়াছে। মাটির একটা চাপড়াই বুঝি মাথায় ঘা দিয়া কুবেরকে অজ্ঞান করিয়া দেয়। মিনিট দশেক পরে চেতনা হয় কুবেরের। প্রথমে কুবেরের মনে হয় এ বুঝি কপিলারই এক কৌতুক। তারপর কষ্টে উঠিয়া বসিয়া সে নিঝুম হইয়া থাকে। শেষ বেলার সূর্য যেন পদ্মাকেও নিঝুম করিয়া দিয়াছে, দূরের নৌকাগুলি এবং আরও দূরের স্টিমারটি যেন হইয়া গিয়াছে গতিহারা। বাতাসের জোর নাই, নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ যেন ক্লান্ত। নিজের এলোমেলো চিন্তাগুলিকে কুবের ভালো বুঝিতে পারে না। মাথার মধ্যে একটা ভোঁতা বেদনা টিপটিপ করিতেছে। মাথার বা পাশটা দিয়া একটু রক্তও পড়িয়াছে। তাই বলিয়া কেবলই এখন মনে আসিতে থাকিবে কেন
false
shirshendu
বিপদ এত সহজ নয়। ওখানে আর একটা মেয়ে আছে। জমজমাট অফিস। মনীশ চুপ করে গেল। মুখে একটুও হাসি নেই। আজ বাবার সঙ্গে খুনসুটি করল না ঝুমকি, যা সে রোজই একটু করে। আজ সে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল এবং ভাবতে বসল। চাকরিটা তার ভাল লাগছে না। চারুমাসির ফোনটা এল রাত আটটা নাগাদ। এই ঝুমকি, চাকরিতে জয়েন করলি আজ? হ্যাঁ মাসি। যাক বাবা, বাঁচা গেল। কেন মাসি? ভাবছি তোর চাকরির অনারে কাল ডিনার খাওয়াবো। তার চেয়ে বেড়ালের বিয়ে দাও না। আগের দিনের বড়লোকরা তো এসব ছুতোয় টাকা ওড়াত। ইয়ার্কি করছিস? যা চাকরি এর অনারে ডিনার দিলে যে আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করবে। শোন, কাল শনিবার। তোর মা বাবা অনুবুবকা সবাইকে নিয়ে চলে আয় সন্ধেবেলা। প্লীজ মাসি, এতটা কোরো না। আমার লজ্জা করছে। যাঃ, লজ্জা কিসের? তুমি সব সময়েই কেবল বাড়িটাকে একটা নেমন্তন্ন বাড়ি করে রাখো! তোমার বুঝি অকেশনেরও দরকার হয় না। এটাই তো জীবন। শোন, সামনের মাসের শেষ দিকে আমি লম্বা ট্যুরে বাইরে চলে যাচ্ছি। অন্তত ছমাস। নন্দকে হয়তো ওর বাবা আমেরিকার একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসবে এবার। ওমা! কেন? ওইটুকু মেয়েকে? ওর বাবা খুব চায় মেয়েটা আমেরিকায় পড়ুক। অবশ্য এখনও সব ঠিক হয়ে যায়নি। আমার ইচ্ছেও নেই। যা সব শুনি আমেরিকার হালচাল তাতে ভয় করে। বারো-তেরো বছর বয়স থেকেই নাকি সেক্স শুরু হয়। ভাব তো একবার কী কাণ্ড! তুমি রাজি হয়োনা মাসি। এখনও হইনি। তা ছাড়া এখন ছাত্র-ছাত্রীদের নিতেও চাইছে না আমেরিকা। সুব্রত খুব চেষ্টা করছে অবশ্য। আসল কথাটা হল, ছমাস তো আমি থাকব না, তাই এই কদিন একটু মেলামেশা করে নেবো সকলের সঙ্গে। তুমি না থাকলে ছমাস যে আমারই কি করে কাটবে! খুব খারাপ লাগবে আমার। কেন, চাকরি তো করছি। ব্যস্ত থাকবি। ছাই। আজ জয়েন করে মন এত খারাপ হয়ে গেল! কেন রে? ওরা ভাল নয়। একদম বাজে। তা হলে ছেড়ে দে। দিয়ে? কিছু তো করতে হবে। আচ্ছা মুশকিল। করতেই হবে কেন? ভাল না লাগলে ছেড়ে দিবি। অত সোজা নয় মাসি। বাড়িতে আমার প্রেস্টিজ বলে কিছু আর থাকবে না। আচ্ছা, তুই কাল সবাইকে নিয়ে আয় তো। দেখা যাবে। কী দেখবে মাসি। কিছু একটা করতেই হবে তার জন্য। আচ্ছা, আমার পি.সি-তেই তো তুই এক্সপিরিয়েন্স গ্যাদার করতে পারিস। চাকরির কী দরকার? একা একা হয় না মাসি। দেখানোর লোক চাই। আমি এমন কিছু বেশি তো শিখিনি। আচ্ছা, আয়। আমি সুব্রতর সঙ্গে কথা বলছি। আবার আমার জন্য ওঁকে কেন জ্বালাতন করবে? করব, আমার ইচ্ছে। ও হয়তো ইচ্ছে করলে পারে। একজনকে তো যথেষ্ট জ্বালাতন করেছে। আবার আর একজনকে কেন? কাকে জ্বালাতন করেছি। হেমাঙ্গর কথা বলছিস? ও একদম কোনও কাজের নয়। এখন তো বলছে কাজকর্ম সব বন্ধ করে পৃথিবীকে দূষণমুক্ত করার কাজে লাগবে। সে কী? এটা কবে থেকে? কৃষ্ণজীবনবাবুর একটা বই বেরিয়েছে জানিস। জানি তো। সেটা পড়ে ওর মাথা গরম হয়েছে। একদম পাগল। জোর করে একটা বিয়ে দিয়ে দাও। পাগলামি সেরে যাবে। বিয়ের কথা আর বলিস না। রশ্মিকে নিয়ে কী বিশ্রী কাণ্ড করল বল তো। অত ভাল মেয়েটা। ভাল মেয়ে অনেক পাবে। রশ্মির মতো তো আর পাবো না। বেশ ছিল। যাই বলো বাপু, আমার আবার তত ভাল লাগত না। কেন রে? কী জানি! রশ্মির সব বেশি বেশি। পড়ে তো থাকবে না। শুনছি তো তারও একটা হিল্পে হচ্ছে। কী বলছো? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চারুশীলা বলল, কাল ফোন করেছিল। সেরকমই একটা আভাস দিল যেন। কী বলল বলো তো? কাল বলব। আসবি কিন্তু। তোর মাকে ফোনটা দে। নেমন্তন্নটা আমারই করা উচিত। ঝুমকির বুক কেন কাঁপছিল? মায়ের হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে সে নিজের ঘরে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। তার যেন ঘাম দিয়ে একটা জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে। হাত-পা অবশ লাগছে। রিলিফ। কিন্তু কেন? পরদিন সন্ধেবেলা চারুশীলার বাড়িতে একগাদা অতিথি দেখে অবাক হল ঝুমকি? পারেও খরচ করতে মানুষটা। এত আয়োজন কেন মাসি? বোলো না যে আমার চাকরির অনারে। চাকরির অনারে না হোক, তোর অনারে। আমার অনারেই বা কেন? আমার তো জানিস একটা ছুতো দরকার হয়। আমি আসলে মানুষ ভালবাসি। সে জানি। অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ল চারুশীলা। ঘুরে ঘুরে হলঘরে সকলের মুখ দেখছিল ঝুমকি। যারা চারুশীলার বাড়ির নেমন্তন্ন প্রায়ই আসে তারা সবাই আছে। বাদ শুধু হেমাঙ্গ। একটু অদ্ভুত ব্যাপারটা। চারুশীলা একটু বাদে এসে বলল, চল কোথাও বসি। একটা ঠাণ্ডা পাবি? না। আমার টনসিলটা বেড়েছে বোধহয়। অফিসের কুলারটা সহ্য হচ্ছে না। ছেড়ে দে। কুলারে আমার অভ্যাস আছে। যেখানে শিখতাম সেখানেও কুলার ছিল। কিন্তু এই অফিসের কুলারটা বড় ঠাণ্ডা। চাকরি করিস না ঝুমকি। এবার বলো তো, রশ্মি কী বলছে? চারুশীলা একটু দ্বিধা করল। বলল, বলাটা কি ঠিক হবে। আমাকে প্রাইভেটলি বলেছে। হেমাঙ্গকে বলতে বারণ করেছে এখন। আহা, বলো না! কাউকে বলিস না। বলব না মাসি। বলো। একটা বাঙালি ছেলের সঙ্গে ওর একটু আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। ছেলেটা লন্ডনের একটা বড় ব্যাঙ্কে মস্ত চাকরি করে। আন্ডারস্ট্যান্ডিং মানে? তুই কি আন্ডারস্ট্যান্ডিং মানেও ভুলে গেলি? কিরকম আন্ডারস্ট্যান্ডিং? বলল, একা থাকা এখন বেশ বিপজ্জনক। ভাল লাগছে না। তাই ও শিগগিরই একটা ডিসিশন নিতে
false
shomresh
এত গম্ভীর এবং যেন মহান কোনো কর্ম সম্পন্ন করার নিষ্ঠায় মগ্ন যে। অনিমেষ চেষ্টা করেও তাদের নিজের ইচ্ছেটা জানাতে পারল না। মাষকলাইবাড়ি ছাড়িয়ে ওরা শ্মশানে এসে গেল। ছোট্ট পুলটা পেরিয়ে শুশানচত্বরে ঢুকতেই অনিমেষের চট করে সমস্ত কিছু মনে পড়ে গেল। মাকে নিয়ে ওরা এখানে এসে ওই গাছটার তলায়। বসেছিল। চিতা সাজানো হয়েছিল এই নদীর ধারটায়। বুকের মধ্যে সেই ব্যথাটা তিরতির করে ফিরে আসছিল যেন, অনিমেষ অনেকদিন পর মায়ের জন্য কেঁদে ফেলল। কোনো-কোনো সময় চোখের জল ফেলতে এত আরাম লাগে-কখনো জানতে না সে। হঠাৎ একজন ওকে জিজ্ঞাসা করল, সুনীল আপনার কেউ হয়? কথাটা বুঝতে না পেরে তার মুখের দিকে তাকাতেই সে প্রশ্নটা শুধরে নিল, আত্মীয়? এবার চট করে চোখের জলটা মুছে ফেলল অনিমেষ, আমরা এক বাড়িতে থাকি। ভদ্রলোক আর কথা বাড়ালেন না। দাহ করার তোড়জোড় চলছে। অনিমেষ ভালো করে নজর করে দেখল সুনীলদার জন্য কেউ কাঁদছে না। সবাই যেন গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে সুনীলদার শেষকৃত্য করে যাচ্ছে। এখন কেউ কোনো ধ্বনি দিচ্ছে না। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল অনিমেষের। যেহেতু সুনীলদা হিন্দু, তাই অন্তর এই সময়ে হরিধ্বনি দেওয়া উচিত। একথাটা কারও মাতায় ঢুকছে না কেন এই সময় হরিধ্বনি নেই, কান্না নেই-যদিও সে কখনো দাহ করতে শ্মশানে আসেনি, তবু পিসিমার কাছ থেকে শুনে-শুনে এটা একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে হচ্ছিল তার। শেষ সময়ে হরিনাম করলে আত্মার শান্তি হয়। কথাটা ও সেই ছেলেটিকে বলল। এতক্ষণ কবিতা আবৃত্তি করার পর শ্মশানে এসে সে চুপচাপ সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিল। কথাটা শুনে সে ম্লান হাসি হাসল, সব মানুষের আত্মা কি এক নিয়মে চলে? কোটিপতি চোরাকারবারি আর সত্যিকারের একজন শহীদ মরার পর হরিনাম শুনলেই যদি আত্মা শান্তি পায় তা হলে বলার কিছু নেই। সত্যিকারের কমিউনিস্ট তার যতক্ষণ দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে ততক্ষণ শান্তি পাবে না। অনিমেষ হঠাৎ অনুভব করল, ও যেন কথাটা অস্বীকার করতে পারছে না। ক্ষুদিরাম বলেছিলেন দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি ফিরে জন্ম নেবেন। সত্যি একটা চোর আর শহীদের আত্মা সমান সম্মান এবং সুবিধে পেতে পারে না। অনিমেষ অলসভাবে পায়চারি করতে লাগল। দূরে একটা চিতা প্রায় নিবে এসেছে। কাঠগুলো জ্বলে জ্বলে আগুন নিবুনিবু। প্রচণ্ড কান্নায় কেউ ভেঙে পড়েছে সেখানে, তাকে সামলাচ্ছে অন্যরা। হরিবোল ধ্বনি দিতে দিতে আর-একটি মৃতদেহ নিয়ে শানের দিকে কিছু লোক আসছে। অনিমেষের এখন রি ভয় করছিল না। দুধেলা জ্যোৎস্নায় এই শ্মশানের মাটি গাছ নদী ধবধব করচে। আকাশে এত নীল রঙ চেয়ে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। গোল আধুলির মতো রুপোলি চাঁদ চুপচাপ সরে সরে যাচ্ছে। আশ্চর্য, ঠিক এরকম সময় কিছু মানুষকে পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর শ্মশানে আনা হয়েছে পুড়িয়ে শেষ করে দেবার জন্য। ওর খুব মন-খারাপ হয়ে গেল, কেন যে ছাই শোনে ও চাঁদের আলো পড়ে। স্নান করিয়ে দাহ করার যে-নিয়মটা এখানে চালু আছে তা সকলে মানেন না, সামান্য জল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে নেয় অনেকে-অনিমেষ শুনতে পেল। যে-ডোমটি তদারক করছিল তার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ অবাক হয়ে গেল। এর মুখ দেখে মনে হয় না এইসব শোক দুঃখ একে স্পর্শ করে। কখনো কি ও মাথা তুলে আকাশ-ভাসানো চাঁদটাকে ভালো করে দেখেছে? মনে হয় না। সুনীলদার উলঙ্গ শরীরটাকে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে সে যেভাবে পা দুটো সোজা করে দিল তাতে পিসিমার উনুন ধরানোর ভঙ্গিটা মনে পড়ে গেল ওর। চিতার কাছাকাছি গোল হয়ে দাঁড়িয়েছিল সবাই সুনীলদার কোমরের পেছনদিকটায় বিরাট জরুলটায় আলো পড়ে চোখ টেনে নিচ্ছে। মানুষ মরে গেলে তার কত গোপন জিনিস সবাই সহজে জেনে যায়-সুনীলদার এখন কিছু করার নেই। হঠাৎ ও মাকে দেখতে পেল। মা শুয়েছিল সমস্ত চিতা আলো করে-ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছিল সেই চুলগুলো। সুনীলদাকে এই মুহূর্তে খুব দুর্বল, অসহায় বলে মনে হচ্ছিল অনিমেষের। কে যেন বলল, মুখাগ্নি করবে কে? সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। সুনীলদার বাবা আসেননি, কোনো আত্মীয় এই শহরে থাকে। সমস্যাটা চট করে সমাধান করতে পারছিল না শুশানযাত্রীরা। এমন সময় অনিমেষ দেখল সেই ছেলেটি, যে আবৃত্তি করেছিল, যার সঙ্গে সুনীলদার খুব তর্ক হত, সে অলসভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে গেল, কই, কী করতে হবে বলুন। একজন একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, তুমি করবে? নিশ্চয়ই! ছেলেটি জাবাব দিল, সংগ্রাম শুরু কর মুক্তির, দিন নেই তর্ক ও যুক্তির। আমার চেয়ে বড় আত্মীয় আর কে আছে! দিন। হাত নেড়ে নেড়ে কথাটা বলে সে পাটকাঠির আগুনটা তুলে নিয়ে সুনীলদার বুকে ছুঁইয়ে মুখের ওপর বুলিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো হাত আগুন ছুঁইয়ে চিতাটাকে জাগিয়ে দিল। কেউ কোনো কথা বলছে না, শুধু ফটফট করে কাঠ ফাটার শব্দ আর আগুনের শিখাগুলো যেন হামাগুড়ি দিয়ে সুনীলদার দিকে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ ডোমটা চেঁচিয়ে উঠল, বোল হরি হরিবোল। তার সেই একক কণ্ঠ শ্মশানের আকাশে একবার পাক খেয়ে ফিরে এল আচমকা। অবাক হয়ে সে শুশানযাত্রীদের দিকে তাকাল, তার অভিজ্ঞতায় এইরকম নৈঃশব্দ্য সে বোধহয় দেখেনি। নীরবতা এতখানি বুকচাপা হয় এর আগে অনিমেষ এমন করে কখনো বোঝানি। সেই বাড়ি থেকে বের হবার পর যে-ধ্বনি দেওয়া চলছিল, যে-মানুষগুলো সুনীলদাকে কেন্দ্র করে জেহাদ জানাচ্ছিল, এখন এই সময় তারা ছবির মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কতখানি ভালোবাসা পেলে এরকমটা হয়-অনিমেষ আঁচ করতে পারছিল না। তবে সুনীলদা কিছু মানুষকে
false
humayun_ahmed
বুশ এবং বারাক ওবামা বিষয়ে জটিল আলোচনায় চলে গেলেন। এই ফাঁকে আমি খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, খালু সাহেবের মানি ব্যাগে যে নাম্বার পাওয়া গেছে তার সর্বশেষ অবস্থা কি? যার নাম্বার তাকে আইডেনটিফাই করা গেছে? খালা বিরস গলায়, বললেন, হ্যাঁ। যার নাম্বার সেই হারামজাদা নিউমার্কেটের কসাই। গরুর মাংস বিক্রি করে। তোর খালু তার কাছ থেকে মাংস কিনে। মেজাজ এমন খারাপ হয়েছে। এই খবর বের করতে চল্লিশ হাজার টাকা খরচ করেছি। বাদ দে কসাইটার কথা, তোদের মেসে না-কি অতিক্ষমতাধর এক পীর সাহেব থাকেন। অশ্রু বাবা নাম। অশ্রু বাবা না, অশ্রুভাই। বাবা পর্যায়ে উনি এখনো উঠতে পারেন নি। খালা গলা নামিয়ে বললেন, তার কাছ থেকে তাবিজ এনে দিতে পারবি? মাথার চুল পড়া বন্ধ হবার তাবিজ। মাথার সব চুল পড়ে যাচ্ছে। যথা সময়ে তাবিজ পাবে। উরসের দাওয়াতের চিঠিও পাবে। এক বৃষ্টির রাতে আমি এলিতাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে বের হলাম। এলিতা বলল, হিমু আমার কখনো ফ্যামিলি বলে কিছু ছিল না। এখন মনে হচ্ছে, . আমি বললাম, পরিবার মানেই তো যন্ত্রণা। সুখী সেই জন যার কেউ নেই। এমন কেউ কি আছে যার কেউ নেই? আমি বললাম, আছে। তারা মানুষের মতই কিন্তু মানুষ না। প্রবল ঝড় বৃষ্টির রাতে এরা রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে। আমি এদের নাম দিয়েছি। পক্ষীমানব। পক্ষীমানবদের চেনার উপায় হচ্ছে তাদের চোখে থাকে সানগ্নাস। হাতে গ্লাভস। তাদের হাতের আঙ্গুল পাখির নখের মত বলে এরা আঙ্গুল গ্লাভসের ভেতর লুকিয়ে রাখে। হিমু তুমি আমায় লেগ পুলিং করছ। না লেগ পুলিং না। আমি একবার একজনকে দেখেছি। এদের খুব চেষ্টা থাকে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার কিন্তু পারে না। এলিতা বলল, তুমি অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বল। কোনটা বিশ্বাস করব কোনটা করব না, বুঝতে পারি না। পক্ষীমানবদের কথা বিশ্বাস করতে পার। তাদের গলার স্বর অদ্ভুত মিষ্টি। ঝড় বৃষ্টির রাত হলেই এলিতা আমার সঙ্গে পক্ষীমানবের সন্ধানে বের হয়। মানব জাতির সমস্যা হচ্ছে তাকে কোনো না কোনো সন্ধানে জীবন কাটাতে হয়। অর্থের সন্ধান, বিত্তের সন্ধান, সুখের সন্ধান, ভালবাসার সন্ধান, ঈশ্বরের সন্ধান। আমি আর এলিতা সন্ধান করছি সামান্য পক্ষীমানবের। ———– এলিতার একটি ছবি এর বার্ষিক প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার পেয়েছে। ছবিটিতে আমি আছি। তানিজা আমাকে জমজমের পানি খাওয়াচ্ছে। উৎসর্গ / প্রসঙ্গ – হিমু (১৯৯৩) উৎসর্গ আয়েশা মোমেন, আপা, আপনি ভালবাসার যে কঠিন ঋণে আমাকে জড়িয়ে রেখেছেন, সেই ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়।। ঋণ হয়ে থাকতে ভাল লাগে না, কিন্তু কী আর করা! প্রসঙ্গ হিমু —————– হিমু আমার প্রিয় চরিত্রের একটি। যখন হিমুকে নিয়ে কিছু লিখি—নিজেকে হিমু মনে হয়, একধরণের ঘোর অনুভব করি। এই ব্যাপারটা অন্য কোনো লেখার সময় তেমন ঘটে না। হিমুকে নিয়ে আমার প্রথম লেখা ময়ুরাক্ষি। ময়ুরাক্ষি লেখার সময় ব্যাপারটা প্রথম লক্ষ করি। দ্বিতীয়বারে লিখলাম দরজার ওপাশে। তখনো একই ব্যাপার। কেন এরকম হয়? মানুষ ‍হিসেবে আমি যুক্তিবাদী। হিমুর যুক্তিহীন, রহস্যময় জগৎ একজন যুক্তিবাদীকে কেন আকর্ষণ করবে? আমার জানা নেই। যদি কখনো জানতে পারি—পাঠকদের জানাবো। হুমায়ুন আহমেদ এলিফেন্ট রোড। ‘কি নাম বললেন আপনার, হিমু?’ ‘জ্বি, হিমু।’ ‘হিম থেকে হিমু?’ ‘জ্বি-না, হিমালয় থেকে হিমু। আমার ভাল নাম হিমালয়। ‘ঠাট্টা করছেন?’ ‘না, ঠাট্টা করছি না।’ আমি পাঞ্জাবির পকেট থেকে ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট বের করে এগিয়ে দিলাম। হাসিমুখে বললাম, সার্টিফিকেটে লেখা আছে। দেখুন। এষা হতভম্ব হয়ে বলল, আপনি কি সার্টিফিকেট পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ান? ‘জ্বি, সার্টিফিকেটটা পকেটেই রাখি।হিমালয় নাম বললে অনেকেই বিশ্বাস করে না, তখন সার্টিফিকেট দেখাই। ওরা তখন বড় ধরণের ঝাঁকি খায়।’ আমি উঠে দাড়ালাম।এষা বলল, আপনি কি চলে যাচ্ছেন? ‘হুঁ।’ ‘এখন যাবেন না। একটু বসুন।’ আমার যেহেতু কখনোই কোনো তাড়া থাকে না—আমি বসলাম। রাত ন’টার মতো বাজে। এমন কিছু রাত হয়নি—কিন্তু এ বাড়িতে মনে হচ্ছে নিশুতি। কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। বুড়ো মনে হয় এই ফ্ল্যাটের নয়। পাশের ফ্ল্যাটের। এষা আমার সামনে বসে আছে। তার চোখে অবিশ্বাস এবং কৌতুহল একসঙ্গে খেলা করছে। সে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছে, আবার জিজ্ঞেস করতে ভরসা পাচ্ছে না। আমি তাদের কাছে নিতান্তই অপরিচিত একজন। তার দাদীমা রিকসা থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়েছেন। আমি ভদ্রমহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে মাথা ব্যান্ডেজ করে বাসায়ে পৌঁছে বেতের সোফায় বসে আছি।এদের কাছে এই হচ্ছে আমার পরিচয়। আমি খানিকটা উপকার করেছি। উপকারের প্রতিদান দিতে না পেরে পরিবারটা একটু অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে।ঘরে বোধহয় চা-পাতা নেই। চা-পাতা থাকলে এতক্ষণে চা চলে আসত। প্রায় আধঘণ্টা হয়েছে। এর মধ্যে চা চলে আসার কথা। আমি বললাম, আপনাদের বাসায় চা-পাতা নেই, তাই না? এষা আবারো হকচকিয়ে গেল।বিস্ময় গোপন করতে পারল না। গলায় অনেকখানি বিস্ময় নিয়ে বলল, না, নেই। আমাদের কাজের মেয়েটা দেশে গেছে। ওই বাজার-টাজার করে। চা-পাতা না থাকায় আজ বিকেলে আমি চা খেতে পারিনি। ‘আমি কি চা-পাতা এনে দেব?’ ‘না না, আপনাকে আনতে হবে না। আপনি বসুন। আপনি কী করেন?’ ‘আমি একজন পরিব্রাজক।’ ‘আপনার কথা বুঝতে পারছি না।’ ‘আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই।’ এষা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আপনি কি ইচ্ছা করে আমার প্রশ্নের উদ্ভট উদ্ভট জবাব দিচ্ছেন?’ আমি হাসিমুখে বললাম, যা সত্যি তাই বলছি।সত্যিকার বিপদ হল—সত্যি কথার গ্রহণযোগ্যতা কম। যদি বলতাম, আমি একজন বেকার, পথে-পথে ঘুরি, তা হলে আপনি আমার কথা সহজে বিশ্বাস করতেন।’ ‘আপনি বেকার
false
shirshendu
মুক্তি দিয়ে গেছে। যতদিন কাছে ছিল ততদিন উদ্বেগ উৎকণ্ঠা পরিশ্রমে বিলু শুকিয়ে গিয়েছিল। প্রীতম শিলিগুড়িতে থাকলেও তাকে কর্তব্যবশে মাঝে মাঝে যেতে হত সেখানে। এখন সেসব বালাই গেছে। সত্য বটে, প্রীতমের জন্য আজও তার কান্না পায়, কিন্তু সেই সঙ্গে বহুদিনের আকাঙিক্ষত এক মুক্তির আনন্দও ঘিরে ধরে তাকে। সেই আনন্দেই সে গুনগুন করে গান গায়। অসুস্থ স্বামী নিরুদ্দেশ, বেঁচে আছে কি না ঠিক নেই, এই অবস্থায় তোমার কি আর-একটু বিষণ্ণ হওয়া উচিত নয়? এই বলে সে নিজেকে মাঝে মাঝে মৃদু ধমকও দেয়। কিন্তু তাতে কাজ হয় না। আজকাল এক আনন্দই তাকে ভাসিয়ে নেয় যে! সে কি অবৈধ আনন্দ? বিলু খেতে বসতে যাচ্ছিল ঠিক এই সময়ে দরজায় কেউ মৃদু কড়া নাড়ল। রোজ না হলেও মাঝে মাঝেই অরুণ এসে তাকে তুলে নিয়ে পৌঁছে দেয় অফিসে। কিন্তু অরুণের কড়া নাড়ার ধরন আলাদা। তাতে আত্মবিশ্বাস থাকে। এ রকম মৃদু ভীরু আওয়াজ তার নয়। দেখ তো কে?–অচলাকে বলল বিলু। লাবুকে ইস্কুল থেকে আনতে যাওয়ার জন্য পোশাক পরছিল অচলা। একটু সময় নিল। কিন্তু এই ফাঁকটুকুতে আর একবারও কড়ায় নাড়া পড়ল না। অরুণ নয়। সে হলে এর মধ্যে আরও বার চারেক কড়া নাড়ত। অচলা দরজা খুলে অবাক গলায় বলল, ও মা! শতম দাদাবাবু! বিলু একটু থমকে গেল খাওয়ার মাঝখানে। বুকটা কেঁপে উঠল জোরে। ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। খিদে ছিল খুব, কিন্তু হঠাৎ খিদের মাথায় জল ঢেলে দিল কে যেন। উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু হাত-পা একটু কাঁপছিল বলে টক করে উঠতে পারল না। তার আগেই শতম এসে ঢুকল। তেমনি দাড়িওলা মুখ। রুক্ষ জোয়ান শরীর। ব্যাগটা মেঝেয় রেখে একটু শুকনো হেসে বলল, কেমন আছো বউদি? বিলু খানিকক্ষণ শতমের দিকে চেয়ে থাকে। খারাপ খবর থাকলে শতমের মুখ দেখেই বোঝা যাবে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না বিলু। মাঝখানের ঘরে প্রীতমের চৌকিটা এক কোণে সরিয়ে দিয়ে ডাইনিং টেবিলটা পাতা হয়েছে। চৌকিটায় আজকাল অচলা শোয়। শতম বিছানায় বসে একটা ক্লান্তির শ্বাস ছাড়ল। বলল, খাওয়া থামালে কেন? খাও। বিলু অপলক চোখে শতমকে দেখছিল। হাত-পা শরীরে ঢুকে আসবে যেন। বলল, কোনও খবর পেলে? শতম মাথা নাড়ল, না। তবে হাল ছাড়িনি। বিলু মাথা নিচু করে প্লেটে আঙুল দিয়ে কয়েকটা দাগ কাটল। খিদে মরে গেছে। বলল, তোমাকে আচমকা দেখে এত ভয় পেয়েছিলাম। শতম বিষণ্ণ মুখে বলে, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কোনও খবর পেলে টেলিগ্রাম বা ট্রাংককল করতাম। নিজে এসে সময় নষ্ট করতাম না। আমি এসেছি কাজে। আজই সন্ধের গাড়িতে চলে যাব। আজই? আজই। বাড়ি ছেড়ে থাকার উপায় নেই। মা-বাবার অবস্থা তো জানো। কেউই বেশিদিন বাঁচবে বলে মনে হয় না। খুব ভেঙে পড়েছেন? তোমাকে জানাইনি ইচ্ছে করেই। বাবার সেরিব্রেল অ্যাটাক হয়ে গেছে একটা। মার প্রেশার দুশোর নীচে নামছেই না। মরম একটা চাকরি পেয়ে গৌহাটি চলে গেছে। রূপমকে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নিয়েছি। সে বেলকোবার সাইটে রয়েছে ক্যাম্প করে। বাড়িতে শুধু ছবি। ছবির বিয়ের কিছু হল? সেই কথাই বলতে আসা। বিয়ে ঠিক হয়েছে। যদিও প্রীতমের বাড়ির সঙ্গে বিলুর সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ তবু একটা গিঁট তো কোথাও আছে। ছবির যে বিয়ের আর দেরি করা উচিত নয় সেটা মাঝে মাঝে তারও মনে হয়। ছবি দেখতে সুন্দরী নয়। ভাল পাত্র পেলে সেটা কপাল। বিলু জিজ্ঞেস করল, পাত্র কেমন? খুব কিছু নয়। দাদারই এক বন্ধু। দাদার বন্ধু? তা হলে তো বয়সে অনেক বড় হবে। শতম হাসল, আমরা পিঠোপিঠি ভাই বোন। বয়সের ফারাক খুব একটা নয়। বড় জোর বছর দশেক। দশ বছর! বলো কী? সে তো ছবির জ্যাঠামশাই। শতমের মুখ থেকে হাসি গেল না, দশ বছরও আমার মতে কম। স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে বয়সের অনেকটা পার্থক্য না থাকলে ইয়ার বন্ধুর মতো সম্পর্ক হয়। স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাভক্তিও থাকে না। জানো তো, পতি আর পিতা একই ধাতু নিষ্পন্ন শব্দ? ও বাবা, তুমি তো আবার শাস্ত্র পড়া মানুষ! কার সঙ্গে কী বলছিলাম! শতম মাথা নেড়ে বলল, আমি হাওয়ায় ভেসে যেতে পছন্দ করি না। যা ভাল যা মঙ্গলপ্রদ সেটা লোকে উড়িয়ে দিলেও আমি পরীক্ষা করে দেখতে ভালবাসি। বিয়েটা কী করে ঠিক হল? আচমকা। দাদা নিরুদ্দেশ হওয়ায় আমরা ছবির বিয়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎই দাদার আর-এক বন্ধু সম্বন্ধটা আনল। পাত্র কী করে? ইঞ্জিনিয়ার। জলঢাকা প্রজেক্টে আছে। বলো কী? তা হলে তো খুব ভাল পাত্র। আমাদের তুলনায় ভালই। পাত্র এতদিন বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে ছিল। কিন্তু দাদার খবর এবং আমাদের পরিবারের অবস্থা শুনে নিজেই ঠিক করে যে, ছবিকে বিয়ে করবে। বাঃ, খুব ভাল লোক তো! খুবই ভাল। কোনও ডিমান্ড নেই। বরং আমাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছে কিছু দিলেও সে নেবে না। তুমি চেনো ভদ্রলোককে? ছেলেবেলায় দেখেছি। তারপর উনি বাইরে চলে যান। বাইরে বলতে বিদেশে নাকি? না। রাউরকেল্লা, দুর্গাপুর আরও কোথায় যেন। দেখতে কেমন? কালো। তবে বেশ স্বাস্থ্যবান। লম্বাও অনেকটা। মা-বাবা আছে? মা আছে। ভাইবোন? অনেকগুলি। চারজন বিয়ের যুগ্যি মেয়ে রেখে বাবা মারা যান। শিবেনদা চাকরি করে বোনেদের বিয়ে দিয়েছেন। তিনটি ভাইও ভাল চাকরি করছে এখন। ঘরবাড়ি? কোন্নগরে বাড়ি করেছে ইদানীং। ছবিকে কোথায় রাখবে? অতশত জানি না। জিজ্ঞেস করিনি। নামটা কী বললে? শিবেন? হ্যাঁ। বড্ড পুরনো নাম। অবশ্য নামে কীই-বা এসে যায়! ছবি খুশি? খুশি হওয়ার
false
zahir_rayhan
ইতিমধ্যে শুনেছে সব, কিম্বা শোনে নি। তবু কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে গেলো সে। জাহানারা আবার প্রশ্ন করলো, ডলি কেমন আছে? মুনিম বললো, জানি না। জাহানারার ঠোঁটে মৃদু হাসি জেগে উঠলো। না জানবার তো কথা নয়। জাহানারার দিকে স্থির চোখে তাকালে সে। মুখখানা বিরক্তি আর অসহিষ্ণুতায় ভরা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সে বললো, তার কথা আমাকে জিজ্ঞেস করো না। জাহানারা, প্লিজ-1 দৃঢ় গলায় কথাটা বলবে ভেবেছিলো, কিন্ত ফাটা বাঁশের বাঁশির মত শোনাল সবকিছু। এ সময় ডলির কথাটা না তুললে কি ভাল করতো না জাহানারা? কাণ্ডজ্ঞানহীন আর কাকে বলে। তার ওপর রাগ করার কোন অর্থ হতে পারে না জেনেও চেয়ারটাতে সশব্দে পেছনের দিকে ঠেলে, পাশের ঘরের যেখানে অধ্যাপক হাত ধুয়ে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো, সেখানে তার পাশে গিয়ে বসলো মুনিম। জাহানারা বিস্ময়ভরা দৃষ্টি মেলে তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ। রাত দুপুরে কিউ খানের বাসা থেকে লোক আসবে তাকে ডাকতে, এ কথা ঘুমোবার এক মুহূর্ত আগেও ভাবেনি মাহমুদ। লেপের ভেতরে কি আরামে ওয়েছিল সে। একটা সুন্দর স্বপ্নও ইতিমধ্যে দেখেছিলো। এখন আবার কাপড় পড়ে যেতে হবে সেই দু মাইল দূরে, কিউ খানের বাসায়। ভাবতে গিয়ে মেজাজটা বিগড়ে গেলে মাহমুদের। দুত্তরি তোর চাকুরির নিকুচি করি। রাত নেই দিন নেই ডেকে পাঠাবে, যেন কেনা গোলাম আর কি। মনে মনে বিড়বিড় করলো সে। তারপর গরম কোটটা গায়ে চড়িয়ে নিয়ে একটু পরে বাইরে বেরিয়ে এলো। সাহানা ঘুমুচ্ছে। ঘুমোক। কিউ খানের বাসায় এসে দেখলো সে একা নয়। আরো অনেকে এসেছে সেখানে। বাইরে বারান্দায় রীতিমত ভিড় জম গেছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় বাতাসটা নীল হয়ে আসছে। ইন্সপেক্টর রশীদকে সামনে পেয়ে একপাশে ডেকে নিয়ে এলো মাহমুদ। ব্যাপারটা কি বলতো, এই রাত দুপুরে? ইন্সপেক্টর রশীদ বিরক্তি প্রকাশ করে বললো, রাতে কয়েকটি বাসা সার্চ করতে হবে বোধ হয়, আমি ঠিক জানি না। তারপর গলার স্বরটা আরো একটু নামিয়ে এনে বললো, বড় কর্তারা সবাই ভীষণ ক্ষেপে গেছে। ভেতরে এখন ক্লোজ ডোরে আলাপ-আলোচনা চলছে ওদের। মাহমুদ বললো, তাহলে এখনো কিছু ঠিক হয় নি। রশীদ মাথা নাড়লো, না। মাহমুদ হতাশ গলায় বললো, রাতের ঘুমটা একেবারে মাটি হলো। রশীদ মৃদু হেসে বললো, করাতের হয় দেখো! আবহাওয়া ভীষণ গরম। বড় কর্তা রেগে গিয়ে বলেছে, এত কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে শহরে অথচ কাউকে গ্রেফতার করা হলো না, কেমন কথা? মাহমুদ বললো, আমারো তাই মত। ধরে সবগুলোকে জেলে পোরা উচিত। রশীদ আবার হাসলো। তেমনি চাপা স্বরে বললো, ধরা উচিত তো বুঝলাম। কিন্তু কজনকে ধরবে। মাহমুদ পরক্ষণে বললো, কেন যারা এসব করছে তাদের সকলকে। বাইরে আকাশটা কুয়াশায় ছাওয়া ছিলো। সেদিকে তাকিয়ে ইন্সপেক্টর রশীদ জবাব দিলো, ধরে শেষ করতে পারবে বলে তো মনে হয় না বলে চারপাশে তাকিয়ে দেখলো রশীদ। কেউ শুনলো নাতো? কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাহমুদ কাঁধ ঝাঁকালো। যাকগে, আমাদের ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। কর্তারা যা করার করবে যদি বলে ধরো, ধরবো। যদি বলে ছাড়ো, ছাড়বো। যদি বলে মারো, মারবো। আমাদের কি ভাই, টাকা পাই চাকরি করি। বলে একটা চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়লো মাহমুদ। হা তোমার কাছে সিগারেট আছে? তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে আমার প্যাকেটটা ফেলে এসেছি বাসায়। রশীদ কিছু বললো না, পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে নিঃশব্দে এগিয়ে দিলে তার দিকে। বাইরে ঘন কুয়াশা ঝরছে। ভেতরে কর্তারা বৈঠক করছেন এখনো। মাঝে মাঝে তাদের হাসির শব্দ ভেসে আসছে বাইরে। মাঝে মাঝে উগ্র গলার স্বর। এখান থেকে স্পষ্ট কিছু বোঝা যাচ্ছে না কি বলছে তার। মাহমুদ সিগারেটে একটা জোর টান দিলো। পরদিন বিদ্যালয়ের গেটে যেখানে নোটিশ বোর্ডগুলো টাঙ্গানো ছিলো, তার পাশে সাঁটানো, লাল কালিতে লেখা একটি দেয়াল পত্রিকার উপর দল বেঁধে ঝুঁকে পড়লো ছেলেমেয়েরা। কারো পরনে শাড়ি, কারো সেলওয়ার। দেয়াল পত্রিকাটা পড়ছিলো আর গম গম স্বরে কথা বলছিলো ওরা। নীলা আর বেনু অদূরে দাঁড়িয়ে। সারা রাত জেগে ওই দেয়াল পত্রিকা লিখেছে ওরা। কাল রাতে কেউ ঘুমোয় নি। কালো বার্নিশ দেয়া কাঠের সিঁড়িটা বেয়ে পা টিপে টিপে যখন নিচে নেমে আসছিলো নীলা তখন হাত ঘড়িটায় বারটা বাজে। চারপাশে ঘুঘুটে অন্ধকার আর চাপা গলার ফিসফিসানি। করিডোর পেরিয়ে ডাম কোণে বেনুর ঘরে এসে জমায়েত হয়েছিল ওরা। বাতি কি জ্বালবো? না। মোম আছে? আছে। জানালাগুলো বন্ধ করে দাও। সুপার কি ঘুমিয়েছে। হ্যাঁ। দরজায় খিল দিয়ে দাও। ম্যাচেশটা কোথায়। আহ্ শব্দ করো না, সুপার জেগে যাবে। টেবিল চেয়ারগুলো একপাশে সরিয়ে নিয়ে, মসৃণ মেঝের ওপরে গোল হয়ে বসলো ওরা। বাইরে রাত বাড়ছে। মোমবাতির মৃদু আলোয় বসে দেয়াল পত্রিকাগুলো লিখছে ওরা। তাই আজ বিদ্যালয়ের সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে ওরা কান পেতে শোনার চেষ্টা করছিলো কে কি মন্তব্য করে। আমতলায় জটলা করে দাঁড়িয়েছিলো তিনটি ছেলে আর দুটি মেয়ে। একটি ছেলে সহানুভূতি জানিয়ে একটি মেয়েকে বললো, খালি পায়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে নাতো আপনাদের কষ্ট? কি যে বলেন। মেয়েটি ঈষৎ ঘাড় নেড়ে বললো, খালি পায়ে হাঁটার অভ্যাস আছে আমাদের। অদূরে বেলতলায় বসে একদল নতুন ছেলেকে একুশে ফেব্রুয়ারির গল্প শোনাচ্ছিলো কবি রসুল। সত্যি বরকতের কথা ভাবতে গেলে আজো কেমন লাগে আমার। মাঝে মাঝে মনে হয় সে মরে নি। মধুর রেস্তোরাঁয় গেলে এখনো তার দেখা পাবো। বলতে গিয়ে গলাটা ধরে এলো
false
MZI
লি-হানের ছবিটি ছোট স্ক্রিনে ফুটে উঠল। সে একধরনের আতঙ্কিত গলায় বলল, কী হয়েছে তোমার ইবান? আমি জড়িত গলায় বললাম, ঘুমাচ্ছিলাম। নিহিলিন নিয়ে কয়দিন জেগে ছিলাম তো, শরীর আর চলছিল না। আমিও তাই আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু তাই বলে এত দীর্ঘ সময় ঘুমুবে বুঝতে পারি নি। আমিও বুঝতে পারি নি। যা-ই হোক কেন ডেকেছ বল। আমাদের হাতে সময় নেই। তোমাকে এক্ষুনি যাত্রা শুরু করতে হবে। এক্ষুনি মানে কখন? আগামী ছত্রিশ ঘণ্টার মাঝে। একটা চৌম্বকীয় ঝড় আসছে, সেটা আসার আগে শুত্র না করলে অনেক দেরি হয়ে। যাবে। ও। আমি ঘুম থেকে জেগে ওঠার চেষ্টা করতে করতে বললাম, কিন্তু আমার নিজেরও তো একটু প্রস্তুতি নিতে হবে। না। তোমার নিজের প্রস্তুতি নেবার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমার সবকিছুর প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত কিছু কাজ— লি-হান অধৈর্য হয়ে বলল, তোমার কোনো কিছু আর ব্যক্তিগত নেই। যখন থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তোমাকে পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক করা হবে সেদিন থেকে তোমাকে চব্বিশ ঘণ্টা চোখে-চোখে রাখা হয়েছে। তোমার ব্যক্তিগত সবকিছু আমরা জানি— ঠিক সেভাবে ফোবিয়ানে সবকিছু রাখা হয়েছে। তোমার পছন্দসই বইপত্র মেটা ফাইল থেকে শুরু করে প্রিয় খাবার, প্রিয় পোশাক, প্রিয় সঙ্গীত সবকিছু পাবে। তোমার কোনো ব্যক্তিগত কাজ বাকি নেই ইবান। কিন্তু— কোনো কিন্তু নেই। তা ছাড়া ফোবিয়ানের চরম গতিবেগ তোলার আগে পর্যন্ত তুমি নেটওয়ার্কে সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবে। আমি ইতস্তত করে বললাম, আমি সাথে আরো একটি জিনিস নিতে চেয়েছিলাম। কী? রিতুন ক্লিসের মস্তিষ্ক ম্যাপিং। লি-হান এবারে থেমে গিয়ে একটা শিস দেবার মতো শব্দ করল। আমি ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পাওয়া যাবে না? একটু কঠিন হবে কিন্তু আমি চেষ্টা করব। চেষ্টা করলে হবে না। আমাকে পেতেই হবে। তুমি জানো আমি প্রায় একযুগ এই মহাকাশযানে একা-একা বসে থাকব। আমার কথা বলার জন্যে একজন মানুষ দরকার। লি-হান হাসার শব্দ করে বলল, আমাদের সময়ে তুমি প্রায় একযুগ থাকবে, কিন্তু তোমার নিজের ফ্রেমে তো এতো দীর্ঘ সময় নয়। খুব বেশি হলে তিন বছরের মতো। তিন বছর আর একযুগে কোনো পার্থক্য নেই। একই ব্যাপার। একটা-কিছু গোলমাল হলেই তিন বছর সত্যিসত্যি একযুগ নয় একেবারে এক শতাব্দী হয়ে যেতে পারে। বুঝেছি। আমি গলার স্বরে যথেষ্ট গুরত্ব দিয়ে বললাম, আমাকে রিতুন ক্লিসের মস্তিষ্ক ম্যাপিং না দেয়া হলে আমি কিন্তু এই অভিযানে যাব না। লি-হান একটু অধৈর্য হয়ে বলল, আহ্! তুমি দেখি মহাকাশ-দস্যুদের মতো ব্ল্যাক মেইলিং শুরু করলে। এটা ব্ল্যাক মেইলিং নয়— এটা সত্যি। ঠিক আছে আমি যোগাড় করে দেব। আমার আরো একটা জিনিস দরকার। কী? আমার মায়ের জন্যে একটা উপহার। কী উপহার নিতে চাও? ঠিক বুঝতে পারছি না। বায়োডোমের বাইরে ঝড়ো বাতাসের গর্জনের সাথে মিল রেখে একটা সঙ্গীত- ধ্বনি তৈরি হয়েছে। শুনলেই বুকের মাঝে কেমন জানি করতে থাকে। সেই সঙ্গীত-ধ্বনি নিতে পার। ঠিক আছে। কিংবা এই গ্রহের প্রাচীন সভ্যতার কোনো চিহ্ন। কোনো রেলিক। গ্রানাইটের ছোট কোনো মূর্তি? বেশ। তুমি যদি মনে করো সেরকম কিছু খুঁজে পাবে— সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোয়ার্টজের গোলকের ভিতরে করে একটা সৌভাগ্য-বৃক্ষ নিয়ে যাও। সৌভাগ্য-বৃক্ষ? হ্যাঁ। এই গ্রহের একটি বিশেষ ধরনের গাছ রয়েছে, ছোট গাছ তার মাঝে রয়েছে ছোট ছোট নীল পাতা। এখানকার মানুষ বলে যখন জীবনে বড় ধরনের সৌভাগ্য আসে তখন সেখানে ফুল ফোটে। উজ্জ্বল কমলা রংয়ের ফুল। ভারি চমৎকার দেখতে! বেশ। তাহলে এই গাছটাই নেয়া যাক। কিন্তু আন্তঃনক্ষত্র পরিবহনে গাছপালা বা জীবন্ত প্রাণী আনা-নেয়ার উপর নানারকম বিধিনিষেধ রয়েছে না? লি-হান হা হা করে হেসে বলল, তুমি তোমার মহাকাশযানে করে ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে নিয়ে যাচ্ছ। যাকে ম্যাঙ্গেল জ্বাসের মতো একটি বস্তুকে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয় তাকে যে-কোনো জীবন্ত প্রাণী নেয়ার অনুমতি দেয়া হবে। সেটা নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না! ঠিক আছে আমি চিন্তা করব না। তাহলে তুমি চার নম্বর এস্ট্রোডোমে চলে আসো। প্রস্তুতি শুরু করা যাক। তোমাকে তিন ঘণ্টা সময় দেয়া হলো। তিন ঘণ্টা? মাত্র তিন ঘণ্টার মাঝে আমি সারা জীবনের জন্যে একটা গ্রহ ছেড়ে চলে যাব? লি-হান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কেউ যদি আমাকে এই গ্রহ ছেড়ে চলে যাবার সুযোগ করে দিত, আমি তিন মিনিটে চলে যেতাম! আমি কোনো কথা না বলে বাইরে তাকালাম। কুৎসিত বেগুনি আলোতে গ্রহটাকে কী ভয়ঙ্করই-না দেখাচ্ছে। লিহান মনে হয় সত্যি কথাই বলছে। ফোবিয়ানের কারগো ভল্টে স্টেনলেস স্টিলের কালো একটি সিলিন্ডারকে দেওয়ালের সাথে আটকে দিয়ে সামরিকবাহিনীর উচ্চপদস্থ মানুষটি বলল, এটি হচ্ছে ম্যাঙ্গেল ক্বাস। ফোবিয়ানের মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে একে বুঝিয়ে দেওয়া হলো। মহাকাশযানের ভরশূন্য পরিবেশে ভেসে ভেসে আমি সিলিন্ডারটির কাছে গিয়ে সেটি স্পর্শ করে বললাম, এই মানুষটি সম্পর্কে আমি এত বিচিত্র ধরনের গল্প শুনেছি যে আমি নিশ্চিত হতে চাই যে মানুষটি মাঝপথে জেগে উঠবে না। সামরিক অফিসারটি হেসে বলল, সে-ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পার, তাকে তরল হিলিয়াম তাপমাত্রায়২২ জমিয়ে রাখা আছে। জেগে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। তোমার-আমার বেলায় সেটি সত্যি হতে পায়ে, ম্যাঙ্গেল ক্বাসের বেলায় আমি এত নিশ্চিত নই! এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পার, পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র তোমার-আমার জন্যে যেটুকু সত্যি ম্যাঙ্গেল কৃাসের জন্যেও ততটুকু সত্যি। তরল হিলিয়াম তাপমাত্রায় মানুষের শরীরে কোনো জৈবিক অনুভূতি থাকে না। সে আক্ষরিক অর্থে একটি জড়বস্তু। বাইরে থেকে কেউ কোনো সঙ্কেত দিয়ে
false
MZI
করলাম। যখন সত্যিকার টাইট হবে সেদিন বুঝবে মজা। রাত্রে শুনলাম আব্বা আম্মাকে বলছেন, শুনেছি আজরফ আলীর কি হয়েছে আজ? কি হয়েছে তার? একজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে ধরেছিল রাস্তায়। বলেছে তোমার দিন শেষ। কলমা পড়– তাই বলেছে? মুক্তিযোদ্ধা? হ্যাঁ। মুক্তিযোদ্ধার কাছে স্টেনগান ছিল, স্টেনগানটা যেই বের করবে। তখন দুইজন রাজাকার এসে হাজির। সৰ্ব্বনাশ! তারপর? কেউ কেউ বলছে তখন একটা যুদ্ধ হয়েছে, কেউ কেউ বলছে। যুদ্ধ হয়নি, মুক্তিযোদ্ধাটি বাতাসের মত উবে গিয়েছে। সত্যি? হ্যাঁ, আব্বা হাসতে হাসতে বললেন, আর আজরফ আলী মনে করেছে রাজাকার দুজন মুক্তিযোদ্ধা। তখন নাকি তাদের পা ধরে ভেউভেউ করে কান্না! সত্যি? মুক্তিবাহিনী তাহলে শহরে নামতে শুরু করেছে? তাই তো মনে হয়। আমি অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখলাম। সত্যি কথাটা বলতে পারলাম না। পরদিন আমি আর রাশেদ মিলে আজরফ আলীর কাছে দুই নম্বর চিঠিটা পাঠালাম। সেটা শুরু হল। এইভাবে : এই বার তুই রাজাকারের পায়ে মুখ ঘষেছিস, মাপ চেয়েছিস— তারা তোকে মাপ করে দিয়েছে। আর কয়েকদিনের মাঝে আমি যখন তোর সামনে দাড়াব আমার পায়ে মুখ ঘষে তোর কোন লাভ হবে না! আমি তোকে মাপ করব না। … সপ্তাহখানেক পরে একদিন খুব সকালে রাশেদ এসে হাজির। স্কুল নাই কিছু নাই সকালে উঠার তাড়া নাই, ঘুম থেকে উঠতে উঠতে কোনদিন বেলা দশটা বেজে যায়। রাশেদ এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। আমি চোখ কচলে ঘুম থেকে উঠে বললাম, তুই? এত সকালে? মোটেও সকাল না। দশটা বাজে। দশটা বেজে গেছে? হ্যাঁ। রাশেদ চিন্তিত মুখে বলল, খালাম্মা মনে হয় তোর উপর একটু রেগে আছেন। কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইবু কি বাসায় আছে? খালাম্মা বললেন, লাট সাহেব এখনো ঘুমাচ্ছে, দেখি তুলতে পাে=র। কিনা। বিছানা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে বললেন তোকে। আমি চোখ থেকে ঘুম সরানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম, আম্মা এভাবেই কথা বলে! তুই এত সকালে এসেছিস কেন? খবর আছে। আমার ঘুম চটে গেল, কি খবর? এখানে বলা যাবে না। বাইরে যেতে হবে। এখনো মুখ ধুই নি, নাস্ত করি নি। তাহলে মুখ ধুয়ে নাস্ত কর। বিছানায় লাট সাহেবের মত শুয়ে আছিস কেন? আমি উঠে মুখ ধুয়ে এলাম। আম্মা রাশেদকে বললেন, আস তুমি ইরুর সাথে নাস্তা কর। না খালাম্মা আমি নাস্তা করে এসেছি। আরেকটু খাও। না খালাম্পমা। যদি বলেন এক কাপ চা খেতে পারি। চা? হ্যাঁ। কড়া লিকার রং চা। ফ্রেস পাত্তি। আম্মা একটু অবাক হয়ে রাশেদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার বুঝতে একটু সময় লাগল ‘কড়া লিকার রং চা ফ্রেস পাত্তি’ মানে কি। রাশেদ যখন আজীজ মিয়ার রেস্টুরেন্টে চা খেতে যায় চা অর্ডার দেবার সময় সব সময় এইটা বলে। বাসায় আমাকে চা খেতে দেয়া হয় না, কিন্তু আম্মা রাশেদকে নতুন চায়ের পাতা দিয়ে কড়া লিকারের দুধ ছাড়া চা তৈরি করে দিলেন। আমি যখন নাস্তা করছিলাম রাশেদ তখন খুব সখ করে তার চা চুমুক দিয়ে দিয়ে খেল। নান্ত করে আমি রাশেদকে নিয়ে বের হলাম। বাসার সামনে দেওয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে রাশেদ গলা নামিয়ে বলল, মুক্তিবাহিনী এসে গেছে। এসে গেছে? হ্যাঁ। কোথায়? নদীর ওপারে। সত্যি? হ্যাঁ। ছোট একটা দল এসেছে স্পেশাল মিশনে। কি মিশন? স্পেশাল মিশন। সেটা আবার কি? রাশেদ মাথা নাড়ল, আমি জানি না। আমাদের সাথে দেখা করতে চায়। আমি চমকে উঠলাম, কার সাথে? আমাদের সাথে। কেন? মনে আছে আমার স্কুলের ম্যাপ তৈরি করেছিলাম? মিলিটারী ক্যাম্পের সবকিছু দিয়ে? মনে আছে? হ্যাঁ। সেইটা মুক্তিবাহিনীর খুব পছন্দ হয়েছে। সত্যি? হ্যাঁ। কেমন করে পেলে তারা? আমি দিয়েছি। তুই কেমন করে দিলি? রাশেদ রহস্যময় ভঙ্গিতে হয়সে, মাথা নেড়ে বলে আমার সব জায়গায় কালেকশান আছে। তারা এখন আমাদের সাথে দেখা করতে চায়? হ্যাঁ। কিন্তু আমরা— আমরা এত ছোট? ছোট আর বড় আবার কি, দায়িত্ব নিয়ে কথা। ছোট বলে আমরা বড় দায়িত্ব নিতে পরি না? আমি মাথা নাড়লাম, তা ঠিক। উত্তেজনায় আমার বড় বড় নিঃশ্বাস পড়তে থাকে। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন করে দেখা করব? কবে দেখা করব? আজ রাতে। আজ রাতে? আকাশ থেকে পড়লাম, আজ রাতে কেমন কের দেখা করব। রাশেদ মাথা নাড়ল, তাই বলেছে, সময় নাই হাতে। আমি যাব দেখা করতে। তুই যেতে চাস? আমি? আজ রাতে? হ্যাঁ। কেমন করে যাব? বাসায় কি বলব? সেটা জানি না। কোন একটা মিছে কথা বলে — কি মিছে কথা বলব? আমি খানিকক্ষণ বসে চিন্তা করি, সত্যিকার একটা মুক্তিবাহিনীর দলের সাথে দেখা করতে যাওয়ার এমন একটা সুযোগ কেমন করে ছেড়ে দিই? রাশেদ বলল, তোর আম্মাকে বল আজ রাতে আমাদের বাসায় থাকিবি। তুই যদি চাস আমি গিয়ে বলতে পারি। আমি মাথা নড়িলাম, উহু তুই বললে কোন লাভ হবে না। তোর আব্বা না হয় আম্মা বললে একটা কথা ছিল। তা ছাড়া এখন এই মিলিটারী চারিদিকে, প্রতি রাতে দশটার পর কারফিউ, আম্মা রাতে কোথাও যেতে দেবে না। কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার অরু, আপার কথা মনে পড়ল। আমি রাশেদের দিকে তাকলাম, তবে তবে কি? অরু, আপাকে দিয়ে হতে পারে। অক্স আপা? হ্যাঁ— আমি ভুরু কুচকে চিন্তা করতে থাকি। একটা ফন্দী করা যায়, ধরা পড়লে একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে, আব্বা মনে হয় একেবারে জানে মেরে ফেলবেন। কিন্তু দেশের
false
shirshendu
আমি কিছু বুঝতেই পারছি না। প্রস নয়, চাকরি করে, দেখতে সুন্দর, বড়সড় ছেলে আছে, স্বামী জেল খাটছে, সব মিলিয়ে মহিলা খুবই অদ্ভুত। আমি হলে বিয়ে করার সাহস পেতাম না। হ্যাঁ, একটু অন্যরকম। খুবই অন্যরকম। ওর সঙ্গে আপনি জুটলেন কী করে? জুটে যায়।–উদাস গলায় বলে সুখেন। বীথি এত সহজে অচেনা লোককে শরীর দেয় কী করে? ওর ঘেন্না করে না? ভয় করে না? আপনাকে ঘেন্না?–অবাক হয়ে সুখেন বলে, আপনার মতো এরকম ভদ্রলোক ও আর পেয়েছে নাকি? আজ সন্ধেবেলাই তো আপনার কত প্রশংসা করছিল। রাগে তেতে উঠলেও প্রশংসার কথায় একটু থমকে গেল দীপনাথ। বলল, কীরকম? আপনার সম্পর্কে আমি যা ভেবেছি ওরও ধারণা তাই। আজ অনেকক্ষণ আপনার কথা হল। আমি তো কিছুই নই। একটা লম্পট চরিত্রহীন। ছিঃ ছিঃ, ওকথা বলবেন না। পুরুষমানুষের কোনও কলঙ্ক নেই। ওটা আপনার ধারণা, আমার নয়। তা হলে বরং আমার কান মলে দিন।-বলে বাস্তবিকই মাথাটা এগিয়ে দিল সুখেন। সুখেনের সঙ্গে পারা যায় না। কাজেই হাল ছেড়ে দিল দীপনাথ। বীথির সঙ্গে সেই সম্পর্কের কথা ভেবে আজও সে কোনও সুখ পায় না। বরং নিজের ভিতরটা কোনও মহামূল্যবান হারানোর দুঃখে হাহাকারে ভরে ওঠে। আর কোনওদিন সে বীথির কাছে যাবে না। রোদের রাস্তায় আনমনে হাঁটতে হাঁটতে সে ঘটনাটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছিল। এই রহস্যময় নোংরা শহর তার ভাল লাগছে না। একদম ভাল লাগছে না। তুই হুইলচেয়ারে কেন রে? আমাকে সবাই যে রুগি বানিয়ে রাখতে চায়, কী করব বলো তো সেজদা! তুই তো একটু-আধটু হাঁটতে পারছিলি। এখনও কি পারি না? পারি। দেখবে? থাক গে। বসে আছিস বসেই থাক। সারাদিন বসে থাকি। তুমি কতকাল পরে এলে। সময় পাই না রে। মনটাও ভাল নেই। তোমার মনের আবার কী হল? চাকরি যায়নি তো! না, চাকরিটা আছে। পার্মানেন্ট হয়েছ? এবার হয়তো হয়ে যাব। প্রীতম খুব সুন্দর একরকম হেসে বলে, অবশ্য সেটা জেনেই বা আমার কী হবে? জাগতিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে আজকাল ভাবি না। না ভাবাই ভাল। জগৎটা তো ভাল কিছু নয়। তোর মাথায় কোনওকালেই বিষয়বুদ্ধি ছিল না। তুই ছিলি আনমনা, ফিলজফার টাইপের। প্রীতম একমুখ হাসি নিয়ে বলল, তার মানে তো হাঁদা। একটু লজ্জা পায় দীপনাথ। ছেলেবেলায় অন্যমনস্ক প্রীতমকে সে নিজেই হাঁদা বলে ডাকত। তাই থেকে পাড়ায় তার নামই হয়ে গিয়েছিল হাঁদা। বলল, হাঁদা থাকাই ভাল। প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, এ সমাজে হাঁদার জায়গা নেই সেজদা। চার চৌকো না হলে টেকা যায় ‘না। দীপ স্মিতমুখে বলে, তা যদি বলিস তবে আমিও তোর চেয়ে কম দা নই। তুই তবু একটা ভাল চাকরি করছিলি। আমার মতো ওপরওয়ালার ফাইফরমাশ খাটতে হয়নি তোক। প্রীতম একটু থমকে গিয়ে বলে, ওপরওয়ালা কি তোমাকে ফাইফরমাশ করে? বেফাঁস কথাটা বলে ফেলেছে দীপনাথ। প্রীতম তাকে এতটাই ভালবাসে যে, তার আর বোস সাহেবের আসল সম্পর্কটা জানলে দুঃখ পাবে। তাই সে তাড়াতাড়ি বলল, চাকরি করতে গেলে ওরকম একটু আধটু করতে হয় রে। প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, ঠিক বুঝলাম না। বুঝিয়ে বলো। বোঝানোর কিছু নেই। ফাইফরমাশ মানে তো আর সেরকম কিছু নয়। আগেও তুমি এরকম কিছু কথা বলেছ। তখন গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু আজ তোমার মুখ দেখে অন্যরকম লাগছে। অন্যরকম লাগবার কী? আমি ঠিক আছি। চাকরি পাকা হলে সবই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। প্রীতম অনেকক্ষণ গুম হয়ে রিল। আস্তে হুইলচেয়ারটা ঘুরিয়ে মেঝের ওপর খানিকটা গড়িয়ে গিয়ে ফিরে এল। বলল, শুধু চাকরিই নয়, আরও কিছু ব্যাপার ঘটেছে সেজদা। তোমার চোখ অন্যরকম। মনে মনে প্রীতমের নজর থেকে রেহাই চাইছিল দীপনাথ। আগে ওর নজর এত তীক্ষ্ণ ছিল না। রোগে ভুগলে কি মানুষের অনুভূতি বাড়ে? বাড়ে হয়তো। দীপনাথ জানে, টি বি রোগীদের মধ্যে অনেকেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবি বা শিল্পী হয়েছে। হয়তো শরীরের ক্ষয় অন্যদিকে স্নায়ুকে স্পর্শকাতর করে তোলে। সে একটু অস্বস্তিতে ভরা গলায় বলল, কিছুই পালটায়নি। তুই ভুল দেখছিস। তুমি নিজে কিছু টের পাও না? না তো! কী টের পাব? আশ্চর্য! যদি সত্যি টের না পেয়ে থাকো তবে এখন থেকে খুব সাবধান হোয়ো সেজদা। কিসের জন্য সাবধান করছিস? প্রীতম মৃদু স্বরে বলল, যে মানুষ নিজের বশে থাকে না সে নানা অবস্থার চাপে পড়ে নানারকম মানুষের একটা সমষ্টি হয়ে দাঁড়ায়। দূর! কথাটার মানেই বুঝলাম না। তোমাকে কি আমি বোঝাতে পারি? তুমি চিরকালই আমার চেয়ে সবকিছু বেশি বোঝে। চিরকালই তোর মাথায় অদ্ভুত সব কথা আসে। একবার যেন কোন মহাপুরুষের একটা কথা তুলে শুনিয়েছিলি, শয়তান আর কেউ নয়, শয়তান হল মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী ইচ্ছা। কথাটার মানে অনেক ভেবে ভেবে শেষকালে বের করেছি। অদ্ভুত কথা। প্রীতম ভ্রু কুঁচকে বলে, অন্য সব কথা ছেড়ে এ কথাটাই বা মনে রাখলে কেন তুমি? প্রতিদ্বন্দ্বী ইচ্ছা কাকে বলে তা বুঝতে পেরেছি বলে। তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী ইচ্ছা কিছু হয়? সকলেরই হয়। প্রীতম মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তারপর আবার ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবে। খানিক বাদে বলে, আমার মাথা পর্যন্ত এখনও রোগটা পৌঁছয়নি। যতদিন না পৌঁছয় ততদিন আমি সব বুঝতে পারব সেজদা। কিন্তু আমার আজকাল কিছু বুঝতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় রোগটা তাড়াতাড়ি মাথায় পৌঁছে গেলে বুঝি ভাল হয়। দীপনাথ একটু অবাক হয়ে বলে, সে কী? তুই যে নেগেটিভ চিন্তা করতে ভালবাসতি না! তুই যে আমাকে রোগের কথাটাও উচ্চারণ করতে বারণ
false
MZI
মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে বাচ্চাটাকে দেখছে। আমাকে দেখে বলল, কী হল, পেপারটা আনতে এতক্ষণ? আমি ফিসফিস করে বললাম, পেপার না। তা হলে কে? দুর্দানা বেগম আর গনি সাহেব। বাচ্চা দেখতে এসেছে। এক্ষুনি বাচ্চাকে পানি থেকে তোল। এক্ষুনি। বাইরের ঘর থেকে দুর্দানা বেগম আবার বাঘিনীর মতো গর্জন করল, কোথায় বাড়ির মালিক? অনিক ফিসফিস করে বলল, আমি ওদেরকে কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখছি। তুমি বাচ্চাটাকে তোল। মাস্ক খুলে একটা টাওয়েলে জড়িয়ে নিয়ে আস। আ-আ-আমি? তুমি নয় তো কে? বাইরের ঘর থেকে আবার হুঙ্কার শোনা গেল, কোথায় গেল সবাই? অনিক তাড়াতাড়ি উঠে গেল। আমি তখন বাচ্চাটাকে পানি থেকে তোলার চেষ্টা করলাম। এত ছোট একটা বাচ্চাকে যখন শুকনো জায়গায় রাখা হয় তখন সে নড়তে চড়তে পারে না, এক জায়গায় শুয়ে থাকে। কিন্তু পানিতে সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। একটা ছোট বাচ্চা সেখানে তুখোড় সাঁতারু। আমি তাকে চেষ্টা করেও ধরতে পারি না। একবার খপ করে তার পা ধরলাম সে পিছুলে বের হয়ে গেল। আরেকবার তার হাত ধরতেই ডিগবাজি দিয়ে সরে গেল। শুধু যে সরে গেল তা না, মনে হল আমার দিকে তাকিয়ে জিব বের করে একটা ভেংচি দিল। এবার দুই হাত ঢুকিয়ে তাকে ধরতে চেষ্টা করলাম, তারপরেও কেমন করে যেন পিছলে বের হয়ে গেল। অনিক কতক্ষণ দুর্দানা বেগম আর গনি সাহেবকে আটকে রাখতে পারবে কে জানে, আমি এবার তাকে ভালোভাবে ধরার চেষ্টা করলাম আর তখন ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটল। বাচ্চাটার নিশ্বাস নেবার টিউবটা আমার হাতে পেঁচিয়ে গেল, বাচ্চাটা আমার হাত থেকে ছাড়া পাবার জন্যে একটা ডিগবাজি দিতেই তার মুখ থেকে মাস্কটা খুলে যায়। মাস্কটার ভেতর থেকে অক্সিজেনের বুদ্বুদ বের হতে থাকে আর সেটা ধীরে ধীরে পানিতে ভেসে উঠতে থাকে। আমি অনেক কষ্ট করে চিৎকার চেপে রাখলাম-বিস্ফারিত চোখে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আছি, দেখছি ধীরে ধীরে বাচ্চাটা পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চাটাকে ধরার চেষ্টা করছি, আর কী আশ্চর্য সেই অবস্থায় আমার হাত থেকে সে পিছলে বের হয়ে গেল। বাচ্চাটার নিশ্বাস নেবার জন্যে অক্সিজেন নেই কিন্তু সেটা নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই। অ্যাকুরিয়ামের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় মাছের মতো সঁতরে যেতে যেতে দুটো ডিগবাজি দিল। তারপর হাত-পা নাচিয়ে আমার দিকে এগিয়ে জিব বের করে আমাকে ভেংচে দিল। কিন্তু নিশ্বাস নেবে কীভাবে? আমি আবার হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করলাম, বাচ্চাটা আমার হাত থেকে পিছলে বের করে মাথাটা পানির ওপর এনে নিশ্বাস নিয়ে আবার পানির নিচে ড়ুবে গেল! এই বাচ্চার মতো চালু বাচ্চা আমি আমার জন্যে কখনো দেখি নি। আগে মুখে একটা মাঙ্কু লাগানো ছিল, সেখান থেকে অক্সিজেনের নল বের হয়েছিল, এত কিছু ঝামেলা নিয়ে সার দিতে তার রীতিমতো অসুবিধে হচ্ছিল। এখন তার শরীরের সাথে কিছু লাগানো নাই, সাঁতার দিতেও ভারি সুবিধে। তাকে ধরবে এমন সাধ্যি কার আছে? পানির ভেতবে ডিগবাজি দিতে দিতে ছুটে যাচ্ছে, আর যখন নিশ্বাস নেবার দরকার হয় তখন ভুশ করে মাথা বের করে বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে আবার পানিতে ঢুকে যাচ্ছে। আমি বিস্ফারিত চোখে এই বিস্ময়কর দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। পুরো ব্যাপারটি তখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। হঠাৎ করে আমার মাথা ঘুরে উঠল, আমি পড়েই যাচ্ছিলাম, কোনোমতে দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে বসে পড়ার চেষ্টা করলাম। বড় একটা আলমারি ধরে তার পাশে বসে পড়লাম, মনে হচ্ছে এখনই অজ্ঞান হয়ে যাব। ঠিক এই সময় ঘরটাতে দুর্দানা বেগম আর গনি সাহেব এসে ঢুকল। আলমারির আড়ালে ছিলাম বলে তারা আমাকে দেখতে পেল না কিন্তু আমি তাদের দেখতে পেলাম। তারা পুরো ঘরটিতে চোখ বুলিয়ে অ্যাকুরিয়ামের দিকে তাকাল, বাচ্চাটা সাতরে ওপরে উঠে ভুশ করে মাথা বের করে আবার নিচে নেমে এল। আমি নিশ্চিত ছিলাম দুর্দানা বেগম এখন গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দেবে কিন্তু সে চিৎকার দিল না। দুজনেই অ্যাকুরিয়াম থেকে তাদের চোখ সরিয়ে ল্যাবরেটরির অনা কোনায় নিয়ে গেল। তারা নিজের চোখে দেখেও বিষয়টা বুঝতে পারছে না, ধরেই নিয়েছে অ্যাকুরিয়ামে একটা মাছ সাঁতার কাটছে। কী আশ্চর্য ব্যাপার! দুর্দানা বেগম বলল, আপনার বাসায় একটা বাচ্চা অথচ আপনার ঘরবাড়ি এত নোংরা? শুধুমাত্র অনিক পুরো ব্যাপারটি বুঝতে পারছে, সে নিশ্চয়ই নিজের চোখকে বিশ্বাস। করছে না। উত্তরে কোনো একটা কথা বলার চেষ্টা করে বলল, ক-ক-করব। পপ-পরিষ্কার করব। গনি সাহেব নাক দিয়ে ফোঁৎ করে শব্দ করে বলল, আপনার মোটা বন্ধুটা বাচ্চাটাকে নিয়ে আসছে না কেন? অনিক বলল, আ-আ-আনবে। আপনারা বাইরের ঘরে বসেন। এ-এ-এক্ষুনি নিয়ে আসবে। দুর্দানা বেগম আর গনি সাহেব ঘর থেকে বের হতেই আমি কোনোমতে উঠে আবার অ্যাকুরিয়ামে হাত ঢুকিয়ে ফিসফিস করে বাচ্চাটাকে উদ্দেশ করে বললাম, দোহাই লাগে তোমার সোনামণি। আল্লাহর কসম লাগে তোমার কাছে আল! প্লি-ই-জ!। এত চেষ্টা করে যে বাচ্চাটাকে ধরতে পারি নি সেই বাচ্চা হঠাৎ সঁতরে এসে দুই হাত দুই পা দিয়ে আমার হাতটাকে কোলবালিশের মতো ধরে ফেলল। আমি পানি থেকে বাচ্চ আঁকড়ে ধরে রাখা হতিষ্টা বের করে, বাচ্চাটাকে তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। এর আগে কখনো ছোট বাচ্চা ধরি নি, তাই খুব সাবধানে দুই হাতে ধরে বাইরে নিয়ে এসে দাঁড়ালাম। দুর্দানা বেগম ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাচ্চাকে গোসল করাতে গিয়ে দেখি নিজেই গোসল করে ফেলেছেন। গনি সাহেব বলল, ছোট বাচ্চাকে
false
shomresh
করতে লাগল। মুহূর্তে অনিমেষরা বুঝতে পারল বেচারা কথা বলতে পারে না। ওর চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, হাতের কুকুরছানাটা ঝুলে পড়েছে। ছোটমা বোধহয় সামলাতে পারল না নিজেকে, চট করে একটা হাত বাচ্চাটার মাথায় রাখল। অনিমেষ দেখল সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটা কেমন শান্ত হয়ে গেল, তারপর ছোটমার গা-ঘেঁষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু ওর চোখ দুটো ভীষণ অবাক হয়ে ছোটমার মুখের ওপর সেঁটে রইল। মহীতোষ বোধহয় এ-দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখতে চাইছিলেন না, সুটকেসটা তুলে বললেন, লাইনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার দরকার নেই, বরং নদীর ধার দিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই চা-বাগান পড়বে, একবার এতে ঢুকে পড়লে আর কোনো বয় নেই। বাগান দিয়ে সোজা এগিয়ে খুটিমারি ফরেস্টের কাছে বাজারের রাস্তা পেয়ে যাব, চলো। ওরা এগোতেই বাচ্চাটা ছোটমার কাপড় ধরে টানাটানি শুরু করল। এক হাতে কুকুর অন্য হাতে কাপড় ধরে সে গোগোঁ শব্দ করে ছোটমাকে লাইনের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। ঠিক এই সময় দড়াম দড়াম শব্দ শুরু হয়ে গেল। ক্ষিপ্ত কুলিরা ওদের কোয়ার্টারের টিনের ছাদে পাথর ফেলছে। অনিমেষ নদীর ধারে দিয়ে সামান্য এগিয়ে গিয়েছিল, এবার ফিরে এসে বলল, না, কোনো রাস্তা নেই, কাটাগাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মা যেতে পারবে না। মহীতোষ নিজের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যাওয়াটা পছন্দ কছিলেন না, একটু উষ্ণ গলায় বললেন, পারবে না বললে তো হবে না, এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। ছোটমা বলল, যা কপালে আছে হবে–লাইন দিয়েই চলল। মহীতোষ বললেন, যা হলে মিছিমিছি বাড়ি ছেড়ে এলে কেন? কপাল ঠুকে বাড়িতে থেকে গেলেই তো হত! ছোটমার জেদ এসে গেল চট করে, আমি তো তা-ই থাকতে চেয়েছিলাম, তোমরাই তো পেয়ে দৌড়ে মরছ। আমি এগোচ্ছি, এই লাইনের মেয়েরা আমাকে চেনে, কিছু বলবে না। তোমরা আমার পেছনে এসো। মহীতোয় কিছু বলার আগেই ছোটমা সরু পায়ে-চলা-পথটা দিয়ে বাচ্চাটার সঙ্গে হাঁটতে আরম্ভ করল। মহীতোষ চুপচাপ ওদের চলে-যাওয়াটা দেখছিলেন। অনিমেষে কাছে এসে বলল, চলো? কাঁধ ঝাঁকালেন মহীতোষ, জেনেশুনে এরকম রিস্ক নেবার কোনো মানে হয়? যেই বাচ্চাটা আঁচল ধরে টেনেছে অমনি মন নরম হয়ে গেল। অনিমেষ অনেক কষ্টে হাসি চাপল, বাবা এবং মায়ের এই ব্যাপারটা ওর কাছে নতুন–বাবাকে খুব অসহায় দেখাচ্ছে এখন। অগত্যা ছেলের সঙ্গে মহীতোষ স্ত্রীর অনুগাম হলেন। জঙ্গলটুকু পার হতেই কয়লার গুড়ো–বিছানো রাস্তাটা পড়ল। ডানদিকের চা-বাগান থেকে উঠে এসে সোজা ফ্যাক্টরির দিকে চলে গিয়েছে। ট্রাক্টরের ভারী চাকার দাগ রয়েছে এখানে। রাস্তার ওপাশে সার দিয়ে কুলিদের ঘরগুলো। বেশির ভাগই খড়ের ছাউনি, মাটির দেওয়াল, দুএকটা ইটের গাঁথুনি থাকলেও ওপরে খড় চাপানো হচ্ছে। অনিমেষ দেখল সমস্ত লাইনটা খাখা করছে। কোথাও কোনো মানুষের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। বেশির ভাগ বাড়ির দরজা বন্ধু, গরুগুলো খুঁটিতে বাধা, মুরগিগুলো মেজাজে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। মহীতোষও বিস্ময়ে দেখছিলেন। এই অঞ্চলে তিনি অনেক বছর আগে এসেছিলেন। তাঁর কোয়ার্টার থেকে সামান্য দূরত্বের এই লাইনে আসবার কোনো প্রয়োজন তার পড়ে না। এখন এই নিঝুম পরিবেশ তাঁকে ভীষণরকম আশ্বস্ত করল। বোঝাই যাচ্ছে এই লাইনের ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-মন্দ এই মুহূর্তে তার বাড়ির সামনে জমায়েত হয়েছে। বেশ উত্তেজিত গলায় তিনি বললেন, তাড়াতাড়ি এই বেলা লাইনটা পার হয়ে চলো। অনিমেষরা কেউই এরকম আশা করেনি, এখন দ্রুত হাঁটা শুরু করে দিল। বাচ্চাটা সঙ্গে আসছিল, মহীতোষ তাকে ধমকালেন, এ ছোঁড়াটা, ঘর যা। সে শুনল কি না বোঝা গেল না, কারণ তার মুখ খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পরম আনন্দে সে ছোটমার হাত ধরে একটা মাটির বাড়ির দাওয়ার দিকে নেটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ছোটমা বলল, অ গেল যা, এ ছোড়া যে ছাড়ে না। আর এর বাপ-মায়ের বুদ্ধি দ্যাখো–একে একা ফেলে পালিয়েছে সব। পালানো শব্দটা অনিমেষের কানে গাললেও সে কিছু বলল না। ছেলেটা ততক্ষনে গোগোঁ করে আঙুল তুলে কাউকে দেখবার চেষ্টা করছে। একটু এগোতেই ওদের নজরে পড়ল, ঘরটার দাওয়াতে রোদ্দুরে পা ছড়িয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কেউ বসে আছে, তার সামনে অনেকটা গম ওকুতে দেওয়া হয়েছে, বসে-থাকা মানুষটার হাতে একটা লাঠি-বোধহয় কাক চিল থেকে পাহারা দেবার জন্য। অনিমেষ দেখল ম্যানুষটা স্ত্রী কি পুরুষ চট করে বোঝা যাচ্ছে না, কারণ তার মাথার সাদা চুল গুড়িগুড়ি করে ছাঁটা। গায়ের চামড়া ঝুলে গুটিয়ে এসেছে। বেচারা চোখে দ্যাখে না বোধহয় কারণ ওরা এত কাছে এসেছে তবু তার কোনো ভাবান্তর নেই। বাচ্চাটা হঠাৎ ছুটে গিয়ে গোগো চিৎকার করতে সে একটু নড়েচড়ে বসে নিদাঁত মাড়ি বের করে কিছু বলল। মহীতোষ একটু সামনে গিয়ে ভালো করে লক্ষ করে বললেন, সেরা বলে মনে হচ্ছে। ছোটমা বলল, সেরা? সেই যে তুমি যার গল্প বলেছিলো? মহীতোষ মাথা নাড়লেন, তারপর কাছে গিয়ে ডাকলেন, এই তুমার নাম সেরা? লোলচর্ম-মুখটা এবার যেন-হদিস পেল তার সামনে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে। অনিমেষ এর আগে কোনোদিন সেরাকে দেখেনি অথবা এরা নামও শোনেনি। মদেসিয়া লাইনে এ-নামের কেউ থাকতে পারে ভাবা যায় না। যদিও বয়স হয়েছে বেশ তবে বোঝাই যায় রোগে ভুগে ভুগে এর অবস্থা এইরকম জীর্ণতায় এসে ঠেকেছে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এর গায়ে রঙ অন্য পাঁচটি মদেসিয়ার মতো সাদা হয় কখন কে জানে, বরং যে-কোনো বাঙালি মেয়ের সঙ্গে মিলে যায় চট করে। চোখের পাতা সাদা হয় কখন কে জানে, সাদা চোখের মণি যেন আতিপাতি করে খুঁজতে চাইল সামনে দাঁড়ানো মুখগুলোর দিকে চেয়ে, কৌন? সেরাকে দেখে মহীতোষ পুরনো দিনের স্মৃতি নিয়ে
false
tarashonkor
হইয়া উঠিল। গৌরীদিদিমণি কেমন আছেন? ভালই আছেন। কত বড় হয়েছেন এখন? শিবনাথ বিরক্ত হইয়া বলিল, সে শুনে আর তুমি কী করবে, বল? তুমি বরং আপন কাজ করগে যাও। মেসের চাকরটি এটা-ওটা লইয়া যাওয়া-আসা করিতেছিল, এবার সে কুঁজায় জল ভরিয়া লইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতে করিতে শিবনাথের শেষ কথা কয়টি শুনিয়া রূঢ়স্বরে সেই কথারই প্রতিধ্বনি করিল, যা যা, আপনার কাজ করগে যা। ভদ্রলোকের ঘরে দাঁড়িয়ে ব্যাড়র ব্যাড়র করে বতে আরম্ভ করেছে। মেয়েটি মুহূর্তে সাপিনীর মত ফোঁস করিয়া উঠিয়া বলিল, কী রকম মানুষ তুমি গো। তোমার আবার এমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কেনে? আমার দেশের নোক, আমাদের বাবু, বলব না কথা, দেশের খবর নোব না?—বলিতে বলিতে মেয়েটি ঘর হইতে বাহির হইয়া চলিয়া গেল। মেয়েটির উপর প্রবল বিরূপতা সত্ত্বেও চাকরটির এই অনধিকার মধ্যবর্তিতা শিবনাথের ভাল লাগিল না, বরং মেয়েটির ওই শেষের কথাগুলি বেশ ভালই লাগিল—আমাদের দেশের লোক, আমাদের বাবু। মেসটি কতকটা হোটেলের মত, নানা শ্রেণীর লোক এখানে থাকে; ছাত্রের সংখ্যা নাই বলিলেই চলে, চাকুরের সংখ্যাই বেশি। বেলা প্রায় পাঁচটা হইয়া আসিয়াছে, দুই-এক জন। করিয়া আপিস-ফেরত বাবু আসিয়া মেসে ঢুকিতেছিলেন। সারাদিন মুখ বন্ধ করিয়া খাটুনির পর এতক্ষণে বোলচাল যেন তুবড়ি-বাজির মত ফুটিতে আরম্ভ করিয়াছে। একজন মুক্ত দ্বারপথে শিবনাথের ঘরের দিকে চাহিয়া বলিল, বলিহারি বাবা, ব্ল্যাঙ্ক ফিল্ড আপ! এক রাজা যায়, অন্য রাজা হয়, ভারতের সিংহাসন খালি নাহি রয়! নিমাইবাবুর কপাল বটে বাবা! নিমাইবাবু বোর্ডিঙের মালিক। শিবনাথ ওই মেয়েটার কথাই ভাবিতেছিল। মেয়েটা কুগ্ৰহের মত তাহার অদৃষ্টাকাশে আসিয়া জুটিয়াছে। গ্রামের ওই রটনার পর, আবার যদি কোনোরূপে এই সংবাদটা ঘামে যায়, তবে কি আর রক্ষা থাকিবে! মিথ্যা কলঙ্ক অক্ষয় সত্য হইয়া তাহার ললাটে চিরজীবনের মত অঙ্কিত হইয়া রহিবে। অকস্মাৎ একটা তীব্র ক্রুদ্ধ চিৎকার-ধ্বনিতে মেসটা সচকিত হইয়া উঠিল। নারীকন্ঠের চিৎকার ও সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পুরুষের কণ্ঠে সমস্বরে উচ্চারিত প্রশ্নধ্বনি। শিবনাথও কৌতূহলবশে আসিয়া দেখিল, বারান্দার কোণে কয়েকজন বাবু ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। ভিড়ের ওপাশে সেই ডোমবধূ প্রদীপ্ত মুখে অকুণ্ঠিত কণ্ঠে চিৎকার করিয়া বলিতেছে, আপনাদের ওই চাকর মাশায়, আমাকে বলে কী, ওই নতুন বাবুর সঙ্গে তোর এত পিরীত কিসের? মাশায়, উনি আমাদের দেশের নোক, গায়ের নোক। তা ছাড়া ইনি আমার বাপ বল বাপ, মা বল মা, ভাই বল ভাই, সব। আমার মাশায়, সোয়ামি মল কলেরায়, তারপরে আমার হল কলেরা, কেউ কোথাও নাই, ঘরে শকুনি এসে বসে আছে আমার মরণ তাকিয়ে। আমার ময়লামাখা দেহ মায়ের মতন কোলে করে তুলে উনি যতন করে ওষুধ দিয়ে পথ্যি দিয়ে বাঁচিয়েছেন। একা কি আমাকে মাশায়? গাঁয়ে যেখানে যার রোগ হয়েছে, সেইখানে উনি গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাকে দেখে আমার হাসি আসবে না মাশায়? তাকে দেখে খবর শুধাব না মাশায়? বলেন, আপনারাই বলেন? তাকে পেনাম আমি করব না? শিবনাথ আর সেখানে দাঁড়াইল না। প্রশংসার নম্রতায় যশোগৌরবের ভারে তাহার মাথা যেন নুইয়া পড়িতেছিল। মেয়েটি যেন তাহার জয়ধ্বজাই বহন করিয়া অকুণ্ঠিত উচ্চকণ্ঠে সমগ্র পৃথিবীকে তাহার জয়গান শুনাইতেছে। সে তাড়াতাড়ি আসিয়া ঘরে বসিল। মেয়েটির প্রতি বিরূপতা সে আর অনুভব করিতে পারি না, তাহার প্রতি পরম স্নেহে তাহার অন্তর তখন পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে। কালের অংশ কল্প; কল্পনায় কল্পলোক রচনা করিয়া তাই মানুষ করিতে চায় কালজয়। ভবিষ্যতের ইতিহাস রচনা করিবার কল্পনা করিয়া বাংলার যে তরুণের দল ভারতের স্বাধীনতা-লক্ষ্যের সংক্ষিপ্ত পথের সন্ধানে উন্মত্ত অধীর গতিতে নীরন্ধ্র অন্ধকার পথে ছুটিয়াছিল, এই সময়ে তাহাদের গতিবেগ তীব্র হইতে তীব্রতর হইয়া উঠিতেছিল। ভাবীকালের কোন মণিকোঠায় স্বাধীনতার দীপশিখা জ্বলিতেছে, কত দীর্ঘ সে দূরত্ব, কালের কালো জটাজালের অন্ধকার কত জটিল; সে বিবেচনা করিবার অবসর তাদের তখন নাই, পশ্চিমের রণাঙ্গনের রণবাদ্যের ধ্বনি, সৈন্যবাহিনীর পদক্ষেপের শব্দ, মারণাস্ত্রের গর্জনশব্দে উন্মত্ত হইয়া তাহারাও বর্তমানকালকে অতিক্ৰম করিয়া ভাবীকালকে জয় করিতে যাত্রা শুরু করিয়া দিল। সুশীলকে দেখা যায় না। সে নাকি সমগ্র উত্তরাপথ-লাহোর হইতে কলিকাতা পর্যন্ত বিরাট একটা ব্যবস্থার চেষ্টায় ফিরিতেছে। শিবনাথ কথাটার আভাস মাত্র পাইয়াছে, সুস্পষ্ট সংবাদ সে কিছু জানে না। সে জানিবার অধিকারও তাহার হয় নাই। সৈনিকের মত আদেশ পালন করাই তাহার কাজ। অসুখের ছলনায় বাড়ি যাইবার ভান করিয়া আসিয়াছে, কলেজ যাওয়া চলে না; পড়িতেও ভাল লাগে না। শিবনাথ বসিয়া বসিয়া কল্পনার জাল বোনে শুধু। অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে আদেশের, সংবাদের। আজ কুড়ি দিনের উপর বাড়িতে চিঠি দিতে পর্যন্ত সে তুলিয়া গিয়াছে। এ কয়দিন তাহার বাড়ির কথা, তাহার মাকে পিসিমাকে মনে করিবার পর্যন্ত অবকাশ হয় নাই। সে কল্পনা করে, আকাশস্পর্শী প্রাসাদ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধুলার মত গঁড়া হইয়া আকাশ অন্ধকার করিয়া মিলাইয়া গেল। রেলপথের ব্রিজ ভাঙিয়াছে, টেলিগ্রাফের তার চিড়িয়াছে। ওদিকে ফ্রান্সের রণাঙ্গনে জার্মানবাহিনী দৃঢ় পদক্ষেপে ক্যালের দিকে অগ্রসর হইতেছে। পাশের ঘরগুলিতেও যুদ্ধের সংবাদের উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা চলে। কয়জনে মিলিয়া সন্ধ্যার পর ম্যাপ খুলিয়া লাইন টানিয়া যুদ্ধের সংবাদ পড়িয়া থাকেন। যুদ্ধনীতির পদ্ধতির সমালোচনা গভীর হইতে গভীরতর হইয়া ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে তামাক ও সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘরখানা ভরিয়া যায়। কোণের ঘরে ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি একাই বাক্স হইতে হুইস্কির বেঁটে বোতল বাহির করিয়া বসেন; একটি গ্লাস ভরিয়া লইয়া গভীর অভিনিবেশ সহকারে শেয়ার মার্কেটের দরের পাতাখানা খুলিয়া নোট করেন, মধ্যে মধ্যে গ্লাসে এক-একটি চুমুক দেন; বা হাতের আঙুলে জ্বলন্ত সিগারেটের ঘনশুভ্ৰ ধোঁয়া অ্যাঁকিয়ার্বকিয়া উঠিতে থাকে। ম্যানেজারের সঙ্গে চাকরটার এখন রোজ বচসা হয়
false
shorotchandra
ইহারই পরামর্শ মত মেয়ে যেমন আছে তেমনি দেখাইবার আদেশ হইয়াছিল,—কারণ সাজাইয়া দেখানোর মধ্যে ফাঁকি চলিতে পারে। ছেলেটি ছয়টার ট্রেনে কলিকাতায় যাইবে—সে তাড়াতাড়ি করিতে লাগিল স্বর্ণ অন্তরালে দাঁড়াইয়া গলা চাপিয়া ডাকাডাকি করিতে লাগিলেন, কিন্তু জ্ঞানদা আর আসে না। শুদ্ধমাত্র একখানা কাপড় পরিয়া আসিতে যে সময় লাগে তাহার অনেক বেশি বিলম্ব হইতেছে দেখিয়া ঝি গিয়া যখন তাহাকে টানিয়া আনিল, তখন তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াই জ্যাঠাইমা ক্রোধে আত্মহারা হইয়া চিৎকার করিয়া উঠিলেন, খোল এ-সব, কে বললে তোকে এমন করে সেজেগুজে আসতে? যা শিগগির খুলে আয়— যাঁহারা দেখিতে আসিয়াছিলেন, হঠাৎ এই চেঁচামেচি শুনিয়া তাঁহারা আশ্চর্য হইয়া গলা বাড়াইয়া দেখিলেন। ছেলেটি ব্যাপারটা বুঝিতে পারিয়া কহিল, তবে এমনিই নিয়ে আসুন, আমার আর দেরি করবার জো নেই। ঝি যখন তাহাকে আনিয়া সম্মুখে দাঁড় করাইল, তখন কন্যার অপরূপ সাজসজ্জা দেখিয়া ছেলেটি বহু ক্লেশে হাসি দমন করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল এবং কাল খবর দেব, বলিয়া মাতুলকে লইয়া প্রস্থান করিল। জলযোগের আয়োজন ছিল, কিন্তু ট্রেন মিস্‌ করিবার ভয়ে তাহা স্পর্শ করিবারও তাঁহাদের অবকাশ ঘটিল না। কাল খবর দিবার অর্থ যে কি, তাহা সবাই বুঝিল। জ্যাঠাইমা চেঁচাইয়া, গালি পাড়িয়া, চক্ষের পলকে সমস্ত পাড়াটা মাথায় তুলিয়া ফেলিলেন। মেজবৌয়ের অবস্থা ভাল নয়, অনর্থ আশঙ্কা করিয়া পাশের বাড়ির দুই-চারিজন ছুটিয়া আসিয়া পড়িল এবং ঠিক সময়েই অকস্মাৎ কোথা হইতে অতুল আসিয়া উপস্থিত হইল। সেও ছটার ট্রেনে কলিকাতায় যাইতেছিল এবং পথের মধ্যে চিৎকার শুনিয়া এই আশঙ্কা করিয়াই বাড়ি ঢুকিয়াছিল। অতুলকে দেখিতে পাইয়া স্বর্ণের রোষ শতগুণ এবং ক্ষোভ সহস্রগুণ হইয়া উঠিল। শীর্ণ, সঙ্কুচিত, ভয়ে মৃতকল্প, দুর্ভাগা মেয়েটার ঘাড়টা জোর করিয়া অতুলের মুখের উপর তুলিয়া গর্জিয়া উঠিলেন, দ্যাখ অতুল, একবার চেয়ে দ্যাখ! হতভাগী, শতেকখাকী, বাঁদরীর মুখখানা একবার তাকিয়ে দ্যাখ! বাস্তবিক তাহার মুখের পানে চাহিলে হাসি সামলানো যায় না। তাহার ঠোঁটের রঙ গালে, গালের রঙ দাড়িতে, অন্ধকার কোণে স্বহস্তে টিপ পরিতে গিয়া সেটা কপালের মাঝখানে লাগিয়াছে। রুক্ষ চুল বোধ করি তাড়াতাড়ি এক খাবলা তেল দিয়া বাঁধিতে গিয়াছিল, তখনো দুই রগ গড়াইয়া তেল ঝরিতেছে। দুই-একটা মেয়ে পাশ হইতে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। একজনের কোলে ছেলে ছিল, সে কহিল, গিনি পিতি থঙ থেজেচে। পিতি, এমনি কোলে জিব বার কলো—বলিয়া সে হাঁ করিয়া জিভ বাহির করিয়া দেখাইল। আর একবার সবাই খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। মুখপোড়া ছেলে! বলিয়া তাহার মা-ও হাসিয়া ছেলের গালে একটা ঠোনা মারিলেন। কিন্তু অতুলের বুকের ভিতরটা কে যেন তপ্ত শেল দিয়া বিঁধিয়া দিল। অনেকদিন হইয়া গেছে, এমন দিবালোকে এত স্পষ্ট করিয়া সে জ্ঞানদার মুখের পানে চাহে নাই। শুধু পরের মুখে শুনিয়াছিল, রোগে বিশ্রী হইয়া গেছে। কিন্তু সে বিশ্রী যে এই বিশ্রী, তাহা সে স্বপ্নেও কল্পনা করে নাই। একদিন সাংঘাতিক রোগে নিজে যখন সে মরণাপন্ন, তখন এই মুখখানাকে সে ভালবাসিয়াছিল। চোখের নেশা নয়, কৃতজ্ঞতার উচ্ছ্বাস নয়,—অকপটে সমস্ত প্রাণ ঢালিয়াই ভালবাসিয়াছিল। আজ অকস্মাৎ যখন চোখে পড়িল, সেই মুখখানার উপরেই যম তাঁহার ডিক্রিজারি করিয়া শেষ নোটিস আঁটিয়া দিয়া গেছেন, তখন মুহূর্তের জন্য সে আত্মবিস্মৃত হইল। কি একটা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু স্বর্ণের উচ্চকণ্ঠে তাহা চাপা পড়িয়া গেল। অ্যাঁ, খানকীর বেহদ্দ করলি লা? একটা ঘাটের মড়া, তার মন ভুলোবার জন্যে এই সঙ সেজে এলি? কিন্তু পারলি ভুলোতে? মুখে লাথি মেরে চলে গেল যে! কে একজন প্রশ্ন করিল, কে এমন ভূত সাজিয়ে দিলে বড়বৌ? বুড়োর পছন্দ হ’ল না বুঝি? স্বর্ণ তাহার প্রতি চাহিয়া, তর্জন করিয়া কহিলেন,—নিজে সেজেছেন—আবার কে সাজাবে? মা ত অজ্ঞান-অচৈতন্য। বলে দিলাম, শুধু একখানি কাপড় পরে আয়। তা পছন্দ হ’ল না। ভাবলেন, সেজেগুজে না গেলে যদি বুড়োর মনে না ধরে? আর সাজের মধ্যে ত ঐ ছোপানো কাপড়খানি, আর অতুলের দেওয়া এই দু-গাছি চুড়ি। তা দিনের মধ্যে দশবার খুলে তুলে রাখচে, দশবার হাতে পরচে। কালীমুখীর ও-চুড়ি হাতে দিয়ে বার হতে লজ্জাও করে না? বেরো সুমুখ থেকে—দূর হয়ে যা— বেহায়া মেয়েটার এই নির্লজ্জ চরিত্রের সবাই সমালোচনা করিয়া, ছি ছি করিয়া চলিয়া গেল; শুধু যাঁহার কাছে কিছুই অজ্ঞাত থাকে না, সেই অন্তর্যামীর চোখ দিয়া হয়ত বা একফোঁটা জল গড়াইয়া পড়িল। তিনিই শুধু জানিলেন,—যে মেয়েটা আজন্মকাল লজ্জায় কখনো মুখ তুলিয়া কথা কহিতেই পারিত না, সে কেমন করিয়া, আজ সকল লজ্জায় পদাঘাত করিয়া নিজের ওই স্বাস্থ্য-শ্রীহীন দেহটাকে স্বহস্তে সাজাইয়া আনিয়া ঐ অতিবৃদ্ধটার পদেই ঠকাইয়া বিক্রি করিতে গিয়াছিল! কিন্তু বিক্রি হইল না—ফাঁকি ধরা পড়িল। আজ তাই সবাই ছি ছি করিয়া ধিক্কার দিয়া গেল—কেহই ক্ষমা করিল না। কিন্তু অন্তরে বসিয়া যিনি সর্বকালে সর্বলোকের বিচারক, তিনি হয়ত দুর্ভাগা বালিকার এই অপরাধের ভার আপনার শ্রীহস্তেই গ্রহণ করিলেন। জ্ঞানদা উঠিয়া দাঁড়াইল। কখনো সে পরের সমক্ষে কাঁদে নাই—আজ কিন্তু অতুলের সম্মুখে তাহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। অথচ, একটা কথারও কৈফিয়ত দিল না, কাহারো পানে চাহিয়া দেখিল না—নীরবে চোখ মুছিতে মুছিতে চলিয়া গেল। কলিকাতা যাইবার আর গাড়ি ছিল না বলিয়া অতুল সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরিয়া গেল। পথে সব কথা ছাপাইয়া ছোটমাসির সেই শেষ কথাটাই বারংবার মনে পড়িতে লাগিল। সেদিন বাপের বাড়ি যাইবার সময় অতুলকে নিভৃতে ডাকিয়া বলিয়াছিলেন, অতুল, হীরা ফেলে যে কাঁচ আঁচলে বাঁধে, তার মনস্তাপের আর অবধি থাকে না বাবা। সেদিন কথাটা ভাল বুঝিতে পারে নাই; কিন্তু আজ তাহার যেন নিঃসংশয়ে মনে হইল, কথাটা
false
humayun_ahmed
নিজেও এই ঘরের স্বপ্নের অংশ হয়ে গেছি। ইথেন আমাকে লেবুর শরবত বানিয়ে খাওয়াল এবং মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গল্প করতে লাগল– আমাদের কাজের মেয়েটার নাম শুনলে আপনি চমকে উঠবেন। নাম বলব চাচা? বলো। ওর নাম সুধারানী। সুধারানী নাম শুনে চমকাব কেন? কারণ নামটা হিন্দু, কিন্তু সে মুসলমান। সপ্তাহে সে একদিন ছুটি পায়। আজ তাঁর ছুটি। সে ঘরেই আছে, কিন্তু কোনো কাজ করবে না। এক কাপ চ পর্যন্ত নিজে বানিয়ে খাবে না। আমাকে বলবে, ইথু, এক কাপ চা দাও। আমাকে সে ডাকে ইথু। ছুটির দিনে রান্না কে করে? তোমার বাবা? হুঁ। আমি বাবাকে সাহায্য করি। বাবা লবণের আন্দাজ করতে পাৱে না। আমি লবণ চেখে দেই। আজ আমি একটা আইটেম রান্না করব। কোন আইটেম? আগে বলব না। আপনি খেয়ে তারপর বলবেন কোনটা আমি রোধেছি। আমি বললাম, মা, তুমি আমাকে চেনো না। আজ প্রথম দেখলে। আমি কী জন্যে এসেছি তাও জানো না। আমাকে দুপুরের খাবার দাওয়াত দিয়ে বসে আছ? হ্যাঁ। কারণটা বলব? বল। আমার মা তখন খুবই অসুস্থ। বাবা মা’কে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে এসেছেন। যেন মা’র মৃত্যুর সময় আমি এবং বাবা মা’র দুই পাশে থাকতে পারি। কাঁদতে ইচ্ছা হলে আমি যেন চিৎকার করে কাঁদতে পারি। হাসপাতালে তো চিৎকার করে কাঁদতে পারব না। অন্য রোগীরা বিরক্ত হবে। তাই না চাচা? হ্যাঁ। এক রাতে মা’র অবস্থা খুব খারাপ হলো। আমি ঘুমাচ্ছিলাম, বাবা আমাকে ঘুম থেকে তুলে মা’র কাছে নিয়ে গেলেন। মা বললেন, আমার ময়না সোনা চাঁদের কণা ইথেন বাবু কেমন আছ? আমি বললাম, ভালো আছি মা। মা বলল, মাগো! আমি তো চলে যাব, মন খারাপ করো না। আমি বললাম, আচ্ছা। মা বলল, আমি থাকব না। তুমি তোমার বাবার সঙ্গে থাকবে, বড় হবে। অনেকের সঙ্গে তোমার পরিচয়ও হবে। যেসব পুরুষমানুষ তোমাকে প্রথমেই মা ডেকে কথা শুরু করবে ধরে নিবে এরা ভালো মানুষ। কারণ তুমি খুব রূপবতী হবে। অতি অল্প পুরুষমানুষই অতি রূপবতীদের মা ডাকতে পারে। এই বিষয়টা আমি জানি, কারণ আমিও অতি রূপবতীদের দলের। আমি বললাম, এই গল্পটা থাকুক মা। তুমি কাঁদতে শুরু করেছ। আমি কান্না সহ্য করতে পারি না। ইথেন চোখ মুছতে মুছতে বলল, গল্পটা তো শেষ হয়ে গেছে। আর নাই। আপনি আমাকে মা ডেকে কথা শুরু করেছেন তো, এইজন্যে আমি জানি আপনি আমার আপনজন। চাচা ম্যাজিক দেখবেন? তুমি ম্যাজিক জানো না-কি? অনেক ম্যাজিক জানি। দড়ি কেটে জোড়া দেবার ম্যাজিক। কয়েন অদৃশ্য করার ম্যাজিক, অংকের ম্যাজিক। কার কাছে শিখেছ? বই পড়ে শিখেছি। আমার জন্মদিনে বাবা আমাকে একটা বই দিয়েছেন। বই-এর নাম- ছোটদের ম্যাজিক শিক্ষা। সেখান থেকে শিখেছি। আমি ঠিক করেছি। বড় হয়ে আমি জুয়েল আইচ আংকেলের কাছে ম্যাজিক শিখব। আচ্ছা! চাচা উনি কি আমাকে শেখাবেন? শিখানোর তো কথা। আমি যতদূর জানি উনি খুব ভালো মানুষ। ইথেন আয়োজন করে ম্যাজিক দেখাল। দড়ি কাঁটার ম্যাজিকে প্রথমবার কি যেন একটা ভুল করল। কাটা দড়ি জোড়া লাগল না। দ্বিতীয়বারে লাগল। আমি বললাম, এত সুন্দর ম্যাজিক আমি আমার জীবনে কম দেখেছি মা। সত্যি বলছেন চাচা? আমি বললাম, অবশ্যই সত্যি বলছি। ম্যাজিক দেখানোর সময় ম্যাজিশিয়ানের মুখ হাসি হাসি থাকলেও তাদের চোখে কুটিলতা থাকে। দর্শকদের তারা প্রতারিত করছে এই কারণে কুটিলতা। ম্যাজিকের বিস্ময়টাও তাদের কাছে থাকে না। কারণ কৌশলটা তারা জানে। তোমার চোখে কুটিলতা ছিল না। ছিল আনন্দ এবং বিস্ময় বোধ। জামাল সাহেব বাজার নিয়ে ফিরলেন। আমাকে তাঁর মেয়ের সঙ্গে ঘরোয়া ভঙ্গিতে গল্প করতে দেখে মোটেই অবাক হলেন না। যেন আমি তার দীর্ঘদিনের পরিচিত কেউ। ভদ্রলোক স্বল্পভাষী এবং মৃদুভাষী। সারাক্ষণই তাঁর ঠোঁটের কোণায় হাসি লেগে থাকতে দেখলাম। ফোন সারাক্ষণই তার চোখের সামনে আনন্দময় কিছু ঘটছে এবং তিনি আনন্দ পাচ্ছেন। পাঁচজনকে রুটি খাওয়ানো এবং চা খাওয়ানো প্রসঙ্গে বললেন, খেয়াল আর কিছু না। খেয়ালের বশে মানুষ কত কী করে। আমি বললাম, পাঁচ সংখ্যাটি কি বিশেষ কিছু? তিনি বললেন, না রে ভাই। আমি পিথাগোরাস না যে সংখ্যা নিয়ে মাথা ঘামাব। আমি সামান্য কেমিস্ট। বিদায় নিতে গেলাম, তিনি খপ করে আমার হাত ধরে বললেন, পাগল হয়েছেন! দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে তবে যাবেন। আমার মেয়ের আপনি অতিথি। আমি বললাম, ঐ ছড়াটা জানেন? আমি আসছি আৎকা। আমারে বলে ভাত খা। ভদ্রলোক হাসতে হাসতে ভেঙে পড়লেন, যেন এমন মজার ছড়া তিনি তার জীবনে শোনেন নি। তিনি মেয়েকে ডেকে বললেন, ইথেন, তোর চাচু কী বলে শুনে যা! তোর চাচু বলছে- আমি আসছি আৎকা। আমারে বলে ভাত খা। হা হা হা। আমি পুরোপুরি ঘরের মানুষ হয়ে দুপুরে তাদের সঙ্গে খাবার খেলাম। খাবারের আগে আমাকে টাওয়েল-লুঙ্গি দেয়া হলো। নতুন সাবানের মোড়ক খুলে দেয়া হলো। আমাকে গোসল করতে হলো। আমি দীর্ঘ জীবন পার করেছি। এই দীর্ঘ জীবনে বেশ কয়েকবার নিতান্তই অপরিচিতজনদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি। ঐ যে গানটা আছে না- আমাকে তুমি অশেষ করেছ, এ কি এ লীলা তব। খাবার টেবিলে ইথেন বলতে লাগল, বাবা, তুমি চাচুকে মা’র গল্পটা বিলো। কীভাবে তোমাদের বিয়ে হয়েছে সেটা বলে। জামাল সাহেব বললেন, আরেকদিন বলি মা? ইথেন বলল, আজই বলতে হবে কারণ চাচু আর আসবে না। কি করে জানো উনি আর আসবেন না। ইথেন বলল, আমার মন বলছে। আমার
false
robindronath
করিয়া করিয়া জানিল নলিনবাবু যুবাপুরুষ, কিছুকাল হইতে এই বাড়িতে যাতায়াত করিতেছেন। যদিও রমেশ হেমনলিনীর আশা ত্যাগ করিয়াই যাইতেছিল, তথাপি নলিনবাবুটির প্রতি তাহার সদ্ভাব আকৃষ্ট হইল না। রমেশ। তোর দিদিঠাকরুনের শরীর কেমন আছে? বেহারা কহিল, “তাঁহার শরীর তো ভালোই আছে।” সুখন-বেহারাটা ভাবিয়াছিল, এই সুসংবাদে রমেশবাবু নিশ্চিন্ত ও সুখী হইবেন। অন্তর্যামী জানেন, সুখনে বেহারা ভুল বুঝিয়াছিল। রমেশ কহিল, “আমি একবার উপরের ঘরে যাইব।” বেহারা তাহার ধূমোচ্ছ্বসিত কেরোসিনের ডিপা লইয়া রমেশকে উপরে লইয়া গেল। রমেশ ভূতের মতো ঘরে ঘরে এক বার ঘুরিয়া বেড়াইল, দুই-একটা চৌকি ও সোফা বাছিয়া লইয়া তাহার উপরে বসিল। জিনিসপত্র গৃহসজ্জা সমস্তই ঠিক পূর্বের মতোই আছে, মাঝে হইতে নলিনবাবুটি কে আসিল? পৃথিবীতে কাহারো অভাবে অধিক দিন কিছুই শূন্য থাকে না। যে বাতায়নে রমেশ এক দিন হেমনলিনীর পাশে দাঁড়াইয়া ক্ষান্তবর্ষণ শ্রাবণদিনের সূর্যাস্ত-আভায় দুটি হৃদয়ের নিঃশব্দ মিলনকে মণ্ডিত করিয়া লইয়াছিল, সেই বাতায়নে আর কি সূর্যাস্তের আভা পড়ে না? সেই বাতায়নে আর-কেহ আসিয়া আর-এক দিন যখন যুগলমূর্তি রচনা করিতে চাহিবে তখন পূর্ব-ইতিহাস আসিয়া কি তাহাদের স্থান রোধ করিয়া দাঁড়াইবে, নিঃশব্দে তর্জনী তুলিয়া তাহাদিগকে দূরে সরাইয়া দিবে? ক্ষুণ্ন অভিমানে রমেশের হৃদয় স্ফীত হইয়া উঠিতে লাগিল। পরদিন রমেশ এলাহাবাদে না গিয়া একেবারে গাজিপুরে চলিয়া গেল। কলিকাতায় রমেশ মাসখানেক কাটাইয়া আসিয়াছে। এই এক মাস কমলার পক্ষে অল্পদিন নহে। কমলার জীবনে একটা পরিণতির স্রোত হঠাৎ অত্যন্ত দ্রুতবেগে বহিতেছে। উষার আলো যেমন দেখিতে দেখিতে প্রভাতের রৌদ্রে ফুটিয়া পড়ে, কমলার নারীপ্রকৃতি তেমনি অতি অল্পকালের মধ্যেই সুপ্তি হইতে জাগরণের মধ্যে সচেতন হইয়া উঠিল। শৈলজার সহিত যদি তাহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় না হইত, শৈলজার জীবন হইতে প্রেমালোকের ছটা ও উত্তাপ যদি প্রতিফলিত হইয়া তাহার হৃদয়ের উপরে না পড়িত,তবে কতকাল তাহাকে অপেক্ষা করিতে হইতে বলা যায় না। ইতিমধ্যে রমেশের আসিবার দেরি দেখিয়া শৈলজার বিশেষ অনুরোধে খুড়া কলমাদের বাসের জন্য শহরের বাহিরে গঙ্গার ধারে একটি বাংলা ঠিক করিয়াছেন। অল্পস্বল্প আসবাব সংগ্রহ করিয়া বাড়িটি বাসযোগ্য করিয়া তুলিবার আয়োজন করিতেছেন এবং নূতন ঘরকন্নার জন্য আবশ্যকমত চাকরদাসীও ঠিক করিয়া রাখিয়াছেন। অনেক দিন দেরি করিয়া রমেশ যখন গাজিপুরে ফিরিয়া আসিল তখন খুড়ার বাড়িতে পড়িয়া থাকিবার আরেকোনো ছুতা থাকিল না। এতদিন পরে কমলা নিজের স্বাধীন ঘরকন্নার মধ্যে প্রবেশ করিল। বাংলাটির চারি দিকে বাগান করিবার মতো জমি যথেষ্ট আছে। দুই সারি সুদীর্ঘ সিসুগাছের ভিতর দিয়া একটি ছায়াময় রাস্তা গেছে। শীতের শীর্ণ গঙ্গা বহুদূরে সরিয়া গিয়া বাড়ি এবং গঙ্গার মাঝখানে একটি নিচু চর পড়িয়াছে–সেই চরে চাষারা স্থানে স্থানে গোধূম চাষ করিয়াছে এবং স্থানে স্থানে তরমুজ ও খরমুজা লাগাইতেছে। বাড়ির দক্ষিণ-সীমানায় গঙ্গার একটি বৃহৎ বৃদ্ধ নিমগাছ আছে, তাহার তলা বাঁধানো। বহুদিন ভাড়াটের অভাবে বাড়ি ও জমি অনাদৃত অবস্থায় থাকাতে বাগানে গাছপালা প্রায় কিছুই ছিল না এবং ঘরগুলিও অপরিচ্ছন্ন হইয়া ছিল। কিন্তু কমলার কাছে এ-সমস্তই অত্যন্ত ভালো লাগিল। গৃহিণীপদলাভের আনন্দ-আভায় তাহার চক্ষে সমস্তই সুন্দর হইয়া উঠিল। কোন্‌ ঘর কী কাজে ব্যবহার করিতে হইবে, জমির কোথায় কিরূপ গাছপালা লাগাইতে হইবে, তাহা সে মনে মনে ঠিক করিয়া লইল। খুড়ার সহিত পরামর্শ করিয়া কমলা সমস্ত জমিতে চাষ দিয়া লইবার ব্যবস্থা করিল। নিজে উপস্থিত থাকিয়া রান্নাঘরের চুলা বানাইয়া লইল এবং তাহার পার্শ্ববর্তী ভাঁড়ার-ঘরে যেখানে যেরূপ পরিবর্তন আবশ্যক তাহা সাধন করিল। সমস্ত দিন ধোওয়ামোজা, গোছানো-গাছানো–কাজকর্মের আর অন্ত নাই। চারি দিকেই কমলার মমত্ব আকৃষ্ট হইতে লাগিল। গৃহকর্মের মধ্যে রমণীর সৌন্দর্য যেমন বিচিত্র, যেমন মধুর, এমন আর কোথাও নহে। রমেশ আজ কমলাকে সেই কর্মের মাঝখানে দেখিল; সে যেন পাখিকে খাঁচার বাহিরে আকাশে উড়িতে দেখিল। তাহার প্রফুল্ল মুখ, তাহার সুনিপুণ পটুত্ব রমেশের মনে এক নূতন বিসময় ও আনন্দের উদ্রেক করিয়া দিল। এতদিন কমলাকে রমেশ তাহার স্বস্থানে দেখে নাই; আজ তাহাকে আপন নূতন সংসারের শিখরদেশে যখন দেখিল তখন তাহার সৌন্দর্যের সঙ্গে একটা মহিমা দেখিতে পাইল। কমলার কাছে আসিয়া রমেশ কহিল, “কমলা, করিতেছ কী? শ্রান্ত হইয়া পড়িবে যে।” কমলা তাহার কাজের মাঝখানে একটুখানি থামিয়া রমেশের দিকে মুখ তুলিয়া তাহার মিষ্টমুখের হাসি হাসিল; কহিল, “না, আমার কিছু হইবে না।” রমেশ যে তাহার তত্ত্ব লইতে আসিল, এটুকু সে পুরস্কারস্বরূপ গ্রহণ করিয়া তৎক্ষণাৎ আবার কাজের মধ্যে নিবিষ্ট হইয়া গেল। মুগ্ধ রমেশ ছুতা করিয়া আবার তাহার কাছে গিয়া কহিল, “তোমার খাওয়া হইয়াছে তো কমলা?” কমলা কহিল, “বেশ, খাওয়া হয় নাই তো কী? কোন্‌কালে খাইয়াছি।” রমেশ এ খবর জানিত, তবু এই প্রশ্নের ছলে কমলাকে একটুখানি আদর না জানাইয়া থাকিতে পারিল না; কমলাও রমেশের এই অনাবশ্যক প্রশ্নে যে একটুখানি খুশি হয় নাই তাহা নহে। রমেশ আবার একটুখানি কথাবার্তার সূত্রপাত করিবার জন্য কহিল, “কমলা, তুমি নিজের হাতে কত করিবে, আমাকে একটু খাটাইয়া লও-না।” কর্মিষ্ঠ লোকের দোষ এই, অন্য লোকের কর্মপটুতার উপরে তাহাদের বড়ো একটা বিশ্বাস থাকে না। তাহাদের ভয় হয়, যে কাজ তাহারা নিজে না করিবে সেই কাজ অন্য করিলেই পাছে সমস্ত নষ্ট করিয়া দেয়। কমলা হাসিয়া কহিল, “না, এ-সমস্ত কাজ তোমাদের নয়।” রমেশ কহিল, “পুরুষরা নিতান্তই সহিষ্ণু বলিয়া পুরুষজাতির প্রতি তোমাদের এই অবজ্ঞা আমরা সহ্য করিয়া থাকি, বিদ্রোহ করি না, তোমাদের মতো যদি স্ত্রীলোক হইতাম তবে তুমুল ঝগড়া বাধাইয়া দিতাম। আচ্ছা, খুড়াকে তো তুমি খাটাইতে ত্রুটি কর না, আমি এতই কি অকর্মণ্য?” কমলা কহিল, “তা জানি না, কিন্তু তুমি
false
humayun_ahmed
হবে না? ধোঁয়াজাতীয় কিছুতে রোজা নষ্ট হয় না। গাড়ির ধোঁয়া নাকে গেলে রোজা নষ্ট হয় না। ফুলের গন্ধ নাকে গেলেও রোজা নষ্ট হয় না। এমন কোনো মোসালা কি আছে? এটা আমার মোসালা। চিন্তাভাবনা করে বের করেছি। এখন বাবা যাও, এক কাপ চা এনে দাও। চা খেলে রোজা ভাঙবে না? চায়ের গন্ধটা নাকে নিব। চায়ের গন্ধের সঙ্গে সিগারেট খাব। আরেকটা মাসালা শোনো, তৃপ্তির সাথে কিছু খেলেও রোজার সোয়াব লেখা হয়। আপনি তো হুজুর প্রচুর সোয়াব জমা করে ফেলেছেন। হুজুর বললেন, তা করেছি। একজীবনে একটা বড় সোয়াব করাই যথেষ্ট। ব্যাংকে টাকা যেমন বাড়ে, আল্লাহর ব্যাংকে সোয়াবও বাড়ে। লাইলাতুল কদরে আল্লাহপাক সব জমা সোয়াব ডাবল করে দেন। বিরাট সোয়াব একটা করেছি যৌবন বয়সে। কী সোয়াব? এটা বলা যাবে না। সোয়াবের গল্প করলে আল্লাহপাক সঙ্গে সঙ্গে সোয়াব অর্ধেক করে দেন। দুইজনের সঙ্গে গল্প করলে সোয়াব অবশিষ্ট থাকে চাইরের এক অংশ। তিনজনের সঙ্গে গল্প করলে থাকে মাত্র আটের এক অংশ। আপনি কারও কাছেই কী বড় সোয়াব করেছেন এটা বলেন নাই? নাহি। সোয়াব যতটুকু করেছি, সবটা আল্লাহপাকের দরবারে জমা আছে। প্রতি বছর বাড়তেছে। যাও বাবা, চা-টা নিয়ে আসো, তৃপ্তি করে সিগারেট খেয়ে আরেকটা সোয়াব হাসিল করি। যা করে তৃপ্তি পাওয়া যায়, তাতেই সোয়াব। খাদেম (পীর বাচ্চাবাবার মাজার) হিমু আজু করছে। অজু করা দেখে মনটা খারাপ হয়েছে। অনেক ভুলভ্রান্তি। ডান পা আগে ধুবে, তারপর বাম পা। সে করেছে উল্টা। তিনবার কুলি করার জায়গায় সে করেছে চারবার। হাতের কনুই পর্যন্ত অজুর পানি পৌঁছেছে বলে মনে হয় না। এইসব বরখেলাফ আল্লাহপাক পছন্দ করেন না। হিমুকে ধরে ধরে সব শিখাতে হবে। সে ছেলে ভালো। আদব-কায়দা জানে। আমার প্রতি তার আলাদা নজর আছে। রোজা রেখেছি শুনেই আমার মোবাইল নিয়ে কাকে যেন বলল, হুজুর রোজা রেখেছেন। হুজুরের জন্যে ইফতার আর খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। হিমু টেলিফোন ফেরত দিয়ে বলল, হুজুর, ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেছি।বিছমিল্লাহ হোটেলের বাবুর্চি কেরামত চাচা নিজে খানা নিয়ে আসবেন। আমি বললাম, হিমু, তুমি এমন এক কথা বলেছি যে আল্লাহপাক গোস্বা হয়েছেন। খাবারের ব্যবস্থা তুমি করো নাই। খাবারের ব্যবস্থা করেছেন আল্লাহপাক। তুমি উছিলা মাত্র। বলো, আস্তাগাফিরুল্লাহ। হিমু বলল, আস্তাগাফিরুল্লাহ। বলো, সোবাহানাল্লাহ। আলহামদুল্লিল্লাহ, আল্লাহু আকবর। সে ভক্তি নিয়ে বলল, সোবাহানাল্লাহ, আলহামদুল্লিল্লাহ, আল্লাহু আকবর। আমি বললাম, আচ্ছা এখন যাও, কাজকর্ম করো। সে ঝাটা নিয়ে মাজার পরিষ্কার করতে লাগল। এই ছেলের উপর আমার দিলখোশ হয়েছে। আমি তাকে গোপন কিছু জিনিস শিখিয়ে দিব। যেমন, ফজরের নামাজের পর তিনবার সূরা হাসরের শেষ তিন আয়াত পড়লে সত্তুর হাজার ফেরেশতা তার জন্যে দোয়া করবে। বিরাট ব্যাপার। আমি যে সোয়াবের একটা কাজ করেছি—এটা আমি ছেলেটাকে বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঘটনাটা হলো, অনেক বছর আগে আমি ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ দেখি একটা বাচ্চা মেয়ে রাস্তা পার হচ্ছে, আর তার দিকে ট্রাক আসছে। মেয়েটা ট্রাক দেখে নাই, আমি মেয়েটার উপর ঝাপ দিয়ে পড়লাম। মেয়েটা বাঁচল, ট্রাকের চাকা চলে গেল আমার পায়ের উপর দিয়ে। দুটা পা শেষ। অবশ্যি যা হয়েছে আল্লাহপাকের হুকুমে হয়েছে। ট্রাকচালকের এখানে কোনো দোষ নাই। তার উপর আল্লাহপাকের হুকুম হয়েছে ট্রাকের চাকা আমার পায়ের উপর দিয়ে নিতে। সে নিয়েছে। তার কী দোষ? মেয়েটার নাম জয়নাব। নবী-এ-করিমের স্ত্রীর নামে নাম। অনেক দিন মেয়েটার জন্যে দোয়া খায়ের করা হয় না। আগে নিয়মিত দোয়া করতাম। আবার শুরু করা প্রয়োজন। অন্যের জন্য দোয়া করলেও নেকি পাওয়া যায়। আছর ওয়াক্তে হিমুর পরিচিত এক ভদ্রলোক এসে উপস্থিত। মাশাল্লাহ অত্যন্ত সুন্দর চেহারা। সুন্দর চেহারা আল্লাহপাকের নিয়ামত। হযরত ইউসুফ আলাহেস সালামের সুন্দর চেহারা ছিল। ভদ্রলোককে দেখে হিমুর ব্যস্ততা চোখে পড়ে মনটা ভালো হয়ে গেল। মানুষকে সম্মান এইভাবে দিতে হয়। যে অন্যকে সম্মান দেয়, আল্লাহপাক তাকে সম্মান দেয়। হিমু বলল, স্যার, এখানকার ঠিকানা কোথায় পেলেন? ভদ্রলোক বললেন, ঠিকানা কীভাবে জোগাড় করেছি এটা জানা কি অত্যাবশ্যক? হিমু বলল, জি-না স্যার। আপনাকে এত অস্থির লাগছে কেন? ভদ্রলোক বললেন, দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়েছিলাম। আবারও সেই জিনিস। ইলেকট্রন হয়ে গেলেন? হ্যাঁ, তবে চার্জ নেগেটিভ না হয়ে পজেটিভ ছিল। অর্থাৎ আমি হয়েছি পজিট্রন। ভয়াবহ ব্যাপার! ভয়াবহ কেন? পজিট্রন হলো ইলেকট্রনের অ্যান্টি ম্যাটার। পজিট্রন ইলেকট্রনের দেখা পেলেই এনিহিলেট করবে। এখন চারিদিকে ইলেকট্রনের ছড়াছড়ি। পজিট্রন হয়ে আমি ভয়ে অস্থির-কখন না ইলেকট্রনের সঙ্গে দেখা হয়! আমার অবস্থা বুঝতে পেরেছ? জি স্যার। একে সহজ বাংলায় বলে বেকায়দা অবস্থা। স্যার কোনো খাওয়াদাওয়া কি করেছেন? না। সকালের ব্ল্যাক কফির পর আর কিছু খান নাই? না। মাগরেবের ওয়াক্তে ইফতার চলে আসবে, তখন হুজুরের সঙ্গে ইফতার করবেন। হুজুরটা কে? পীর বাচ্চাবাবা মাজারের প্রধান খাদেম। আমি লক্ষ করলাম, হিমুর স্যার সন্দেহের দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। আমি বললাম, জনাব! আসসালামু আলায়কুম। উনি বললেন, ওয়ালাইকুম সালাম। কিছু মনে করবেন না, মাজারের খাদেম হিসেবে আপনার কাজটা কী? পীর বাচ্চাবাবার মাজার রক্ষা করাই আমার কাজ। মাজার কীভাবে রক্ষা করেন? আমি বললাম, আপনি যে-কোনো কারণেই হোক অস্থির হয়ে আছেন। আপনার আত্মা কষ্ট পাচ্ছে। আত্মা শান্ত হোক, তখন কথা বলব। ভদ্রলোক বললেন, আত্মা বলে কিছু নাই। আমি হাসলাম! এই বুরবাক কী বলে? ভদ্রলোক চোখ-মুখ শক্ত করে বললেন, আপনি বলুন আত্মা কী? মানুষের শরীরের কোথায় সে থাকে? আমি বললাম, ইফতারের
false
toslima_nasrin
দুষ্টু দুষ্টু হাসতেন আর বাড়ির ভেতর ঢুকেই তিনি মা’র তোতলা শিশু, মুখে লোকমা তুলে খাওয়াতেন তাঁকে মা। বাবার শিয়রের কাছে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বলেন–একটা হিন্দু মেয়েরে, কী কইরা একটা হিন্দু মেয়েরে বিয়া করল কামাল! মেয়েটা কয়দিন আইছে এই বাড়িতে। ওর আচার ব্যবহার আমার ভালা লাগে নাই। আইসা নোমানরে সিনেমায় লইয়া যাইতে চায়। নোমান না যাইতে চাইলে কামালরে সাধে। ছেড়াগোর পিছে পিছে ঘুরার স্বভাব। বড় চতুর মেয়ে, আমার শাদাসিধা ছেলেটারে পটাইছে। কামালের কয়দিন ধইরা দেখতাছিলাম বড় উড়া উড়া মন। ওই মেয়ের পাল্লায় পড়ছে এইটা যদি জানতাম আগে! তাইলে ওরে আমি সাবধান কইরা দিতাম। খাটের রেলিংএ কুনই রেখে গালে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা বলেন–আল্লাহই পারেন ছেলের মন ফিরাইতে। আল্লাগো ছেলেরে আমার ফিরাইয়া আনো। হিন্দু বাড়িত বিয়া হইত ক্যা আমার ছেলের! আমার হীরার টুকরা ছেলের লাইগা কত বড় বড় ঘরের মেয়ের বাপেরা ভিড় করত অইলে! কত জাঁক জমক কইরা বউ ঘরে আনতাম! লেখাপড়া শেষ কইরা চাকরি বাকরি করতে থাকব, তারপরে না বিয়া! মন ঠিকই ফিরব আমার ছেলের, ফিইরা আইব। ভুল ত মাইনষেই করে! গীতা মিত্র বিদ্যাময়ীতে পড়ত, মুখখানা গোল, তেঁতুলের গুলির মত, মায়া মায়া কালো মুখে হরিণের চোখ। ইস্কুলে নানা পরবে অনুষ্ঠানে নাচত মেয়ে। ছোটদার সঙ্গে তাঁর পরিচয় আনন্দ মোহন কলেজে পড়তে গিয়ে। আবার তাঁর খোঁড়া মাসির কারণে, খোঁড়া মাসি পড়াত আমাদের, সে সূত্রে এ বাড়িতেও ক’দিন এসেছে সে, এসে আমাদের দু’বোনের সঙ্গে রসিয়ে গল্প করেছে, বলেছে আমাদের সে লুকিয়ে সিনেমায় নিয়ে যাবে, নাচ শেখাবে, গাছ থেকে আতাফল পাড়তে গিয়ে তরতর করে গাছের মগডালে গিয়ে বসেছে, অমন এক দস্যি মেয়ে দেখে আমরা তখন খুশিতে বাঁচি না। বেবি ছিল অন্যরকম, সেলাই জানা রান্না জানা ঘরকুনো মেয়ে। বেবির দাপিয়ে বেড়ানোর স্বভাব ছিল না, গীতার যেমন। দস্যি মেয়েটি খুব অল্পতেই আমাদের হৃদয় দখল করে ফেলে। অবশ্য হৃদয়ের কপাট তখন এমন খোলা যে কেউ পা রাখলেই দখল হয়ে যায়। ঈদের জামা বানাতে শাদা সার্টিনের জামার কাপড় কিনে আনা হল, গীতা বাড়ি এসে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল কাপড়, বলল আমি খুব ভাল শিলাই জানি, আমি শিলাইয়া দিব। ব্যস, বাড়িতে দিনে দু’বার করে আসতে লাগল গজফিতায় গায়ের মাপ নিতে আমাদের। তিন দিনে সেলাই হবে বলেছিল, লাগিয়েছে তের দিন। তাও জামা জোটে ঈদের সকালে। পরতে গিয়ে দেখি বুক এমন আঁটো যে প্রায় ফেটে যায়, ঝুল এত বড় যে মনে হয় পীরবাড়ির আলখাল্লা। এমন অদ্ভুত জামা এর আগে কখনও পরিনি। ঈদটিও গিয়েছিল মাঠে মারা। ঈদের সকালে বাড়ি এসে জামা পরিয়ে দিয়ে সে হাততালি দিয়ে ইঁদুর-দেতো হাসি দিয়ে বলল–ইস কি যে সুন্দর লাগতাছে তুমারে! দারুন! দারুন। বলল–চল তুমারে দারুন এক জায়গায় নিয়া যাব বেড়াইতে। দারুন এক জায়গায় যাওয়ার জন্য আমার তর সয় না। রিক্সা করে গীতার সঙ্গে দিব্যি রওনা হয়ে গেলাম। উঠলাম গিয়ে সাহেব কোয়ার্টারে জজের বাড়িতে। বড়লোকের বাড়ি। রুহি নামের এক মেয়ে গীতার বান্ধবী, তাকে নিয়ে তার বেরোতে হবে কোথাও। রুহি, চ্যাপ্টা দেখতে মেয়ে, বেজায় ফর্সা, তার মা’কে পটাতে লাগল বাইরে বেরোবে বলে। মা’র পটতে যত দেরি হয় গীতা আর রুহি তত ফিসফিস কথা বলে নিজেদের মধ্যে, আর আমি বসে থাকি খেলনার মত সোফায়। ঘন্টা দুই পর রুহির মা পটল, রুহি মুখে লাল পাউডারের আস্তর মেখে চোখে কাজল ফাজল লাগিয়ে বের হল, তিনজন এক রিক্সায় বসে রওনা হলাম সেই দারুন জায়গায়। আমার তখন দারুন জায়গাটি ঠিক কোথায়, জানা হয়নি। ওরা রিক্সায় বসে খিলখিল হাসে, আর আমি কাঠের ঘোড়ার মত বসে থাকি গীতার কোলে। গুলকিবাড়ির এক বাড়িতে রিক্সা থামে, বাড়ির এক শিয়াল-মুখো লোক আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে গেটে তালা দিয়ে দেয়। লোকটিকে আমি কখনও দেখিনি এর আগে। নিঝুম একটি বাড়ি, বড় মাঠঅলা। ঘরের ভেতর ঢুকে দেখি সারা বাড়িতে আর কোনও লোক নেই, শিয়াল-মুখো ছাড়া। দুটো ঘর পাশাপাশি। ভেতরে শোবার ঘরে রুহি ঢুকে যায় লোকটির সঙ্গে। পাশের ঘরের সোফায় খেলনার মত নাকি কাঠের ঘোড়ার মত নাকি জানি না, বসে আমি দেখতে থাকি লোকটি রুহির সঙ্গে ঘন হয়ে বিছানায় বসল। এত ঘন হয়ে যে আমার পলক পড়ে না। শিয়াল-মুখো শুয়ে পড়ল বিছানায় রুহিকে বুকের ওপর টেনে। হঠাৎই এক লাফে রুহিকে সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে এসে লোকটি আমাদের হাতে ফানটার বোতল ধরিয়ে দিয়ে গীতা যাও, লনে বস গিয়া বলে শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। মাঠে গিয়ে আমি কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করি–লোকটা কে? মিটিমিটি হেসে গীতা বলল–খুররম ভাই। অনেক বড়লোক। গাড়ি আছে। — রুহিরে নিয়া যে লোকটা দরজা বন্ধ কইরা দিল। ঢোঁক গিলে বলি, এহন কি হইব। আমার ডর লাগতাছে। চল যাইগা। গীতা তার কালো মুখে শাদা হাসি ফুটিয়ে বলে, আরে বস, এহনি যাইয়া কি করবা! দুপুর পার হয়ে বিকেল হয়ে গেল চল যাইগা চল যাইগা করে করে। আমি ছটফট করি, প্রতিটি মুহূর্ত কাটে আমার অস্বস্তিতে। শিয়াল-মুখো ঘন্টায় ঘন্টায় ফানটার বোতল দিয়ে যায় এদিকে। ফানটা খেয়ে তখন আর আমার পোষাচ্ছে না। ক্ষিধেয় চিনচিন করছে পেট। গেটের কাছে গিয়ে কান্না-গলায় বলি–গেট খুইলা দেও। আমি যাইগা। আমার আর ভাল লাগতাছে না। গীতার মুখও শুকনো হয়ে ছিল। শোবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল–ও খুররম
false
shordindu
শেষ হয়েছে। এদিকে দেখছি নটা বাজে; কৈলাসবাবুকে আর কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। —ভাল কথা‌, কৈলাসবাবু্‌, আপনি বাড়ি থেকে নিয়মিত চিঠিপত্ৰ পান তো?’ কৈলাসবাবু বলিলেন‌, ‘আমাকে চিঠি দেবে কে? একমাত্র ছেলে-তার গুণের কথা তো শুনেছেন; চিঠি দেবার মত আত্মীয় আমার কেউ নেই।’ প্রফুল্লম্বরে ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বড়ই দুঃখের বিষয়। আচ্ছা‌, আজ তাহলে চললুম; মাঝে মাঝে আপনাকে বিরক্ত করতে আসব। আর দেখুন‌, এটার কথা কাউকে বলে দরকার নেই।’ বলিয়া দেয়ালের ছিদ্রের দিকে নির্দেশ করিল। কৈলাসবাবুঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইলেন। রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িলাম। রৌদ্র তখন কড়া হইতে আরম্ভ করিয়াছে। দ্রুতপদে বাসার দিকে চলিলাম। হঠাৎ শশাঙ্কবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘ব্যোমকেশ‌, ওই আঙুলের দাগটা সম্বন্ধে তোমার সত্যিকার ধারণা কি?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমার ধারণা তো বলেছি‌, ওটা হত্যাকারীর আঙুলের দাগ।’ অধীরভাবে শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘কিন্তু এ যে তোমার জবরদস্তি। হত্যাকারী কে তার নামগন্ধও জানা নেই।–অথচ তুমি বলে বসলে ওটা হত্যাকারীর। একটা সঙ্গত কারণ দেখান চাই তো।’ ‘কি রকম সঙ্গত কারণ তুমি দেখতে চাও?’ শশাঙ্কবাবুর কণ্ঠের বিরক্তি আর চাপা রহিল না‌, তিনি বলিয়া উঠিলেন‌, ‘আমি কিছুই দেখতে চাই না। আমার মনে হয় তুমি নিছক ছেলেমানুষী করছ। অবশ্য তোমার দোষ নেই; তুমি ভাবিছ বাংলা দেশে যে প্রথায় অনুসন্ধান চলে এদেশেও বুঝি তাই চলবে। সেটা তোমার ভুল। ও ধরনের ডিটেকটিভগিরিতে এখানে কোন কাজ হবে না।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ভাই‌, আমার ডিটেকটিভ বিদ্যে কাজে লাগাবার জন্য তো আমি তোমার কাছে আসিনি‌, বরং ওটাকে একটু বিশ্রাম দেবার জন্যই এসেছি। তুমি যদি মনে কর এ ব্যাপারে আমার হস্তক্ষেপ করবার দরকার নেই তাহলে তো আমি নিষ্কৃতি পেয়ে বেঁচে যাই।’ শশাঙ্কবাবু সামলাইয়া লইয়া বলিলেন‌, ‘না‌, আমি তা বলছি না। আমার বলার উদ্দেশ্য‌, ওপথে চললে কস্মিন কালেও কিছু করতে পারবে না–এ ব্যাপার অত সহজ নয়।’ ‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি।’ ‘ছ’মাস ধরে আমরা যে-ব্যাপারের একটা হদিস বার করতে পারলুম না‌, তুমি একটা আঙুলের টিপ দেখেই যদি মনে কর তার সমাধান করে ফেলেছি‌, তাহলে বুঝতে হবে এ কেসের গুরুত্ব তুমি এখনো ঠিক ধরতে পােরনি। আঙুলের দাগ কিম্বা আস্তাকুড়ে কুড়িয়ে পাওয়া ছেড়া কাগজে দুটো হাতের অক্ষর-এসব দিয়ে লোমহর্ষণ উপন্যাস লেখা চলে‌, পুলিসের কাজ চলে না। তাই বলছি‌, ওসব আঙুলের টিপা-ফিপ ছেড়ে—’ ‘থামো।’ পাশ দিয়া একখানা ফিটন গাড়ি যাইতেছিল‌, তাহার আরোহী আমাদের দেখিয়া গাড়ি থামাইলেন; গলা বাড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘কি ব্যোমকেশবাবু্‌, কদ্দুর?’ তারাশঙ্করবাবু গঙ্গাস্নান করিয়া বাড়ি ফিরিতেছেন; কপালে গঙ্গামৃত্তিকার ছাপ‌, গায়ে নামাবলী্‌্‌, মুখে একটা ব্যঙ্গ-হাস্য। ব্যোমকেশ তাঁহার প্রশ্নে ভালমানুষের মত প্ৰতিপ্রশ্ন করিল—’কিসের?’ ‘কিসের আবার—বৈকুণ্ঠের খুনের। কিছু পেলেন?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এ বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করছেন কেন? আমার তো কিছু জািনবার কথা নয়। বরং শশাঙ্ককে জিজ্ঞাসা করুন।’ তারাশঙ্করবাবু বাম ভু ঈষৎ তুলিয়া বলিলেন‌, ‘কিন্তু শুনেছিলুম যেন‌, আপনিই নূতন করে এ কেসের তদন্ত করবার ভার পেয়েছেন! তা সে যা হোক‌, শশাঙ্কবাবু্‌, খবর কি? নূতন কিছু আবিষ্কার হল?’ শশাঙ্কবাবু নীরসকণ্ঠে বলিলেন‌, ‘আবিষ্কার হলেও পুলিসের গোপন কথা সাধারণে প্রকাশ করবার আমার অধিকার নেই। আর‌, ওটা আপনি ভুল শুনেছেন।–ব্যোমকেশ আমার বন্ধু‌, মুঙ্গেরে বেড়াতে এসেছে‌, তদন্তের সঙ্গে তার কোন সংস্রব নেই।’ পুলিসের সহিত উকিলের প্রণয় এ জগতে বড়ই দুর্লভ। দেখিলাম‌, তারাশঙ্করবাবু ও শশাঙ্কবাবুর মধ্যে ভালবাসা নাই। তারাশঙ্করবাবু কণ্ঠস্বরে অনেকখানি মধু ঢালিয়া দিয়া বলিলেন‌, ‘বেশ বেশ। তাহলে কিছুই পারেননি। আপনাদের দ্বারা যে এর বেশি হবে না তা আগেই আন্দাজ করেছিলুম।–হাঁকো।’ তারাশঙ্করবাবুর ফিটন বাহির হইয়া গেল। শশাঙ্কবাবু কটমটে চক্ষে সেইদিকে তাকাইয়া অস্ফুটস্বরে যাহা বলিলেন তাহা প্রিয়সম্ভাষণ নয়। ভিতরে ভিতরে সকলেরই মেজাজ রুক্ষ হইয়া উঠিয়াছিল। পথে আর কোন কথা হইল না‌, নীরবে তিনজনে বাসায় গিয়া পৌঁছিলাম। দুপুরবেলাটা ব্যোমকেশ অলসভাবে কাটাইয়া দিল। একবার ছেড়া কাগজখানা ও আঙুলের টিপ বাহির করিয়া অবহেলাভরে দেখিল; আবার সরাইয়া রাখিয়া দিল। তাহার মনের ক্রিয়া ঠিক বুঝিলাম না; কিন্তু বোধ হইল‌, এই হত্যার ব্যাপারে। এতাবৎকাল সে যেটুকু আকর্ষণ অনুভব করিতেছিল তাহাও যেন নিবিয়া গিয়াছে। অপরাহ্নে বরদাবাবু আসিলেন। বলিলেন‌, ‘এখানে আমাদের বাঙালীদের একটা ক্লাব আছে‌, চলুন আজ। আপনাদের সেখানে নিয়ে যাই।’ ‘চলুন।’ দুইদিন এখানে আসিয়াছি কিন্তু এখনো স্থানীয় দ্রষ্টব্য বস্তু কিছুই দেখি নাই; তাই বরদাবাবু আমাদের কষ্টহারিণীর ঘাট‌, পীর-শানফার কবর ইত্যাদি কয়েকটা স্থান ঘুরাইয়া দেখাইলেন। তারপর সূৰ্য্যস্ত হইলে তাঁহাদের ক্লারে লইয়া চলিলেন। কেল্লার বাহিরে ক্লাব। পথে যাইতে দেখিলাম-একটা মাঠের মাঝখানে প্রকাণ্ড তাঁবু। পড়িয়াছে; তাহার চারিদিকে মানুষের ভিড়-তাঁবুর ভিতর হইতে উজ্জ্বল আলো এবং ইংরাজি বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ আসিতেছে। জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘ওটা কি?’ ‘একটা সার্কাস পাটি এসেছে।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এখানে সার্কাস পাটিও আসে নাকি?’ বরদাবাবু বলিলেন‌, ‘আসে বৈকি। বিলক্ষণ দু’পয়সা রোজগার করে নিয়ে যায়। এই তো গত বছর একদল এসেছিল–না‌, গত বছর নয়‌, তার আগের বছর।’ ‘এরা কতদিন হল এসেছে?’ ‘কাল শনিবার ছিল‌, কাল থেকে এরা খেলা দেখাতে শুরু করেছে।’ প্রসঙ্গত শহরের আমোদ-প্রমোদের অভাব সম্বন্ধে বরদাবাবু অভিযোগ করিলেন। মুষ্টিমেয় বাঙালীর মধ্যে চিরন্তন দলাদলি‌, তাই থিয়েটারের একটা সখের দল থাকা সত্ত্বেও অভিনয় বড় একটা ঘটিয়া ওঠে না; বাহির হইতে এক-আধটা কাৰ্ণিভালের দল যাহা আসে তাঁহাই ভরসা। শুনিয়া খুব বেশি বিস্মিত হইলাম না। বাঙালীর বাস্তব জীবনে যে জাঁকজমক ও বৈচিত্র্যের অসদ্ভাব‌, তাহা সে থিয়েটারের রাজা বা সেনাপতি সাজিয়া মিটাইয়া লইতে চায়। তাই যেখানে দুইজন বাঙালী আছে সেইখানেই থিয়েটার ক্লাব থাকিতে বাধ্য এবং যেখানে থিয়েটার ক্লাব আছে
false
robindronath
করবেন।” “ঠাট্টা নয়, আমার সতীর্থ অমূল্য আড্ডি ছিলেন সেখানকার ডাক্তার। বিশপঁচিশ বছর প্র্যাকটিস করেছেন। কিছু বিষয়সম্পত্তিও জমিয়েছেন। হঠাৎ বিধবা স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে রেখে মরেছেন হার্টফেল করে। দেনাপাওনা চুকিয়ে জমিজমা বেচে তাদের উদ্ধার করে আনতে হবে আমাকে। কতদিন লাগবে ঠিক জানি নে।” “এর উপরে আর কথা নেই।” “এ সংসারে কথা কিছুরই উপরে নেই সোহিনী। নির্ভয়ে বলো, যা হবেই তা হোক। যারা অদৃষ্ট মানে তারা ভুল করে না। আমরা সায়ান্টিস্ট্‌রাও বলি অনিবার্যের এক চুল এদিক-ওদিক হবার জো নেই। যতক্ষণ কিছু করবার থাকে করো, যখন কোনোমতেই পারবে না, বোলো বাস্‌।” “আচ্ছা তাই ভালো।” “যে মজুমদারটির কথা বললুম,দলের মধ্যে সে তত বেশি মারাত্মক নয়। তাকে ওরা দলে টেনে রাখে মান বাঁচাবার জন্যে। আর-যাদের কথা শুনেছি, চাণক্যের মতে তাদের কাছ থেকে শত হস্ত দূরে থাকলেও ভাবনার কারণ থেকে যায়। অ্যাটর্নি আছে বঙ্কুবিহারী, তাকে আশ্রয় করা আর অক্টোপসকে জড়িয়ে ধরা একই কথা। ধনী বিধবার তপ্ত রক্ত এই-সব লোক পছন্দ করে। খবরটা শুনে রাখো, যদি কিছু করবার থাকে কোরো। সবশেষে আমার ফিলজফিটা মনে রেখো।” “দেখুন চৌধুরীমশায়, রেখে দিন ফিলজফি। মানব না আপনার অদৃষ্ট, মানব না আপনার কার্যকারণের অমোঘ বিধান, যদি আমার ল্যাবরেটরির ’পরে কারো হাত পড়ে। আমি পাঞ্জাবের মেয়ে, আমার হাতে ছুরি খেলে সহজে। আমি খুন করতে পারি তা সে আমার নিজের মেয়ে হোক, আমার জামাইপদের উমেদার হোক।” ওর শাড়ির নীচে ছিল কোমরবন্ধ লুকোনো। তার থেকে ধাঁ করে এক ছুরি বের করে আলোয় ঝলক খেলিয়ে দিয়ে গেল। বললে, “তিনি আমাকে বেছে নিয়েছিলেন— আমি বাঙালির মেয়ে নই, ভালোবাসা নিয়ে কেবল চোখের জল ফেলে কান্নাকাটি করি নে। ভালোবাসার জন্যে প্রাণ দিতে পারি, প্রাণ নিতে পারি। আমার ল্যাবরেটরি আর আমার বুকের কলিজা, তার মাঝখানে রয়েছে এই ছুরি।” চৌধুরী বললেন, “এক সময়ে কবিতা লিখতে পারতুম,আজ আবার মনে হচ্ছে হয়তো পারি লিখতে।” “কবিতা লিখতে হয় লিখবেন, কিন্তু আপনার ফিলজফি ফিরিয়ে নিন। যা না মানবার তাকে আমি শেষ পর্যন্ত মানব না। একলা দাঁড়িয়ে লড়ব। আর বুক ফুলিয়ে বলব, জিতবই, জিতবই, জিতবই।” “ব্র্যাভো, আমি ফিরিয়ে নিলুম আমার ফিলজফিটা। এখন থেকে লাগাব ঢাকে চাঁটি তোমার জয়যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে। আপাতত কিছুদিনের জন্যে বিদায় নিচ্ছি, ফিরতে দেরি হবে না।” আশ্চর্যের কথা এই সোহিনীর চোখে জল ভরে এল। বললে, “কিছু মনে করবেন না।” জড়িয়ে ধরলে চৌধুরীর গলা। বললে, “সংসারে কোনো বন্ধনই টেঁকে না, এও মুহূর্তকালের জন্যে।” ব’লেই গলা ছেড়ে দিয়ে পায়ের কাছে প’ড়ে সোহিনী অধ্যাপককে প্রণাম করলে। ১০ খবরের কাগজে যাকে বলে পরিস্থিতি সেটা হঠাৎ এসে পড়ে, আর আসে দল বেঁধে। জীবনের কাহিনী সুখে দুঃখে বিলম্বিত হয়ে চলে। শেষ অধ্যায়ে কোলিশন লাগে অকস্মাৎ, ভেঙেচুরে স্তব্ধ হয়ে যায়। বিধাতা তাঁর গল্প গড়েন ধীরে ধীরে, গল্প ভাঙেন এক ঘায়ে। সোহিনীর আইমা থাকেন আম্বালায়। সোহিনী তার কাছ থেকে টেলিগ্রাম পেয়েছে, ‘যদি দেখা করতে চাও শীঘ্র এসো।’ এই আইমা তার একমাত্র আত্মীয় যে বেঁচে আছে। এরই হাত থেকে নন্দকিশোর কিনে নিয়েছিলেন সোহিনীকে। নীলাকে তার মা বললে, “তুমিও আমার সঙ্গে এসো।” নীলা বললে, “সে তো কিছুতেই হতে পারে না।” “কেন পারে না।” “ওরা আমাকে অভিনন্দন দেবে তারই আয়োজন চলছে।” “ওরা কারা।” “জাগানী ক্লাবের মেম্বররা। ভয় পেয়ো না, খুব ভদ্র ক্লাব। মেম্বরদের নামের ফর্দ দেখলেই বুঝতে পারবে। খুবই বাছাই করা।” “তোমাদের উদ্দেশ্য কী।” “স্পষ্ট বলা শক্ত। উদ্দেশ্যটা নামের মধ্যেই আছে। এই নামের তলায় আধ্যাত্মিক সাহিত্যিক আর্টিস্টিক সব মানেই খুব গভীরভাবে লুকোনো আছে। নবকুমারবাবু খুব চমৎকার ব্যাখ্যা করে দিয়েছিলেন। ওরা ঠিক করেছে তোমার কাছ থেকে চাঁদা নিতে আসবে।” “কিন্তু চাঁদা দেখছি ওঁরা নিয়ে শেষ করেছে। তুমি ষোলো-আনাই পড়েছ ওর হাতে। কিন্তু এই পর্যন্তই। আমার যেটা ত্যাজ্য সেটাই ওরা পেয়েছে। আমার কাছ থেকে আর কিছু পাবার নেই।” “মা, এত রাগ করছ কেন। ওঁরা নিঃস্বার্থভাবে দেশের উপকার করতে চান।” “আচ্ছা সে আলোচনা থাক্‌। এতক্ষণে তুমি বোধ হয় তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে খবর পেয়েছ যে তুমি স্বাধীন।” “হাঁ পেয়েছি।” “নিঃস্বার্থরা তোমাকে জানিয়েছেন যে তোমার স্বামীর দত্ত অংশে তোমার যে টাকা আছে সে তুমি যেমন খুশি ব্যবহার করতে পারো।” “হাঁ জেনেছি।” “আমার কানে এসেছে উইলের প্রোবেট নেবার জন্যে তোমরা প্রস্তুত হচ্ছ। কথাটা বোধ হয় সত্যি? ” “হাঁ সত্যি। বঙ্কুবাবু আমার সোলিসিটর।” “তিনি তোমাকে আরো কিছু আশা এবং মন্ত্রণা দিয়েছেন।” নীলা চুপ করে রইল। “তোমার বঙ্কুবাবুকে আমি সিধে করে দেব যদি আমার সীমানায় তিনি পা বাড়ান। আইনে না পারি বে আইনে। ফেরবার সময় আমি পেশোয়ার হয়ে আসব। আমার ল্যাবরেটরি রইল দিনরাত্রি চারজন শিখ সিপাইয়ের পাহারায়। আর যাবার সময় এই তোমাকে দেখিয়ে যাচ্ছি— আমি পাঞ্জাবের মেয়ে।” ব’লে নিজের কোমরবন্ধ থেকে ছুরি বের করে বললে, “এ ছুরি না চেনে আমার মেয়েকে, না চেনে আমার মেয়ের সোলিসিটরকে। এর স্মৃতি রইল তোমার জিম্মায়। ফিরে এসে যদি হিসেব নেবার সময় হয় তো হিসেব নেব।” ১১ ল্যাবরেটরির চার দিকে অনেকখানি জমি ফাঁকা আছে। কাঁপন বা শব্দ যাতে যথাসম্ভব কাজের মাঝখানে না পৌঁছয়। এই নিস্তব্ধতা কাজের অভিনিবেশে রেবতীকে সহায়তা করে। তাই ও প্রায়ই এখানে রাত্রে কাজ করতে আসে। নীচের ঘড়িতে দুটো বাজল। মুহূর্তের জন্য রেবতী তার চিন্তার বিষয় ভাবছিল জানলার বাইরে আকাশের দিকে চোখ মেলে। এমন সময়ে
false
robindronath
আর ঐ তাপসের মাঝখানে যেন তপস্যার লক্ষ যোজন ক্রোশের দূরত্ব। হাজার হাজার বছরেও এতটা বিচ্ছেদ পার হয়ে একটুখানি কাছে আসবার আশা নেই। তা নাই-বা রইল আশা। তবু ওর কান্না আসে; মনে মনে বলে, দিনে একবার যদি বলেন ‘কেমন আছ’ তা হলে সেই কথাটুকুতে দিন কেটে যায়, এক বেলা যদি একটু ফল আর জল গ্রহণ করেন তা হলে অন্নজল ওর নিজের মুখে রোচে। ৩ এ দিকে ইন্দ্রলোকে খবর পৌঁছল, মানুষ মর্ত্যকে লঙ্ঘন করে স্বর্গ পেতে চায়— এত বড়ো স্পর্ধা। ইন্দ্র প্রকাশ্যে রাগ দেখালেন, গোপনে ভয় পেলেন। বললেন, ‘দৈত্য স্বর্গ জয় করতে চেয়েছিল বাহুবলে, তার সঙ্গে লড়াই চলেছিল; মানুষ স্বর্গ নিতে চায় দুঃখের বলে, তার কাছে কি হার মানতে হবে।’ মেনকাকে মহেন্দ্র বললেন, ‘যাও, তপস্যা ভঙ্গ করো গে।’ মেনকা বললেন, ‘সুররাজ, স্বর্গের অস্ত্রে মর্তের মানুষকে যদি পরাস্ত করেন তবে তাতে স্বর্গের পরাভব। মানবের মরণবাণ কি মানবীর হাতে নেই।’ ইন্দ্র বললেন, ‘সে কথা সত্য।’ ৪ ফাল্গুনমাসে দক্ষিণহাওয়ার দোলা লাগতেই মর্মরিত মাধবীলতা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। তেমনি ঐ কাঠকুড়নির উপরে একদিন নন্দনবনের হাওয়া এসে লাগল, আর তার দেহমন একটা কোন্ উৎসুক মাধুর্যের উন্মেষে উন্মেষে ব্যথিত হয়ে উঠল। তার মনের ভাবনাগুলি চাকছাড়া মৌমাছির মতো উড়তে লাগল, কোথা তারা মধুগন্ধ পেয়েছে। ঠিক সেই সময়ে সাধনার একটা পালা শেষ হল। এইবার তাকে যেতে হবে নির্জন গিরিগুহায়। তাই সে চোখ মেলল। সামনে দেখে সেই কাঠকুড়নি মেয়েটি খোঁপায় পরেছে একটি অশোকের মঞ্জরী, আর তার গায়ের কাপড়খানি কুসুম্ভফুলে রঙ করা। যেন তাকে চেনা যায় অথচ চেনা যায় না। যেন সে এমন একটি জানা সুর যার পদগুলি মনে পড়ছে না। যেন সে এমন একটি ছবি যা কেবল রেখায় টানা ছিল, চিত্রকর কোন্ খেয়ালে কখন এক সময়ে তাতে রঙ লাগিয়েছে। তাপস আসন ছেড়ে উঠল। বললে, ‘আমি দূর দেশে যাব।’ কাঠকুড়নি জিজ্ঞাসা করলে, ‘কেন, প্রভু।’ তপস্বী বললে, ‘তপস্যা সম্পূর্ণ করবার জন্যে।’ কাঠকুড়নি হাত জোড় করে বললে, ‘দর্শনের পুণ্য হতে আমাকে কেন বঞ্চিত করবে।’ তপস্বী আবার আসনে বসল, অনেক ক্ষণ ভাবল, আর কিছু বলল না। ৫ তার অনুরোধ যেমনি রাখা হল অমনি মেয়েটির বুকের এক ধার থেকে আর এক ধারে বারে বারে যেন বজ্রসূচি বিঁধতে লাগল। সে ভাবলে, ‘আমি অতি সামান্য, তবু আমার কথায় কেন বাধা ঘটবে।’ সেই রাতে পাতার বিছানায় একলা জেগে ব’সে তার নিজেকে নিজের ভয় করতে লাগল। তার পরদিন সকালে সে ফল এনে দাঁড়াল, তাপস হাত পেতে নিলে। পাতার পাত্রে জল এনে দিতেই তাপস জল পান করলে। সুখে তার মন ভরে উঠল। কিন্তু তার পরেই নদীর ধারে শিরীষগাছের ছায়ায় তার চোখের জল আর থামতে চায় না। কী ভাবলে কী জানি। পরদিন সকালে কাঠকুড়নি তাপসকে প্রণাম করে বললে, ‘প্রভু, আশীর্বাদ চাই।’ তপস্বী জিজ্ঞাসা করলে, ‘কেন।’ মেয়েটি বললে, ‘আমি বহুদূর দেশে যাব।’ তপস্বী বললে, ‘যাও, তোমার সাধনা সিদ্ধ হোক।’ ৬ একদিন তপস্যা পূর্ণ হল। ইন্দ্র এসে বললেন, ‘স্বর্গের অধিকার তুমি লাভ করেছে।’ তপস্বী বললে, ‘তা হলে আর স্বর্গে প্রয়োজন নেই।’ ইন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী চাও।’ তপস্বী বললে, ‘এই বনের কাঠকুড়নিকে।’ মাঘ-ফাল্গুন ১৩২৮ সুয়োরানীর বুঝি মরণকাল এল। তার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে, তার কিছুই ভালো লাগছে না। বদ্দি বড়ি নিয়ে এল। মধু দিয়ে মেড়ে বললে, ‘খাও।’ সে ঠেলে ফেলে দিলে। রাজার কানে খবর গেল। রাজা তাড়াতাড়ি সভা ছেড়ে এল। পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলে, ‘তোমার কী হয়েছে, কী চাই।’ সে গুমরে উঠে বললে, ‘তোমরা সবাই যাও; একবার আমার স্যাঙাৎনিকে ডেকে দাও।’ স্যাঙাৎনি এল। রানী তার হাত ধরে বললে, ‘সই, বসো। কথা আছে।’ স্যাঙাৎনি বললে, ‘প্রকাশ করে বলো।’ সুয়োরানী বললে, ‘আমার সাতমহলা বাড়ির এক ধারে তিনটে মহল ছিল দুয়োরানীর। তার পরে হল দুটো, তার পরে হল একটা। তার পরে রাজবাড়ি থেকে সে বের হয়ে গেল। তার পরে দুয়োরানীর কথা আমার মনে রইল না। তার পরে একদিন দোলযাত্রা। নাটমন্দিরে যাচ্ছি ময়ূরপংখি চ’ড়ে। আগে লোক, পিছে লশকর। ডাইনে বাজে বাঁশি, বাঁয়ে বাজে মৃদঙ্গ। এমনসময় পথের পাশে, নদীর ধারে, ঘাটের উপরটিতে দেখি একখানি কুঁড়েঘর, চাঁপাগাছের ছায়ায়। বেড়া বেয়ে অপরাজিতার ফুল ফুটেছে, দুয়োরের সামনে চালের গুড়া দিয়ে শঙ্খচক্রের আলপনা। আমার ছত্রধারিণীকে শুধোলেম, ‘আহা, ঘরখানি কার।’ সে বললে, দুয়োরানীর। তার পরে ঘরে ফিরে এসে সন্ধ্যার সময় বসে আছি, ঘরে প্রদীপ জ্বালি নি, মুখে কথা নেই। রাজা এসে বললে, ‘তোমার কী হয়েছে, কী চাই।’ আমি বললেম, ‘এ ঘরে আমি থাকব না।’ রাজা বললে, ‘আমি তোমার কোঠাবাড়ি বানিয়ে দেব গজদন্তের দেওয়াল দিয়ে। শঙ্খের গুড়ায় মেঝেটি হবে দুধের ফেনার মতো সাদা, মুক্তোর ঝিনুক দিয়ে তার কিনারে এঁকে দেব পদ্মের মালা।’ আমি বললেম, ‘আমার বড়ো সাধ গিয়েছে, কুঁড়েঘর বানিয়ে থাকি তোমার বাহির-বাগানের একটি ধারে।’ রাজা বললে, ‘আচ্ছা বেশ, তার আর ভাবনা কী।’ কুঁড়েঘর বানিয়ে দিলে। সে ঘর যেন তুলে-আনা বনফুল। যেমনি তৈরি হল অমনি যেন মুষড়ে গেল। বাস করতে গেলেম, কেবল লজ্জা পেলেম। তার পরে একদিন স্নানযাত্রা। নদীতে নাইতে গেছি। সঙ্গে একশো সাত জন সঙ্গিনী। জলের মধ্যে পাল্কি নামিয়ে দিলে, স্নান হল। পথে ফিরে আসছি, পাল্কির দরজা একটু ফাঁক করে দেখি, ও কোন্ ঘরের বউ গা। যেন নির্মাল্যের ফুল। হাতে সাদা শাঁখা, পরনে লালপেড়ে শাড়ি। স্নানের পর
false
humayun_ahmed
আমি ওকে দেখে আসি। নার্স ছাড়াও একজন ডাক্তার মুহিবের পাশে আছেন। জেবা পায়ের কাছে দাঁড়াল। ক্ষীণ স্বরে বলল, ওর নিঃশ্বাসে এ-রকম শব্দ হচ্ছে কেন? ডাক্তার সাহেব ওর কি নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? ডাক্তার সাহেব কিছু বললেন না। জেবা বের হয়ে এল। শফিকুর রহমান সাহেব এসেছেন। বাবার হাত ধরে প্রিয়দর্শিনী দাঁড়িয়ে আছে। দু‘জনই চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। জেবা তাদের দেখল, কিছু বলল না। শফিকুর রহমান সাহেব বললেন, প্রিয়দর্শিনী তার মামাকে দেখার জন্যে খুব কানড়বাকাটি করছিল। ওকে নিয়ে এসেছি। এই প্রথম শফিকুর রহমান তাঁর মেয়েকে প্রিয়দর্শিনী নামে ডাকলেন। নাম উচ্চারণ করলেন স্পষ্ট করে, সুন্দর করে। জেবা বলল, তোমার মামাকে এখন দেখে তোমার ভাল লাগবে না মা। না দেখাই ভাল। প্রিদর্শিনী কঠিন স্বরে বলল, আমি দেখব। ‘এসো আমার সঙ্গে।‘ ‘আমি একা যাব।‘ প্রিয়দর্শিনী ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের দরজায় হাত রেখে মিষ্টি রিণরিণে গলায় বলল, আমি কি দু‘মিনিটের জন্যে ভেতরে আসতে পারি? শফিকুর রহমান সাহেব ভয়ংকর অস্বস্তি বোধ করছেন। স্ত্রীর দিকে চোখ তুলে তাকাতেও পারছেন না। স্বাভাবিক থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে বললেন, জেবা, ওর অবস্থা কেমন? জেবা বলল, অবস্থা ভাল না। ডাক্তাররা কিছু বলছেন না, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি। ওর গলা দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে। প্রিয়দর্শিনী একা একা গিয়েছে। ও ভয় পাবে। শফিকুর রহমান বললেন, ও শক্ত মেয়ে, এতটুকুও ভয় পাবে না। আরেকটা কথা জেবা, তুমি নাকি চাও যে মেয়েটার সঙ্গে মুহিবের বিয়ে হয়েছে তাকে এখানে নিয়ে আসতে? ‘হ্যাঁ।‘ ‘সেটা কি ঠিক হবে জেবা? এই ভয়ংকর ঘটনাটা মেয়ের আড়ালেই হওয়া কি ভাল না? মেয়েটাকে তো একটা নতুন জীবন শুরু করতে হবে। তাকে যদি এখন এখানে নিয়ে আস তাহলে নতুন করে জীবন শুরু করা তার জন্যে খুব সহজ হবে না। সবচে‘ ভাল হয় কি জান? যদি কেউ কোনদিন না জানে যে মেয়েটার বিয়ে হয়েছিল। আমি খুব প্রাকটিক্যাল কথা বললাম জেবা। লিভ হার এলোন।‘ জেবা বলল, তুমি মুহিবের দিকটা দেখবে না? তুমি কি মনে কর না মৃত্যুর সময় স্ত্রীকে পাশে পাবার অধিকার তার আছে? শফিকুর রহমান জবাব দিলেন না। কোন জবাব তাঁর মাথায় এল না। অরু জেগেই ছিল। সে জানত আবরার যাবার আগে তার ঘরে একবার উঁকি দেবে। জ্বর কেমন জানতে চাইবে। কপালে হাত রেখে উত্তাপ দেখবে। সেটাই তো স্বাভাবিক। যা স্বাভাবিক আবরার তা করল না। জ্বর দেখতে চাইল না। লাজুক মুখে বলল, তোমাকে একটা কথা বলতে এসেছি – আজ আমার জন্মদিন। খুব ইচ্ছা ছিল তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাব। অরু বলল, আগে বললেন না কেন? বললেই হত। কোথাও বেড়াতে যেতাম। ‘লজ্জা লাগল।‘ ‘তখন লজ্জা লাগল তো এখন লাগছে না কেন?‘ আবরার বলল, বুঝতে পারছি না। একটু বসি তোমার ঘরে? ‘বসুন।‘ মীরু এসে বলল, অরু তোর টেলিফোন। অরু বলল, কে? ‘জানি না কে? একজন মহিলা। বললাম তোর অসুখ। শুয়ে আছিস। তারপরেও চাচ্ছেন। খুব না-কি জরুরি।‘ অরু উঠে দাঁড়াল। আবরারকে বলল, আপনি কিন্তু নড়বেন না। আমি এক্ষুনি আসছি। ‘হ্যালো, কে?‘ ‘আমাকে তুমি চিনবে না। আমার নাম জেবা। আমি মুহিবের বড় বোন?‘ অরু হকচকিয়ে গিয়ে বলল, স−ামালেকুম আপা। ‘তুমি কি এক্ষুণি, এই মুহূর্তে আসতে পারবে?‘ ‘কোথায়?‘ ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।‘ ‘কি ব্যাপার আপা?‘ ‘মুহিব একসিডেন্ট করেছে।‘ ‘অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর অরু বলল, ওর কি জ্ঞান আছে?‘ ‘না, জ্ঞান নেই।‘ ‘অরু ক্ষীণ গলায় প্রায় অস্পষ্ট ভাবে বলল, ওর অবস্থা খুব খারাপ, তাই না আপা?‘ ‘হ্যাঁ।‘ ‘আমি আসছি।‘ ‘আমি কি আসব তোমাকে নিতে?‘ ‘আপনাকে আসতে হবে না।‘ জামিল সাহেব শোবার আয়োজন করছিলেন। অরু এসে দরজা ধরে দাঁড়াল। জামিল সাহেব বললেন, কি হয়েছে মা? অরু ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমাকে নিয়ে চল বাবা। আমি একা যেতে পারব না। আমি কিছুতেই একা যেতে পারব না। অরু হাঁটু গেড়ে মুহিবের পাশে বসে আছে। তার সমস- শরীর থর থর করে কাঁপছে। সে চাপা গলায় বলল, ডাক্তার সাহেব, আমি কি ওর হাত একটু ধরতে পারি? বৃদ্ধ ডাক্তার কোমল গলায় বললেন, অবশ্যই ধরতে পার মা, অবশ্যই পার। ‘আমি যদি ওকে কোন কথা বলি তাহলে ওকি তা শুনবে?‘ ‘জানি না মা। কোমার ভেতর আছে, তবে মস্তিষ্ক সচল শুনতেও পারে। মৃত্যু এবং জীবনের মাঝামাঝি জায়গাটা খুব রহস্যময়। আমরা ডাক্তাররা এই জায়গা সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না।‘ ডাক্তার সাহেব আমি ওকে কয়েকটা কথা বলব। আপনি কি আমকে কিছুক্ষণের জন্যে ওর পাশে থাকতে দেবেন? ডাক্তার সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ঘরে অরু একা। ছোট্ট ঘরটাকে তার সমুদ্রের মত বড় মনে হচ্ছে। মুহিবের বিছানায় সাদা চাদরের জন্যে বিছানাটাকে মনে হচ্ছে সমুদ্রের ফেনা। সেই ফেনা অবিকল ঢেউয়ের মত দুলছে। অরু দুহাতে মুহিবের ডান হাত ধরে আছে। সে খুব স্পষ্ট করে ডাকল, এই তুমি তাকাও। তোমকে তাকাতেই হবে। আমি সব কিছুর বিনিময়ে তোমাকে চেয়েছিলাম। তোমাকে পেয়েছি। আমি তোমাকে চলে যেতে দেব না। তোমাকে তাকাতেই হবে। তাকাতেই হবে। ॥ ১১ ॥ পঁচিশ বছর পরের কথা। অরুর বড় মেয়ে রুচির আজ বিয়ে। বিরাট আয়োজন। ছাদে প্যাণ্ডেল হয়েছে। পাঁচশ‘র মত মানুষ দাওয়াত করা হয়েছিল – ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে হাজারের ওপর দাওয়াতী মেহমান এসে পড়েছে। সমস্যা
false
shomresh
থাকবে না। বাইরে বেরিয়ে এসে মিনিস্টারের আদেশ মনে করলেন ভার্গিস। খবরটা এখনই ম্যাডামের কাছে পৌঁছে দিতে হবে তাকে অথচ বাবু বসন্তলালের স্ত্রীকে আগে খবরটা জানানো দরকার ছিল। ভদ্রমহিলা নাকি খুব গোড়া, বাইরে বের হন না, ভার্গিস তাকে কখনও দ্যাখেননি। কিন্তু স্বামীর মৃত্যু সংবাদ তো স্ত্রীর আগে পাওয়া উচিত। ওয়ারলেসে হেডকোয়ার্টার্সে খবর পাঠালেন ভার্গিস, একজন অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার এখনই যেন দায়িত্বটা পালন করে। শহরের সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকাটাকে ভি আই পি পাড়া বলা হয়। ভার্গিসের কনভয় বাড়িটার সামনে থামল তার সামনেটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মেয়েলি সাজগোজের দোকান। প্ৰায় প্রতিটি জিনিসই বিদেশি এবং চড়া দামে বিক্রি হয়। ভার্গিসের জিপ ঢুকল সেখানে। সুন্দর সাদা দোতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামতেই দারোয়ান ছুটে এল। ভার্গিস বলল, ম্যাডামকে খবর দাও, জরুরি দরকার। দারোয়ান মাথা নিচু করল, মাফ করবেন হুজুর আপনি সেক্রেটারি সাহেবের সঙ্গে কথা বলুন। কেন? ভার্গিস বিস্মিত। হুকুম আছে। সকাল নটার আগে ওঁকে যেন বিরক্ত করা না হয়। ভার্গিস ঘড়ি দেখলেন, এখনও পঁয়ত্ৰিশ মিনিট বাকি। অগত্য সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলেন। দারোয়ান আগে আগে ছুটে গিয়ে সেক্রেটারিকে খবর দিয়েছিল। মহিলাকে আগেও দেখেছেন ভার্গিস। পাঁচ ফুট লম্বা হাড়সর্বস্ত চিমসে মুখের মহিলা কখনও হাসেন বলে মনে হয় না। এই একটা ব্যাপারে তার সঙ্গে মিল থাকলেও বিরক্তি আসে। সেক্রেটারি বললেন, ইয়েস-। ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করা দরকার। জরুরি। মাফ করবেন, আপনি নটার পরে আসুন। আমি বলছি ব্যাপারটা জরুরি। আমি আদেশ মান্য করতে বাধ্য। টেলিফোনে কথা বলতে পারি? ব্যাপারটা ওঁরই প্রয়োজনে। সেক্রেটারি একটু ইতস্তত বললেন, ম্যাডাম এখন আসন করছেন। এইসময় কনসেন্ট্রেশন নষ্ট করতে তিনি পছন্দ করেন না। তবু—। ইন্টারকমের বোতাম টিপে কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর সেক্রেটারি বললেন, ম্যাডাম, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু কমিশনার অফ পুলিশ খুব জরুরি ব্যপারে নিজে কথা বলতে এসেছেন- ইয়েস, ঠিক আছে ম্যাডাম। রিসিভার নামিয়ে রেখে সেক্রেটারি বললেন, আসুন। সাধারণত দোকানের পেছন দিকের অফিসেই কয়েকবার তাকে যেতে হয়েছে। ম্যাডামের খাসমহলে ঢোকার অভিজ্ঞতা। এই প্রথম। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময় মনে হল এই ভদ্রমহিলার রুচি আছে। কী চমৎকার সাজানো সব কিছু। নির্দিষ্ট একটি ঘরের বন্ধ দরজায় টোকা দিলেন সেক্রেটারি। ভেতর থেকে আওয়াজ ভেসে এল, কাম ইন, প্লিজ। সেক্রেটারি ইঙ্গিত করতেই ভার্গিস দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। ম্যাডাম বসে আছেন একটা কাঠের চেয়ারে। তাঁর উধ্বাঙ্গে সাদা তোয়ালে জড়ানো। নিম্নাঙ্গে ট্র্যাকসুট গোছের কিছু। কাছে যেতেই বললেন, সুপ্ৰভাত। বসুন মিস্টার ভার্গিস। বসার ইচ্ছে না থাকলেও আশে পাশে তাকিয়ে কোনও চেয়ার দেখতে পেলেন না ভার্গিস। একটা বেঁটে মোড়া সামনে রয়েছে। সেটাকেই টেনে নিতে হল। বসেই মনে হল ভদ্রমহিলার অনেক নীচে তিনি মুখ তুলে কথা বলতে হবে। কি খাবেন? চা না কফি? ধন্যবাদ। এখন আমি খুবই ব্যস্ত। স্বাভাবিক। সময়সীমা পার হতে বেশি দেরি নাই। ম্যাডাম। আমি সবরকম উপায়ে চেষ্টা করছি। আগামী কাল সকালে লোকটাকে ঠিক গ্রেপ্তার করতে পারব। হঠাৎ এই আত্মবিশ্বাস পেলেন কি করে? আমি নিশ্চিত। বাঃ। তাহলে সবাই খুশি হবে। আমার এই লোকটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। ধরামাত্ৰ যেন ওকে না মেরে ফেলা হয়। ওর বিচার স্বাভাবিক নিয়মেই হওয়া উচিত। অবশ্য আমার যে কথা শুনতে হবে তার কোনও মানে নেই। আপনাদের মিনিস্টার আছেন—। আপনার নির্দেশ আমার মনে থাকবে ম্যাডাম। এইসময় আমি কারও সঙ্গে দেখা করি না। ম্যাডাম উঠলেন। ভার্গিসের মনে হল কে বলবে এই মহিলার যৌবন চলে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। এমন মাপা-শরীরের সুন্দরী। তিনি কখনও দ্যাখেননি। আমি দুঃখিত ম্যাডাম। ঠিক আছে। আমি দেখা করলাম কারণ আপনি বিয়ে করেননি। ভার্গিস হতভম্ব। এই ব্যাপারটা যে তার যোগ্যতা হয়ে দাঁড়াবে তা কখনও ভাবেননি। বিবাহিত পুরুষদের আমি ঘেন্না করি। ওদের বাসনার শেষ হয় না। কেন এসেছেন? শেষ শব্দ দুটো এত দ্রুত উচ্চারণ করলেন ম্যাডাম যে ভার্গিসের মাথায় ঢুকল না কেন তিনি এখানে এসেছেন। ম্যাডাম হাসলেন, আপনি নিশ্চয়ই আমার শরীর দেখতে এখানে আসেননি? এবার নড়েচড়ে বসলেন ভার্গিস। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। আজ্ঞে না। ম্যাডাম আমি একটা খারাপ খবর নিয়ে এখানে এসেছি। বলে ফেলুন। ইয়ে, আমি খুবই দুঃখিত, বাবু বসন্তলাল আর জীবিত নেই। ম্যাডাম তার সুন্দর মুখটা ওপরে তুললেন, তাই? প্রচন্ড হতাশ হলেন ভার্গিস। তিনি ভেবেছিলেন এই খবরটা ম্যাডামকে খুব আহত করবে। নিজেকে সামলে বললেন, হ্যাঁ। গতরাত্রে তাঁর মৃতদেহ আবিষ্কার হয়েছে। কোথায়? তারই বাংলোয়। কিন্তু তার তো এখন বিদেশে থাকার কথা। সেটাই রহস্যের। এমনকি বাংলোর বাইরে তার গাড়ি ছিল না। আর কে ছিল সেখানে? কেউ না! ভার্গিস বললেন, তবে হত্যাকারী ধরা পড়বেই। কিরকম? ওঁর চৌকিদার উধাও হয়েছে। লোকটাকে ধরলেই রহস্যের কিনারা হয়ে যাবে। লোকটাকে ধরা আপনার কর্তব্য। হ্যাঁ, ম্যাডাম। কিন্তু আপনি কতগুলো কাজ একসঙ্গে করবেন? আকাশলালকে না ধরতে পারলে– জানি ম্যাডাম। কে ওর মৃতদেহ আবিষ্কার করেছিল? এক ডাক্তার দম্পতি ওখানে আশ্রয়ের জন্যে গিয়ে প্রথম সন্ধান পায়। পরে আমি ফোর্স পাঠিয়ে ডেডবডি নিয়ে আসি। খুব দৃঢ়ভাবে সঙ্গে কখাগুলো বললেন ভার্গিস। ওর স্ত্রীকে জানানো হয়েছে? হ্যাঁ, ম্যাডাম। তাহলে ওর শেষকাজ আজই করে ফেলা হোক। একটু সময় লাগবে বোধহয়। কেন? পোস্টমর্টেম করতে হবে। মৃত্যুর কারন জানা দরকার। বাবু বসন্তলালের মৃত্যুর কারণ বিষ অথবা বুলেট হলে সেটা জানার পর তো তার প্রাণ ফিরে আসবে না। মিছিমিছি ওই শরীরটাকে কাটাছেঁড়া না করে শেষকৃত্যের জন্যে পাঠিয়ে দেওয়া যুক্তিসঙ্গত
false
humayun_ahmed
তোমরা ঝামেলা সেরে ফেল। কী ব্যামেলা? বিয়ের ঝামেলা। আপনি অবলীলায় এইসব কথা কীভাবে বলছেন? দীর্ঘদিনের অভ্যাস। জটিল কথা সহজ করে বলে ফেলি। ফুলফুলিয়া শোন, তুমি কিন্তু আমার কথা রাখ নি। তোমাকে বলেছিলাম আমি না বলা পর্যন্ত তুমি যেন জহিরের চিঠি না পড়। তুমি কিন্তু পড়ে ফেলেছি। এটাও কি অনুমান করে বললেন? হ্যাঁ। আপনার অনুমান শক্তি ভালো। এখন বলুন তো চিঠিতে কী লেখা। আমি হাসতে হাসতে বললাম, দীর্ঘ চিঠিতে একটাই বাক্য গুটি গুটি করে লেখা— তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসি। জহির চিঠিতে এত অসংখ্যবার তোমাকে ভালোবাসি বলে ফেলেছে যে বাকি জীবনে সে যদি আর একবারও না বলে তোমার কোনো অসুবিধা হবার কথা না। ফুলফুলিয়া তুমি খুবই ভাগ্যবতী মেয়ে। ফুলফুলিয়ার কঠিন চোখ কোমল হতে শুরু করেছে। চোখের দুপাশের ল্যাকরিমাল গ্র্যান্ড উদ্দীপ্ত হয়েছে। এখনই চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। চোখের পানি বর্ণহীন। কিন্তু ভালোবাসার চোখের পানির বর্ণ ঈষৎ নীলাভ। ফুলফুলিয়া গাঢ় স্বরে বলল, হিমু ভাইজান আমাদের বিয়েতে আপনি থাকবেন না? আমি তার প্রশ্নের জবাব দিলাম না। সব প্রশ্নের জবাব দিতে নেই। ওসি সাহেব নিজেই আমাকে জেল হাজতে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার হাতে হাতকড়া নেই, কোমরে দড়ি নেই। আমি পুলিশের জিপের পেছনের সিটে বেশ আরাম করেই বসে আছি। ওসি সাহেব বসেছেন। আমার পাশে। তিনি একটার পর একটা সিগারেট টানছেন। জিপের ভেতরটা ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেছে। ওসি সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন–ওপরের দিকে যারা আছেন তাদের কাজকর্ম বোঝা খুবই মুসকিল। এখন প্ৰাণপণ চেষ্টা চলছে— যে প্যাচে আপনি পড়েছেন সেখান থেকে আপনাকে উদ্ধার করা। আপনার এক আত্মীয়, সম্ভবত সম্পর্কে আপনার খালু, তিনি হেন কোনো জায়গা নেই যেখানে ধরনা না দিচ্ছেন। কিন্তু একটা ব্যাপার। তিনি বুঝতে পারছেন না যে, প্যাচ থেকে আপনাকে উদ্ধার করা অসম্ভব কঠিন। আপনি এখন হত্যা মামলার আসামি। মৃত ব্যক্তি আপনাকে ফাঁসিয়ে ডেথ বেড কনফেসন দিয়ে গেছে। আমাকে দড়িতে বুলতেই হবে? ওসি সাহেব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে কাশতে শুরু করলেন। আমি বললাম, ওসি সাহেব। আপনি এত আপসেট হবেন না। জগৎ খুব রহস্যময়। হয়তো এমন কিছু ঘটবে যে আমি হাসিমুখে জেল থেকে বের হয়ে আসব। জহিরের বিয়েতে আমার সাক্ষী হবার কথা। হয়তো দেখা যাবে যথাসময়ে আমি কাজি অফিসে উপস্থিত হয়েছি। ওসি সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, এটা কীভাবে সম্ভব? আমি বললাম, যে লোক আসলেই খুনটা করেছে। হয়তো দেখা যাবে সে অপরাধ স্বীকার করে পুলিশের হাতে ধরা দেবে, কিংবা পুলিশ বলবে উপরের নির্দেশে আমরা নিরপরাধ একটা লোককে ধরে এনে মামলা সাজিয়েছি। কী বলেন এ রকম কি ঘটতে পারে না? ওসি সাহেব জবাব দিলেন না। আমি বললাম, ভাই আপনি কি আমার ছোট্ট একটা উপকার করবেন? জেল-হাজতে ঢুকবার আগে আমি একজনের সঙ্গে দেখা করে যেতে চাই। কার সঙ্গে? একটা গাছের সঙ্গে। মানুষ জেল হাজতে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে।। গাছতো পারবে না। তার কাছ থেকে বিদায় নিতে হলে তার কাছেই যেতে হবে। আমি রাধাচুড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। গাছের রোগমুক্তি ঘটেছে। পত্রে পুষ্পে সে ঝলমল করছে। বিকেলের পড়ন্ত আলো পড়েছে। মনে হচ্ছে গাছের পাতায় আগুন ধরে গেছে। অপার্থিব কোনো আগুন। যে আগুনে উত্তাপ নেই— আলো আছে, আনন্দ আছে। আমি গাছের গায়ে হাত রেখে বললাম, বৃক্ষ তুমি ভালো থেকো। বৃক্ষ নরম কিন্তু স্পষ্ট স্বরে বলল, হিমু তুমিও ভালো থেকো। ভালো থাকুক। তোমার বন্ধুরা। ভালো থাকুক সমগ্ৰ মানব জাতি। (সমাপ্ত) রাত একটা। আমার জন্যে এমন কোন রাত না—বলা যেতে পারে রজনীর শুরু। . কিন্তু ঢাকা শহরের মানুষগুলি আমার মত না। রাত একটা তাদের কাছে অনেক রাত। বেশির ভাগ মানুষই শুয়ে পড়েছে। যাদের সামনে , বা এ জাতীয় পরীক্ষা তারা বই সামনে নিয়ে ঝিমুচ্ছে। নব বিবাহিতদের কথা আলাদা—তারা জেগে আছে। একে অন্যকে নানান ভঙ্গিমায় অভিভূত করার চেষ্টা করছে। আমি হাঁটছি। বলা যেতে পারে হন হন করে হাঁটছি। নিশি রাতে সবাই দ্রুত হাঁটে। শুরু পশুরা হাঁটে মস্থর পায়ে। তবে আমার হন হন করে হাঁটার পেছনে একটা কারণ আছে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। কিছু হোটেল-রেস্টুরেন্ট এখনো খোলা। কড়কড়া ভাত, টক হয়ে যাওয়া বিরিয়ানী হয়তবা পাওয়া যাবে। তবে খেতে হবে নগদ পয়সায়। নিশিরাতের খদ্দেরকে কোন হোটেলেওয়ালা বিনা পয়সায় খাওয়ায় না। আমার সমস্যা হচ্ছে, আমার গায়ে যে পাঞ্জাবি তাতে কোন পকেট নেই। পকেট নেই বলেই মানিব্যাগও নেই। পকেটহীন এই পাঞ্জাবি আমাকে রূপা কিনে দিয়েছে। খুব বাহারী জিনিশ। পিওর সিল্ক। খোলা গলা, গলার কাছে, সূক্ষ্ম সূতার কাজ। সমস্যা একটাই—পকেট নেই। পাঞ্জাবির এই বিরাট ত্রুটির দিকে রূপার দৃষ্টি ফেরাতেই সে বলল, পকেটের তোমার দরকার কি! রূপবতী মেয়েদের সব যু্ক্তিই আমার কাছে খুব কঠিন যুক্তি বলে মনে হয়। কাজেই আমিও বললাম, তাই তো, পকেটের দরকার কি। রূপা বলল, তুমি নিজেকে মহাপুরুষ টাইপের একজন ভাব। মহাপুরুষদের পোশাক হবে বাহূল্য বর্ত। পকেট বাহূল্য ছাড়া কিছু না। আমি আবারো রূপার যুক্তি মেনে নিয়ে হাসিমুখে নতুন পাঞ্জাবি পরে বের হয়েছি—তারপর থেকে না খেয়ে আছি। যখন পকেটে টাকা থাকে তখন নানান ধরনের বন্ধু—বান্ধবের সঙ্গে দেখা হয়। তারা চা খাওয়াতে চায়, সিঙ্গাড়া খাওয়াতে চায়। আজ যেহেতু পকেটেই নেই, কাজেই এখন পযর্ পরিচিতি কারো সঙ্গে দেখা হয়নি। আমার শেষ ভরসা বড় ফুপার বাসা। রাত
false
shorotchandra
তালুক রেখে যাননি যে, রাজা-রাজড়ার মত পণ্ডিত-বিদায় করতে হবে! যাও, যাও, ওসব আমিরী চাল আমার কাছে খাটবে না। লোকটা যারপরনাই কুণ্ঠিত ও লজ্জিত হইয়া চলিয়া গেল। ভবানী জানিতে পারিয়া ঘরের বাহিরে চৌকাঠের কাছে আসিয়া বসিলেন। সস্নেহে মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোর কি কোনরকম অসুখ বোধ হচ্ছে গোকুল? গোকুল যেমন শুইয়া ছিল, তেমনিভাবে জবাব দিল, না। ভবানী বলিলেন, না, তবে যে কিছু খেলিনে, হঠাৎ এমন সময়ে এসে যে শুয়ে পড়লি? গোকুল কহিল, পড়লুম। ভবানী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, অধ্যাপক-বিদায়ের ফর্দটা ছিঁড়ে ফেলে দিলি যে? কাল সকালেই নিমন্ত্রণপত্র না পাঠালে আর সময় হবে না বাবা। গোকুল ঠিক তেমনি করিয়া জবাব দিল, না হয় নাই হবে। ভবানী কিছু বিস্মিত কিছু বিরক্ত হইয়া কহিলেন, ছি গোকুল, এ সময়ে ও-রকম অধীর হলে ত হবে না। কি হয়েচে আমাকে খুলে বল্‌—আমি সমস্তই ঠিক করে দেব। মায়ের কথার উত্তরে গোকুল তাহার কম্বলের শয্যা ত্যাগ করিয়া চোখ পাকাইয়া উঠিয়া বসিল। কাহার সহিত কি ভাবে কথা কহিতে হয়, সে কোনদিন শিক্ষা করে নাই। কর্কশকণ্ঠে কহিল, তোমার যে মতলব শোনে মা, সে একটা গাধা। বাবা তোমার কথা শুনত বলে কি আমিও শুনব? আমি দশটি ব্রাহ্মণ খাইয়ে শুদ্ধ হব, কোন জাঁকজমক করব না। বলিয়া সে তৎক্ষণাৎ দেওয়ালের দিকে মুখ করিয়া শুইয়া পড়িল। ভবানী শান্তস্বরে কহিলেন, ছি বাবা, তিনি স্বর্গে গেছেন—তাঁর সম্বন্ধে কি এমন করে কথা কইতে আছে! গোকুল জবাব দিল না। তিনি কিছুক্ষণ চুপ থাকিয়া পুনরায় কহিলেন, এ রকম করলে লোকে কি বলবে বল দেখি বাছা! যাদের যেমন সঙ্গতি, তাদের তেমনি কাজ করতে হয়, না করলেই অখ্যাতি রটে। গোকুল তেমনিভাবে থাকিয়াই কহিল, রটাক গে শালারা। আমি কারো ধার ধারিনি যে ভয়ে মরে যাব। ভবানী বলিলেন, কিন্তু তাঁর এতে তৃপ্তি হবে কেন? তিনি যে এত বিষয়-আশয় রেখে গেলেন, তাঁর মত কাজ না করলে তিনি সুখী হবেন না। ভবানী ইচ্ছা করিয়াই গোকুলের বড় ব্যথার স্থানে ঘা দিলেন। পিতাকে সে যে কি ভালবাসিত তাহা তিনি জানিতেন। গোকুল উঠিয়া বসিয়া কাঁদ-কাঁদ স্বরে কহিল, খরচের কথা কে বলচে মা। যত ইচ্ছে তোমরা খরচ কর; কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই যে আমার হাত-পা বন্ধ হয়ে আসচে। বিনোদ অভিমান করে উদাসীন হয়ে গেল মা, আমি একলা কি করে কি করব? বলিয়া সে অকস্মাৎ উচ্ছ্বসিত হইয়া কাঁদিয়া উঠিল। ভবানী নিজেকেও আর সামলাইতে পারিলেন না। কাঁদিয়া ফেলিলেন, অনেকক্ষণ নিঃশব্দে থাকিয়া শেষে আঁচলে চোখ মুছিয়া অশ্রুজড়িত-স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, সে কি এ খবর পেয়েচে গোকুল? গোকুল তৎক্ষণাৎ কহিল, পেয়েচে বৈ কি মা। কে তাকে খবর দিল? কে যে তাহাকে বাড়ির এই দুঃসংবাদ দিয়াছে, গোকুল নিজেও তাহা জানিত না। মাস্টারমশায়ের পুত্র হারাণের সম্বন্ধে তাহার নিজেরও সন্দেহ জন্মিয়াছিল। তথাপি কেমন করিয়া যেন নিঃসংশয়ে বুঝিয়া বসিয়াছিল—বিনোদ সমস্ত জানিয়া-শুনিয়াই শুধু লজ্জা ও অভিমানেই বাড়ি আসিতেছে না। সে মায়ের মুখপানে চাহিয়া কহিল, খবর সে পেয়েচে মা। বাবা চিরকালের মত চলে গেলেন—এ কি সে টের পায়নি? আমার মত তার বুকের ভেতরেও কি হাহা করে আগুন জ্বলে যাচ্ছে না? সে সব জেনেচে মা, সব জেনেচে। ভবানী ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া অবশেষে যখন কথা কহিলেন, গোকুল আশ্চর্য হইয়া লক্ষ্য করিল—মায়ের সেই অশ্রুগদ্‌গদ কণ্ঠস্বর আর নাই। কিন্তু তাহাতে উত্তাপও ছিল না। সহজকণ্ঠে বলিলেন, গোকুল, তাই যদি সত্যি হয় বাবা, তবে অমন ভায়ের জন্যে তুই আর দুঃখ করিস নে। মনে কর, আমাদের বংশে আর ছেলেপিলে নেই। যে রাগের বশে মরা বাপ-মায়ের শেষ-কাজ করতেও বাড়ি আসে না, তার সঙ্গে আমাদেরও কোন সম্পর্ক নেই। গোকুল এ অভিযোগের যে কি জবাব দিবে, তাহা ভাবিয়া না পাইয়া চুপ করিয়া রহিল। কিন্তু জবাব দিল তাহার স্ত্রী। সে দ্বারের আড়ালে বসিয়া সমস্ত আলোচনাই শুনিতেছিল। সেইখান হইতেই বেশ স্পষ্ট গলায় কহিল, ঠাকুর কি না বুঝেই এমন একটা কাজ করে গেলেন? তিনি ছিলেন অন্তর্যামী। তিন-চারদিন ধরে কলকাতার বাসায় ঠাকুরপোকে যখন খুঁজে পাওয়া গেল না, তখনই ত তিনি তাঁর গুণগান সব ধরে ফেললেন। তাঁর বিষয় তিনি যদি সমস্ত দিয়ে যান, তাতে আমাদের কেউ ত আর দোষ দিতে পারবে না। তুমি যাই, তাই ভাই ভাই কর, আর কেউ হলে— টানটা অসমাপ্তই রহিল। আর কেহ কি করিত তাহা খুলিয়া বলা এ ক্ষেত্রে বড়বৌ বাহূল্য মনে করিল। কিন্তু ভবানী মনে মনে ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া গেলেন। কারণ ইতিপূর্বে শ্বশুর বর্তমানে বড়বৌ এরূপ কথা কোনদিন বলে নাই, এমন কি শাশুড়ীর সামনে স্বামীকে লক্ষ্য করিয়া সে কথাই কহে নাই। এই কয়দিনেই তাহার এতখানি উন্নতিতে তিনি নির্বাক হইয়া রহিলেন। গোকুলও প্রথমটা কেমন-যেন হতবুদ্ধি হইয়া গেল। কিন্তু পরক্ষণেই উন্মুক্ত দরজার দিকে ডান হাত প্রসারিত করিয়া ভবানীর মুখের পানে চাহিয়া একেবারে ক্ষ্যাপার মত চেঁচাইয়া উঠিল, শোন মা শোন। ছোটলোকের মেয়ের কথা শোন। প্রত্যুত্তরে বড়বৌ চেঁচাইল না বটে, কিন্তু আরও একটুখানি সবল-কণ্ঠে স্বামীকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, দ্যাখো, যা বলবে আমাকে বল। খামকা বাপ তুলো না—আমার বাপ তোমার বাপ একই পদার্থ। জবাব দিবার জন্য গোকুলের ঠোঁট কাঁপিতে লাগিল—কিন্তু কথা ফুটিল না। কিন্তু তাহার দুই চক্ষু দিয়া যেন আগুন বাহির হইতে লাগিল। ভবানী এতক্ষণ চুপ করিয়াই ছিলেন। এখন মৃদু তিরস্কারের স্বরে বলিলেন, বৌমা, তোমার কথা ক’বার দরকার কি মা! যাও, নিজের কাজে
false
shorotchandra
অশুভ, অসুন্দর, যা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী,—সেই কুৎসিতের জন্যেও যে নারীর অবিজ্ঞাত চিত্ত-তলে এতবড় আসন পাতা ছিল, পুরুষের বিমুখতা যে তাকে এমন নির্মম অপমানে আহত করতে পারে আজকের পূর্বে সে তার কি জানত?” হরেন্দ্র কহিল, অজিত বেশ ত বলেন। গল্পটা খুব মন দিয়ে পড়েছেন। মেয়েরা চুপ করিয়া শুধু চাহিয়া রহিল, কোন মন্তব্যই প্রকাশ করিল না। আশুবাবু বলিলেন, হাঁ। তার পরে অজিত? অজিত বলিতে লাগিল,—মহিলাটির অকস্মাৎ মনে পড়ে গেল যে, কেবল ঐ মানুষটিই ত নয়, বহু লোকে বহুদিন ধরে তাকে ভালবেসেছে, প্রার্থনা করেছে,—সেদিন তার একটুখানি হাসিমুখের একটিমাত্র কথার জন্যে তাদের আকুলতার শেষ ছিল না। প্রতিদিনের প্রতি পদক্ষেপেই যে তারা কোন্ মাটি ফুঁড়ে এসে দেখা দিতো, তার হিসেব মিলতো না। তারাই আজ গেল কোথায়? কোথাও ত যায়নি, এখনো ত মাঝে মাঝে তারা চোখে পড়ে। তবে গেছে কি তার নিজের কণ্ঠের সুর বিগড়ে? তার হাসির রূপ বদলে? এই ত সেদিন—দশ-পনেরো বছর, কতদিনই বা, এরই মাঝখানে কি তার সব হারালো? আশুবাবু সহসা বলিয়া উঠিলেন, যায়নি কিছুই অজিত, হয়ত শুধু গেছে তার যৌবন—তার মা হবার শক্তিটুকু হারিয়ে। অজিত তাঁহার প্রতি চাহিয়া বলিল, ঠিক তাই। গল্পটা আপনি পড়েছিলেন? না। নইলে ঠিক এই কথাটিই জানলেন কি করে? আশুবাবু প্রত্যুত্তরে শুধু একটুখানি হাসিলেন, কহিলেন, তুমি তার পরে বল। অজিত বলিতে লাগিল, তিনি বাড়ি ফিরে শোবার ঘরের মস্ত বড় আরশির সুমুখে আলো জ্বেলে দাঁড়ালেন। বাইরে যাবার পোশাক ছেড়ে রাত্রিবাসের কাপড় পরতে পরতে নিজের ছায়ার পানে চেয়ে আজ এই প্রথম তাঁর চোখের দৃষ্টি যেন একেবারে বদলে গেল। এমন করে ধাক্কা না খেলে হয়তো এখনো চোখে পড়তো না যে, নারীর যা সবচেয়ে বড় সম্পদ,—আপনি যাকে বলছিলেন তার মা হবার শক্তি,—সে শক্তি আজ নিস্তেজ, ম্লান; সে আজ সুনিশ্চিত মৃত্যুর পথে পা বাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে; এ জীবনে আর তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। তার নিশ্চেতন দেহের উপর দিয়ে অবিচ্ছিন্ন জলধারার ন্যায় সে সম্পদ প্রতিদিন ব্যর্থতায় ক্ষয় হয়ে গেছে। কিন্তু এতবড় ঐশ্বর্য যে এমন স্বল্পায়ু, এ বার্তা পৌঁছল তাঁর কাছে আজ শেষ বেলায়। আশুবাবু নিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, এমনিই হয় অজিত, এমনিই হয়। জীবনের অনেক বড় বস্তুকেই চেনা যায় শুধু তাকে হারিয়ে। তার পরে? অজিত বলিল, তার পরে সেই আরশির সুমুখে দাঁড়িয়ে যৌবনান্ত দেহের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ আছে। একদিন কি ছিল এবং আজ কি হতে বসেছে। কিন্তু সে বিবরণ আমি বলতেও পারবো না, পড়তেও পারবো না। নীলিমা পূর্বের মতই ব্যস্ত হইয়া বাধা দিল, না না না, অজিতবাবু, ও থাক। ঐ জায়গাটা বাদ দিয়ে আপনি বলুন। অজিত কহিল, মহিলাটি বিশ্লেষণের শেষের দিকে বলেছেন, নারীর দৈহিক সৌন্দর্যের মত সুন্দর বস্তুও যেমন সংসারে নেই, এর বিকৃতির মত অসুন্দর বস্তুও হয়ত পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই। আশুবাবু বলিলেন, এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি অজিত। নীলিমা মাথা নাড়িয়া প্রতিবাদ করিল, না, একটুও বাড়াবাড়ি নয়। এ সত্যি। আশুবাবু বলিলেন, কিন্তু মেয়েটির যা বয়েস, তাকে তো বিকৃতির বয়স বলা চলে না নীলিমা। নীলিমা কহিল, চলে। কারণ ও তো কেবলমাত্র বছর গুণে মেয়েদের বেঁচে থাকবার হিসেব নয়, এর আয়ুষ্কাল যে অত্যন্ত কম, এ কথা আর যেই ভুলুক, মেয়েদের ভুললে ত চলবে না। অজিত ঘাড় নাড়িয়া খুশী হইয়া বলিল, ঠিক এই উত্তরটি তিনি নিজে দিয়েছেন। বলেছেন—“আজ থেকে সমাপ্তির শেষ প্রতীক্ষা করে থাকাই হবে অবশিষ্ট জীবনের একটি মাত্র সত্য। এতে সান্ত্বনা নেই, আনন্দ নেই, আশা নেই জানি, তবু তো উপহাসের লজ্জা থেকে বাঁচবো। ঐশ্বর্যের ভগ্নস্তূপ হয়ত আজও কোনো দুর্ভাগার মনোহরণ করতে পারে, কিন্তু সে মুগ্ধতা তার পক্ষেও যেমন বিড়ম্বনা, আমার নিজের পক্ষেও হবে তেমনি মিথ্যে। যে রূপের সত্যকার প্রয়োজন শেষ হয়েছে, তাকেই নানাভাবে, নানা সজ্জায় সাজিয়ে ‘শেষ হয়নি’ বলে ঠকিয়ে বেড়াতে আমি নিজেকেও পারবো না, পরকেও না।” আর কেহ কিছু কহিল না, শুধু নীলিমা কহিল, সুন্দর। কথাগুলি আমার ভারী সুন্দর লাগলো অজিতবাবু। সকলের মত হরেন্দ্রও একমনে শুনিতেছিল; সেই মন্তব্যে খুশী হইল না, কহিল, এ আপনার ভাবাতিশয্যের উচ্ছ্বাস বৌদি, খুব ভেবে বলা নয়। উঁচু ডালে শিমুল ফুলও হঠাৎ সুন্দর ঠেকে, তবু ফুলের দরবারে তার নিমন্ত্রণ পৌঁছোয় না। রমণীর দেহ কি এমনিই তুচ্ছ জিনিস যে, এ ছাড়া আর তার কোন প্রয়োজনই নেই? নীলিমা কহিল, নেই এ কথা তো লেখিকা বলেন নি। দুর্ভাগা মানুষগুলোর প্রয়োজন যে সহজে মেটে না, এ আশঙ্কা তাঁর নিজেরও ছিল। একটুখানি হাসিয়া কহিল, উচ্ছ্বাসের কথা বলছিলে ঠাকুরপো, অক্ষয়বাবু উপস্থিত নেই, তিনি থাকলে বুঝতেন ওর আতিশয্যটা আজকাল কোন্‌ দিকে চেপেছে। হরেন্দ্র জবাব দিল, আপনি গালাগালি দিতে থাকলেই যে পচে যাবো তাও নয় বৌদি। শুনিয়া আশুবাবু নিজেও একটু হাসিলেন, কহিলেন, বাস্তবিক হরেন, আমারও মনে হয় গল্পটিতে লেখিকা মেয়েদের রূপের সত্যকার প্রয়োজনকেই ইঙ্গিত করেছেন,— কিন্তু এই কি ঠিক? ঠিক নয়, এ কথা জগৎ-সংসারের দিকে চেয়ে মনে করা কঠিন। হরেন্দ্র উত্তেজিত হইয়া উঠিল, বলিল, জগৎ-সংসারের দিকে চেয়ে যাই কেননা মনে করুন, মানুষের দিকে চেয়ে একে স্বীকার করা আমার পক্ষেও কঠিন। মানুষের প্রয়োজন জীবজগতের সাধারণ প্রয়োজনকে অতিক্রম করে বহুদূরে চলে গেছে,—তাই ত সমস্যা তার এমন বিচিত্র, এত দুরূহ। একে চালুনিতে ছেঁকে বেছে ফেলা যায় না বলেই ত তার মর্যাদা আশুবাবু। তাও বটে, গল্পের বাকীটা শুনি অজিত! হরেন্দ্র ক্ষুণ্ণ হইল, বাধা দিয়া কহিল, সে হবে না আশুবাবু।
false
humayun_ahmed
আমার সেই সুবিধা নাই। পাকিস্তানই আমার দেশ। নারায়ণ কাশতে কাশতে বললেন, আমার এক বিঘা জমির উপর যে বাড়িটা আছে সেটা বিক্রি করতে চাই। আমার নগদ টাকা প্রয়োজন। আপনি কি খরিদ করবেন? আজই ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছেন? যেদিন বিক্রি করব তার পরদিনই চলে যাব। শিলচর দিয়ে যাব, ব্যবস্থা করা আছে। আপনার বাড়ি আমি কিনতে রাজি আছি। আপনারা তো একই জায়গা তিনচারজনের কাছে বিক্রি করেন। আপনার জমি আর কার কার কাছে বিক্রি করেছেন? আমি দুপুর তিনটায় ছাড়া পেয়েছি। সরাসরি আপনার কাছেই এসেছি। দাম কত চান? আপনি নগদ যা দিতে চান তা-ই আমি নিব। স্ট্যাম্পে সই করে বাড়ি আপনার নামে লিখে দিব। মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন না নিয়ে যাব। ওই দেশে আমার মেয়ের বিষয়ে কেউ কিছু জানে না। হাবীব বললেন, চার হাজার টাকা নগদ দিতে পারব। এতে চলবে? কিছুক্ষণ চুপ থেকে নারায়ণ বললেন, চলবে। পানির দাম বলেছেন, কিন্তু চলবে। হাবীব বললেন, চেম্বারে স্ট্যাম্প পেপার আছে। প্রণব লিখে ফেলবে। আমি টাকাটা নিয়ে আসি। মেয়েটাকে কি আজই নিয়ে যাবেন? আজ না, যেদিন শিলচর যাব সেদিন নিয়ে যাব। তার সঙ্গে কথা তো বলবেন। নাকি কথাও বলবেন না? কথা বলব। হাবীব, প্রণবকে পাঠালেন পদ্মকে নিয়ে আসার জন্যে। পদ্ম বলল, আমি বাবার সঙ্গে দেখা করব না। তার সঙ্গে যাবও না। নাদিয়া বলল, কেন যাবে না? পদ্ম বলল, বাবা-মা দুজনেই আমাকে ত্যাগ করেছে। আমি তাদের ত্যাগ করেছি। নাদিয়া বলল, তারা ভুল করেছে বলে তুমি ভুল করবে? পদ্ম কঠিন গলায় বলল, আপনি যা-ই বলেন আমি যাব না। আপনার স্যার যদি এসে আমাকে বলেন তারপরেও যাব না। নারায়ণকে টাকা দেওয়া হয়েছে। হাবীব বললেন, টাকা গুনে নিন। নারায়ণ বললেন, প্রয়োজন নাই। অবশ্যই প্রয়োজন আছে। টাকা গুনুন। নারায়ণ টাকা গুনছেন, তাঁর হাত সামান্য কাঁপছে। প্রণব স্ট্যাপ পেপারে লিখছে। হাবীব বললেন, প্রণব! বাড়িটা লিখবে নারায়ণ বাবুর মেয়ের নামে। সীতা নামে না, নাদিয়া যে নাম দিয়েছে সেই নামে—পদ্ম। মেয়েটার তো কিছুই নাই—বাড়িটা থাকুক। নারায়ণ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। বিস্ময়ে তিনি বাক্যহারা। প্রণব স্বাভাবিক। শেষ মুহূর্তে এরকম একটা কাণ্ড যে ঘটবে তা তিনি জানতেন। হাবীব নামের মানুষটির মধ্যে খারাপ অংশ যতটা প্রবল, ভালো অংশও ঠিক ততটাই প্রবল। প্রণবের প্রধান সমস্যা, কোনো মানুষের খারাপ অংশ তার চোখে পড়ে না। ভালোটাই পড়ে। অনেক রাত হয়েছে, হাবীব ঘুমাতে এসেছেন। স্ত্রীর জন্যে অপেক্ষা। স্ত্রী শোবার পর তিনি শোবেন। লাইলী পানের বাটা নিয়ে ঢুকলেন। হঠাৎ নিচু হয়ে স্বামীকে কদমবুসি করলেন। হাবীব বললেন, ঘটনা কী? লাইলী বললেন, প্রণব বাবুর কাছে শুনেছি পদ্ম মেয়েটার নামে আপনি বাড়ি কিনেছেন। আমি মন থেকে আপনার জন্যে আল্লাপাকের দরবারে দোয়া করেছি। ভালো। আপনার মেয়ে কী যে খুশি হয়েছে। সে কাদতেছিল। মাশাল্লাহ, আল্লাপাক আপনাকে একটা ভালো মেয়ে দিয়েছেন। হাবীব বললেন, আমি মনস্থির করেছি হাসান রাজা চৌধুরীর সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিব। তারিখ ঠিক করেছি ২৫ ফেব্রুয়ারি। গভর্নর সাহেব ওই তারিখ দিয়েছেন। তিনি নানান ঝামেলায় আছেন। তার জন্যে সময় বার করা কঠিন। বলো, আলহামদুলিল্লাহ। লাইলী বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। তোমার মেয়ে কি জেগে আছে? মনে হয় জেগে আছে। সে অনেক রাতে ঘুমায়। রাত জেগে কী করে? তার দাদির বিষয়ে কী যেন লেখে। হাবীব উঠে দাঁড়ালেন। লাইলী বললেন, কোথায় যান? তোমার মেয়ের কাছে। বিয়ের তারিখ হয়েছে এটা তাকে বলি। সকালে বলুন। হাবীব বললেন, রাতে বলতে অসুবিধা কী? নাদিয়া পদ্মকে ম্যাজিক দেখাচ্ছিল। এন্টিগ্র্যাভিটি ম্যাজিক। পদ্ম মুগ্ধ হয়ে দেখছে। নাদিয়া বলল, এর কৌশলটা আমি তোমাকে শেখাব না। নিজে নিজে বের করতে পারো কি না দেখো। এই নাও বোতল, এই নাও দড়ি। হাবীবকে ঘরে ঢুকতে দেখে পদ্ম বের হয়ে গেল। নাদিয়া অবাক হয়ে বলল, বাবা, এত রাতে তুমি? একটা সুসংবাদ দিতে এসেছি রে মা। কী সুসংবাদ? তোর বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি। গভর্নর সাহেব ওই দিন সময় দিয়েছেন। উনাকে ছাড়া বিয়ে হয় কীভাবে? তুই ঝিম ধরে আছিস কেন? কিছু বলবি? একজন বুনির সঙ্গে আমার বিয়ে? হাসান রাজা চৌধুরী কোনো খুন করে নাই। যে খুন করেছে তার ফাঁসির হুকুম হয়েছে। নাদিয়া মাথা নিচু করে হাসল। হাসছিস কেন? এমনি হাসলাম। তুমি ২৫ ফেব্রুয়ারি বিয়ে ঠিক করেছ। আমি ওইদিন বিয়ে করব। আমি কখনো তোমাকে ছোট করব না। আমার যখন এগারো বছর বয়স, তখন প্রণব কাকা তোমার বিষয়ে একটা গল্প বলেছিলেন। তখন ঠিক করেছি, আমি কখনো তোমার অবাধ্য হব না। গল্পটা কী? আমার টাইফয়েড় হয়েছিল। এক রাতে এমন অবস্থা হলো, সবাই ভাবল আমি মারা যাচ্ছি। তুমি আমাকে কোলে করে বাগানে চলে গেলে। চিৎকার করে বললে, আল্লাপাক তুমি আমার জীবনের বিনিময়ে আমার মেয়ের জীবন রক্ষা করো। হাবীব বললেন, সব বাবাই এরকম করবে। তা হয়তো করবে। পরের অংশটা করবে না। চার দিন চার রাত তুমি আমাকে কোলে নিয়ে বসে রইলে। পঞ্চম দিনে আমার জ্বর কমল। তুমি আমাকে মায়ের পাশে রেখে ঘুমাতে গেলে। হাবীব বললেন, ঘুমের কথা বলায় ঘুম পাচ্ছে। মা উঠি। বাবা একটু বসো। হাবীব বসলেন। নাদিয়া বলল, আমার মনে মস্ত বড় একটা কনফিউশন আছে। কনফিউশন দূর করো। কী কনফিউশন? নাদিয়া ইতস্তত করে বলল, সফুরা নামের মায়ের কাজের মেয়ের একটা ছেলে আছে। ছেলেটা কি আমার ভাই? না। আমার অনেক ত্রুটি আছে।
false
shomresh
ধরাধরি করে হরবিলাসবাবুকে রিকশায় তুলে দিল। অনিমেষ লক্ষ করছিল যে তিনি ওর মুখ থেকে চোখ সরাচ্ছিলেন না। অনিমেষের মনে হল, তিনি ওর বুকের ভেতরটর দেখতে পাচ্ছেন। ও ঝুঁকে পড়ে তাকে প্রণাম করল। হরবিলাসবাবু জড়সড় হয়ে রিকশায় বসেছিলেন, বোধহয় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শরীর নাড়তে পারলেন না। সঙ্গী ছেলেটি নিচে দাঁড়িয়েছিল, বলল, আপনি একা যেতে পারবেন? অনিমেষ বলল, ওঁকে একা ছাড়া কি ঠিক হবে? ছেলেটি বেজারমুখে বলল আমার কাছে পয়সা নেই, রিকশাভাড়া আপনার কাছে আছে? ভীষণ বিরক্ত হয়ে পড়লেন হরবিলাসবাবু, আড়চোখে অনিমেষ সেটা দেখতে পেল। ও চট করে পকেটে হাত দিয়ে দুটো আধুলি খুঁজে পেল। স্বর্ণছেঁড়া থেকে ফিরে ওর কাছে কিছু পয়সা এসেছে। অনিমেষ চট করে সেটা ছেলেটির হাতে খুঁজে দিতে সে দ্বিরুক্তি না করে নিয়ে নিল। রিকশাটা চলে গেলে অনিমেষ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। কোথাও যেন একটা খুশির ঝরনা মুখ বুজে বসে ছিল, হঠাৎ সামান্য ফাঁক পেয়ে সেটা তিরতির করে ওর সমস্ত বুঝ ভাসিয়ে দিচ্ছে। হরবিলাসবাবুর জন্য সামান্য কিছু করতে পারায় ওর নিজেকে খুব মূল্যবান বলে মনে হতে লাগল। মিছিলটা তখন হারিয়ে গিয়েছে। অন্যমনস্ক হয়ে সে মণ্টুদের বাড়ির দিকে হাঁটাছিল। মণ্টুদের বাড়ি উমাগতি বিদ্যামন্দিরের পাশে। মন্টর মাকে অনিমেষের খুব ভালো লাগে। মণ্টুর বাবা অসুস্থ হয়ে আছেন অনেক দিন, তাই সংসারের হাল ধরে আছেন মাসিমা। এখানকার একটা বাচ্চাদের স্কুলে তিনি পড়ান, পুর খাটতে পারেন এবং যখনই দেখা হয় এমন মিষ্টি করে হাসেন ভালো না লেগে পারা যায় না। মণ্টুদের বাড়ির সামনে এসে অনিমেষ বুঝতে পারল মিছিল ভেঙে গেছে স্কুলের মাঠে পেীছে। কারণ কন্দরপরা মানুষগুলো গল্প করতে করতে ফিরে যাচ্ছেন। রিকশাওয়ালারা যেন মেলা বসেছে এমন ভঙ্গিতে হর্ন বাজাচ্ছে। টিনের দরজা ঠেলে উঠোনে ঢুকে পড়ল অনিমেষ। বিরাট কাঠালগাছের সামনে মণ্টুদের টিনের চালওয়ালা বাড়ি। অনিমেষ দেখল মাসিমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। ওকে দেখে মিষ্টি মুখ হাসিতে ভরে গেল, পাশ করে তোর পিঠে ডানা গজিয়েছে শুনলাম, আমাকে প্রণাম করার সময় পাচ্ছিস না! কথার ধরন এমন যে না হেসে পারা যায় না। অনিমেষ প্রায় দৌড়ে গিয়ে ওকে প্রণাম করল। মাসিমা চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খেলেন, তারপর, এখন তো তোরা সব কলকাতার বাবু হতে চললি! আমাদের কথা মনে থাকবে তো? কেন মনে থাকবে না, বাঃ! অনিমেষ প্রতিবাদ করল। বোস গিয়ে ঘরে, আমি সন্ধেটা দিয়ে আসি। মাসিমা বললেন। মণ্টু কোথায় মাসিমা। অনিমেষ চারধারে নজর বোলাল। তার গলা শুনলে মণ্টু নিশ্চয়ই বাইরে বেরিয়ে আসত। মাসিমা বললেন, ও আজ সকালে শিলিগুড়ি গেল আমার হোটদার কাছে। তোর সঙ্গে রেজাল্ট বের হবার পর আর দেখা হয়নি? মণ্টু বাড়িতে নেই শুনে অনিমেষ হতাশ হল, না। ও কবে যাবে কলকাতায়। ওই তো হয়েছে মুশকিল। আমার ছোটদার শালার বাড়ি বেহালায়। বউদির ইচ্ছে ও সেখানে থেকে পড়াশুনা করুক। তা এত আগে থেকে গিয়ে কী হবে! মণ্টু তাই বউদিকে মার্কশিট দিতে গিয়েছে, ভরতি-টরতি হয়ে গেলেও যাবে। তা তুই কবে যাচ্ছিস রে? মাসিমা যেতে-যেতে ঘুরে দাঁড়ালেন। আগামীকাল। অনিমেষ বলল। ওমা, তাই নাকি। কোথায় উঠবি? কার সঙ্গে যাবি? মাসিমা আবার এগিয়ে এলেন। যেন এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটা ওঁর ধারণায় ছিল না। কার সঙ্গে আবার, একাই যাব! আমি কি ছোট আছি নাকি? ওখানে বাবার এক বন্ধু আছেন, তার বাড়িতে উঠে হোস্টেল ঠিক হলে চলে যাব। খুব গম্ভীর গলায় অনিমেষ জবাব দিল। সে কী! তোকে বাড়ি থেকে একা ছাড়বে আর তা ছাড়া কাল হরতাল, কলকাতায় যদি কোনো বিপদ-আপদ হয়? আমার কিন্তু ভালো লাগছে না। মাসিমাকে সত্যি সত্যি খুব চিন্তিত দেখাল। অনিমেষ জোর করে হাসল, কিছু হবে না। কিন্তু মনেমনে ও হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়ল। কলকাতায় যাবার সময় যত এগিয়ে আসছে তত যেন একটা অনিশ্চিত এবং অজান্ম জগতে পা বাড়াবার উত্তেজনা বুকের মধ্যে ড্রাম বাজাচ্ছে। ও লক্ষ করল এখন ওর হাতের চেটো ঘামছে। কিন্তু খুব গম্ভীর হয়ে সে এই দুর্বলতাকে ঢেকে রাখতে চাইল। মাসিমা আর সন্ধে দিতে গেলেন না। যদিও এখনও শেষ বিকেলের আলো কোনোরকমে নেতিতে পড়ে আছে আকাশটায়, তবু সন্ধে বলা যায় না। তবে যে-কোনো মুহূর্তেই রাত নেমে আসতে পড়ে আছে আকাশটায়, তবু সন্ধে বলা যায় না। তবে যে-কোনো মুহূর্তেই রাত নেমে আসতে পারে। আজ অবশ্য ছটার মধ্যে বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। কাল যখন কলকাতায় যাবার জন্য জলপাইগুড়ি ছাড়তেই হবে তখন আজ নিশ্চয়ই দেরি করে গেলে দাদু কিছু মনে করবেন না। এর মধ্যেই ওর নিজেকে বেশ বড় বড় বলে মনে হচ্ছে। এখন ঠোঁটের ওপর নরম সিল্কি চুল বেরিয়ে গোঁফের আকৃতি নিয়ে নিয়েছে। সে-তুলনায় গালে দাড়ি কম, চিবুকে অবশ্য বেশকিছু বড় হয়েছে। এখন পর্যন্ত নিয়মিত দাড়ি কামানো অভ্যাস করেনি। একবার পেন্সিলে ব্লেড ঢুকিয়ে টেনেছিল, কেমন অস্বস্তি হয়। কলেজে না ভরতি হলে দাড়ি কামাবে না ঠিক করেছিল অনিমেষ। একটা প্লেটে কিছু পাটিসাপটা নিয়ে মাসিমা বেরিয়ে এলেন, বন্ধু নেই বলে পালাবার মতলব করছিস বুঝতে পাচ্ছি, এটা খেয়ে যা। এখন পাটিসাপটা? অনিমেষের খুব ভালো লাগল। সারাদিন বসে ছিলাম, করে ফেললাম। বড় ছেলেটা খুব ভালোবাসে। মাসিমা ওকে সামনে বসিয়ে ওগুলো খাওয়ালেন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। টিনের দরজা খুলে বাইরে বেরুতে বেরুতে ও মাসিমার শাখ বাজানোর আওয়াজ পেল। তিনবারের আওয়াজটা শেষ হতে ও হাঁটা শুরু করল। উমাগতি বিদ্যামন্দিরের মাটে এখনও
false
shorotchandra
আমার গৃহেই আসবেন, না হয় কোনদিনই আসবেন না। পারি, সসম্মানে প্রতিষ্ঠা করব, না পারি অন্ততঃ অসম্মানের মধ্যে টেনে আনব না। এ সঙ্কল্প হতে কেউ আমাকে বিচলিত করতে পারবে না। দিবাকর ধীর-পদে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া সুরবালার ঘরের সুমুখে দাঁড়াইয়া ডাকিল, বৌদি! ভিতর হইতে মৃদুকণ্ঠের আহ্বান আসিল, ঘরে এস। দিবাকর প্রবেশ করিয়া দেখিল, আলমারি উজাড় করিয়া সুরবালা নতমুখে বসিয়া তোরঙ্গ সাজাইতেছে; জিজ্ঞাসা করিল, ছোড়দা মফঃস্বলে যাবেন? সুরবালা তেমনিভাবে কহিল, না, কলকাতায় যাবেন। ইহার পরে আর দিবাকরের মুখে কথা যোগাইল না। নিজের নির্জন ঘরের মধ্যে যে শক্তি তাহাকে ঠেলিয়া তুলিয়া দিয়া এতদূরে আনিয়াছিল, প্রয়োজনের সময় সে শক্তি অন্তর্ধান করিল। সে মৌনমুখে ভাবিতে লাগিল, কি করিয়া শুরু করা যায়। এমন সময় বারান্দায় জুতার শব্দ শোনা গেল, এবং পরক্ষণেই উপেন্দ্র পর্দা সরাইয়া ঘরে ঢুকলেন। দিবাকর অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া পলাইবার উপক্রম করিতেই উপেন্দ্র ‘দাঁড়া’ বলিয়া ধীরে-সুস্থে খাটের উপর বসিলেন এবং জামা খুলিতে খুলিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, ফেল হলি কি করে? রোজ রাত্রি একটা পর্যন্ত জেগে জেগে এতদিন তবে করেছিলি কি? এ কথার আর জবাব কি? দিবাকর অধোবদনে দাঁড়াইয়া রহিল। উপেন্দ্র বলিতে লাগিলেন, এ বাড়িতে থেকে তোর কিছু হবে না দেখচি। যা, কলকাতায় গিয়ে পড়্‌ গে, তা হলে যদি মানুষ হতে পারিস। তারপর একটু হাসিয়া বলিলেন, বৌদির কাছে কি দরবার করতে এসেছিলি? বিয়ে করবি নে, এই ত? কথা শুনিয়া দিবাকর বাঁচিয়া গেল। তাহার সমস্ত দুঃখ যেন একেবারে ধুইয়া মুছিয়া গেল, সে সহসা হাসিয়া ফেলিয়া মুখ তুলিয়া চাহিল। উপেন্দ্র হাসিলেন, যদিচ সে হাসির মর্ম কেহ বুঝিল না, তারপরে বলিলেন, আচ্ছা, এখন মন দিয়া পড়্‌ গে—আগামী অঘ্রান পর্যন্ত তোর ছুটি—তার এখনও অনেক বাকী। স্ত্রীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, সতীশ টেলিগ্রাফ করেছে, হারানদার অবস্থা ভারী খারাপ—আমি রাত্রির ট্রেন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারব না, এই এগারটার গাড়িতেই যাব, একবার থারমোমিটারটা দাও ত দেখি, জ্বরটা বাড়ল কি না—ওকি, অত বড় তোরঙ্গ কি হবে? একটা ছোটখাটো দেখে দাও না। সুরবালা কাপড় পাট করিয়া তোরঙ্গ বোঝাই করিতেছিল, কাজ করিতে করিতে মৃদুস্বরে কহিল, ছোট তোরঙ্গে দুজনার কাপড় আঁটবে না,—আমিও সঙ্গে যাব। উপেন্দ্র অবাক হইয়া কহিলেন, তুমি যাবে! ক্ষেপে গেলে নাকি? সুরবালা মুখ না তুলিয়াই বলিল, না। পরে দিবাকরের উদ্দেশে কহিল, ঠাকুরপো, একটু শিগগির করে স্নান করে খেয়ে নাও, তুমিও আমার সঙ্গে যাবে। দিবাকর সবিস্ময়ে উপেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিতেই তিনি হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, তুইও কি পাগল হলি নাকি? হারানদার ভারী ব্যারাম, বোধ করি দিন শেষ হয়ে এসেছে, আমি যাচ্চি তাঁর সৎকার করতে, তোরা তার মাঝখানে যাবি কোথায়? যা, তুই নিজের কাজে যা। সুরবালা এবার মুখ তুলিল। দিবাকরের দিকে চাহিয়া শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে বলিল, আমি আদেশ করছি ঠাকুরপো, তুমি প্রস্তুত হও গে। তোমার ছোড়দা তিনদিন জ্বরে ভুগছেন, আজও জ্বর ছাড়েনি—তাই আমিও সঙ্গে যাব, তোমাকেও যেতে হবে। যাও, দেরী করো না। উপেন্দ্র মনে মনে ভারী আশ্চর্য হইয়া গেলেন। তিনি ইতিপূর্বে কোনদিন সুরবালার এরূপ কণ্ঠস্বর শোনেন নাই। সে যে স্বচ্ছন্দে একজন পুরুষমানুষকে এমন ছোট ছেলেটির মত হুকুম করিতে পারে, তাহা স্বকর্ণে না শুনিলে বোধ করি তিনি বিশ্বাস করিতেই পারিতেন না। তথাপি তিরস্কারের স্বরে কহিলেন, আমি যাচ্চি বিপদের মাঝখানে। তোমরা কেন সঙ্গে গিয়ে সেই বিপদ বাড়িয়ে তুলবে? তোমার যাওয়া হবে না। তাঁহার শেষ কথাটা কিছু কঠোর শুনাইল। সুরবালা দাঁড়াইয়া উঠিয়া স্বামীর মুখপানে চাহিয়া পূর্ববৎ দৃঢ়কণ্ঠে কহিল, কেন তুমি সকলের সামনে সব কথায় আমাকে বকো? তুমি অসুখ নিয়ে বাইরে গেলে আমি সঙ্গে যাবোই। নটা বাজে, দাঁড়িয়ে থেকো না ঠাকুরপো, যাও। দিবাকরের সুমুখে নিজের রূঢ়তায় উপেন্দ্র অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া কহিলেন, বকবো কেন তোমাকে, বকিনি। কিন্তু বাবা শুনলে কি মনে করবেন বল ত? যা দিবাকর, তুই খেয়ে নে গে। সুরবালা কহিল, বাবা আমাকে সঙ্গে যেতে বলেছেন। এর মধ্যে তাঁর কাছেও গিয়েছিলে? হাঁ, যাই তোমার দুধ নিয়ে আসি, বলিয়া সুরবালা ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল। উপেন্দ্র গলার উড়ানিটা আলনা লক্ষ্য করিয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া চিত হইয়া শুইয়া পড়িলেন। সুরবালা যে সঙ্গে যাইবেই, স্বামীর অসুস্থ দেহটা সে যে কিছুতেই চোখের আড় করিবে না, ইহাতে আর কাহারও সংশয় রহিল না। দিবাকর প্রস্তুত হইবার জন্য ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। উপেন্দ্র ভাবিতে লাগিলেন, জিদ করিয়া সুরবালা এই যে এক নূতন সমস্যার সৃষ্টি করিল, কলিকাতায় পৌঁছিয়া তাহার কি মীমাংসা করা যাইবে! কোথায় গিয়া উঠা যাইবে! হারানদাদার ওখানে অসম্ভব, কারণ, শুধু যে সেখানে স্থানাভাব, তাহা নহে, সেখানে কিরণময়ীর স্বামী মরিতেছে। তথাপি তাহারই চোখের উপর সুরবালা যে নিজের স্বামীর বিন্দু-পরিমাণ পীড়াটুকুও উপেক্ষা করিবে না, শোভন-অশোভন কিছুই মানিবে না, স্বামীর স্বাস্থ্যটুকু অনুক্ষণ সতর্ক প্রহরা দিয়া ফিরিবে, ব্যাপারটা মনে করিয়াও তাঁহার লজ্জাবোধ হইল। বন্ধু জ্যোতিষের বাটীতে উপস্থিত হওয়াও প্রায় তদ্রূপ। সুরবালা বিষম হিন্দু; এই বয়সেই রীতিমত জপ-তপ আরম্ভ করিয়াছে,—সে বাটীতে এতটুকু অহিন্দু-আচার চোখে দেখিলে হয়ত জলগ্রহণ পর্যন্ত করিবে না। অতবড় বাটীর মধ্যে একমাত্র মায়ের আচার-বিচার বিশেষ কোন কাজেই লাগিবে না। তা ছাড়া, সেখানে সরোজিনী তাহার প্রায় সমবয়সী। তাহার বাড়িতে বসিয়া তাহাকেই ছুঁই ছুঁই করিয়া বাস করা সুখেরও নয়, উচিতও নয়। বাকী রহিল সতীশ। উপেন্দ্র শুনিয়াছিলেন, তাহার নূতন বাসায় সে একা থাকে। স্থানও যথেষ্ট। বিশেষতঃ সেও এই জপ-তপের দলভুক্ত। সতীশ ও দিবাকর—আচারনিষ্ঠ এই দুটি দেবর লইয়া
false
humayun_ahmed
হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে। মানুষটাকে ছুঁয়ে না দিলে সে আর নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। একটা অজুহাত তৈরি করে কি মানুষটাকে ছুঁয়ে দেয়া যায় না! সে কি বলতে পারে না- এই যে। শুনুন, আপনার কপালে এটা কী লেগে আছে? খুব স্বাভাবিকভাবে এই কথাটা বলে সে কপালে হাত দিতে পারে। কপালে হাত দিয়ে অদৃশ্য ময়লা সরিয়ে ফেলা। মানুষটার নিশ্চয়ই এত বুদ্ধি নেই যে কপালে ময়লার আসল রহস্য ধরে ফেলবে। এই জাতীয় ব্যাপারগুলোতে পুরুষদের বুদ্ধি থাকে কম। হ্যাপি কটেজের বারান্দায় তৃণা দাঁড়িয়ে আছে। সে শামাকে দেখে হাত নাড়ছে। শামা বাড়ির ভেতর ঢুকল। তৃণা অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে শামার কাছে এসে বলল, মারাত্মক একটা ব্যাপার হয়েছে। বিয়ের পর মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। না? মীরাকে আজ নিচ্ছে না। এই বাড়িতেই বাসর হবে। মারাত্মক না? শামা বলল, মারাত্মক কেন? বুঝতে পারছি না কেন মারাত্মক? না। তৃণা বিরক্ত গলায় বলল, তোর কি মাথায় বুদ্ধি বলতে কিছু নেই নাকি? এই বাড়িতে বাসর হচ্ছে তার মানে কী? আমরা বাসর ঘর সাজানোর সুযোগ পাচ্ছি। অলরেডি সাজানো শুরু হয়েছে। আমার দূর সম্পর্কের এক ভাই আছে, তার কলাবাগানে ভিডিওর দোকান। তাকে খবর দেয়া হয়েছে। সে বাসর ঘরে গোপন। ভিডিও ক্যামেরা সেট করে রাখবে। একটা সাউন্ড রেকর্ডারও থাকবে। মীরার যাবতীয় অডিও ভিজুয়াল কর্মকাণ্ড রেকর্ডের অবস্থায় থাকবে। এখন বুঝতে পারছিস কেন মারাত্মক? পারছি। মীরা কিছু বুঝতে পারছে না? সে তার বিয়ের টেনশনে বাঁচে না, সে কী বুঝবে তার হচ্ছে মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা। বাসর হচ্ছে কোথায়? মীরার ঘরে হচ্ছে না। ছাদে এদের প্রকাণ্ড একটা কামরা আছে। সেখানে হচ্ছে। তুই এ বাড়িতে আগে এসেছিস। এসেছি। মাত্র একবার এসেছি। এত প্রকাণ্ড বড়লোকের বাড়িতে বারবার আসা যায় না। এত বড় বাড়িতে নিজেকে সব সময় পর পর লাগে। তবে আমরা সবাই এক সঙ্গে আছিতো আমাদের লাগছে না। সবাই এসে গেছে? তুই আর টুনি তোরা দু’জন বাদ ছিলি। এখন বাকি শুধু টুনি। মনে হয় সে আসবে না। বাসা থেকে ওকে ছাড়বে না। টুনি খুবই ভুল করল। বাসর ঘরে ভিডিও ফিট করাতেই আমাদের শেষ না। আরো অনেক ফান হবে। আমাদের সোসিওলজির শাহানা ম্যাডামও এসেছেন। উনি প্রথম আলগা আলগা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এখন আমাদের দলে ভিড়ে গেছেন। ভিডিও ক্যামেরা ফিট করার তদারকি তিনিই করছেন। সে-কী। বিয়ে বাড়িতে গেলে সব মেয়ের মাথাই খানিকটা হলেও আউলা হয়। উনার সবচে’ বেশি আউলা হয়েছে। ভিডিও ক্যামেরা বসানোর লোক চলে এসেছে। তার নাম তাহের। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে লজ্জায় মুখ তুলতে পারছে না। এতগুলো মেয়ের পাশে সে খুবই অস্বস্তিবোধ করছে। কেউ কিছু বললেই চমকে উঠছে। একবারতো হাত থেকে ক্যামেরাও ফেলে দিল। শাহানা ম্যাডাম বললেন, তাহের ক্যামেরাটা ফিট করছ কোথায়? খাটের মাথায়? তাহের হা-সূচক মাথা নাড়ল। ম্যাডাম বললেন, ফিল্ড অব ভিশন কি রেখেছ? শুধু খাটটা কভার করলেই হবে। যা ঘটনা সব খাটেই ঘটবে। অডিও রেকর্ডারের কী করেছ? ভিডিওর সঙ্গেই অডিও আছে। ক্যামেরাটা গাদাফুল দিয়ে খুব ভালোমতো ঢেকে দাও যেনো বোঝা না যায় ক্যামেরা। সব ঠিকঠাক হলে একটা টেস্টরান করবে। তাহের আবারো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তৃণা বলল, এখন আমাদের দরকার নকল দাড়ি গোঁফ। ফর এভরিবডিস ইনফরমেশন— মীরাকে আমি অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। সে বাসর ঘরে ঢোকার আগে নকল দাড়ি গোফ পরে ঘোমটা দিয়ে থাকবে। তার স্বামী ঘোমটা খুলে দাড়ি গোফওয়ালা স্ত্রী দেখে যে কাণ্ডটা করবে আমাদের ভিডিওতে তা ধরা থাকবে। যূথী বলল, মীরা কি জানে তার বাসর ঘরে ভিডিও ক্যামেরা বসানো হয়েছে। তৃণা বলল, আমরা এই ক’জন ছাড়া কেউ জানে না। বাইরের মানুষের মধ্যে শুধু মীরার মা জানেন। শামা বিস্মিত হয়ে বলল, উনি কিছু বলেন নি? খালা কিছুই বলেন নি। উনি বরং সবচে’ বেশি মজা পাচ্ছেন। প্রথম মেয়ের বিয়েতে সবচে’ বেশি ফান’ পায় মেয়ের মা। এক লাখ টাকা বাজি উনি মেয়ের বাসর ঘরের ভিডিও দেখতে চাইবেন। শাহানা ম্যাডাম বললেন, মেয়েরা তোমরা খেয়াল রেখো কোনো ছেলে যেন এদিকে না আসে। তিন তলার ছাদ আউট অব বাউন্ড ফর এভরিবডি। তৃণা বলল, মিঃ হুক্কা কি আসতে পারবেন? না হুক্কাও আসতে পারবেন না। শামা বলল, হুক্কা কে? তৃণা বলল, মীরার দূর সম্পর্কের ভাই। আমরা নাম দিয়েছি হুক্কা। সে তার চশমা খুঁজে পাচ্ছে না। তার ধারণা আমরা চশমা লুকিয়ে রেখেছি। বারবার আসছে আমাদের কাছে। হুক্কা নাম কেন? ফানি টাইপ ক্যারেক্টর, এই জন্যে হুক্কা নাম দেয়া হয়েছে। একসময় মীরা হুক্কার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। কিন্তু হুঙ্কা সাহেব পাত্তাই দেন নি। আমরা ঠিক করেছি হুক্কা সাহেবকেও একটু টাইট দেব। শামা এক কোণায় বসে বাসর ঘরের ফুল সাজানো দেখছে। গাদাফুল আর। বেলিফুল এই দু’রকমের ফুল মশারি স্ট্যান্ড থেকে ঝুলছে। বিছানায় থাকছে শুধু গোলাপ। শাহানা ম্যাডাম এখন গোলাপের কাটা বাছছেন। টুনিও চলে এসেছে। জবরজং সাজে সেজেছে। টুনিকে দেখে সবাই হৈহৈ করে উঠল। যূথী বলল, এই তোকেতো একেবারে বিহারিদের মত লাগছে। মনে হচ্ছে তুই মোহাম্মদপুরের পাকিস্তান কলোনিতে থাকিস। হাওয়াই মিঠাইওয়ালা শাড়ি তুই পরলি কী মনে করে? সবাই হো হো করে হেসে উঠল। শামা লক্ষ করল তার কিছুই ভাল লাগছে না। নিজেকে আলাদা এবং একলা লাগছে। মনে হচ্ছে এদের কারো সঙ্গেই তার কোনো যোগ নেই। তার যোগ অন্য কোথাও। অন্য
false
shirshendu
তুলতে গিয়ে পেরে ওঠেনি। সেটার ছাদ-ঢালাই করে দিয়েছে কৃষ্ণজীবন। পলেস্তারা পড়ে গেছে, জানালা-দরজাও বসে গেছে। রং হলেই সে বাড়িও হেসে উঠবে। পুরনো ঘরগুলো ভেঙে জায়গা চৌরস করে বাগান হচ্ছে। ময়দানবের কাণ্ড যেন, রামজীবনের আধখ্যাচড়া ঘর আর মুখ ভ্যাংচায় না বিষ্ণুপদকে। বিষ্ণুপদ এখন দোতলার চওড়া বারান্দায় বসে দুনিয়াটা দেখে। কিন্তু নতুন রকম লাগে কি? তা তো লাগে না! সুখের যে একটা বান ডেকেছে সেটা বুঝতে পারে বিষ্ণুপদ। কিন্তু এত সুখে যখন নয়নতারা উথলে ওঠে তখনও বিষ্ণুপদ কেন ঠাণ্ডা মেরে থাকে! কোনও সুখই কেন ভিতর অবধি গিয়ে সেঁধোয় না। তার! সুখের চিহ্নগুলো সারাদিন ধরে ঘরে-বাইরে খুঁজে বেড়ায় সে। বাড়ি হল, সাহেবি সব আসবাব হল, আজকাল পাতে রোজ মাছ তো বটেই, তার সঙ্গে আরও দুই-তিন পদ। রামজীবনকে দোকান করে দিয়েছে কৃষ্ণজীবন। সে দোকানও চলছে। রামজীবন আজকাল মদটদ খাচ্ছে না কিছুদিন! সবই সুখের বৃত্তান্ত। কুয়োর ধারে বড় জমিটা মস্ত ভরসা ছিল সংসারের। আনাজপাতি না জুটলে ওই বাগান থেকে যা-হোক কিছু খুঁটে তুলে আনত নয়নতারা। শাকপাতা, কচু-ঘেঁচু, নিদেন একটা লেবু। আজকাল আর তার দরকার হচ্ছে না। অনটন নেই। তবু বুকে একটু টনটনানি থেকে যায় কেন! কী নেই? আরও কী চায় বিষ্ণুপদ! আগাছায় ভরা বাগানটায় বিষ্ণুপদ একদিন সকাল থেকে গিয়ে বসে রইল। আজ বাদলা মেঘ নেই। বৃষ্টি একটু থিতু রয়েছে। আতা গাছের ছায়ায় বসে বিষ্ণুপদ ভাবনাচিন্তার ঝাঁপি খুলে বসল। নিরিবিলি এরকম নিজের মোকাবিলা করা মাঝে মাঝে ভাল। কিন্তু তার ভিতরটা চিরকালই বড় নিস্তব্ধ। সেখানে কথার ভুড়তুড়ি কম, ভাবনা-চিন্তাও যেন খেই-হারা। সুখের কথাই ভাবছে বিষ্ণুপদ। এই যে বাড়ি হল, কতকালের কত অভাবের সঙ্গে লড়াই শেষ হয়ে গেল, এসব হওয়ার পরও সে কেন যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেছে? একটা এই হতে পারে যে, তার পুরনো চেনা বাড়িটা লোপাট হয়ে যাওয়ায় কেন যেন নতুন বাড়িতে সে খাপে খাপে বসছে না। খুঁতখুঁতুনি হচ্ছে, নতুন জুতো পরলে যেমন ধারা হয়! তাই কি! আর এক অস্বস্তি বামাচরণ। শোনা যাচ্ছে, তার চিকিৎসা শুরু হয়েছে। মাথার ব্যামো। লোভে, অশান্তিতে, আক্রোশেই কি পাগল হয়ে গেল ছেলেটা? সব মিলিয়ে বিষ্ণুপদর তেমন সুখ হচ্ছে না। কেমন যেন মনে হচ্ছে, পরের বাড়িতে বাস করছে সে। কেন এরকম হয়! একখানা দা হাতে বোধ হয় গুলতির কাঠ কাটতে বাগানে ঢুকেছিল পটল। দাদুকে দেখে থমকে দাঁড়াল। দাদু, কী করছে? বসে আছি দাদা। এ সময়টায় সাপ বেরোয় তো। বিষ্ণুপদ মৃদু হাসল, হেলে ঢোঁড়া সব। না দাদু, চক্করওলাও আছে। বিষ্ণুপদ মাথা নাড়ল, নেই। ভিত ঘোড়ার সময় দু দুটা বাঞ্ছসাপ মেরে ফেলল মিস্তিরিরা, দেখিসনি? আর নেই? বিষ্ণুপদ বলল, সাপও আজকাল কই? আগে কত দেখা যেত। বসত বাড়ছে, সব নিকেশ হয়ে যাচ্ছে। পটল বলল, সাপের বিশ্বাস কি! তুমি বারান্দায় গিয়ে বোসো। বিষ্ণুপদ উদাস গলায় বলে, গায়ের ছেলে হয়ে সাপকে ভয় পাস? খুব পাই দাদু। বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আগে লোকে বাঘ-সিংহী। ভয় পেত, আজকাল দেখ তাদের কী দুৰ্দশা! ফৌত হয়ে হয়ে মাত্র কয়েকটিতে দাঁড়িয়েছে। এখন ভয় দেখা দিয়েছে, একদিন না। এসব জন্তু লোপাট হয়ে যায়। সাপেরও সেই অবস্থা হয়ে এল। আগে বর্ষাকালে হেলে-টোডা কত কিলবিল করত। চার ধারে। উঠোনে, পুকুরে। আজকাল কোথায়? পটল একটু হাসল, তুমি বুঝি সাপখোপ বাঘ-সিংহ চাও? বিষ্ণুপদ নাতির দীঘল চেহারা আর কোমল মুখখানার দিকে চেয়ে বলল, তুই চাস না? না তো! তোর বড় জ্যাঠা চায়। দুনিয়াটা এক অদ্ভুত জায়গা। প্রকৃতি এমন করে সৃষ্টি করেছিল সব যে পান থেকে চুন খসলেই গণ্ডগোল। প্রকৃতির ভারসাম্য না কী যেন বলে! তোর জ্যাঠা জানে। সে অনেক জানে, বুঝিয়ে বলতে পারবে। আমি তত জানি না। কিন্তু আমারও কেন যেন মনে হয়, সাপখোপ বাঘ-ভালুক না হয় থাকত কিছু, কী ক্ষতি হত তাতে! সাপের কামড়ে যে কত মানুষ মারা যায় দাদু! বিষ্ণুপদ একটু হেসে বলে, সাপের কামড়ে যত না মানুষ মরেছে তার চেয়ে লক্ষ গুণ সাপ মরেছে মানুষের লাঠিতে। বাঘা যত না মানুষ মেরেছে তার বহুগুণ বেশি বাঘ মরেছে মানুষের হাতে। সবসময়ে যে না মারলেই চলত না, এমন নয়। তবু মেরেছে। মানুষের দাঁতে নখে জোর না থাক, তবু মানুষের চেয়ে হিংস্র আর কে আছে বল তো! পটল একটু ভাবল। তারপর দাদুর সামনে উবু হয়ে বসে মুখের দিকে চেয়ে বলল, দাদু, বড় জ্যাঠা এইসব নিয়ে লেখে, না? ও বাবা! সে পণ্ডিত মানুষ, কী নিয়ে লেখে তার আমি কী বুঝি? তবে এসব কথাও নাকি আছে তার বইতে। বইটা আমি জ্যাঠার কাছে চেয়েছি। বলেছে দেবে। সে বই কি তুই বুঝবি? বুঝব দাদু। জ্যাঠার কথা আমি বুঝতে পারি। বিষ্ণুপদ একটু আনমনা হয়ে গেল। আপনমনে শুধু বলল, সে বড় ভালবাসে দুনিয়াটাকে। পটল এখন অনেকটাই বড় হয়েছে। সামনের বছর তার মাধ্যমিক পরীক্ষা। সে আজকাল ক্লাসে ফাস্ট হয়। গোপালকে কলকাতার ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে কৃষ্ণজীবন। হোস্টেলেরও ব্যবস্থা হয়েছে। পটলের একটু ফাঁকা লাগে তাই। পটল বিষ্ণুপদর দিকে চেয়ে বলল, জ্যাঠা এখন কোথায় আছে দাদু? আমেরিকা না ইউরোপ? বিষ্ণুপদ এক-গাল হাসল, না রে, কলকাতাতেই আছে এখন। গিয়েছিল কাছেপিঠে কোথায় যেন! ম্যানিলা হবে বোধ হয়। ফিরে এসেছে। যদি ভাল করে লেখাপড়া করিস তাহলে তুইও তার মতো কত দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াবি। কী যে বলো! জ্যাঠার
false
humayun_ahmed
এই মেয়েটি ভয়াবহ একটা সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে এসেছিল। তিনি সেই সমস্যার দ্রুত সমাধান করেছিলেন। তারপরই মেয়েটির মাথায় ঢুকে গেছে মিসির আলি তাঁর জীবনে যত সমস্যার সমাধান করেছেন সেগুলি সে লিখে ফেলবে। প্রতিমা হাসতে হাসতে বলল, স্যার আপনি এমন হতাশ চোখে তাকাচ্ছেন কেন? আমি বাঘ-ভালুক কিছু না। আমি খুবই সাধারণ একটা মেয়ে। সাধারণ হলেও ভালো মেয়ে। আমি নানানভাবে আপনাকে সাহায্য করব। মনে করুন সকালকেলা আপনার কাছে এলাম। আপনি কিছুক্ষণ কথা বললেন, আমি নোট নিলাম। তারপর আপনার ঘরের কাজকর্ম গুছিয়ে দিলাম। আমি রান্না করা শিখেছি। আপনার জন্যে রান্ন করলাম। তোমার এখনো বিয়ে হয় নি? না। আমি তো আগেই বলেছি–আমি কখনো বিয়ে করব না। প্রতিমা খিলখিল করে হাসছে। মিসির আলি বললেন, হাসছ কেন? প্রতিমা বলল, আপনি হতাশ চোখে তাকাচ্ছেন। আপনাকে দেখে খুবই মায়া লাগছে। এই জন্যে হাসছি। চা খাবে? না। চা খাব না। আমি চলে যাব। আপনি প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিন। তারপর আমি আসব। স্যার, ভালো কথা আপনার সঙ্গে আমার সাক্ষাতের বিবরণ আমি গুছিয়ে লিখে ফেলেছি। কপি আপনার জন্যে নিয়ে এসেছি। কপি আপনি পড়বেন-এবং বলবেন কিছু বাদ পড়েছে কি না। স্যার ঠিক আছে? হ্যাঁ ঠিক আছে। আজই পড়বেন। স্যার, আপনি ঘুম থেকে কখন ওঠেন? রাত করে ঘুমাতে যাই তো, ঘুম ভাঙতে নটা-দশটা বেজে যায়। আমি যখন চার্জ নেব, আপনাকে ঠিক রাত দশটায় ঘুমাতে যেতে হবে। ভোর ছটায় ঘুম থেকে তুলে দেব। এক ঘণ্টা আপনাকে হাঁটতে হবে। এক ঘণ্টা পর মর্নিং ওয়াক সেরে এসে দেখবেন–ব্রেকফাস্ট রেডি। মিসির আলি চিন্তিত গলায় বললেন, তুমি এখানে থাকবে নাকি? প্রতিমা বলল, হ্যাঁ। তবে এ বাড়িতে না। বারিধারায় আমার পাশাপাশি দুটা ফ্ল্যাট আছে-একটায় আপনি থাকবেন, অন্যটায় আমি থাকব। আমি একজন ইনটেরিয়ার ডিজাইনারকে খবর দিয়েছি–সো আপনার ফ্ল্যাটটা আপনার প্রয়োজনমতো সাজিয়ে দেবে। লাইব্রেরি থাকবে, লেখার টেবিল থাকবে। আমাকে গিয়ে তোমার ফ্ল্যাটে উঠতে হবে? হ্যাঁ। স্যার এ রকম শুকনা মুখ করে তাকালে হবে না। আমি আগামীকাল সকাল নটার সময় আসব। ঝড়-বৃষ্টি-সাইক্লেন-হরতাল যাই হোক না কেন সকাল নটায় আমি উপস্থিত হব। ঠিক আছে। এর মধ্যে আমার লেখাটা পড়ে ফেলবেন। লেখার কিছু কিছু অংশ ভালোমতো দেখে দেবেন। আমি দাগ দিয়ে রেখেছি। তুমি কি এখন চলে যাচ্ছ? প্রতিমা হাসতে হাসতে বলল, হ্যা-তবে কাল দেখা হবে। ঠিক সকাল নটায়। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। লাভ নেই-আপনি নিশ্চয়ই একদিনের মধ্যে বাড়ি বদলাতে পারবেন না? মিসির আলির মনে হল মেয়েটা পুরোপুরি সুস্থ না। কিছু সমস্যা তার এখনো রয়ে গেছে। মিসির আলি দুপুরের খাওয়া শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকালেন, দুটা পঁচিশ বাজে। বিছানায় এসে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করা যায়। দুপুরের খাবার শেষ করে বই হাতে বিছানায় কত হবার মধ্যে আনন্দ আছে। শরীর ভরা আলস্য, চেখভর্তি ঘুম-হাতে চমৎকার একটা বই। আজ অবিশ্যি হাতে বই নেই-প্রতিমা নামের জ্বলন্ত মোমবাতির লেখা বাহান্ন পৃষ্ঠার খাতা। হাতের লেখা না, কম্পিউটারে কম্পোজ করা হয়েছে, স্পাইরেল বাইন্ডিং করা হয়েছে। হাতের লেখা হলে ভালো হত। মানুষ তার চরিত্রের অনেকখানি হাতের লেখায় প্রকাশ করে। কারো লেখা হয় জড়ানো। একটা অক্ষরের গায়ে আরেকটা অক্ষর মিশে থাকে। কেউ কেউ লেখে গোটা গোটা হরফে। কেউ প্রতিটি অক্ষর ভেবেচিন্তে লেখে। কেউ অতি দ্রুত লেখে। লেখা দেখেই মনে হয় তার চিন্তা করার ক্ষমতা দ্রুত। সে মাথার চিন্তাকে অনুসরণ করছে বলে লেখাও দ্রুত লিখতে হচ্ছে। তবে কেউ কেউ লেখে টিমোতালে। কম্পিউটার মানুষকে অনেক কিছু দিচ্ছে, আবার অনেক কিছু কেড়েও নিচ্ছে। কম্পিউটারের লেখায় কোনো কাটাকুটি নেই। হাতের লেখায় কাটাকুটি থাকবেই। সেই কাটাকুটিই হবে মানুষের চরিত্রের রহস্যের প্রতিফলন। হাতের লেখার যুগ পার হয়েছে। এখন শুরু হয়েছে কম্পিউটারে লেখার যুগ। এই যুগ শেষ হয়ে নতুন যুগ আসবে। কী রকম হবে সেটা? মানুষ চিন্তা করছে আর সেই চিন্তা লেখা হয়ে বের হয়ে আসবে? সে রকম কিছু হলে মন্দ হয় না। তা হলে সেই যুগ হবে হাতের লেখার যুগের কাছাকাছি। কারণ চিন্তার মধ্যেও কাটাকুটি থাকবে। প্রতিমার লেখার ওপর মিসির আলি চোখ বুলাতে শুরু করলেন। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে তিনি কোনো গল্পের বই পড়ছেন। মেয়েটা সে রকম ভঙ্গিতেই লেখার চেষ্টা করছে। লেখার ভঙ্গিটা জার্নালিস্টিক হলে ভালো হত। প্রতিমা লিখছে– আমার নাম প্রতিমা। এটা কিন্তু কাগজপত্রের নাম না। কাগজপত্রে আমার নাম আফরোজা। যেহেতু আমার মা খুব শখ করে প্রতিমা নাম রেখেছিলেন, এবং আমার বয়স এক বছর পার হবার আগেই মারা গেছেন সে কারণে মার প্রতি মমতাবশত সবাই আমাকে ডাকা শুরু করল প্রতিমা। মুখে মুখে ডাকনাম এক ব্যাপার, কাগজপত্রে নাম থাকা অন্য ব্যাপার। আকিকা করে আমার মুসলমানি নাম রাখা হল। তবে সেই নামে কেউ ডাকত না। শুধু বাবা মাঝে মধ্যে ডাকতেন। তখন আমি জবাব দিতাম না। আমার বাবা আমাকে অতি আদরে মানুষ করতে লাগলেন। তিনি আদর্শ পত্নীপ্রেমিকদের মতো দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি। বাড়িতে মাতৃস্থানীয় কেউ না থাকলে তার কন্যার অযত্ন হবে ভেবে তিনি সাৰ্ব্বক্ষণিক একজন নার্স রাখলেন। ছোটবেলায় এই নার্সকেই আমি মা ডাকতাম। আমার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন কী একটা কারণে যেন এই নার্স মহিলাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। শৈশবের এই স্মৃতিটি আমার মনে আছে। এই মহিলা হাউমাউ করে কাঁদছেন এবং বাবার পা জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছেন। বাবা বলছেন-ডোন্ট টাচ মি। ডেন্ট টাচ
false
humayun_ahmed
আপনার সঙ্গে আমার একটি অত্যন্ত জরুরি কথা আছে। এতক্ষণ যা বললে সেগুলো জরুরি নয়? না নয়। বেশ, বল শুনি। বলছি–কিন্তু আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমার জরুরি কথাটা বলা শেষ হবার পরেও আগে যেভাবে আসতেন এ-বাড়িতে ঠিক এইভাবেই আসবেন। আহসান হাসিমুখে বলল, বেশ নাটকীয় ওপেনিং ব্যাপার কী বলত? আপনার বাবা, আমার বাবাকে একটি চিঠি দিয়েছেন। সেই চিঠি পড়ে বাসার সবাই খুব মন খারাপ করেছে। সবচেয়ে বেশি মন খারাপ করেছি আমি। আপনি বোধ। হয় জানেন না আমি কোনোদিন কাঁদি না, কিন্তু সেই চিঠি পড়ে খুব কেঁদেছি। কেঁদেছি কারণ আমার ধারণা ঐ চিঠি আপনি আপনার বাবাকে দিয়ে লিখিয়েছেন। আপনার বাবা, সরি আমার বোধ হয় ভালই সাহেব বলা উচিত—নিজ থেকে এরকম একটা চিঠি লিখতে পারেন না। চিঠিটা দেখি। জেরিন ড়ুয়ার থেকে চিঠি বের করল, আহসানের হাতে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে। গেল। আহসানের অনেক সময় লাগল চিঠি শেষ করতে। তার বাবা কুতুবপুর এম. ই. হাই স্কুলের এ্যাসিসটেন্ট হেড মাস্টার জনাব নেছারউদ্দিন অত্যন্ত প্যাঁচল অক্ষরে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেছেন— ॥ ইয়া রব ।। প্রিয় বেয়াই সাহেব, আসোলামু আলায়কুম। পর সমাচার এই যে, দীর্ঘদিন আপনার সঙ্গে পত্ৰ মারফত কোনো যোগাযোগ নাই। গত রমজানে আপনাকে একটি পত্ৰ দিয়াছিলাম সম্ভবত আপনার হস্তগত হয় নাই। যাই হোক, একটি বিশেষ আবদার নিয়া আপনার নিকট এই পত্র প্রেরণ করিতেছি। আবদারটি আপনার তৃতীয় কন্যা জেরিন প্রসঙ্গে। এই অত্যন্ত সুলক্ষণা, বিদ্যাবতী ও গুণবতী কন্যাটির সঙ্গে আহসানের বিবাহ কি হইতে পারে না? যদি হয় তাহা হইলে মারুফ সম্পর্কে আমাদের সকলের সকল আশংকা দূর হয়। সৎ মার গৃহে শিশুদের কী অবস্থা হয় তা তো আপনার অজানা নাই। আমি নিজেও ভুক্তভোগী। মা জেরিনের সঙ্গে আহসানের বিবাহ দিতে পারিলে সব দিক নিশ্চিত হওয়া যায়। পত্র মারফত এইসব বিষয় আলোচনা করা সম্ভব না। বাধ্য হইয়া করিলাম। কারণ আমি বর্তমানে বাতব্যাধিতে শয্যাশায়ী। হাঁটাচলার সামর্থ্য নাই। আপনি এই পত্রটি বেয়ান সাহেবকে দেখাইবেন। এবং তাঁহার সহিতও পরামর্শ করিবেন। এই হচ্ছে চিঠি শুরুর প্রস্তাবনা। এরপরও নানান প্রসঙ্গ আছে। তাঁর অসুখের পূর্ণ বিবরণ আছে। কুতুবপুর এম. ই. স্কুল নিয়ে বর্তমানে যে পলিটিক্স চলছে এবং এই পলিটিক্সের ফলে যে স্কুলের অস্তিত্বই বিপন্ন হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তার বিশদ বিবরণ আছে। এই অবস্থায় কি করা উচিত বলে বেয়াই সাহেব মনে করেন?—এইসবও আছে। আহসান চিঠিটি খামে ভরে টেবিলের ওপর রাখল। জেরিন চা নিয়ে ঢুকছে। শান্ত ভঙ্গিতে টি-পট থেকে চা ঢালছে। দুলাভাই, মা ফিরেছে। আমাকে বলেছে আপনাকে যেন চলে যেতে না দিই। মা নামাজ পড়েই আসবে। চায়ে চিনি হয়েছে? হ্যাঁ হয়েছে। এখন আপনাকে আরেক কাপ চা খেতে হবে বাবার সঙ্গে। তিনি চা-নাশতা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তাহলে আর এখানে চা দিলে কেন? আপনি সিগারেট ছাড়া চা খেতে পারেন না এই জন্যে। জেরিন হাসল। হাসতে-হাসতে বলল, আজ রাতে তো আপনি থাকবেন এখানে তাই না? তেমন কোনো কথা ছিল কি? না ছিল না। কিন্তু আমি জানতাম আজ আপনি আসবেন এবং রাতে থেকে যাবেন। আমি মাকে সকালবেলাতেই বলে রেখেছি ভালোমতো বাজার করতে। আজ কি কোন বিশেষ দিন? জেরিন তীব্র গলায় বলল, কেন প্রিটেন্ড করছেন? আপনি ভালোই জানেন আজ কোন দিন। জানেন বলেই এসেছেন। গত দু মাসে কি একবারও এসেছেন এ-বাড়িতে? আহসানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আজ এগারই শ্রাবণ। এই দিনে পাঁচ বছর আগে তারিনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। বাসর হয়েছিল এ-বাড়িতেই। খুব ঝড়-বৃষ্টির রাত ছিল বলে বর-কনেকে যেতে দেওয়া হয় নি। জেরিন ঠাণ্ডা গলায় বলল, যান বাবা বসে আছে। দেখা করে আসুন। আহসানের শ্বশুর ইমতিয়াজ সাহেব ঠাণ্ডা ধরনের মানুষ। কোন কিছুতেই উত্তেজিত না হওয়ার অসাধারণ গুণটি তিনি আয়ত্ত করেছেন। সারাজীবন জজিয়তি করে-করে কথা না বলে শুধু শুনে যাওয়ার বিষয়টিও তাঁর মজ্জাগত হয়েছে। অসম্ভব ভদ্রলোক। নিজের জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলার সময়ও খুব লক্ষ রাখেন যেন কোথাও সৌজন্য এবং শিষ্টতা ক্ষুণ্ণ না হয়। আহসানকে তিনি কখনো সহজভাবে নিতে পারেন নি। অবশ্যি তা বুঝতেও দেন নি; তবে এইসব ব্যাপারগুলি বোঝা যায়। আহসানের বুঝতে অসুবিধা হয় নি। নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিকভাবে একবার সে তারিনকে বলেও ফেলল, তোমার বাবা আমাকে সহ্য করতে পারে না কেন বল তো? তারিন খুবই স্বাভাবিকভাবে বলল, সবাই কি আর সবাইকে সহ্য করতে পারে? এমন যে মহাত্মা গান্ধী তাঁকেও তো অনেকে সহ্য করতে পারত না। মহাত্মা গান্ধী অনেক বড় ব্যাপার। এইসব তুচ্ছ ব্যাপারে তাঁর কিছু যায় আসে না। আমি ক্ষুদ্র ব্যক্তি আমার খারাপ লাগে। আমারো লাগে কিন্তু কী আর করা। না, করার কিছুই নেই। মেনে নেওয়া ছাড়া আর কি পথ আছে? আহসান মেনে নিয়েছিল। এ-বাড়িতে পা দিলে সে নিয়ম মাফিক কিছু সময় কাটাত ইমতিয়াজ সাহেবের সঙ্গে। ইমতিয়াজ সাহেব ন্যাশনাল জিওগ্রাফির পাতা বন্ধ করে অতি ভদ্ৰ স্বরে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলে এক সময় ইতি টানতেন। সেই ইতি টানার ব্যাপারটিও রুচি সম্মত। যাও তোমাকে আর আটকে রাখতে চাচ্ছি না। বড়ো মানুষদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানো ভালো নয়—এতে মনের মধ্যে বুড়ো-বুড়ো ভাব ঢুকে যায়। যা মোটেই ডিজায়ারেবল নয়। আহসান পাশের কামরায় ঢুকল। শ্বশুরের সঙ্গে তার কথাবার্তা হল মামুলি ধরনের। সে এদিকে তেমন আসে না কেন? ছেলেটি এখানে আছে সে কারণেও তো আসা উচিত। এবং ছেলেটিকে নিজের কাছে মাঝেমধ্যে
false
shottojit_roy
চোরকে ধরে দিতে পারি। তা হলে আরও বেশি নাম হবে; কিন্তু সেটা সাহসে কুলোল না। যাই হাক।–কাল রাত্রে কৈলাসের কাছে গিয়ে লুকিয়ে ছিলাম। যখন দেখলাম একে একে বাংলোর সবাই ঘুরতে বেরিয়েছে, তখন বাংলোয় গিয়ে জমাদারের দরজা দিয়ে চট্টোরাজের ঘরে ঢুকে মাথাটা নিয়ে আসি। ফেলুদা বলল, আপনার পেছনেও যে একজন গোয়েন্দা লেগেছে সেটা বুঝতে পেরেছিলেন কি? মোটেই না; আর সেজন্যেই তো হঠাৎ ধরা পড়ে এত বোকা হয়ে গিয়েছিলাম! মিস্টার ঘোটে হা হা করে হেসে উঠলেন। ফেলুদা বলল, যখন দেখলাম। আপনি এতখানি পথ লুইসনের সঙ্গে গিয়েও তাকে মূর্তিটা গছাননি, তখনই প্রথম বুঝতে পারলাম যে আপনি নিদোষ। তার আগে পর্যন্ত, আপনি গোয়েন্দা জেনেও, আপনার উপর থেকে। আমার সবটুকু সন্দেহ যায়নি। কিন্তু আপনি তো চট্টোরীজকে সন্দেহ করেছিলেন, তাই না?–প্রশ্ন করলেন মিস্টার মল্লিক। ফেলুদা বলল, হ্যাঁ, কিন্তু প্ৰথমে সেটা ছিল শুধু একটা খটকা। যখন দেখলাম একটা পুরনো সুটকেসে নতুন করে নাম লেখা হয়েছে আর এন রক্ষিত, তখনই সন্দেহ হল-~~নামটা ঠিক তো? তারপর কাল রাত্রে উনি রেনকোট পরে বেরিয়েছিলেন সে কথা লালমোহনবাবুর কাছে শুনি। পনেরো নম্বর গুহাতে একজন লোক ঢুকেছে। সন্দেহ করে ওপর থেকে গুহার সামনে একটা নুড়ি পাথর ফেলি। ফলে অন্ধকারে লোকটা পালায়। ভেতরে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে পেছন দিকের একটা ছোট গুহায় দেখি রেনকোট, আর তার বিরাট স্পেশাল পকেটে হাতুড়ি, ছেনি। আর নাইলনের দড়ি। আমি ওগুলো সেইখানেই রেখে আসি। বুঝতে পারি চট্টোরাজ হলেন মূর্তিচোর। সেই রাত্রেই দেখলাম চট্টোরাজ তার ঘরে পাগলের মতে কী জানি খুঁজছেন। পরদিন সকালে শুনলাম। আপনি বম্বেতে টেলিফোন করেছেন-মেয়ে ভাল আছে। বুঝলাম মূর্তি এখন আপনার কাছে। অথচ মুশকিল। এই যে, মূর্তিটা হাত ছাড়া হলে আসল চারকে শায়েস্তা করা যাবে না। তাই আপনাকে অ্যারেস্ট করতে হল। এ দিকে শুভঙ্কর বোসের অপঘাত মৃত্যু হয়েছে। তার ডেডবডি দেখতে গিয়ে হাতের মুঠো থেকে নীল কাপড়ের টুকরো পাওয়া গেল। আপনি রাত্রে নীল শার্ট পরেছিলেন, কিন্তু এদিকে আমার সন্দেহ চট্টোরাজের উপর পড়েছে! আসলে আমারও আগে চট্টোরাজ পৌঁছেছিলেন ডেডবডির কাছে। উনিই নাড়ি দেখার ভান করে নিজের একটা নীল শার্ট থেকে ছেঁড়া টুকরো শুভঙ্করের হাতে গুঁজে দেন—কারণ শুভঙ্করের মৃত্যুর জন্য অন্য কাউকে দায়ী করার প্রয়োজন ছিল। উনি নিজের শর্টটি অবিশ্যি পরে বাংলোর পশ্চিম দিকে গাছপালায় ভর্তি একটা নিরিবিলি জায়গায় লুকিয়ে রাখেন, আর আমি গিয়ে সেটা উদ্ধার করি। কিন্তু এত করেও যে সমস্যাটা বাকি রইল, সেটা হল কী করে চট্টোরাজকে ধরা যায়। একটা পথ পেলাম যখন শুনলাম যে কে জানি লালমোহনবাবুর ঘরে ঢুকে বাক্স ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। এ ব্যক্তি নিঃসন্দেহে চট্টোরাজ, কারণ তারই একটি মূল্যবান জিনিস খোওয়া গেছে। লালমোহনবাবুর বাক্সে লালমোহনবাবুর নোটবই ছিল, এবং তাতে যক্ষীর মাথা, প্লেন ক্র্যাশ ইত্যাদির উল্লেখ ছিল। এই খাতা চট্টোরাজ না পড়ে পারেন না। এই আন্দাজে আমি লালমোহনবাবুর হাতের লেখা নকল করে চট্টোরাজকে যে চিঠিটা লিখলাম সেটার কথা জানেন। তার আগেই আমি চট্টোরাজকে নিশ্চিন্ত করার জন্য জানিয়ে দিলাম যে মূর্তি চোর ধরা পড়েছে- সেই ফ্রেঞ্চকটি দাড়ি?–আমি আর লালমোহনবাবু একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম। হ্যাঁ?-ফেলুদা হেসে বলল। -সেটা আমার দু নম্বর ছদ্মবেশী! তোদের কাছাকাছি থাকার দরকার হয়ে, পড়েছিল, কারণ লোকটা ডেঞ্জারাস। যাই হাক–চিঠির টোপ উনি বেমালুম গিলে ফেললেন। এবং তার ফলে যে কী হল সেটা আপনারা সকলেই জানেন। এবার এইটুকুই বলতে বাকি যে, এই যে গ্যাংটা ধরা হল, এর কৃতিত্বের অংশীদার ভার্গব এজেন্সির মিস্টার মল্লিক যাতে উপযুক্ত স্বীকৃতি পান সেটা আমি নিশ্চয় দেখব, আর-মিস্টার ঘোটের যাতে পদোন্নতি হয় সেটাও একান্তভাবে কামনা করব। মিস্টার কুলকার্নির ভূমিকাও যে সামান্য নয়। সেটা কলাই বাহুল্য, আর সাহসের জন্য যদি মেডাল দিতে হয় তা হলে সেটা অবশ্যই পাবেন শ্ৰীমান তপেশ ও শ্ৰীযুক্ত লালমোহন গাঙ্গুলী। সকলের হাততালি শেষ হলে জটায়ু একটা কিন্তু কিন্তু ভাব করে বললেন, আমার বোমটা তা হলে আর কোনও কাজে লাগল না বলছেন? ফেলুদা চোখ গোল গোল করে বলল, সে কী মশাই-এত যে ধোঁয়া হল সেটা এল কোখোঁকে? ওটা তো আর এমনি এমনি বোমা নয়-একেবারে তিনশো ছাপ্পান্ন মেগাটন খাস মিলিটারি স্মোক-বম্ব। ‘কার্ডটা কীরকম হয়েছে দ্যাখ তো।’ ফেলুদা ওর মানিব্যাগের ভিতর থেকে সড়াৎ করে একটা ভিজিটিং কার্ড বার করে আমায় দেখতে দিল। দেখি তাতে ছাপার অক্ষরে লেখা রয়েছে . , । বুঝতে পারলাম ফেলুদা এবার তার গোয়েন্দা গোয়েন্দাগিরির ব্যাপারটা বেশ ফলাও করে জাহির করছে। আর তা করবে নাই বা কেন। বাদশাহি আংটির শয়তানকে ফেলুদা যে-ভাবে শায়েস্তা করেছিল, সে কথা ও ইচ্ছে করলে সকলকে বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াতে পারত। তার বদলে ও শুধু একটি ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়েছে এই তো! ফেলুদার নাম আপনা থেকেই বেশ রটে গিয়েছিল। আমি জানি ও এর মধ্যে দু তিনটে রহস্যের ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরির অফার পেয়েছে, কিন্তু কোনওটাই ওর মনের মতো হয়নি বলে না করে দিয়েছে। কার্ডটা ব্যাগের মধ্যে পুরে রেখে পা দুটো টেবিলের উপর তুলে লম্বা করে ছড়িয়ে দিয়ে ফেলুদা বলল, ‘বড়দিনের ছুটিতে কিছুটা মাথা খাটানোর প্রয়োজন হবে বলে মনে হচ্ছে।’ আমি বললাম, ‘নতুন কোনও রহস্য বুঝি?’ ফেলুদার কথাটা শুনে ভীষণ এক্‌সাইটেড লাগছিল—কিন্তু বাইরে সেটা একদম দেখালাম না। ফেলুদা তার প্যান্টের পাশের পকেট থেকে একটা ছোট্ট কৌটো বার করে তার থেকে খানিকটা মাদ্রাজি সুপুরি নিয়ে মুখে পুরে দিয়ে বলল, ‘তোর খুব উত্তেজিত
false
toslima_nasrin
দিতে গেলে পুলিশ তাকেও বেদম পেটায়। পুলিশ এরপর পুলিন, রবীন্দ্রনাথ আর বিকাশকে বেঁধে থানায় নিয়ে যায়, সেখানে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে হাজতে পাঠিয়ে দেয়। তাদের জামিন দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার কিছু আগে শোলাকুড়া গ্রামের আবদুল হাকিম মোল্লা লক্ষ্মণ চন্দ্রের ভাইয়ের মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল এবং বাড়ির অন্য সদস্যদের পিটিয়েছিল। এই অপরাধে দীর্ঘকাল জেলবাস হয় হাকিম মােল্লার। জেল থেকে ফিরে তালবুনিয়া গ্রামের সিরাজ মল্লিক, হারুণ মল্লিক ও আবদুল জব্বার কাজিকে নিয়ে প্রতিশোধ নেয় পুলিশ দিয়ে লক্ষ্মণচন্দ্রের পরিবারের সদস্যদের এ ধরনের শাস্তি দিয়ে। এই ঘটনার পর নিরাপত্তাহীনতায় এলাকার অনেক হিন্দুই দেশত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছে। গোপালগঞ্জ, কোটালিপাড়া, মকসুদপুর সহ পুরো গোপালগঞ্জ জেলায় হিন্দুদের বাড়িতে চুরি, ডাকাতি, লুট, জালিয়াতি, অবৈধভাবে বাড়ি দখল, মিথ্যা মামলা, নারী ধর্ষণ, মন্দির ভেঙে আগুন লাগিয়ে দেওয়া তো আছেই, সঙ্গে পুলিশি নিযাতনও আছে। কোটালিপাড়া উপজেলার চেয়ারম্যান মন্টু কাজির পোষা গুণ্ডাবাহিনী কুশলা ইউনিয়নের মান্দ্রা লাখিরপাড় গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে হামলা চালায়, হিন্দু মেয়েদের নিযতন করে, এরা মাদারবাড়ি, আদায়, দামি জিনিসপত্র লুট করে স্ট্যাম্পে সই নিচ্ছে। এখানকার অনেক হিন্দুই ভয়ে দেশ ত্যাগ করেছে। মাষ্ট্ৰ কাজি কোটালিপাড়া সোনালি ব্যাঙ্কের মিসেস ভৌমিককে ধরে এনে পাশবিক নিযাতন চালিয়েছে। কান্দি গ্রামের মমতা, মধু সহ অনেককে চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে উপজেলা কার্যালয়ে আটকে রেখে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। বাগেরহাটের চিতলমারি উপজেলার গরীবপুর গ্রামের অনিলচন্দ্রের বাড়িতে অষ্ট আশির তেসরা জুলাই গভীর রাতে পুলিশ ঢেকে। অনিলচন্দ্র বাড়িতে ছিলেন না, পুলিশ তাঁর বউ আর বাচ্চাকে বেদম পেটায়, ওই রাতে গ্রামের স্কুলমাস্টার অমূল্যবাবুর বাড়িতেও পুলিশ লুটপাট করে। চার তারিখে সুড়িগতি গ্রামের ক্ষিতীশ মণ্ডলের বাড়িতে হামলা চালায় পুলিশ। বাড়িতে কোনও পুরুষ না পেয়ে ক্ষিতীশ মণ্ডলের স্ত্রী কন্যার ওপর পাশবিক নিযাতন চালায়। পাঁচ তারিখে একই গ্রামের শ্যামল বিশ্বাসের বাড়িতে পুলিশি হামলা চলে। শ্যামলবাবুকে না পেয়ে পুলিশ তাঁর মেয়েকে ধর্ষণ করে, এবং ঘরের মূল্যবান জিনিস লুট করে নিয়ে যায়। এসব ঘটনার কয়েকদিন পর চিতলমারি গ্রামের নীরদ বিহারী রায়ের বাড়িতে এক সমাজবিরোধী লোক জোর করে বসবাস শুরু করে দিয়েছে। প্রশাসনকে জানিয়ে কোনও কাজ হয়নি। কালাশিরা গ্রামের একজন হিন্দুকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে ইউ পি সদস্য মনসুর মল্লিক। সেখানে জোর করে বসবাস শুরু করেছে। নিরাশ্রয় হিন্দু এখন পথে পথে ঘোরে। গোপালগঞ্জের শিক্ষা কর্মকতা জহুরসাহেব হিন্দু মহিলাদের চাকরির লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ করেছেন। ডেমাকৈর গ্রামের বিশ্বাস।বাড়ির দুজন মহিলা এভাবে ধর্ষিতা হয়েছে। এই লোক হিন্দু শিক্ষক-শিক্ষিকদের বদলির ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেন। গোপালগঞ্জের আলতি গ্রামের জগদীশ হালদারের বাড়িতে পুলিশ ও এলাকার সশস্ত্র যুবকেরা একযোগে হামলা চালায়। গোটা বাড়ি তছনছ করা হয়, পরিবারের সদস্যদের মারধোর করা হয় এবং লুটপাট চালানো হয়। ওরা যাবার সময় সবাইকে মেরে ফেলবার হুমকি দিয়ে যায়। ওই বছরের বারেই আগস্ট গ্রামের আরও কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে পুলিশসহ সশস্ত্র যুবকেরা হামলা চালায় এবং কয়েকটি মন্দির ভেঙে ফেলে। আশুতোষ রায়, সুকুমার রায়, মনোরঞ্জন রায়, অঞ্জলি রায়, সুনীতি রায়, বেলা বিশ্বাস তাদের হাতে নিগৃহীত হন। ওরা যাওয়ার সময় হুমকি দিয়ে যায় যে এ দেশে কোনও মন্দির থাকতে পারবে না। গোপালগঞ্জ জেলার মকসুদপুর উপজেলার উজানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খায়ের মোল্লার মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে মৌলবাদীরা ও পুলিশ এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার চালায়। পুলিশ বাসুদেবপুর গ্রামের শিবুর স্ত্রী ও মহাটলি গ্রামের কুমারী অঞ্জলি বিশ্বাসকে ধর্ষণ করে। শিমুলপুর গ্রাম থেকে বারোজনকে সর্বহারা দলের সমর্থক অভিযোগে গ্রেফতার করে প্রচণ্ড নিযাতন চালানো হয়। এরং বড় অঙ্কের টাকা দেবার পর এদের ছাড়া হয়। বিশে জুন তারিখে পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার বাস্তুকাঠি গ্রামে পুলিশ হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। বাস্তুকাঠি নদীর দুই তীরে পুলিশ হিন্দু সম্প্রদায়ের জমির ফসল। তছনছ করে দেয়। মাঠে যারা কাজ করছিল তাদের আটক করে এবং প্রচুর টাকার বিনিময়ে ছাড়ে। এই গ্রামেই এগারোই জুন উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সেবিকা মিনতি রানী তার বৌদি ও ভাইকে নিয়ে বান্ধবী ছবি রানীর সঙ্গে দেখা করতে আদমকাঠি যাওয়ার পথে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পে তাদের আটক করা হয় এবং নিযািতনের হুমকি দেওয়া হয়। পরে এক হাজার টাকা আদায় করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। স্বরূপকাঠির পূর্বজলা বাড়ি গ্রামে সুধাংশু কুমার হালদারের মেয়ে চৌদ্দ বছর বয়সের শিউলিকে মামার বাড়ি যাবার পথে রুস্তম আলি নামের এক লোক ধর্ষণ করে। রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে শিউলি। সুধাংশু হালদার স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে এ ঘটনার বিচার চাইলে তাকে বলা হয়, ‘এসব সহ্য করতে না পারলে দেশ ত্যাগ করতে হবে। ‘ উনআশি সাতই এপ্রিল তারিখে বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বুড়িগঞ্জ বাজারে ডাঃ শচীন্দ্ৰ কুমার সাহার বসতবাড়ির কাছে মসজিদ নিমণিকে কেন্দ্র করে মসজিদ কমিটির লোকেরা হামলা চালায়, তারা ডাঃ সাহার বাড়ির দরজা জানোলা ভেঙে ফেলে, লুটপাট করে এবং বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারা সংলগ্ন মন্দির ভেঙে ধূলিসাৎ করে দেয়। প্রায় দুঘণ্টা ধরে তাণ্ডবলীলা চালিয়ে এগারো লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। ঘটনার সময় ডাঃ সাহার ছেলে কোনও রকমে পালিয়ে গিয়ে থানায় খবর দিলে পুলিশ কর্মকতা পুলিশ ফোর্স নিয়ে গেলে আসামী আলতাফ হোসেন মণ্ডলের নেতৃত্বে অন্যান্য আসামীরা লাঠিসোটা, লোহার রড, ইট পাটকেল নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়, এতে ক’জন পুলিশ কর্মকতা আহতও হয়। পরে শিবগঞ্জ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা বাদী হয়ে আলতাফ হোসেন মণ্ডল সহ পয়ষট্টি জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন,
false
shomresh
যাচ্ছিল। কিছু লোক এই পথ ধরে হাঁটছে। এরা যাবে দিকেভঞ্জন। শীত বাড়ছে। এর আগের বার যাওয়ার সময় দিকেভঞ্জনে কয়েকটা ঘরবাড়ি সে দেখেছিল। ওই অবধি পোঁছাতেই রাত হয়ে যাবে। আর এখানে খোলা আকাশের তলায় রাত মানে নিশ্চিত মৃত্যু। দ্রুত পা চালাচ্ছিল কল্যাণ। সুকিয়াপোকরির খাওয়া আর গাড়িতে বসে পুরোটা পথ ঘুমিয়ে শরীর এখন অনেকটা তাজা। যদিও বুকে সর্দির ভাবটা বেশ জমাট। এটা জ্বালাবে। লামার বাড়ির সামনে দিয়ে সে কালিয়াপোকরি ছাড়িয়ে নির্জন পাহাড়ে নেমে পড়ল। অদ্ভুত আলো ছড়ানো পাহাড়ে, গাছেদের বুকে। পৃথিবীটা আচমকা অলৌকিক সুন্দরী হয়ে উঠেছে সেই আলো মেখে। কল্যাণের মন ভরে গেল সেদিকে তাকিয়ে। তার হাঁটার উৎসাহ বাড়ল। এবং সেই কারণেই সে গলা খুলে রবীন্দ্রনাথের একটা গান প্রায় নিজের সুরে গাইতে লাগল চেঁচিয়ে। আশেপাশে যারা হাঁটছে তারা খুশির চোখে তাকাল। যে মানুষ গান গায় তার সম্পর্কে লোকে চট করে খারাপ ধারণা করতে চায় না। ঠিক ঘণ্টাখানেক চলার পর নিচ থেকে চিৎকারটা ভেসে এল। এখন আলো প্রায় নিবে এসেছে। দিকেভঞ্জন চোখের সামনে। ঘন কুয়াশা পাক খাচ্ছে পথের ওপর। চিৎকার শুনে পিছন ফিরল কল্যাণ। গোটা ছয়েক লোককে কয়েকশ ফুট নিচুতে দেখা যাচ্ছে। তারা চেষ্টা করছে যতটা সম্ভব দ্রুত ওপরে আসতে। এবং চকিতে এতদূরে দাঁড়িয়েও কল্যাণের নজরে এল মানুষগুলোর পরনে খাকি পোশাক এবং হাতে বন্দুক। ওরা অত নিচে থেকেও নিশ্চয়ই তাকে দেখতে পেয়েছে নইলে চিৎকার করে থামতে বলত না। কল্যাণ এবার মরীয়া হল। সঙ্গীরা দেখল গান বন্ধ করে সে ঝোলা নিয়ে দ্রুত পা চালাচ্ছে। এখনও ওরা অনেকটা নিচে আছে। পাহাড়ি পথ ঘুবে আসতে যে সময় লাগবে তাতে সে দূরত্ব বাড়াবাব সুযোগ পাবে। কিন্তু সে যখন কুয়াশার জঙ্গলে পড়ে গেল তখন অন্ধ। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কোনটা পথ কোনটা নয় তা ঠাওর করা অসম্ভব। শীত এখন হাড়ে, কাঁপুনিটা দুটো কারণেই হতে পাবে। দিকেভঞ্জনে পৌঁছে মনে হল কলজেটা বুক থেকে বেরিয়ে আসবে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বোঝাঁটা সঙ্গে না থাকলে আরও দ্রুত যাওয়া যেত। কিন্তু এখন এটাই তার সম্মান। কল্যাণ পিছনদিকে তাকাল। এখন অন্ধকার মাটিতে এবং সেই সঙ্গে চাপ কুয়াশা। যাবা আসছে তাবাও তাকে চট করে খুঁজে পাবে না। কিন্তু দিকেভঞ্জনে থাকা চলবে না। সামান্য ওই কটা ঘরবাড়ি, যেই তাকে আশ্রয় দিক ওদের পক্ষে খুঁজে বের করতে অসুবিধে হবে না। টলতে টলতে কল্যাণ আবার হাঁটতে লাগল। কুয়াশা কিংবা অন্ধকারে তার কোন খেয়াল নেই। পায়ের তলার পথ এঁকেবেঁকে উঠে গেছে। হাঁটলে শরীরে উত্তাপ বাড়ে। কিন্তু পথ এবার এমন খাড়াই যে তাকে বারংবার দম নিতে হচ্ছিল। এখন আর চিৎকার শোনা যাচ্ছে না। ক্রমশ সে অনেকটা ওপরে উঠে এল। আর তখনই সর্বাঙ্গে একটা তৈলাক্ত অনুভূতি। চোখের সামনে সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছিল। একটা পাথরের গায়ে ধপ করে বসে পড়ল সে ঝোলাটাকে পাশে রেখে। পা থেকে কোমর পর্যন্ত এখন তীব্র যন্ত্রণা। কল্যাণ চোখ বন্ধ করল। কতক্ষণ এইভাবে পড়েছিল সে জানে না। হঠাৎ স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সে উঠে বসল। আর তখনই অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। দৃষ্টি এখনও তার পরিষ্কার নয়। কিন্তু মনে হল আশেপাশে কোথাও কুয়াশা নেই। সমস্ত আকাশটা চকমকে জ্যোৎস্নায় নিকানো। আর তারই উপচানো আলোয় পাহাড় বনানী মাখামাখি। দেখতে দেখতে বুকের ভেতর একটা আনন্দ জন্ম নিল যা তার হৃৎপিণ্ডের গায়ে নরম আদব ছড়িয়ে দিল। এবং তখনই নিচে চিৎকারটা শুনতে পেল সে। অর্থাৎ অনুসরণকারীরা হাল ছাড়েনি। যে সময়টা কল্যাণ পেল সেটা দিকেভঞ্জনের বাড়ি-বাড়িতে তল্লাশ চালানোর জন্যেই। কল্যাণ উঠল। না, সে ধরা দেবে না। ওষুধগুলো তাকে পৌঁছে দিতেই হবে। শরীর টলছে কিন্তু সে এগোল। মুশকিল হল পথটা যেন আকাশে উঠে গেছে। আর একটু এগোলে সোজা চাদের ঘরে পৌঁছানো যাবে। একটা পা ফেলার পর এখন অন্য পা-কে টেনে আনতে হচ্ছে এগোতে। চিৎকারটা শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু তার মানে এই নয় অনুসরণকারীরা ফিরে গিয়েছে। কল্যাণ পিছন ফিরে তাকাল। এই ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় যে কেউ দূর থেকে মানুষ চিহ্নিত করতে পারবে। কুয়াশারা এখন নিচে নেমে গিয়েছে। তার সামনে আর আড়াল বালে কিছু নেই। যেটুকু সামর্থ্য ছিল তা উজাড় করে কল্যাণ যখন অপেক্ষাকৃত সমতলে উঠে এল তখন ওর অপুষ্ট শরীর আর তার রোগা হাড়গুলো কাঁপছে। এবং সেই সময় সে লোকগুলোকে দেখতে পেল। শিকার দেখতে পেয়ে ওরা এবার হইচই করতে করতে এগোচ্ছে। সামনের খোলা মাঠ জ্যোৎস্নায় ভাসছে। দূরে কয়েকটা বাড়ি। ওঃ, কল্যাণ চিনতে পারল, এই হল সান্দাকফু। আর তারপরেই তার মনে পড়ল। তাপল্যাঙ থেকে যে ছেলেটা তার সঙ্গী হয়েছিল সে অপেক্ষা করে আছে একটু এগোলেই। ওর কাছে পৌঁছে গেলে নিশ্চয়ই একটা বিহিত হবে। আর কিছু না হোক এই ওষুধগুলো ওর হাতে তুলে দেওয়া যাবে। ভাবনটা মাথায় আসামাত্র শরীরে উদ্যম ফিরে এল। মুহূর্তে সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে গেল সে। ঘোড়ার নালের মত রাস্তার শেষে পৌঁছানো মাত্র সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল লোকগুলো এবার ওপরে উঠে এসেছে। দূরত্ব এখন কয়েক মিনিটের। সমস্ত সান্দাকফু আজ নিশূপ। কোনরকমে ওপরে রাস্তায় উঠে আসামাত্র গুলির আওয়াজ হল। থমকে দাঁড়াল এক মুহূর্তের জন্যে কল্যাণ। এবং তারপরেই শরীরে অলৌকিক শক্তি ভর করল। পিছনের মানুষগুলো হিন্দীতে চিৎকার করছে, যদি সে পালাবার চেষ্টা করে তাহলে গুলি শরীরে বিধবে। কিন্তু সেসব কথা ওর কানে যাচ্ছিল না। নিচে পড়ে রইল সান্দাকফু। এখন সে ফালুটের
false
shorotchandra
এ ক্ষেত্রেও তিনিই কথা কহিলেন, বলিলেন, হুজুরের পাছে নিদ্রার ব্যাঘাত হয়, তাই একটু বিলম্ব করেই আমরা সকলে— জীবানন্দ খাতাপত্র এক পাশে ঠেলিয়া রাখিয়া সহাস্যে কহিলেন, বিলম্ব না করে এলেও হুজুরের নিদ্রার ব্যাঘাত হতো না শিরোমণিমশায়, কারণ দিনের বেলা তিনি নিদ্রা দেন না। কিন্তু আমরা যে শুনি হুজুর— শোনেন? তা আপনারা অনেক কথা শোনেন যা সত্য নয়, এবং অনেক কথা বলেন যা মিথ্যে। এই যেমন আমার সম্বন্ধে ভৈরবীর কথাটা—, বলিয়া বক্তা হাস্য করিলেন, কিন্তু শ্রোতার দল থতমত খাইয়া একেবারে মুষড়িয়া গেল। জীবানন্দ কহিলেন, কিন্তু যেজন্যে ত্বরা করে আসতে চেয়েছিলেন তার হেতুটা শুনি? জনার্দন রায় নিজেকে কথঞ্চিৎ সামলাইয়া লইলেন, মনে মনে কহিলেন, এত ভয়ই বা কিসের? প্রকাশ্যে বলিলেন, মন্দির-সংক্রান্ত গোলযোগ যে এত সহজে নিষ্পত্তি করতে পারা যাবে তা আশা ছিল না। নির্মল যে-রকম বেঁকে দাঁড়িয়েছিল— জীবানন্দ কহিলেন, তিনি সোজা হলেন কি করে? এই ব্যঙ্গ জনার্দন অনুভব করিলেন, কিন্তু শিরোমণি তাহার ধার দিয়াও গেলেন না, খুশী হইয়া সদর্পে কহিলেন, সমস্তই মায়ের ইচ্ছা হুজুর, সোজা যে হতেই হবে। পাপের ভার তিনি আর সইতে পারছিলেন না।। জীবানন্দ ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, তাই হবে। তার পরে? শিরোমণি বলিলেন, কিন্তু পাপ ত দূর হলো, এখন—বল না জনার্দন, হুজুরকে সমস্ত বুঝিয়ে বল না? এই বলিয়া তিনি রায়মশায়কে হাত দিয়া ঠেলিলেন। জনার্দন চকিত হইয়া কহিলেন, মন্দিরের চাবি ত আমরা দাঁড়িয়ে থেকেই তারাদাস ঠাকুরকে দিইয়েছি। আজ তিনিই সকালে মায়ের দোর খুলেচেন, কিন্তু সিন্দুকের চাবিটা শুনতে পেলাম ষোড়শী হুজুরের হাতে সমর্পণ করেচে। জীবানন্দ সায় দিয়া কহিলেন, তা করেচে। জমাখরচের খাতাও একখানা দিয়েচে। শিরোমণি বলিলেন, বেটী এখনও আছে, কিন্তু কখন যে কোথায় চলে যায় সে ত বলা যায় না। জীবানন্দ মুহূর্তকাল বৃদ্ধের মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু সেজন্যে আপনাদের এত উদ্বেগ কেন? উত্তরের জন্য তিনি জনার্দনের প্রতি চাহিলেন। জনার্দন সাহস পাইয়া কহিলেন, দলিলপত্র, মূল্যবান তৈজসাদি, দেবীর অলঙ্কার প্রভৃতি যা-কিছু আছে গ্রামের প্রাচীন ব্যক্তিরা সমস্তই জানেন। শিরোমণিমশায় বলছেন যে, ষোড়শী থাকতে থাকতেই সেগুলো সব মিলিয়ে দেখলে ভাল হয়। হয়ত— হয়ত নেই? এই না? কিন্তু না থাকলেই বা আপনারা আদায় করবেন কি করে? জনার্দন সহসা জবাব খুঁজিয়া পাইলেন না, শেষে বলিলেন, তবু ত জানা যাবে হুজুর! কিন্তু আজ আমার সময় নাই রায়মশাই। জনার্দন মনে মনে উল্লসিত হইয়া উঠিলেন, প্রায় এইপ্রকার ফন্দি করিয়াই তাঁহারা আসিয়াছিলেন! শিরোমণি ব্যগ্র হইয়া কহিলেন, চাবিটা জনার্দন ভায়ার হাতে দিলে আজই সন্ধ্যার পূর্বে আমরা সমস্ত মিলিয়ে দেখতে পারি। হুজুরেরও আর কোন দায়িত্ব থাকে না—কি আছে না আছে সে পালাবার আগেই সব জানা যায়। কি বল ভায়া? কি বল হে তোমরা? ঠিক না? সকলেই এ প্রস্তাবে সম্মতি দিল, দিল না কেবল যাহার হাতে চাবি। সে শুধু একটু ঈষৎ হাসিয়া কহিল, ব্যস্ত কি শিরোমণিমশায়, যদি কিছু নষ্ট হয়েই থাকে ত, ভিখিরীর কাছে থেকে আর আদায় হবে না। আপনারা আজ আসুন, আমার যেদিন অবসর হবে, মিলিয়ে দেখতে আপনাদের সকলকেই আমি সংবাদ দেব। ফন্দি খাটিল না দেখিয়া সবাই মনে মনে রাগ করিল। রায়মহাশয় উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, কিন্তু দায়িত্ব একটা— জীবানন্দ তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া কহিলেন, সে ত ঠিক কথা রায়মশায়। দায়িত্ব একটা আমার রইল বৈ কি। দ্বারের বাহির হইয়াই শিরোমণি জনার্দনের গা টিপিয়া কহিলেন, দেখলে ভায়া, ব্যাটা মাতালের ভাব বোঝাই ভার। গুয়োটা কথা কয় যেন হেঁয়ালি। মদে চুর হয়ে আছে। বাঁচবে না বেশী দিন। জনার্দন শুধু বলিলেন, হুঁ। যা ভয় করা গেল, তাই হ’লো দেখছি। শিরোমণি কহিলেন, এবার গেল সব শুঁড়ির দোকানে। বেটী যাবার সময় আচ্ছা জব্দ করে গেল। একজন কহিল, হুজুর চাবি আর দিচ্চেন না। শিরোমণি উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, আবার! এবার চাইতে গেলে গলা টিপে মদ খাইয়ে দিয়ে তবে ছাড়বে। কথাটা উচ্চারণ করিয়াই তাঁহার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। ঘরের মধ্যে জীবানন্দ খোলা দ্বারের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া স্থির হইয়া বসিয়া ছিল; প্রফুল্ল কহিল, দাদা, আবার একটা নূতন হাঙ্গামা জড়ালেন কেন, চাবিটা ওঁদের দিয়ে দিলেই ত হতো! জীবানন্দ তাহার মুখের প্রতি চক্ষু ফিরাইয়া কহিল, হতো না প্রফুল্ল, হলে দিতাম। পাছে এই দুর্ঘটনা ঘটে বলেই সে কাল রাতে আমার হাতে চাবি দিয়েছে। প্রফুল্ল মনে মনে বোধ হয় ঠিক বিশ্বাস করিতে পারিল না, জিজ্ঞাসা করিল, সিন্দুকে আছে কি? জীবানন্দ একটু হাসিয়া কহিল, কি আছে? আজ সকালে তাই আমি খাতাখানা পড়ে দেখছিলাম। আছে মোহর, টাকা, হীরে, পান্না, মুক্তোর মালা, মুকুট, নানারকম জড়োয়া গয়না, কত কি দলিলপত্র, তা ছাড়া সোনারূপোর বাসন-কোসনও কম নয়। কতকাল ধরে জমা হয়ে এই ছোট্ট চণ্ডীগড়ের ঠাকুরের যে এত সম্পত্তি সঞ্চিত আছে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। চুরি-ডাকাতির ভয়ে ভৈরবীরা বোধ করি কাউকে জানতেও দিত না। প্রফুল্ল সভয়ে কহিল, বলেন কি! তার চাবি আপনার কাছে? একমাত্র পুত্র সমর্পণ ডাইনীর হাতে? জীবানন্দ রাগ করিল না, কহিল, নিতান্ত মিথ্যা বলনি ভায়া, এত টাকা দিয়ে আমি নিজেকেও বিশ্বাস করতে পারতাম না। ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, অথচ, এ আমি চাইনি প্রফুল্ল। আমি যতই তাকে পীড়াপীড়ি করলাম জনার্দন রায়কে দিতে, ততই সে অস্বীকার করে আমার হাতে গুঁজে দিলে। প্রফুল্ল নিজেও ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এর কারণ? জীবানন্দ কহিল, বোধ হয় সে ভেবেছিল, এ দুর্নামের ওপর আবার চুরির কলঙ্ক চাপলে তার আর সইবে
false
humayun_ahmed
বল? ঐ মেয়েটা কী কান্ডকারখানা করে বেড়াচ্ছে তা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। নিশ্চয়ই। আমি এক্ষুণি যোগাযোগ করে দিচ্ছি। মাথুরের চিন্তাশক্তি প্ৰায় লোপ পেয়েছে। লীর নিয়ে আসা বইটির শেষ অংশ নেই, এতেই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। এদিকে ফিহার কোনো খোঁজ নেই। সিরান-পল্লীর বিজ্ঞানীরা তাঁকে বয়কট করেছেন। কাজকর্ম চালাচ্ছে স্রুরা। স্রুরা সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে, মাথুরের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সমস্তই মাথুরের কানে আসে। মহাকাশ প্রযুক্তি-বিদ্যা গবেষণাগারের তিনি মহাপরিচালক, অথচ তাঁর হাতে কিছুমাত্র ক্ষমতাও নেই। মাথুর সময় কাটান শুয়ে শুয়ে। নিজের ঘর ছেড়ে বাইরে যাবার কথা মনেও হয় না। তাঁর। দশ থেকে পনেরটি খবরের কাগজ খুঁটিয়ে খুটিয়ে পড়েন। কাজ বলতে এই। রাতের বেলা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ঘুমুতে যান। ঘুম হয় না, বিছানায় ছটফট করেন। সেদিনও খবরের কাগজ দেখছিলেন। সরকারী নির্দেশ থাকার জন্যেই কোথাও মহাবিপদের কোনো উল্লেখমাত্র নেই, অথচ সমস্ত খবরের মূল কথাটি হচ্ছে, বিপদ এগিয়ে আসছে পায়ে-পায়ে। পাতায় পাতায় লেখা, শহরে আইনশৃঙ্খলা নেই, খাদ্য সরবরাহ বিঘ্নিত, যানবাহন চলাচল বন্ধ, কল-কারখানার কমীরা কাজ ছেড়ে বিনা নোটিশে বাড়ি চলে যাচ্ছে। ছয় জন তরুণী আতঙ্ক সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে বসেছে। পড়তে পড়তে মাথুরের মনে হল তিনি নিজেও কি আত্মহত্যা করে বসবেন কোনো দিন? ট্রিইই, ট্রিইই। যোগাযোগের স্বচ্ছ পদা নীলাভ হয়ে উঠল। মাথুর চমকে তাকালেন সেদিকে। এ সময়ে তাঁর সঙ্গে কে কথা বলতে চায়? মাথুর, আমি ফিহা বলছি। কেমন আছ তোমরা? মাথুর উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠলেন। পাওয়া গেছে, ফিহাকে পাওয়া গেছে। মাথুর, লী বলে সেই পাগলা মেয়েটি এসেছিল? জ্বি এসেছিল। সে কি এখনো আছে তোমার কাছে? না, সে চলে গেছে। ফিহা, আপনার সঙ্গে আমার খুব জরুরী কথা ছিল। কী কথা? আমি এখন একটু ব্যস্ত। শত ব্যস্ত থাকলেও আপনাকে শুনতে হবে। আপনি কি ইদানীং কোনো আজগুবি ব্যাপার দেখেছেন, কেউ এসে কি আপনাকে ভয়টয় দেখাচ্ছে? ফিহা একটু অবাক হলেন। থেমে থেমে বললেন, তুমি জানলে কী করে! নিকি কি এর মধ্যেই তোমাকেও এসব জানিয়ে বসে আছে? না না, নিকি নয়। একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে। আপনাকে সব বোঝান যাবে না। তা ছাড়া সময়ও খুব কম। বেশ, তাহলে জরুরী কথাটাই সেরে ফেল। আপনি ত্রিমাত্রিক সময় সমীকরণের সমাধান করেছিলেন? করেছিলাম, তা তো তোমার মনে থাকা উচিত। মনে আছে ফিহা। কিন্তু আপনার সমীকরণের দুটি সমাধান ছিল। দুটি নয় একটি। অন্যটিতে ইমাজিনরি টার্ম ব্যবহার করা হয়েছিল, কাজেই সেটি বাদ দিতে হবে। কারণ এখানে সমাধানটির উত্তর ও ইমাজিানারি টার্মে এসেছিল। ফিহা, আমাদের দ্বিতীয় সমাধানটি দরকার? কেন? দ্বিতীয় সমাধানটি সঠিক সমাধান। মাথুর, একটা কথা বলছি, রাগ করো না। বলুন। তোমার মাথায় দোষ হয়েছে। বুঝতে পারছি, এই পরিস্থিতিতে মাথা ঠিক রাখা খুব মুশকিল। আমার মাথা খুব ঠিক আছে। আমি আপনার পায়ে পড়ি, আমার কথা শুনুন। বেশ বেশ বল। দ্বিতীয় সমাধানটি যদি আমরা সঠিক বলে ধরে নিই, তাহলে আমরা নিজেরাই একটি চত্বমাত্রিক জগৎ তৈরি করতে পারি। হ্যাঁ, তা করা যেতে পারে। কিন্তু সমাধানটি তো ভুল। সমাধানটি ভুল নয়। আমার কাছে তার প্রমাণ আছে। আচ্ছা ফিহা, ধরুন। এক দল বিজ্ঞানী একটি নির্দিষ্ট পথের সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্রকে চতুমাত্রায় পরিবর্তিত করছেন, এখন তাঁদের আমরা আটকাতে পারি, যদি সেই পথে আগেই আমরা একটি চতুর্মাত্রিক জগৎ তৈরি করে রাখি। মাথুর, তোমার কথায় আমি যেন কিসের ইঙ্গিত পাচ্ছি। মাথুরা, এসব কী বলছ? আমি ঠিক কথাই বলছি ফিহ। আপনি কি সমাধানটি নিজে এখন একটু পরীক্ষা করবেন? ফিহা উত্তেজিত হয়ে বললেন, আমি করছি, আমি এক্ষুণি করছি। আর তুমি নিজেও করে দেখ, স্রুরাকে বল করে দেখতে। সমাধানটি লিখে নাও। ফিহা একটির পর একটি সংখ্যা বলে যেতে লাগলেন। মাথুর এক মনে লিখে চললেন। দু জনের চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করছে। সন্ধ্যা হয় নি তখনো, শেষ বিকেলের লালচে আলো গাছের পাতায় চিকচিব করছে। ফিহা বারান্দায় চেয়ার পেতে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বিকাল হলেই তাঁর মনে এক ধরনের বিষণ্ণ অনুভূতি হয়। নিকি চায়ের পেয়ালা হাতে বাইরে এসে দেখে, ফিহা ভু কুচকে দূরের গাছপালার দিকে তাকিয়ে আছেন। বাতাসে তাঁর রূপালি চুল তিরতির করে উড়ছে। নিকি কোমল কণ্ঠে ডাকল, ফিহা। ফিহা চমকে উঠে ফিরে তাকালেন। নিচু গলায় প্রায় ফিসফিস করে বললেন, নিকি! আমার মনে হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা অর্থহীন। নিকি কিছু বলল না, চায়ের পেয়ালা নামিয়ে রেখে পাশেই দাঁড়িয়ে রইল। ফিহা বললেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান তো মানুষের জন্যে, আর একটি মানুষ কতদিন বাঁচে? তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে তার সব সম্পর্কের ইতি। ঠিক নয় কি? নিকি শক্ত মুখে বলল, না ঠিক নয়। ফিহা চুপ করে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। একটু অস্বস্তির সাথে নিকি বলল, দেখুন ফিহা, আপনার সাথে তর্ক করা আমার সাজে না। কিন্তু নবম গণিত সম্মেলনে আপনি একটা ভাষণ দিয়েছিলেন–। কী বলেছিলাম। আমার মনে নেই। বলেছিলেন, মানব জাতি জন্মমুহূর্তেই একটা অত্যন্ত জটিল অঙ্ক কষতে শুরু করছে। এক-এক যুগে এক-এক দল মানুষ এসেছে, আর সে জটিল অঙ্কের এক একটি ধাপ কষা হয়েছে। অজানা নতুন নতুন জ্ঞান মানুষের ধারণায় এসেছে। বেশ। আপনি বলেছিলেন, একদিন সে অঙ্কটির সমাধান বের হবে। তখন সব রহস্যই এসে যাবে মানুষের আওতায়। বের হয়ে আসবে মূল রহস্য কী। মানুষের ছুটি হচ্ছে সেই দিন। ফিহা বললেন, এইসব বড় বড় কথা অর্থহীন নিকি। নিকি কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে এলোমেলোভাবে বসে
false
shomresh
মুখে কোন কথা নেই। শেষ পর্যন্ত অলোকই বলল, তুমি এখনও মনে রেখেছ? মনে রাখিনি, এগুলো জন্মটিকার মত, মন থেকে ওঠে না। কিন্তু তার জন্যে নয়, আমি ওসব মন্ত্রে বিশ্বাস করি না। ইউজলেস। বিয়ের পিঁড়িতে বসে যে শব্দগুলো মানুষ বলে তা অন্যের শেখানো। পাখির বুলি আওড়ানোর মত। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে জীবন অন্য কথা বলে কিছুদিনের মধ্যেই। হ্যাঁ, খেলা হিসেবে পাঁচজনকে দেখিয়ে ওইভাবে বিয়ে করার মধ্যে যে মজা আছে তা অন্তত আমার ক্ষেত্রে নেই কারণ ওই ব্যবস্থাটাকে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। তুমি বা তোমার মায়ের যদি এর বিকল্প ব্যবস্থায় তৃপ্তি না হয় তাহলে অলোক, তুমি যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পার। হঠাৎ টেবিলে রাখা দীপাবলীর হাতের ওপর নিজের হাত রাখল অলোক, তুমি অনর্থক উত্তেজিত হচ্ছ! বিকল্পে আমাদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু দিনটা কবে ঠিক করছ? এখন নয়। নাগপুর থেকে বেরিয়ে। এখনও দেড় বছর? আমি ঝাড়া হাত পা হতে চাই। অগত্যা মানতে হচ্ছে। আরও কিছু কথা ছিল। শুনব, আর এক কাপ চা বা কফি বলবে? আমি খাব না। তুমি খেতে পার। না থাক। চল। স্ত্রী হিসেবে আমার কাছে তুমি ঠিক ঠিক কি চাও? অলোক চোখ বন্ধ করল, নাথিং। ভেবে পাচ্ছি না। আমি কতগুলো ব্যাপারে সারেণ্ডার করছি। বারো বছর থেকে যে ওলট-পালট হয়েছিল তারপরে আর পাঁচটা মেয়ের মত স্বাভাবিক ভাবে আমি বড় হইনি। কলেজ থেকে তো হোস্টেলে হোস্টেলে অথবা ঘর ভাড়া করে আছি। রান্নাবান্না শেখার সুযোগই পাইনি। তাছাড়া চা বাগানের বাড়িতেও খুব সাদামাটা রান্না হত। তোমাদের বাড়ির খাবার আমি খেয়েছি। আমার রান্না খেতে তাই তোমার খুব অসুবিধে হবে। দীপাবলী সোজাসুজি বলে ফেলল। এটা কোন প্রব্লেম নয়। তুমি জানোনা। মানুষ খাওয়ার সময় নিজের তৃপ্তি খোঁজে। বাব্বা। আমি বলছি রান্না কোন প্রব্লেম নয়। দুজনে রোজগার করব অতএব, রান্নার লোক রেখে দিলে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। দ্বিতীয় পয়েন্ট হল, আমি চাকরি করব, আমার স্বাধীনতা কতখানি? যতখানি চাও। আমরা এমন কিছু করব না যাতে কেউ অসম্মানিত হতে পারি। আমরা কেউ পরাধীন নই যে স্বাধীনতার প্রশ্ন উঠবে। আর আমার কিছু বলার নেই। আমার আছে। চট করে বলে ফেলল অলোক। বলে ফ্যালো। যখন তোমার মনে কোন প্রশ্ন জমবে তুমি আমাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করবে। এনিথিং, মনে মনে সেটাকে পাকাবে না। চেষ্টা করব। মদের ব্যাপারে তোমার কোন অ্যালার্জি আছে? মানে? আঁতকে উঠল দীপাবলী, আমি কি মদ খাই যে অ্যালার্জি হবে কিনা বুঝতে পারব? আহা, তা বলছি না। আমি মদ খেলে তুমি সহ্য করবে? তুমি মদ খাও? খুব কম। কখনও কোন পার্টিতে গেলে এক আধ পেগ। অ্যাভয়েড করা যায় না? একটু রুঢ় হতে হয়। অলোক হাসল, বুঝতে পেরেছি। দীপাবলী মাথা নাড়ল, না। যেমন আছ তেমনই থাকো। কিন্তু কথা দিতে হবে কখনও মাতাল হবে না। মাতালদের আমি ঘেন্না করি। তথাস্তু। আমি তোমার কাছে ঘেন্না পেতে চাই না। দীপাবলী হাসল, আচ্ছা আমরা কেমন অফিসিয়াল কথা বলছি, না? জানি না অন্য কেউ এরকম বলে কিনা। তবে বলে নিয়ে কোন ক্ষতি করিনি আমরা। পরে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে আগে বলে নেওয়া ঢের ভাল। চল, এখান থেকে বের হই। একটু হাঁটি। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। পড়ুক, এই বৃষ্টি গায়ে লাগবে না। বাইরে বের হওয়া মাত্র মনে হল ঠাণ্ডার দাঁত আরও ধারালো। শালটাকে মাথার ওপর তুলে দিল দীপাবলী। কুচি কুচি বৃষ্টি পড়ছে। মাঝেমাঝে হওয়া এসে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের। হাঁটতে ভাল লাগছিল। দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, কোন হোটেলে উঠেছ? এবার স্নো পিকে। খুব সুন্দর ঘর। কাল চলে যাবে? হ্যাঁ। দীপাবলীর খুব খারাপ লাগল। এই এক রাত্রের জন্যে আসা কেন? কেন অলোক বলতে পারে না সাতদিন থাকব। তাহলে প্রত্যেকটা দিন নতুন বলে মনে হত। সে বলে ফলল, তুমি খুব কৃপণ। দিতে পারে না। বদনাম দিচ্ছ কেন? এইভাবে একরাত্রে জন্যে কেন এলে? অলোক থতমত হয়ে তাকাল। শালের প্রান্তে কপালের ওপর যে চুলগুলো বেরিয়ে ছিল। তাতে জলের কণা মুক্তোর মত ঝুলছে। মুখ ভেজা। সে গাঢ় গলায় বলল, আই অ্যাম সরি। এর পরের বার কয়েকদিন থাকার পরিকল্পনা নিয়ে আসব। আমি বুঝতে পারিনি। থাক। তোমাকে কিছু করতে হবে না। জোর করে আদায় করে কিছু সুখ হয় না। আমি বলছি বলে তুমি আসবে, নিজে থেকে যখন আসতে পারেনি তখন বেশীদিন থাকার জন্যে আসতে হবে না। আমি ক্ষমা চাইছি তো! ভেতর থেকে যেটা আসবে সেটাই করবে। আমি বলছি বলে কিছু করতে হবে না। দীপাবলীর গলায় অভিমানের সুর এবার স্পষ্ট। বেশ, করব না। শোনামাত্র খুব রাগ হয়ে গেল। আশ্চর্য! তার কথা শুনে যেন বেঁচে গেল অলোক। বেশীদিন কাজ ছেড়ে থাকতে হবে না আর। কিন্তু খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিল সে। কি ছেলেমানুষের মত ঝগড়া করছে সে। সে যা বলছে অলোক তাতেই সায় দিচ্ছে। সে কেন। চাইছে অলোক তার মনের কথা বুঝে নিক, মুখের কথার মানে না ধরুক। এগুলোর জন্যে। সময় দরকার হয়। দুজনকে ভালমত জানার জন্যে সময়। সেটা তো এখনও হয়নি। খানিকটা যাওয়ার পর, আলো যখন বেশ কমে এসেছে, অলোক বলল, চল, আমার হোটলে গিয়ে একটু বসবে। এর আগের বার দীপাবলী অলোকের হোটেলে গিয়েছিল। নির্জন একটি ঘরে অলোক তার সঙ্গে আধঘণ্টা গল্প করেছিল তখন প্রতিটি মুহূর্তে একধরনের উত্তেজনা
false
shunil_gongopaddhay
দেখেনি। বাংলায় ধনী ব্যবসায়ী ও জমিদার তো কম নেই, কিন্তু আর কেউ এত বৃহৎ দেবালয়ের প্রতিষ্ঠাও করেননি, এ রকম বিপুল উৎসবের আয়োজনও কেউ করতে পারেননি শুধু অর্থ থাকলেই হয় না, সেই অর্থব্যয় করার মতন অন্তঃকরণও থাকা দরকার। সময়ে, যখন হিন্দুধর্ম নানাদিক থেকে বহু রকম আক্রমণে পর্যুদস্ত। অনেক হিন্দু শাস্ত্র এবং সংস্কৃত গ্ৰন্থ অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল প্রায়, ইংরেজ পণ্ডিতগণই তা উদ্ধার করেন। আবার এক শ্রেণীর ইংরেজ সেই সব শাস্ত্র ঘেঁটেই প্রমাণ করতে চান যে, হিন্দু ধর্মের মধ্যে কত রকম বর্বর প্রথা ও বিশ্বাস রয়েছে। খৃষ্টান মিশনারিরা হিন্দু ধর্মের অকাট্য সব দোষ তুলে ধরেছেন ভারতবাসীর সামনে এবং সেই সুবাদে তাদের আকৃষ্ট করছেন খৃষ্টধর্ম গ্ৰহণ করতে। অন্যদিকে ব্ৰাহ্মরাও হিন্দু ধর্মের নানান ত্রুটির কথা প্রচার করছেন, দেব-দেবীরা তাঁদের চক্ষে পুতুল মাত্র, এবং এই পুতুল পূজা তাঁদের কাছে দু-চক্ষের বিষ। শুধু কি তাই, সম্প্রতি তাঁরা এমনও ঘোষণা করেছেন যে, বেদ অপৌরুষেয় নয় এবং বেদ বাক্য মাত্রই অভ্রান্ত নয়। হিন্দু ধর্মের পরম পবিত্র গ্রন্থের প্রতি এই আঘাত হেনে ব্ৰাহ্মরা আরও দূরে সরে গেলেন। শিক্ষিত ব্যক্তিরা প্রায় সকলেই হিন্দু ধর্মের কুসংস্কার এবং অনৈতিক প্রথাগুলি সম্পর্কে ঘৃণা বোধ করেন। এই কি সেই মহান ধর্ম যা স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারার বিপ্নান দেয়। এই ধর্মে পুরুষের বহুবিবাহ প্রশস্ত। কিন্তু নারী যদি ছ-সাত বছরেও বিধবা হয়, তাহলেও তাকে সারা জীবন বঞ্চিত, অসহ দিনাতিপাত করতে হবে। এই সেই ধর্ম যেখানে একজন মানুষ বিদ্যায় বুদ্ধিতে অন্যের চেয়ে উচ্চ হলেও শুধু সে জন্ম কারণে শূদ্র বলেই ব্ৰাহ্মণ ইত্যাদি জাতির সঙ্গে একাসনে বসতে পারবে না! এই সেই ধর্ম, যে ধর্মের মানুষ মুসলমান চাষীর শ্রমে ফলানো ধান অন্নান বদনে আহার করবে: কিন্তু মুসলমানের হাতে ছোঁয়া জল পান করবে না। অনেক মুক্তমনা হিন্দু, যাঁদের মনের মধ্যে ধর্মের জন্য আকৃতি আছে, কিন্তু বিজাতীয় খৃষ্ট ধর্মও গ্রহণ করতে চান না, ব্ৰাহ্মদের সম্পর্কেও পুরোপুরি আস্থা নেই, তাঁরাও নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেন এই ধর্মের নানা দোষের কারণে। এই রকম সময়ই কালীপদ অভিলাষী রাসমণি দাসী পৌত্তলিক হিন্দু ধর্মেই নতুন প্ৰাণ সঞ্চারের জন্য দক্ষিণেশ্বরে শুরু করলেন এই মহাযজ্ঞ। জ্যৈষ্ঠ পৌর্ণমাসী তিথিযোগে জগন্নাথের স্নানযাত্রার দিনটি শুভযোগ, সেইদিন হলো প্রতিষ্ঠা-উৎসব। বরাহনগর থেকে নাটমন্দির পর্যন্ত পথের দু-পাশে টানানো হলো ঝাড়ি লণ্ঠন। মধ্যে মধ্যে এক একটি বাঁধা মঞ্চে বাজনাদাররা বাজনা বাজাচ্ছে। সামনের তোরণটি যেন আকাশচুম্বী এবং বহু বৰ্ণ সব কুসুমে সজ্জিত। শুধু নিমন্ত্রিতের সংখ্যাই প্ৰায় এক লক্ষ, এছাড়া অনাহুত, রবাহুত যে কত, তার ইয়ত্তা নেই। রানী রাসমণির নির্দেশ যে কেউই অভুক্ত অবস্থায় কিংবা দান না নিয়ে ফিরে যাবে না। বারাণসী, পুরী, পুণা, মান্দ্ৰাজ থেকেও তিনি বিশিষ্ট ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতদের আনিয়েছেন; নবদ্বীপ, ভাটপাড়া, কোটালিপাড়ার কোনো ব্ৰাহ্মণই বাকি নেই। দেশের সম্ভ্রান্ত নাগরিকদেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সকলকে। গঙ্গার বুকে পিনিস, বজরা বোট, ভাউলিয়া প্রভৃতি জলযান গিসগিস করছে, আবার রাজপথে গাড়িও অসংখ্য। মন্দির প্রাঙ্গণের এক পাশে অনেকগুলি হৃষ্টপুষ্ট গোরু বাঁধা, এক পাশে স্তৃপাকার পট্টবস্ত্র। এছাড়াও কয়েকটি পাহাড় সাজিয়েছেন, রৌপ্য মুদ্রার পাহাড়, সন্দেশের পাহাড়, পাকা কলার পাহাড়, অন্নের পাহাড়। কলকাতার বাজার তো বটেই, পানিহাটি, বৈদ্যবাটি, ত্ৰিবেণী ইত্যাদি সন্নিহিত সব এলাকার বাজার সাফ করে আনা হয়েছে সন্দেশ, সব মিলিয়ে পাঁচশত মণি। আর অন্নের পাহাড়টি তো অন্নমেরু পর্বত। রানী রাসমণি সম্মান অনুসারে ব্ৰাহ্মণদের গোধন, স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা এবং বস্ত্ৰ দান করবেন। এবং অন্ন ও মিষ্টদ্রব্য ইত্যাদি উৎসগ করবেন দেবতাকে। উৎসবের কয়েকদিন আগে একটি বাধা দেখা দিয়েছিল। মাহিষ্য সম্প্রদায়কে গোঁড়া ব্ৰাহ্মণের দল শূদ্র বলে মনে করে, সেই শূদ্র প্রতিষ্ঠিত মন্দিরকে ব্ৰাহ্মণরা অশাস্ত্রীয় বলে ঘোষণা করেছিল। তারপর ঝামাপুকুর টোলের রামকুমার পণ্ডিতের বিধান মতন দেবালয়টি রানী রাসমণি তাঁর গুরুদেবের নামে আগে উৎসর্গ করায় সে সংকট থেকে উত্তীর্ণ হওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ঐ মন্দিরের প্রতিদিনের পূজারী হবেন কে? কোনো শাস্ত্ৰজ্ঞ পণ্ডিতই শূদ্রের বেতনভুক পূজারী হতে সম্মত হলেন না, সামাজিক অপবাদের ভয়ে। শেষ পর্যন্ত রানী রাসমণির নির্দেশে তাঁর জামাতা মথুর ঐ রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কেই সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেন মন্দিরের পূজার ভার গ্রহণ করার জন্য। সব ব্ৰাহ্মণই পূজারী নয়। বঙ্গে ভট্টাচাৰ্যরাই বংশানুক্রমিক পূজারী। চট্টোপাধ্যায় বংশীয় রামকুমার রানীর প্রস্তাবে কিছু দ্বিধা করেছিলেন প্রথমে। জীবিকার জন্য তিনি কামারপুকুর থেকে এসে কলকাতার ঝামাপুকুরে টোল খুলেছিলেন। পিতৃবিয়োগের পর রামকুমারের ওপরেই সংসারের ভার বর্তেছে। অধ্যাপনা ছেড়ে তিনি বেতনভুক পূজারী হবেন? এদিকে রানী রাসমণি মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন পর্যন্ত ঘোষণা করে ফেলেছেন, পুরোহিতের অভাবে যে সব পণ্ড হয়ে যায়! রামকুমার শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলেন। নিয়তি নির্বন্ধে রামকুমারই হলেন মন্দির প্রতিষ্ঠার দিনের হোতা। সঙ্গে তাঁর ছোট ভাই গদাধর, তাঁর বয়েস এখন উনিশ। গদাধর বড় লাজুক প্রকৃতির। গ্রাম থেকে এসে এখনো সে এখানকার লোকজনদের সঙ্গে ঠিক মতন মিশতে পারে না। রানী রাসমণি, তাঁর মুখখানি ভক্তি ও তৃপ্তির ভাবে বিভোর। অন্যদিকে বসে আছে যুবক গদাধর, মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাবার ভয়ে সে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পাশ ছাড়েনি একবারও। তার দুই চোখ বিস্ময়াবিষ্ট, এত মানুষ, এত দ্রব্য, আর নবরত্বের মন্দিরটি যেন একটি পর্বত। গদাধরের এক ভাগিনেয় হৃদয়ও এসেছে সঙ্গে। সে বয়ঃকনিষ্ঠ হলেও গদাধরের চেয়ে অনেক চটপটে, সে ঘোরাঘুরি করছে চতুর্দিকে। জানবাজারের মাঢ় পরিবারের সঙ্গে জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবারের সম্পর্ক অনেক দিনের। তাই সিংহ পরিবারকে রাসমণি বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দক্ষিণেশ্বরের উৎসবে যোগদান
false
shirshendu
আপনার কি মনে হয় না যে, ওরা মেড ফর ইচ আদার? হয়। চারুশীলা উজ্জ্বল হয়ে বলে, হয়? তাহলে আমি নিশ্চয়ই ভুল করিনি! আচ্ছা, আপনি কথা চেপে রাখতে পারেন? চয়ন উদ্বেগের সঙ্গে বলে, এসব কি গোপনীয় কথা? না, এসব নয়। আপনি বোধ হয় জানেন না, হেমাঙ্গ বিয়ের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। উইক এন্ডে কোথায় চলে যাচ্ছে। হ্যাঁ, আপনি হেমাঙ্গীবাবুর হাইড আউটের কথা আমাকে বলেছেন। সামনের শনিবার সেখানে আপনার যাওয়ার কথা। হ্যাঁ, বাঁকা মিঞার গ্রামে। সেখানে ও একটা বাড়ি কিনেছে। শুধু তাই নয়, করবে বলে অনেকটা জমি কেনার চেষ্টাও করছে। বাঁকা মিঞা হেমাঙ্গর এসব কাণ্ড দেখে ভয় পেয়ে মামাকে জানিয়ে গেছে। তখনই ওর হাইড আউটের কথা আমরা জানতে পারি। হেমাঙ্গকে কি আপনার পাগলাটে বলে মনে হয়? না তো! উনি তো বেশ স্মাট আর ড্যাসিং। ছাই জানেন। আসলে একটা হাঁদারাম। ওকে আমার মতো কেউ চেনে না। যখন এইটুকু ছিল তখন আমার সঙ্গে ছায়ার মতো ঘুরত। সারাদিন কেবল চারুদি আর চারুদি। সেকথাও বোধ হয় একদিন বলেছেন। বলেছি? ওটাই আমার দোষ। বলে ভুলে যাই। ডোন্ট মাইন্ড। এসব কথা কিন্তু খুব গোপন রাখবেন। খুব বিনয়ের সঙ্গে চয়ন বলে, গোপনই থাকবে। বলার মতো আমার কেউ নেইও। আচ্ছা, হেমাঙ্গ কেন পালাচ্ছে বলুন তো! ব্যাপারটা খুব পাজলিং এবং অস্বস্তিকরও। একটা মেয়ের সঙ্গে ওর একটা আন্ডারাষ্ট্যান্ডিং হয়েছে, গার্জিয়ানরা সবাই মত দিয়েছে, তা হলে ও পালাচ্ছে কেন বলতে পারেন? না, চয়ন তা বলতে পারে না। কিন্তু সে কথা কবুল করাটা যে ঠিক হবে না। এ কাণ্ডজ্ঞান তার আছে। সুতরাং অত্যন্ত গভীরভাবে ব্যাপারটা যেন ভেবে দেখার একটা ভান করল সে। তারপর বলল, তাই তো! আমি কিছু বুঝতে পারছি না। চয়ন সময়োচিত গাম্ভীর্য এবং একটা দুঃখের ভাব মুখে ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগল। কে কাকে বিয়ে করতে চায় বা চায় না। এটা নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কী আছে সেটা সে জানে না। এদের সমস্যাও এত শৌখিন ও ফিনফিনে যে, সে অবাক না হয়ে পারে না। তার মতো সমস্যা তো এরা কখনও ভোগ করবে না। বিশ্বাসঘাতক এক শরীর নিয়ে সে যে টিকে আছে, প্রতি মুহূর্তে যার আশ্রয় হারানোর ভয়, যাকে প্রতিদিন হাজারো অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে হয়, যে কখনও তার যৌবনকে টেরই পায় না, উপভোগ তো দূরস্থান। সুতরাং তার কাছে এসব সমস্যা অবান্তর ও বাহুল্য। মানুষ তার সঙ্গে হেসে কথা বললে, ভাল ব্যবহার করলে, সমবেদনা প্রকাশ করলেই সে ভীষণ খুশি হয়ে যায়, তার বুকে যেন পূর্ণিমার জ্যোস্না এসে পড়ে। আচ্ছা, আপনার সিক্সথ সেন্স নেই? চয়ন দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, আজ্ঞে না। আপনি জ্যোতিষী জানেন? আজেও না। কিন্তু আমার যে এখন এরকম একটা কিছু দরকার। চারুশীলা বিরক্তির সঙ্গে বলে, সে আমিও জানি। একজন বিখ্যাত জ্যোতিষীকে আমি হাত দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা আমার হাজব্যান্ড কবে চাকরি পাবে বলুন তো, আর কি চাকরি পাবে? জ্যোতিষী অনেকক্ষণ দেখেটেখে বলল, আর দেড় বছরের মাথায় পাবে। কী চাকরি সেটা আর বলেনি। তখন আমার হাজব্যান্ড দুহাতে পয়সা রোজগার করছে। চয়ন জ্যোতিষীদের ব্যর্থতার কাহিনী শুনে দুঃখিতভাবে বলল, তাহলে কি করা যায়? চারুশীলা হঠাৎ তার মুখোমুখি একটা চেয়ারে ধাপ করে বসে বলল, আচ্ছা আমার কেন কেবলই মনে হয় বলুন তো, যে, আপনার বোধ হয়। সত্যিই ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় আছে। চয়নের একবার বলতে ইচ্ছে হল, সিক্সথ সেন্স আপনারই আছে, তাই বোধ হয় আমার ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় টের পান। কিন্তু সেটা বলে ফেললে স্পর্ধার প্রকাশ হয়ে যেত। তাই সে আপাদমস্তক লজ্জিত হয়ে বলে, আজ্ঞে, আমি অতি সামান্য মানুষ। আমার কোনও ক্ষমতা নেই। চারুশীলা তার এলো চুল অবিন্যস্ত হাতে পাট করতে করতে বলল, আপনার বিনয় ব্যাপারটা আমার একদম সহ্য হয় না। ওরকম বিনয় করবেন না তো! মেরুদণ্ডটা নুয়ে যাবে যে! একটু অহঙ্কারী হতে পারেন না? কী বলবে তা ভেবেই পেল না চয়ন। অসহায়ভাবে শুধু বলল, অহঙ্কার! অহঙ্কার না থাকলে পুরুষমানুষকে কি মানায়? মেয়েদেরও মানায় না। একটু অহঙ্কার থাকলে দেখবেন লোকে আর অবহেলা করতে সাহস পায় না। তবে অহঙ্কার করতে হলে বুদ্ধি চাই। অনেকে বোকার মতো নিজের গল্প নিজেই করে বেড়ায়। তাদের নিয়ে লোকে হাসোহাসি করে। ওরকম নয়, একটু মাথা উঁচু করে, নিজের ওপর বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা রেখে এবং কাউকেই— সে যত বড়ই হোক না কেন, বেশি মাথায় উঠতে না দিয়ে যদি চলেন তা হলে দেখবেন সবাই আপনার ওপর মনোযোগ দিচ্ছে। প্রকাশ্যে নয়, তবে সংগোপনে চয়ন একটি হতাশার শ্বাস মোচন করল। আর শুনুন, আমরা কিন্তু আপনার বস নই, বন্ধু। আমার হাজব্যান্ড লেফটিস্ট, একটু কমিউনিস্ট মাইন্ডেড। উনি শ্রমের মর্যাদা জানেন। আমি অবশ্য ওঁর মতো নই, তবু আমি কোনও মানুষকেই সাফারিং আর বন্ডেড দেখতে ভালবাসি না। চয়ন বিব্রত হয়ে বলে, তা জানি। আপনারা খুবই মহৎ। ফের? ওরকম বললে আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে কি করে? আজ্ঞে, আর একটু সময় দিন। হেসে ফেলল, বলল, সময় দিলে আরও বাজে লোক হয়ে যাবেন। মনোভাবটা শুধু পালটে ফেলুন। আপনি আমার বাড়িতে এসে আপনার শ্রম ও মেধা দান করছেন। প্রাপ্য দক্ষিণা নিচ্ছেন। এর বেশি তো কিছু নয়। যে আজ্ঞে। এবার আমার সমস্যাটার কথা একটু বলুন। এভাবে তো বসে থাকলে হবে না। হেমাঙ্গ আমার রাতের ঘুম কেড়ে দুঙ্গু,
false
shomresh
সকালে দীপাবলী কিছু বলার আগেই জানিয়ে দিয়েছে ওকে তার দরকার নেই। তার বদলে একটি বছর পনেরর ইউ পির ছেলেকে অলোক ধরে নিয়ে এসেছে। চা বানান, রুটি সেঁকা এবং দু-একটা ভাজাভুজি ছাড়া তার কোন কৃতিত্ব নেই। সকালে উঠে সে-ই চা বানায়, ব্রেকফাস্টের যোগাড় করে। দীপাবলী শেষ পর্বে তার সাহায্য নিয়ে টেবিলে সেগুলো পরিবেশন করে। অলোক এবং সে খাওয়া শেষ করে প্রায় নির্বাক থেকেই। খুব বাধ্য না হলে কেউ বেশী শব্দ ব্যবহার করে না। অফিস যাওয়ার পথে অলোক তাকে নামিয়ে দিয়ে যায়। কোন কোন দিন দীপাবলীকে নামাবার সময় জানায় যে কাজের চাপ থাকায় সে বিকেলে আসতে পারবে না। সেদিন একা একাই ফেরে দীপাবলী। দিল্লীর বাস সার্ভিসে সে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। যেদিন অলোক সঙ্গে থাকে সেদিন বাড়ি ফিরে বা খাওয়ার পর সে বই নিয়ে বসে। কিছুটা সময় বাড়িতে কাটিয়ে অলোক বেরিয়ে যায়। ফেরে রাত দশটার পরে। যেদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরা হয় না। সেদিন অলোক একটু বেহিসাবী। অন্তত বারোটা বেজে গেলে সে বেল বাজায়। পায়ে জোর থাকে না, টেবিলে চাপা দেওয়া খাবারে একটুও আগ্রহ থাকে না। দিন তিনেক ওর জন্যে না খেয়ে অপেক্ষা করার পর দীপাবলী এখন দশটা বেজে গেলে আর অপেক্ষা করে না। এই বাড়িতে কাজ করতে এসে চাকরটি খুব খুশি। সে যে দুহাতে পয়সা মারছে তা বুঝেও চুপ করে থাকে দীপাবলী। এক জায়গায় নির্লিপ্ত ক্রমশ বিস্তার করেছে সবক্ষেত্রেই। অলোকের বাইরের জীবন, সন্ধের পর পার্টি পার্টিতে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যেসটা থেকে নিজেকে একেবারে সরিয়ে নিয়েছে সে। এই নিয়ে কথাও হয়েছিল একদিন। দীপাবলী খুব ভদ্ৰভাবেই বলেছিল, যেখানে তাকে না নিয়ে গেলে অলোকের সম্মানহানি হবার আশংকা। থাকবে সেখানে সে নিশ্চয়ই যাবে। অলোক হেসে জবাব দিয়েছিল, অনেক ধন্যবাদ। তুমি আমায় বাঁচালে। অবশ্য তার পরে এতদিনেও সেইরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য নয় কিন্তু অলোক কি ভাবে ম্যানেজ করছে তা সে-ই জানে। এই রকম সম্পৰ্ক যার কোন ব্যাখ্যা নেই, যা আছে বললে ভুল বলা হবে আবার নেই মানে অত্যন্ত মিথ্যে ভাষণ তাই বুলেছিল ওদের ফ্ল্যাটে। পরেশবাবু এলেন এই পটভূমিতে। বৃদ্ধকে দেখে আপ্লুত হল দীপাবলী। অত্যন্ত আন্তরিক হয়ে উঠল সে। সোফায় বসে পরেশবাবু বললেন, অলোক এখন আমার ওখানে। এই দ্যাখখা, আমার বলছি কেন, ওটা তো তোমাদেরও বাড়ি। বুঝলাম তুমি একা আছ তাই কথা বলতে এলাম। আজকাল তো একা বেশী চলাফেরা করতে পারি না, বয়স খুব কামড় দিচ্ছে, কিন্তু কিছুদিন থেকে মনে হচ্ছিল তোমার কাছে আসা দরকার। দীপাবলী পাশে বসে বলল, এত কষ্ট করলেন কেন? আমায় ডেকে পাঠালেই তো হত। ডেকে পাঠালেই যে যেতে তা আমি জানি। কিন্তু তাতে তো কথা হত না মা। দীপাবলী আড়ষ্ট হল। বৃদ্ধকে দেখেই সে আন্দাজ করেছিল কিছু একটা ঘটেছে। এই মানুষটিকে তার খুব ভাল লাগে। কালীবাড়িতে যেচে আলাপ করে তিনি স্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন কনে হিসেবে পছন্দ করার জন্যে বলে নয়, মানুষটির বুকে একটা নরম মন আছে যার স্পর্শ পেলে খুব ভাল লাগে। সে কথা ঘোরাবার জন্যে জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে একটু চা করে দিই? না হে। দুবারের বেশী চা খেলে রাত্রে জেগে থাকতে হয়! বৃদ্ধ চুপ করে রইলেন। দীপাবলীও নির্বাক। সে বুঝতে পারছিল শ্বশুরমশাই কথা খুঁজছেন। ঠিক কিভাবে বক্তব্য রাখবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি আমাদের ব্যাপারে কিছু জানতে চান? বৃদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়লেন, ঠিক বলেছ। জানতে চাই। যা জেনেছি তার ওপর নির্ভর করে কিছু বলতে মন থেকে সায় পাচ্ছিলাম না। তোমার মুখে কিছু শুনি, তারপর বলব। বেশ, কি জানতে চান বলুন! তোমাদের কি হয়েছে? আমাদের? দীপাবলী তাকাল। তারপর নিচু গলায় বলল, মতবিরোধ। হঠাৎ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন বৃদ্ধ, ও হো, তাই বল। তোমার শাশুড়ি যা বলল তাতে মনে হচ্ছিল কত কি না ঘটে গেছে। তা মতবিরোধটা মিটিয়ে নেওয়া যায় না? দীপাবলী জবাব দিল না। এই বৃদ্ধের সঙ্গে ওই তেতো বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে একটুও ইচ্ছে করছিল না। সে চুপ করে আছে দেখে বৃদ্ধ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কি হল? দীপাবলী বলল, আপনি কি শুনেছেন তা জানলে বলতে সুবিধে হত। হাত নাড়লেন পরেশ মুখার্জি, একদিন শুনলাম তোমার রান্না নাকি অলোক খেতে পারছে না। তা তোমার শাশুড়ি যখন আমাদের সংসারে এল তখন সে লুচি বেললে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপ হয়ে যেত। শিখতে শিখতে শেখা হয়ে যায়। তোমার শাশুড়ি রান্নার লোক পাঠালেন। আমার ভাল লাগেনি ব্যাপারটা। বলেছিলাম ওদেরটা ওদের বুঝতে দাও। এই করে তিনি বড় ছেলে আর বড়বউ-এর মধ্যে অশান্তি বাঁধিয়েছেন। না, না, আমায় বলতে দাও। তারপর কানে এল অলোক নাকি রোজ খুব মদ খাচ্ছে আর সেই সঙ্গে তুমিও তাল দিচ্ছ। দ্যাখো, দেশটা তো বিলেত আমেরিকা হয়ে যায়নি যে চায়ের বদলে মদ খেতে দেখলে কিছু মনে হবে না। ছেলে রোজ মদ খাচ্ছে শুনলে রাগ হয় কিন্তু ছেলের বউ মদ খাচ্ছে শুনলে বুকের ভেতর কষ্ট হয়। ওটা কি খাওয়ার জিনিস? অলোকের বন্ধুদের বউরা খায়? হ্যাঁ। তাঁরা কোল্ড ড্রিঙ্কসের রঙের আড়াল রেখে খান। তুমি খাও? সত্যি? হ্যাঁ, কখনও সখনও। কেন মদ খাও? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, অলোক তোমায় খেতে বলেছে? ওঁকে দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই। হ্যাঁ, উনি বলেছেন। কিন্তু খেয়েছি তো আমি। তবে মদ খেতে আমার
false
shirshendu
যে! গায়ের লোক আপনাকে আড়ালে কি বলে জানেন ? বলে পাগলবাবু, অবশ্য আদর করেই বলে, আপনার ওপর কারও কোনও খার নেই। তবে ওসব শুনতে কি আমার ভাল লাগে, বলুন! হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমি তো পাগলই। লোকে যখনই জীবনের সবচেয়ে সত্য বস্তুর সন্ধান পায় তখনই কি করে যেন লোকের চোখে পাগল বা ক্ষ্যাপা বলে মনে হয় লোকটিকে। তা সে লোকে যাই বলুক আমার কিছুই যায়-আসে না। আরও একটা কথা । আপনার বাড়ির লোকের ধারণা হয়েছে, আপনি এই গাঁ-গঞ্জেই একটা বিয়েশাদি করে বসবেন। হয়তো। তা হলে ষোলো কলা পূর্ণ। হেমাঙ্গ একটু অবাক হয়ে বলে, তুমি এটাও মাকে বুঝিয়েছ নাকি ? তুমি তো মহা বিপজ্জনক লোক! জিব কেটে বাকা বলে, মিছে কথা বলব আপনার নামে ? ওসব নষ্টামো করতে যাব কেন ? কিছু বলিনি। তবে আপনাকে একটা বিষয়ে একটু সাবধান করে দিই। নগেন সামন্তর মেয়েটা বড্ড ঘুরঘুর করছে আজকাল। অত আসকারা। দেবেন না। পারুল! সে তো পড়তে আসে মাঝে মাঝে। বয়সের মেয়ে, বুঝলেন না! গা-গঞ্জ জায়গা, পাঁচটা কথা উঠে পড়বে। হেমাঙ্গ অবাক হয়ে বলে, সে তো বাচ্চ মেয়ে! তোমরা কিরকম মানুষ বলে তো! ওটুকু মেয়েকে নিয়েও কথা হয়? টুকু আবার কি? ষোলো বছর বয়স হল। ধুস! বারোর বেশি হতেই পারে না। আপনার কি দেখার চোখ আছে? অতি উদাস থাকলে ওরকমই হয়। ও মেয়ের বয়স পনেরো পুরে এই ষোলো চলছে। সন্ধের পর টর্চ বাতি নিয়ে পড়তে আসার অত কি গরজ? আর পড়া মানে তো হয় করে আপনার মুখের দিকে চেয়ে থাকা। আপনি আর ওসব একদম ঘাড়ে নেবেন না। হেমাঙ্গ একটু অসহায়ভাবে চুপ করে রইল। পারুল তার কাছে পড়তে আসছে মাত্র মাসখানেক হল! তাও সপ্তাহে মাত্র দুদিন, শনি আর রবিবার, হেমাঙ্গ এখানে আসে; নগেন সামন্ত নিজেই নিয়ে এসে বলেছিল একদিন, বাবু, আমার মেয়েটা লেখাপড়ায় ভাল। সবাই বলে, মাথা আছে। ক্লাসে ফাস্টও হয়। যদি আপনি একটু দেখিয়ে দেন তাহলে আরও ভাল করবে। সেই থেকে একটু করে পড়ায় হেমাঙ্গ; মেয়েটার মাথা সত্যিই ভাল। গাঁয়ে-গঞ্জে–কে জানে কেন–ছেলেমেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার চাড় এবং মেধা নেই। এই মেয়েটার আছে দেখে হেমাঙ্গ একটু উৎসাহ বোধ করেছিল। পারুল দেখতে খুব সাদামাটা গেয়ো আর পাঁচটা মেয়ের চেয়ে সামান্য আলাদা চেহারার। চোখে বুদ্ধির দীপ্তি আছে। কিন্তু তার বয়স এতই কম যে তাকে পুরুষের চোখ দিয়ে কখনও লক্ষই করেনি হেমাঙ্গ। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ভুলটা আমারই। গায়ের মেয়ের বয়স আর শহরের মেয়ের বয়সের যে আলাদা হিসেব সেটা মনে ছিল না, বুঝলে বাকা? আপনার বরাবরই হিসেবের ভুল। অথচ আপনি নাকি হিসেবের ওস্তাদ। হেমাঙ্গ একটু ভয়ে ভয়ে বলে, গায়ে কি পারুলকে নিয়ে কথা উঠেছে নাকি? না আমাকে ভয় দেখোচ্ছ? বাঁকা মিঞা ঘাড় চুলকে বলল, কথাটা ওঠেনি, তবে উঠে পড়বে। আমি আপনাকে আগাম একটা হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখলাম। সামন্তকেও বলে দিয়েছি যেন বাবুকে আর ডিস্টার্ক করা না হয়। হেমাঙ্গ হেসে বলল, তুমি আমার মাকেও ছাড়িয়ে গেলে দেখছি। আমি হলাম। আপনার লোকাল গার্জেন। ঠাকরুন। তাই বলে দিয়েছেন। তা হলে তো কথাই নেই। আপনি কিন্তু আমার প্রথম কথাটার জবাব দেননি। বলছি এ ভাবেই কি চলবে। সাধা-সন্ন্যাসীই হয়ে যাবেন শেষ অবধি? তা আর হতে পারলাম। কই। সাধুরা তো জপতপ করে, আমি তো তা করি না। আমি শুধু পৃথিবীটা দেখি! চার দিকে কত রূপ বলো তো! ছোট্ট একটা পোকা, একটু ফুল, একটা পাতার মধ্যেও কত সূক্ষ্ম মেকানিজম আর এসথেটিক্স! তুমি দেখতে পাও না? তা পাই, তবে আপনার মতো অমন মজে যাই না। শুধু দেখে বেড়ালে কি জীবন চলে? এবার একটু সংসারী হওয়ার কথাও ভাবুন। হেমাঙ্গ শুধু হাসল, কিছু বলল না। বাঁকা মিঞা আরও কিছুক্ষণ সদুপদেশ দিয়ে উঠে গেল। লোকটা যে তাকে ভীষণ ভালবাসে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু ওর ভালমন্দের বোধটা অন্যরকম। গতকাল শুক্রবার ছিল। অফিস থেকে দুপুরবেলা বেরিয়ে সে সোজা চলে এসেছে। এখানে; এখানে যেন গাছপালা, পোক-মাকড়, বাতাসটা অবধি তার জন্য অপেক্ষা করছিল। এসব কথা সে কাকে বোঝাবে? এখানে আকাশে মেঘ ও রৌদ্রের খেলা, জলের লহরী, পাতার কোপন, উড়ন্ত পোকার পাখনায় আলোর বর্ণালী সে ছাড়া আর কে দেখবে? এখানে এসে সে কত শিখেছে, কত কি বুঝতে পেরেছে, অনুভূতি হয়েছে কত সূক্ষ্ম! তাকে কেন পাগল ভাবে লোক? নতুন শীতের সকালবেলার রোদ চাঁদরের মতো বিছিয়ে পেতে দিয়ে গেছে কে। সেই চাঁদরে গাছপালার ছায়ার নানা নকশা। উঠোন নিকোনো, তকতকে। এ সবই করে বাসন্তী। বাসন্তীর কথা ভাবতে ভাবতেই বাসন্তী চলে এল। একদিন বাসন্তীকে বলেছিল। হেমাঙ্গ, হ্যাঁ রে, অত নোংরা। উলোকুলো হয়ে থাকিস কেন? পরিষ্কার থাকতে পারিস না? সেই থেকে বাসন্তী এখন ফরসা শাড়িই শুধু পরে না, চুল বঁধে, মুখে বোধ হয় পাউডারও দেয়, তারপর আসে। আজ এসেই বলল, ও দাদা, গত সোমবার থেকে ব্রাশ আর পেষ্ট দিয়ে দাঁত মাজছি, তা জানো? কী ভাল গো স্বাদটা! মুখটা যেন মিষ্টি হয়ে যায়। হেমাঙ্গ একটু হেসে বলল, তুই বোধ হয় দাঁত মাজতে গিয়ে পেস্ট একটু খেয়েও ফেলিস! লজ্জা পেয়ে বাসন্তী বলে, দু-একবার কি আর গিলে ফেলিনি। তবে ব্ৰাশে বাপু মুখে রীড় জ্বালা করে প্রথমটায়। ছড়ে গিয়েছিল। এখন অবশ্য সয়ে গেছে। মুড়ি এনেছি, এই দেখা। সকালে ভাজিয়ে আনলাম সুবাসীর
false
shirshendu
চাইছেন। তিনি কে? রিঙ্কুর মা। শ্যামলী। তিনি কেন দেখা করবেন? বোধহয় ভজনবাবুকে নিজের হাতে খুন করতে চান। আপনি রাজি হয়েছেন নাকি? হয়েছি। কেন? ভজনবাবুকে শক দেওয়ার কোনও চেষ্টাই আমি ছাড়ছি না। ও। আপনি সবসময়ে ডেনজার নিয়ে খেলা করেন। অ্যান্ড হোয়াই নটী? ঘোষাল হাসল, ইটস ওকে ইফ ইট পেজ। কিন্তু এসব তো পণ্ডশ্রম। মনে হচ্ছে তাই। বাই দি বাই, রেপ করার সময় যদি রিঙ্কু ভজনবাবুকে বাধা দিয়ে থাকে তা হলে ভজনবাবুর গালে বা গলায় বা পিঠে বা হাতে নখের দাগ থাকার কথা। নিশ্চয়ই। তবে গণপ্ৰহারে ভজনবাবুর সারা শরীর এমনই ক্ষতবিক্ষত ছিল যে রিঙ্কুর নখের দাগের মতো সূক্ষ্ম জিনিস খোঁজা খড়ের গাদায় ছুচ খোঁজার সামিল। তাও তো বটে। আরও একটা কথা। কী বলুন তো! রিঙ্কু যদি ভজনের প্রেমেই পড়ে থাকে তা হলে সেক্সের সময় বাধা দেবে কেন? কিন্তু আপনিই তো বললেন যে ভজন ভায়োলেন্ট লাভার। হ্যাঁ। সেক্ষেত্রে বাধা দিতে পারেই। সেটা ঠিক। তবু সব দিক ভেবে দেখতে হচ্ছে। চার্জশিট তো নিশ্চয়ই ফাইল করা হয়নি? না। ভজনবাবু উকিল নিয়েছেন? হ্যাঁ। ওর পরিবার জামিন চেয়েছে। এখন আপনার অ্যাঙ্গেল অফ থটটা কী? মাথা নেড়ে শবর বলল, আই অ্যাম ইন কনফিউশন। শবর দাশগুপ্তর মুখে এ কথা শুনব বলে ভাবিনি। শবর মৃদু হেসে বলল, ঘটনাবলি নয়, আমাকে কনফিউজ করছে লোকটা। ভজন আচার্য। লোকটাকে কি আপনার ক্রিমিন্যাল বলে মনে হচ্ছে না? তা বলছি না। হতেই পারে। রজাতদা আসলে কী চাইছেন বলুন তো! রজাতদা ভেঙে কিছু বলেননি। তিনি আমাকে শুধু বলেছেন, এ কেসটািয় আমার একটা পারসোনাল ইন্টারেস্ট আছে। তুমি প্যারালেল ইনভেস্টিগেশন করো। আমি লোকাল থানাকে বলে দিচ্ছি। তোমার সঙ্গে কো-অপারেট করতে। ওঁর ইন্টারেস্টটা কোন দিকে তা বুঝতে পেরেছেন? ভিকটিম না। সাসপেক্ট? সম্ভবত সাসপেক্ট। মাই গড! তাই আপনি মুশকিলে পড়েছেন। অনেকটা তাই। ছবিটা আবার দেখুন তো দাদা। ঘোষাল রঙিন ছবিটা তুলে নিয়ে দেখল। গায়ে একটা পোলকা ডটওলা টিলা কামিজ, পরনে নীল জিনস, একখানা সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো, পিছনে একটা মাঠ। মেয়েটার মুখে একটু হাসি। কিছু মনে হয়? না। ছবি তো স্থির জিনিস। একটা এক্সপ্রেশন মাত্র। এ থেকে কী বোঝা যাবে বলুন! ইজ শি সেক্সি? টিন এজাররা সবাই বয়সের গুণেই অ্যাট্রাকটিভ। যৌবনে কুক্কুরী ধন্যা। আমি মহিলাদের ব্যাপারে একটু অনভিজ্ঞ, তাই জিজ্ঞেস করলাম। অনভিজ্ঞ থাকার দরকারটা কী? বয়স তো বোধহয় একত্রিশ-বত্ৰিশ হল। ওরকমই। তা হলে টোপরটা এবেলা পরে ফেললেই তো হয়। ঘোষালদা, নিজের কথা ভুলে যাচ্ছেন। বছর খানেক আগেও আপনি ফ্যামিলি লাইফ নিয়ে আতঙ্কিত ছিলেন। হ্যাঁ দাশগুপ্ত, সেবার আপনি আমার পাশে না দাড়ালে মরতে হত। ফ্যামিলি লাইফকে আমি একটু ভয় পাই। ভয়ও আছে, ভরসাও আছে। আমার এরকমই ভাল লাগে। সিঙ্গল, অ্যাকটিভ, ফ্রি। দাঁড়ান। আমার বউকে আপনার পেছনে লাগাব। সে খুব ভাল ঘটকী। সর্বনাশ! আমি ওর কাছে যাব। একটা রেপিস্ট, খুনির কাছে আমি যাব কেন শবরবাবু? আমার তো ওর সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই। জানি, সব জানি। আমি শুধু একটা জিনিস জানতে চাই। কী সেটা? সেদিন রাতে উনি সত্যিই রিঙ্কুর সঙ্গে কথা বলছিলেন কি না। অবভিয়াসলি রিঙ্কু। আর কে হবে! মানছি। কিন্তু তবু সন্দেহের কোনও অন্ধুর আমি রাখতে চাইছি না। এটা আপনার বাড়াবাড়ি। কোনও কিছুই বাড়াবাড়ি নয়। সত্যের শিকড়ে পৌঁছানো সবসময়েই কঠিন। সত্যকে আপনি স্বীকার করতে চাইছেন না। সত্য হলে অবশ্যই স্বীকার করব। কিন্তু আমাকে টানাটানি করছেন কেন? জেরা বা রুটিন প্রশ্ন করে ভজনবাবুর কাছ থেকে কিছুতেই কথাটা বের করা যাচ্ছে না। আপনি হয়তো জানেন না লোকটার সহ্যশক্তি অসীম। আমি কাউকে এত ফিজিক্যাল টর্চার সহ্য করার পরও এত শান্ত থাকতে দেখিনি। তাতে কী হ’ল? লোকটাকে ক্র্যাকডাউন করাটাই আমার স্বার্থ। কেসটার যা অবস্থা ভজনরাবুর রেহাই পাওয়ার কোনও উপায় নেই। আমি ওঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি না। লোকটার ফাঁসি হোক কি যাবজ্জীবন আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু লোকটার কাছ থেকে কথাটা বের করা यद ब्न्मा 6दङन्म? এটা কি আপনার জেদ বা প্রেস্টিজ ইসু? না একেবারেই তা নয়। মেয়েটা যে রিঙ্কুই তা আপনার মনে হচ্ছে না কেন? মনে হচ্ছে। আবার হচ্ছেও না। বড্ড হেঁয়ালি করেন। আপনি। আমার তো মনে হচ্ছে ভজন আপনাকে ঘুষ দিয়েছে। শবর হাসল, মনে রাখবেন ভজনবাবু গুল্ডা বদমাশদের হাতে মার খেয়েও তাদের চাদা দেননি। ঘুষ দেওয়ার লোক নন। আমাকে কী করতে হবে? জাস্ট মিট হিম। মিট করে কথাটথা বলতে হবে তো! তা হবে। কী বলব। তখন? যেমন মনে হয় বলবেন! প্ৰস্পট করার বা শিখে পড়ে যাওয়ার দরকার নেই। আমি যে ওর ওপর ভীষণ রেগেও আছি। তা থাকুন না। কী যায় আসে তাতে? কোন লাইনে কথা বলতে হবে তা তো বুঝতে পারছি না। নানা ধরনের কথা হতে পারে। বুদ্ধি খাটিয়ে বলবেন। বলার চেয়েও শোনাটা বেশি জরুরি। ও আমাকে সব বলবে কেন? উনি কারও সঙ্গেই কথা বলছেন না বিশেষ। আপনার সঙ্গেও না বলতে পারেন। তবে আমার একটা ধারণা, উনি আপনার ওপর টর্চার করেছেন বলেই একটু অপরাধবোধ থাকতে পারে। নরপশুদের অনুতাপ থাকে না। রিঙ্কুকে মেরে কি ও অনুতপ্ত? এ প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। আপনি লোকটাকে দেখে বুঝতে চেষ্টা করুন। আমার কী দরকার? দরকারটা তো আপনার নয়, আমার। আপনি আমাকে বড্ড মুশকিলে ফেললেন। আচ্ছা, একটা শর্তে দেখা
false
humayun_ahmed
চলে গেছে। পাঞ্জাবি ঠিক করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। আজমল সাহেব সাবধানী মানুষ ইলেকট্রসিটি থাকা সত্ত্বেও তিন ব্যাটারির একটা টর্চ সাথে নিয়ে এসেছেন। টৰ্চটা এখন কাজে আসছে। আঞ্জামাল সাহেব বললেন, দরজায় তালা না দিয়েই রওনা হচ্ছেন। তালা দিন। এখন তালা খুঁজে পাব না। টাৰ্চটা নিয়ে খুঁজে বের করুন। ঘর খোলা রেখে যাবেন নাকি? অসুবিধা নেই। অবশ্যই অসুবিধা আছে। আমি প্রায়ই লক্ষ করেছি। দরজায় তালা না দিয়ে আপনি বাইরে যান। এটা ঠিক না। পাঞ্জাবিও দেখি উল্টা পরেছেন। পাঞ্জাবি ঠিক করে পরুন। মেয়েরা উন্টা শাড়ি পরলে নতুন শাড়ি পায়। ছেলেরা উল্টা কাপড় পরলে অসুখে পড়ে। এটা পরীক্ষিত সত্য। আজমল সাহেবের বসার ঘরে টেলিফোন। সেখানেই বাড়ির মেয়েরা ভিসিআরো ছুবি দেখছে। ইলেকট্রসিটি নেই। এদের জেনারেটরও নেই। তারপরেও টিভিভিসিআর চলছে কী করে! দর্শকরা মিসির আলির দিকে তাকাল। তিনি সংকুচিত বোধ করলেন। অকারণে এতগুলো মানুষের বিরক্তি তৈরি করা। টেলিফোন না ধরলেই হতো! টেলিফোন নিয়ে যে দূরে চলে যাবেন সে উপায় নেই। কথাবার্তা ভিসিআরের দর্শকদের সামনেই বলতে হবে। হ্যালো। মিসির আলি সাহেব কথা বলছেন? জি। আমাকে চিনতে পারছেন? জি না। গলার স্বরটি কি চেনা মনে হচ্ছে না? আমি টেলিফোনে গলার স্বর চিনতে পারি না। আপনাদের দিকে কি বৃষ্টি হচ্ছে? হুঁ হচ্ছে। ক্যাটস অ্যান্ড ডগস, মুষলধারে? হ্যাঁ, মুষলধারে। আপনাদের ওদিকে ইলেকট্রসিটি চলে গেছে না আছে? মিসির আলি জবাব দিলেন না। টেলিফোনে একজন পুরুষ কথা বলছে। সে তার গলার স্বর বদলানোর চেষ্টা করছে। গলা ভূগরী করে কথা বলছে। এটা কোনো জরুরি কল না। লুইসেন্স কল। মানুষকে বিরক্ত করে আনন্দ পাওয়ার জন্য এ ধরনের টেলিফোন করা হয়। টেলিফোনের এক পর্যায়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা থাকে। মিসির আলি সাহেব? জি। আমি আপনার খুবই পরিচিত একজন। ভালো। আপনি কি আমার উপর বিরক্ত হচ্ছেন? বিরক্ত হচ্ছি। আপনি অকারণে কথা বলে যাচ্ছেন। মূল কথাটা বলুন। মূল কথা অবশ্যই বলব। কথাটা ভয়াবহ বলে সামান্য সময় নিচ্ছি। আচ্ছা আপনি কি অপরিচিত মানুষের কথা বিশ্বাস করেন? কী বলতে চাচ্ছেন বলুন। আমি টেলিফোন রেখে দেব। আমি টেলিফোন করেছি আপনাকে সাবধান করার জন্য। আপনি একটা ভয়ঙ্কর বাড়িতে বাস করছেন। ও আচ্ছা। রেবু নামের একটা মেয়ের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে না? অল্পবয়সী মেয়ে তার মামার বাসায় থাকতে এসেছে। এই মেয়ে একটা ভয়ঙ্কর মেয়ে। কোন অৰ্থে? সৰ্বঅর্থে। মেয়েটা খুনি। ও আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না? মিসির আলি বললেন, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে? প্রায় শেষ। মেয়েটা তার স্বামীকে আর তিন মাস বয়সী মেয়েকে খুন করেছে। পুলিশি মামলা হয়। অবশ্য মেয়েটা ছাড়া পায়। মেয়েটা তার মাকেও খুন করেছে। এখন যে বাড়িতে আছে সে বাড়ির কেউ না কেউ অবশ্যই খুন হবে। কিন্তু কেউ কিছু ধরতে পারবে না। আপনি এসব বিষয় নিয়ে কাজ করেন। আপনাকে এই কারণেই জানালাম। আচ্ছা। মেয়েটি যে তার স্বামী-সন্তানকে খুন করেছে সেটি নিয়ে কাগজে নিউজ হয়েছিল তার কাটিং আমি পোষ্ট করে আপনার ঠিকানায় পাঠিয়েছি। দু-একদিনের মধ্যে পাবেন। স্যার, আমার কথা কি আপনার কাছে মিথ্যা বলে মনে হচ্ছে? মানুষের কথা আমি চট করে বিশ্বাস করি না। আবার অবিশ্বাসও করি না। স্যার, আপনি কি আমাকে এখনো চিনতে পারেন নি? চিনতে পেরেছি। তুমি মনসুর। জি। কে খুন হবে বলব স্যার? মিসির আলি রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। ভিসিআর দর্শকদের মধ্যে রেবু বসে আছে। সে তাকিয়ে আছে মিসির আলির দিকে। মিসির আলির চোখে চোখ পড়তেই সে চোখ ফিরিয়ে নিল। মেয়েটি তাকে চিনতে না পারার ভঙ্গি করছে। কিংবা এও হতে পারে খুব ভালো কোনো ছবি চলছে। মেয়েটা ছবি থেকে চোখ সরাতে পারছে। না। তার সমস্ত মনোযোগ টিভি পর্দায়। মানুষ একসঙ্গে দুজায়গায় মনোযোগ দিতে পারে না। মেয়েটিকে ভয়াবহ খুনি বলে মনে হচ্ছে না। সহজ-সরল মুখ। যে ভঙ্গিতে বসে আছে তার মধ্যেও আরামদায়ক আলস্য আছে। মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। আজমল সাহেব বললেন, চা খেয়ে যান। চা দিতে বলেছি। রাতের খানা কি হয়েছে? জি হয়েছে। নিজেই রেঁধেছেন? জি। আপনার জন্য একটা কাজের মেয়ে আনতে বলেছি। ময়মনসিংহের দিকে আমার কর্মচারীরা যায়। ওদের বলেছি। একজন আনতে। ময়মনসিংহের কাজের মেয়ে ভালো হয়। তাই নাকি? জি একেকটার জন্য একেক জায়গা। মাটিকাটা লেবারের জন্য ভালো ফরিদপুর। অফিসের পিয়ান-দারোয়ানের জন্য রংপুর। আর কাজের মেয়ের জন্য ময়মনসিংহ। আমি এইভাবে কখনো বিবেচনা করি মা। টেলিফোনে কোনো দুঃসংবাদ পেয়েছেন নাকি? জি না। যেভাবে আপনাকে চেয়েছিল, ভাবলাম দুঃসংবাদ। মিসির আলি চা খেলেন। পান খেলেন। পানে প্রচুর জুর্দা ছিল বলে মাথা ঘুরতে লাগল। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ভাই সাহেব আজ যাই। আজমল সাহেব বললেন, যাই-যাই করছেন কেন? ইলেকট্রসিটি আসুক তারপর যাবেন! বসেন ছবি দেখেন। নতুন ইউপিএস লাগিয়েছি। কারেন্ট চলে গেলে দুইতিন ঘণ্টা টিভি চলে, ফ্যান ঘোরে। সায়েন্স ধাই—ধাই করে কোথায় যে চলে যাচ্ছে! পয়সা খরচ করে ইউপিএস লাগিয়ে ভালো করেছি না? জি, ভালো। পয়সা থাকলে সবই করা যায়। আমার এক বন্ধু গাজীপুর জঙ্গলে বাড়ি বানিয়েছে। সেখানেও সে সোলার এনার্জির ব্যবস্থা করেছে। সূর্যের আলো থেকে সোলার প্যানেল দিয়ে ইলেকট্রসিটি। তাই নাকি? আপনাকে একদিন নিয়ে যাব, অবশ্য আপনাকে কোথাও যেতে দেখি না। যখনই দেখি-হাতে বই! এত পড়লে চোখের তো বারোটা বেজে যাবে। চোখের ক্ষতি যখন হয়েছে, আরেকটু হোক। আসুন ছবি দেখি। মাঝখান থেকে দেখলে
false
MZI
ইম্পরট্যান্ট। নুরুল ইসলাম হাসার ভঙ্গি করে বললেন, এনডেভার দেশে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। পৃথিবীর একটা জায়ান্ট কম্পিউটার কোম্পানি। কাজেই যত্ন করে ওদের ইন্টারভিউ নেবে। যত্ন করে? হ্যাঁ। মানে বুঝেছ তো? ঘটাবে না। এরা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী দেশের বিশাল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। একটা সময় ছিল, যখন এসব কোম্পানিকে গালাগাল করা ছিল ফ্যাশন। এখন হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগ। এখন এদের তোষামোদ করা হচ্ছে ফ্যাশন! তার মানে এদের তোষামোদ করে আসব? না। আমি সেটা বলছি না। তোষামোদ করবে না, কিন্তু কথা বলবে একটা পজিটিভ ভঙ্গিতে। এদের ঘটাবে না, বিরক্ত করবে না। ওদের সঙ্গে পজিটিভ ভাবে কী বলা যায়, জেনে আসবে।। যদি পজিটিভ কিছু না পাই, তবুও– নুরুল ইসলাম আবার হাসির ভঙ্গি করলেন। বললেন, আগে থেকে কেন সেটা ধরে নিচ্ছ, গিয়ে দেখো। ঈশিতা যখন নুরুল ইসলামের অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তখন তাকে বললেন, আর শোনো, বিদেশিরা সময় নিয়ে খুবই খুঁতখুঁতে। পাঁচটায় সময় দিয়েছে, তুমি ঠিক পাঁচটার সময় হাজির হবে, এক মিনিট আগেও না, এক মিনিট পরেও না। বুঝেছ? বুঝেছি। যারা পাঁচ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করতে পারে, তারা এই দেশের একটা পত্রিকাকে অনেক টাকার বিজ্ঞাপন দিতে পারে! ঈশিতা নুরুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। খবরের কাগজ আসলে খবরের জন্য নয়, খবরের কাগজ এখন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। সেটা নিয়ে একসময় তর্কবিতর্ক করা যেত, ইদানীং সেটাও করা যায় না। নুরুল ইসলামের কথামতো কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটার সময় ঈশিতা এনডেভারের অফিসে এসে হাজির হয়েছে। কাজটা খুব সহজ হয়নি, ট্রাফিক জ্যামের কারণে কেউ আজকাল ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় যেতে পারে না। ঈশিতা মোটরসাইকেল চালিয়ে যায় বলে সে মোটামুটি ঠিক সময়ে পৌঁছে যেতে পারে, তার পরও আজ সে ঝুঁকি নেয়নি। অনেক আগে রওনা দিয়ে অনেক আগে পৌঁছে গেছে। বাড়তি সময়টা কাটাতে তার রীতিমতো কষ্ট হয়েছে। মোটরসাইকেলে ঘোরাফেরা করা শার্টপ্যান্ট পরে থাকা মেয়েদের নিয়ে সবারই এক ধরনের কৌতূহল।জামি ক্যামেরাটা থাকায় একটু সুবিধে, সাংবাদিক হিসেবে মেনে নেয়। প্রয়োজন না থাকলেও সে এদিক-সেদিক তাকিয়ে খ্যাচ-খ্যাচ করে ছবি তুলে নেয়, লোকজন তখন তাকে একটু সমীহ করে। ডিজিটাল ক্যামেরা, আজকাল ছবি তুলতে এক পয়সাও খরচ হয় না। ঈশিতা অবশ্যি তার এত দামি ক্যামেরাটা নিয়ে ভেতরে যেতে পারল না, গেটের সিকিউরিটির মানুষটি একটা টোকেন দিয়ে ক্যামেরাটা রেখে দিল, যাওয়ার সময় ফেরত দেবে। ঈশিতাকে বলল, এনডেভারের অফিসের ভেতরে ক্যামেরা নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই। ক্যামেরাটা প্রায় জোর করে রেখে দেওয়ার সময়ই ঈশিতার মেজাজটা একটু খিচে ছিল, ভেতরে গিয়ে ওয়েটিং রুমে যখন টানা কুড়ি মিনিট অপেক্ষা করতে হলো, তখন তার মেজাজ আরও একটু খারাপ হলো। শেষ পর্যন্ত যখন তার অফিসের ভেতর ডাক পড়েছে, তখন সে ভেতরে ভেতরে তেতে আছে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সে অবশ্যি বেশ অবাক হয়ে যায়—অফিস বলতেই যে রকম চোখের সামনে বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিল, গদি আঁটা চেয়ার, ফাইল কেবিনেট, কম্পিউটারের ছবি ভেসে ওঠে, এখানে সে রকম কিছু নেই। চৌদ্দতলায় এক পাশে ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত কাচের দেয়াল দিয়ে বহুঁ দূর দেখা যায়। ঈশিতা একটু অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, যদিও এলাকাটি শহরের মোটামুটি দরিদ্র এলাকা কিন্তু এত ওপর থেকে দেখলে সেটি বোঝা যায় না। এই দেশে অনেক গাছ, মনে হয় গভীর মমতায় সেই গাছগুলো দারিদ্রকে ঢেকে রাখে। ঘরের অন্যপাশে দেয়ালে সারি সারি ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি। এক ঘরে এতগুলো টিভি কেন, কে জানে। প্রত্যেকটা টিভিতেই নিঃশব্দে কিছু একটা চলছে। মেঝেটিতে ধবধবে সাদা টাইল এবং কুচকুচে কালো কিছু ফার্নিচার। যে ইন্টেরিওর ডেকোরেটর ঘরটিকে সাজিয়েছে, তার রুচিবোেধ আধুনিক এবং তীব্র। কাচের দেয়ালের সামনে একজন বিদেশি মানুষ দাঁড়িয়েছিল, ঈশিতার পায়ের শব্দে ঘুরে তাকাল এবং এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ঈশিটা? ঈশিতা ইংরেজিতে বলল, আসলে ঈশিতা। কিন্তু তুমি যেহেতু ত এবং ট আলাদাভাবে শুনতে পাও না বা উচ্চারণ করতে পার না, এতেই চলে যাবে। মানুষটা কেমন যেন অবাক হলো, শুধু অবাক নয়, মনে হলো কেমন যেন একটু ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। কেউ তার ভুল ধরিয়ে দেবে, সে মনে হয় এই। ব্যাপারটায় অভ্যস্ত নয়। বলল, তুমি বলতে চাইছ ট উচ্চারণটি দুই রকম? কী আশ্চর্য! আমি এত দিন এই দেশে আছি, কেউ আমাকে এটা বলেনি! ঈশিতা বলল, প্রয়োজন হয়নি। কিংবা তোমার মুখে এই উচ্চারণটিই হয়তো সবাই পছন্দ করে। মানুষটা ঈশিতাকে নিয়ে একটা চেয়ারে বসায়। চেয়ারের সামনে একটি টেবিল, টেবিলের অন্য পাশে আরেকটি চেয়ারে বসে বলল, বলো, আমি তোমার জন্য কী করতে পারি? ঈশিতা বলল, বব লাস্কি, আমাকে পাঠানো হয়েছে, তোমার একটি ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য। তোমরা এই দেশে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করতে যাচ্ছ। কাজেই আমরা তোমাদের মুখ থেকে কিছু শুনতে চাই। বব লাস্কি চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, আমরা কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারার। সাদা ভাষায় তোমরা কম্পিউটার বলতে যা বোঝাও, সেই কম্পিউটার না। আমরা বিশেষ কাজ মাথায় রেখে কম্পিউটার তৈরি করি। এক ধরনের সুপার কম্পিউটার। আর্কিটেকচার সম্পূর্ণ আলাদা, নিউরাল নেটওয়ার্ক– ঈশিতা ইতস্তত করে বব লাস্কিকে থামিয়ে বলল, আমি গত বিশ মিনিট তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ডেস্কে রাখা কাগজপত্র থেকে এগুলো জেনে গেছি। আমি আসলে তোমার কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু জানতে চাই। বব লাস্কির মুখ কঠিন হয়ে উঠল, ঈশিতা মোটামুটি স্পষ্ট ভাষায়
false
shunil_gongopaddhay
কিন্তু কত স্বপ্ন ছিল ভূমিসূতাকে ঘিরে। একদিন ভূমিসূতা চলে আসবে তার কাছে, সে তখন সরকারি খাতায় নাম লিখিয়ে বিয়ে করবে ভূমিসূতাকে। সেই সময় অবশ্য বন্ধু-বান্ধবদের সাহায্য নিতে হতোই। দ্বারিকা আর যদুপতি তাকে নিশ্চয়ই সাহায্য করত। তারপর তার ওই হরি ঘোষ ছোট বাড়িতেই বসে পড়াত। লেখাপড়ায় খুব আগ্ৰহ ভূমিসূতার, তাকে সে ইংরেজি পড়তেও শিখিয়ে দিত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আর কোথাও যেত না ভরত, সোজা ছুটে আসত বাড়িতে। ভূমিসূতা সেই এল, কিন্তু এই কি আসা! এখন এই মুহূর্তে, ভূমিসূতা রয়েছে তারই ঘরে, তারই বিছানায় শুয়ে আছে। কিন্তু সেখানে ভরতের থাকার কোনও অধিকার নেই। কাল সকালে তাকে যে শুধু ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হবে তাই-ই নয়, মন থেকেও মুছে ফেলতে হবে। তার স্বপ্নে আর ভূমিসূতার স্থান নেই। নিজের ঘরখানির কথা ভাবতে গেলেই তার চোখে ভেসে উঠছে শশিভূষণের ক্রুদ্ধ বেদনার্ত মুখ। মায়ের কথা মনে নেই ভরতের, রক্তের সম্পর্কে যিনি পিতা, তিনি ভরতকে সঁপে দিয়েছিলেন ঘাতকদের হাতে। একমাত্র শশিভূষণই ভরতের মতন এক অকিঞ্চিৎকর মানুষকে মূল্য দিয়েছিলেন। শশিভূষণ দয়া না করলে সে এক গঞ্জের কাঙালি হয়ে থাকত। শশিভূষণ তার কাছে বাবা-মায়ের চেয়েও বেশি। সেই শশিভূষণের মনে আঘাতের কারণ হয়েছে সে। শশিভূষণ ভেবেছেন, ভরত তলে তলে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে ভূমিসূতাকে পেতে চেয়েছে? ছিছিছিছি। শশিভূষণ যে ভূমিসূতার প্রতি আকৃষ্ট হবেন, এ কথা ঘুণাক্ষরেও তার মনে আসেনি কখনও। নারী জাতির প্রতি ফিরে তাকাতেন না শশিভূষণ, ত্রিপুরায় তাঁর কত প্রলোভন ছিল, ইচ্ছে করলেই তিনি নিজের বাসস্থানে একাধিক সোমথ দাসী রাখতে পারতেন, তাতে কেউ কিছু মনে করে না। ভবানীপুরের বাড়িতেও ভূমিসূতার সঙ্গে শশিভূষণকে কখনও একটি কথাও বলতে দেখেনি ভরত। যদি নিজের প্রাণ দিয়েও প্রমাণ করতে হয় যে ভরত অকৃতজ্ঞ নয়, তাতেও সে রাজি আছে। যারা অনিদ্রা রোগী, যারা সাধক-যোগী, তাদেরও এক সময় ঘুম আসে, কিন্তু ভরতের চোখে ঘুম নেই। বিছানায় আরাম করে শুতেও তার ইচ্ছে করছে না, সে মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছে। নিশ্ছিদ্ৰ অন্ধকারের মধ্যে সে দেখতে পাচ্ছে তার অকিঞ্চিৎকর জীবনের সমগ্ৰ ছবি। তার আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই। সে শুধু এইটুকু ঠিক করে ফেলেছে, সে আর কলকাতা শহরে থাকবে না। একদিন সে মহারাজের দৃষ্টিপথ থেকে এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেছিল, এখন থেকে সে আর শশিভূষণ-ভূমিসূতার দৃষ্টিপথেও থাকবে না। এঁদের দু’জনের জীবনে কোনও অস্তিত্ব থাকবে না ভরতের। রাস্তার ওপারে তাঁতিদের বস্তিতে ডেকে উঠল মোরগ। এখনও আকাশে আলো ফোটেনি, পুব দিগন্তে শুধু সামান্য লালচে আভা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যেই ভোর হয়ে গেল? ভরত তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। আর দেরি করা ঠিক হবে না। পাশের বাড়ির পুরুতে বাণীবিনোদ এক একদিন এমন ভোরেই চা খাওয়ার জন্য ছাদ ডিঙিয়ে চলে আসে। নিজের জামা ও ধুতি শুধু ভিজে নয়, একেবারে নোংরা। হয়তো কাল আসার পথে দু-একবার আছড়ে খেয়েছে, খেয়ালও নেই। এগুলো পরে যাওয়া যায় না। ভোর হতে না হতেই শহরের অনেক জেগে ওঠে। ভরত দ্বারিকার ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকল। একটা আলনায় পরিপাটি করে সাজানো আছে বেশ কয়েকটা ধুতি, বেনিয়ান ও কুর্তা। দ্বারিকার কাছ থেকে এক প্রস্থ পোশাক ধার করতে কোনও বাধা নেই। পোশাক বদলাবার পর রান্নাঘরে এসে একটা ধারালো মাংস কাটা ছুরিও নিয়ে নিল ভরত। সেটা কোমরে গুঁজে রাখল, একটা অস্ত্র রাখা দরকার। শশিভূষণ যদি কোনওক্রমে তাকে অবিশ্বাস করেন, তাহলে তাঁর সামনেই নিজের গলায় ছুরি বসিয়ে দেবে ভরত। এরই মধ্যে রাস্তা দিয়ে দল বেঁধে বেঁধে চলেছে গঙ্গাস্নানার্থীরা। কিছু কিছু ফেরিওয়ালা বেরিয়ে পড়েছে সওদা নিয়ে। বাড়ির কাছেই একটা মিষ্টির দোকানে মস্ত বড় একটা কড়াইতে দুধ জ্বাল দেওয়া হয়। ভরত এক পোয়া দুধ নিয়ে নিল একটা ভাঁড়ে। তার কাছে পয়সা নেই, কিন্তু এ দোকানে সে ধার রাখতে পারে। জিলিপি ভাজার মাদকতাময় গন্ধ নাকে আসছে। ভূমিসূতা কি জিলিপি খেতে ভালোবাসে! ভূমিসূতা তার বাড়িতে এল, কিছু না খেয়ে চলে যাবে? দু’আনার জিলিপিও নিল ভরত। একটা বড় শালপাতার ঠোঙায় সব কিছু নিয়ে এক হাতে ধরে সে অন্য হাত চাপা দিয়ে সাবধানে হেঁটে চলল। চিলে ছোঁ মারার ভয় আছে। নীচের গেট খোলা, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে এসে ভরত দেখল বাইরের দরজাও খেলা। তার শয্যা শূন্য। সে দুবার ডাকিল, ভূমি, ভূমি! এরপর শালপাতার ঠোঙাটা নামিয়ে রেখে ভরত দৌড়োদৌড়ি করে রান্নাঘর, স্নানের ঘর, বারান্দা, ছাদ, ন্যাড়া ছাদ সব খুঁজে দেখল বটে, কিন্তু আগেই সে বুঝে গেছে, ভূমিসূতা নেই। কোনও কোনও শূন্যতায় পা দিলেই টের পাওয়া যায় যে তা একেবারেই শূন্য। কোনও ঘরেই ভূমিসূতার উত্তাপ নেই। ভরতের বিছানাটি নিভাঁজ, সেখানে কেউ শোয়নি। ভূমিসূতাকে ভরত শেষ দেখেছিল দেওয়ালে এক কোণে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে, সেখান থেকেই বোধহয় ভূমিসূতা চলে গেছে। কোথায় চলে গেল! সে নিজেই ফিরে গেল শশিভূষণের কাছে? ভরতের প্রত্যাখ্যানে সে অপমানিত বোধ করেছে, ভূমিসূতা তেজস্বিনী মেয়ে, সে রকম অপমান বোধ তার হবেই। ভরত তার চোখে একটা অপদাৰ্থ, কাপুরুষ, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী, হ্যাঁ ভরত এর সবটাই মেনে নিতে রাজি আছে। ভূমিসূতার চোখে এখন সে একটা ঘৃণ্য জীব হওয়াই ভালো। ভরতের পক্ষেও ভূমিসূতাকে স্বপ্ন থেকে মুছে ফেলা সহজ হবে। সেই জন্যই ভূমিসূতা আর ভরতের সাহায্য চায়নি, নিজেই সে চলে গেল আগে থেকে। কিন্তু সে কি পথ চিনে যেতে পারবে? রাজবাড়ি থেকে সে তো আগে বেরোয়নি, কালও এসেছে অনেক রাত্রে।
false
MZI
“বাবা গো” বলে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পড়ার চেষ্টা করেন। লোকজনের ভেতর একটা বিস্ময়ের গুঞ্জন শুরু হয়ে হঠাৎ থেমে যায়। সাগরেদরা হতভম্ব। বড়। সাগরেদ সবচেয়ে আগে সম্বিত ফিরে পান, ভয়ের ভঙ্গিতে বললেন, নাউজুবিল্লাহ্ নাউজুবিল্লাহ্ নাউজুবিল্লাহ—আপনারা দরুদ শরিফ পড়েন, সবাই জোরে জোরে দরুদ শরিফ পড়েন, জোরে জোরে। দরুদ শরিফের আওয়াজে আর কিছু শোনা যায় না, পীর সাহেবের কারেনি চাপা পড়ে গেল। পীর বাবা লাফিয়ে উঠে পড়তে চাইছিলেন, কিন্তু সাগরেদরা তাঁকে ঠেসে ধরে রাখল, তার মাঝে এক জন জোর করে বুকের মাঝে একটা তক্তা বিছিয়ে দিয়ে দুটো থান ইট এনে রেখে দেয়। আমি দেখতে পেলাম আতঙ্কে পীর বাবার চোখ গোল-গোল হয়ে উঠেছে, কী একটা বলে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন ছাড়া পাবার জন্যে, কিন্তু সাগরেদরা তাঁকে কিছুতেই ছাড়ছে না। কালু খাঁয়ের লাখ টাকার লোভ খুব সহজ ব্যাপার নয়। গুণ্ডা গোছের এক জন লোেক প্রকাণ্ড একটা হাতুড়ি নিয়ে হাজির হয়। পীরবাবার প্রচণ্ড চিল্কার অগ্রাহ্য করে সেই হাতুড়ির প্রচণ্ড আঘাতে সে থান ইট দুটি গুড়ো করে ফেলে। সাথে সাথে পীর বাবা এক গগনবিদারী চিৎকার করে লাফিয়ে ওঠেন, দশ জন সাগরেদ তখন তাঁকে ধরে রাখতে পারে না, তিনি বাবা গো, মা গো, মেরে ফেলল গো বলে চিৎকার করে লাফাতে থাকেন। দর্শকরা হতচকিত হয়ে একেবারে নীরব হয়ে যায়। সাগরেদরা দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে রীতিমতো কুস্তির ভঙ্গিতে গদিতে আছড়ে ফেলল, বড় সাগরেদ তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে কী একটা বলতে থাকেন আর পীর সাহেব প্রবল বেগে মাথা নেড়ে আপত্তি করতে থাকেন। কয়জন সাগরেদ ছুটে গিয়ে ব্যান্ডেজ মলম এনে তাঁকে উল্টে ফেলে পিঠে একটা ব্যান্ডেজ করে দিল—সিকের সাদা পাঞ্জাবিতে রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছিল, তাঁকে চেপে শুইয়ে রেখেই পাঞ্জাবি বদলে দেয়া হল। উপস্থিত দর্শক তখন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। কথাবার্তায় আসর রীতিমতো সরগরম। হঠাৎ দেখি নান্টু তার কাগজের বান্ডিল নিয়ে গুটিগুটি এগিয়ে আসছে। আমি দৌড়ে গিয়ে তাকে আটকে নিচু গলায় বললাম, এক্ষুনি নয়, আরেকটু পর। খুশিতে নান্টুর দাঁত বেরিয়ে ছিল, সেগুলো লুকানোর কোনো চেষ্টা না করে বলল, আরো মজা আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। নান্টু হাতে কিল মেরে বলল, নদী মে খাল, মিরচা মে ঝাল। শেষ পর্যন্ত বড় সাগরেদ উঠে দাঁড়ালেন, কেশে গলা পরিষ্কার করতেই উপস্থিত জনতা একেবারে চুপ করে যায়। বড় সাগরেদ হুঁঙ্কার দিয়ে বললেন, আমি এক শ’ বার বললাম যার অজু নাই সে যেন জিকিরে যোগ না দেন, কিন্তু আপনাদের মাঝে এক জন আমার কথা শুনেন নাই, অজু ছাড়া জিকিরে টান দিয়েছেন। উপস্থিত জনতা পাংশু মুখে বসে থাকে। বড় সাগরেদ চিৎকার করে বললেন, হুঁজুরের জানের জন্যে যার মায়া নাই, জাহান্নামে তার জায়গা নাই। খবরদার বে-অজু মানুষ জিকিরে সামিল হবেন না। পীর বাবা আবার জিকির শুরু করেন, এবারে তাঁর সাথে যোগ দিল অল্প কিছু লোক, অজু সম্পর্কে সন্দেহ নেই, এরকম লোকের সংখ্যা বেশি নয়। পীর বাবার সমাধিস্থ হতে বেশি সময় লাগল না। লাখ টাকার লোভ খুব সহজ জিনিস নয়। বড় সাগরেদ আবার উঠে দাঁড়িয়ে গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, হুঁজুরের রুহ এখন সাত আসমান সাত জমিন পার হয়ে উঠে গেছেন, হুঁজুরের শরীরে এখন ব্যথা-বেদনা নাই। খবরদার, আপনারা কেউ শব্দ করবেন না, রুহ্ তাহলে শরীরে ফিরে আসতে চায়। তখন রুহের কষ্ট হয়, শরীরে আজাব হতে পারে। খোদার রহমত মানুষের শরীরে নাজেল হলে মানুষের শরীর ফিরিশতার শরীর হয়ে যায়। আপনারা এখন তার প্রমাণ দেখবেন। আগুনের বড় কুণ্ডতে অনেকক্ষণ থেকে বেশ কয়টা কাঠের গুড়ি দাউদাউ করে জ্বলছিল, এবারে সাগরেদরা এসে গনগনে কয়লাগুলি সমানসমান করে বিছিয়ে দিতে থাকে। প্রায় দশ ফুট লম্বা দুই ফুট চওড়া জ্বলন্ত কয়লার একটা রাস্তা তৈরি হয়, পীর বাবা সেটার উপর দিয়ে হেঁটে যাবেন। আধো অন্ধকারে জ্বলন্ত কয়লার লাল আভা দেখে ভয় ভয় করতে থাকে, এর উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। সফদর আলী অবশ্যি বুঝিয়ে দিয়েছেন পা ভিজিয়ে তাড়াতাড়ি হেঁটে গেলে ব্যাপারটি তেমন কঠিন নয়। আজ অবশ্যি অন্য ব্যাপার, সফদর আলী ব্যবস্থা করে রেখেছেন, সব ভণ্ডামি আজ ধরা পড়ে যাবে। পেরেকের বিছানাটি এত চমৎকার কাজ করেছে যে এবারেও সফদর আলীর ব্যবস্থাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই! পীর বাবা অনেকক্ষণ থেকেই অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছেন, সবাই মিলে তাঁর পা ভালো করে ধুয়ে দিয়ে ধরাধরি করে জ্বলন্ত কয়লার কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। পীর বাবা টলতে টলতে দুলতে দুলতে কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকেন। পিছন থেকে বড় সাগরেদ একটা ধাক্কা দিতেই তিনি এক পা কয়লার উপরে দিলেন। মুহূর্তে তাঁর ভাবগম্ভীর মুখ বিবর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি এক লাফে পিছিয়ে আসতে চাইলেন। কিন্তু বড় সাগরেদ আবার তাঁকে ধাক্কা মেরে জ্বলন্ত কয়লার দিকে ঠেলে দিলেন। পীর বাবা নাকমুখ খিচিয়ে কোনোমতে দুই পা সামনে এগিয়ে গেলেন, তারপর হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার করে বাবা গো, মা গো, মেরে ফেললে গো বলে লাফাতে লাফাতে জ্বলন্ত কয়লা থেকে বেরিয়ে এলেন। তার বিরাট থলথলে শরীর নিয়ে তিনি বারকতক ঘুরপাক খেয়ে বড় গামলা ভর্তি শরবতে নিজের পা ড়ুবিয়ে দিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকেন। এর মাঝে কয়েক বার ফ্লাশের আলো জ্বলে উঠল। আমার সাংবাদিক বন্ধু নিশ্চয়ই ছবি তুলে নিয়েছে। উপস্থিত দর্শকেরা বিচলিত হয়ে ওঠে। তাদের শব্দ করা নিষেধ। কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে। এখন
false
MZI
কেন বুঝেছ?” আমি বললাম, “আপনার নাম জামশেদ” “হ্যাঁ। আমি মেজর জামশেদ। তোমাদের ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা আসলে বাচ্চা কাচ্চার জিনিষ না। এটা হচ্ছে বড়দের জিনিষ। তাই এটা বড়দের হাতে থাকা ভাল। এটার নামও হওয়া উচিত বড়দের নামে। বুঝেছ?” আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। জামশেদ নামের মানুষটা গম্ভীর মুখে বলল, “এখন এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলি। জিনিষটা খুব সহজে কীভাবে করা যায় বল দেখি?” আমি বললাম, “এটা করা সম্ভব না। এটা মিঠুন আবিষ্কার করেছে এটা সবসময়ে মিঠুনের নামে থাকবে।” মানুষটা আমার কথা শুনে খুব অবাক হয়েছে এরকম ভাব করে বলল, “ও আচ্ছা! তাই নাকী?”। আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ।” “তোমার নামটা যেন কী? বগা নাকি ইবু?” “ইবু।” “শোনো ইবু–আমি বেয়াদপ ছেলে ছোকড়া পছন্দ করি না। বুঝেছ? এখন থেকে আমি পারমিশান না দিলে কোনো কথা বলবে না। শুধু শুনে যাবে। বুঝেছ?” আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। জামশেদ নামের মানুষটা বলল, “আমি তোমাদের ফ্লাইং মেশিন তুলে নিয়ে এসেছি। এর ভিতরে আছে তোমাদের ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা। দড়ি দিয়ে বাঁধা এই যন্ত্র খুলে সেই ব্লাকহোলের বাচ্চা বের করতে সময় লাগবে পনেরো মিনিট। কাজেই ধরে নাও ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাটা এখন আমার। আমি এখন তোমাদেরকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারি। কেন বের করছি না বল দেখি?” আমরা কোনো কথা বললাম না। জামশেদ বলল, “ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করছি না কারণ বের হয়েই যদি ইন্দুরের বাচ্চার মত প্যানপ্যানানী শুরু কর? কোনো ফাজিল সাংবাদিকেরা যদি তোমাদের কথা বিশ্বাস করে ফেলে? সেই ছাগল সাংবাদিক যদি তোমাদের কথা বিশ্বাস করে রিপোর্ট করে ফেলে তখন একটা কাজ বাড়বে। রিপোর্টারকে ফিনিস করতে হবে। সেইটা অবশ্যি সমস্যা না, আমি মাসে দুই চারটা সাংবাদিক জুতো দিয়ে পিশে ফেলি।” কথা শেষ করে মানুষটা চেয়ারে তার পা দিয়ে পিষে ফেলার অভিনয় করে দেখাল। মেজর জামশেদ নামে মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার শরীরটা কেমন যেন শির শির করতে থাকে। সর্বনাশ! কি ভয়ংকর মানুষ। জামশেদ একটু দম নিল তারপর বলল, “কাজেই আমাকে একটা জিনিষ নিশ্চিত করতে হবে, সেটা হচ্ছে তোমরা এখান থেকে বের হয়ে যেন আলতু ফালতু কথা না বল। বুঝেছ? আমার কথা বুঝেছ?” তার কথা বুঝতে আমাদের কোনো সমস্যা হল না। কিন্তু আমরা কোনো কথা বললাম না, চুপ করে রইলাম। জামশেদ আরেকটা কী কথা বলার জন্যে তার চকচকে সোনার দাঁত বের করে মুখ হা করল ঠিক তখন তার টেলিফোন বাজল। সে টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন কাচুমাচু হয়ে গেল। টেলিফোনটা ধরে সোজা হয়ে দাড়িয়ে গিয়ে হড়বড় করে বলল, “ইয়েস স্যার। মালিকুম স্যার।” টেলিফোনের অন্য পাশ দিয়ে কে কী বলছে আমরা শুনতে পেলাম না কিন্তু মনে হল মানুষটা অনেক বড় অফিসার আর সেই বড় অফিসার জামশেদকে একটা ধমক দিল। জামশেদ আরো কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “সরি স্যার। ভুল হয়ে গেছে স্যার। ছেলেমেয়েগুলোকে রিকভার করে ভেহিকেলটা নিয়ে ফিরে আসতে আসতে দেরী হয়ে গেছে স্যার। আই অ্যাম সরি স্যার আমার আরো আগে রিপোর্ট করা উচিৎ ছিল স্যার। আর ভুল হবে না স্যার।” মনে হল বড় অফিসারটা বলল যে সে আমাদের দেখতে আসবে সেটা শুনে জামসেদ খুব ব্যস্ত হয়ে বলল, “না না না স্যার। আপনার আসার কোনো দরকার নাই স্যার। কোনো দরকার নাই স্যার। দে আর লাইক স্ট্রীট আরফিন। স্যার, মহব্বতজান স্কুলের ছাত্র তাই বুঝতেই পারছেন চাল চুলো নেই কিছু বদ ছেলে মেয়ে স্যার। নো ডিসিপ্লিন ইন লাইফ স্যার। স্যার, ওদের দেখলে আপনার মন খারাপ হবে স্যার।” জামশেদ মনে হল তার বড় অফিসারকে খুব ভয় পায়। প্রত্যেকটি বাক্যের আগে এবং পরে স্যার বলছে। তার বড় অফিসার মনে হয় ফ্লাইং মেশিন নিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করল, কারণ জামশেদ মুখ শক্ত কর বলল, “নো স্যার। আকাশে ওড়ার ভেহিকেলটা ইজ নট সায়েন্টিফিক স্যার। এই বদ ছেলেমেয়ে গুলোর মাথায় অনেক বদবুদ্ধি স্যার। একটা ঝুড়ির সাথে। হান্ড্রেডস এন্ড হান্ড্রেডস অফ বেলুন লাগিয়েছে স্যার। গ্যাস বেলুন। এতো বেলুন কোথা থেকে ম্যানেজ করেছে গড় অনলি নোজ স্যার। আমাদের রাডারে বেলুন ধরা পড়েনি, শুধু ঝুড়ি আর ঝুড়ির মাঝে ছেলে মেয়েগুলো ধরা পড়েছে। সেই জন্যে মনে হয়েছে কোনো ধরণের ফ্লাইং মেশিন স্যার। আসলে খুব জোরাস একটা সিচুয়েশন স্যার। স্যার, চরম পাবলিক নুইসেন্স স্যার। যে কোনো রকম একসিডেন্ট হয়ে যেতে পারত স্যার। বদ ছেলেমেয়ে গুলো মারা যেতে পারত স্যার। তাদের খুব কপাল ভাল আমরা তাদের রক্ষা করেছি স্যার।” আমাদের মনে হল জামশেদের বড় অফিসার এবারে ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা নিয়ে কোনো একটা প্রশ্ন করল, জামশেদ তখন হা হা করে হাসার মত একটা শব্দ করল, বলল, “স্যার এটা একটা জোক স্যার। মাইক্রো রাকহোল, মাস এনার্জী কনভারসান এগুলো একেবারেই বাজে কথা স্যার। এই ছেলেমেয়েগুলো এই কথাগুলোর মানে জানা দূরে থাকুক শব্দগুলো। বানানই করতে পারবে না স্যার। নিজেদের ভিতরে এগুলো নিয়ে কথা বলতো, ভাব দেখাতো স্যার। ফাজিল ছেলেমেয়ে তো, কী বলে কী না বলে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই স্যার।” বড় অফিসার মনে হল জামশেদের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করল না। জামশেদকে অনেকভাবে বোঝাতে হল যে আমরা খুবই ফালতু টাইপের ছেলে মেয়ে একটা ঝুড়ির মাঝে অনেকগুলো গ্যাস বেলুন বেঁধে আকাশে উড়ে গেছি। শেষ পর্যন্ত মনে হয় অফিসারটা জামশেদের কথা
false
shunil_gongopaddhay
যাই। স্পিডবোটের চালক ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, স্যার, এই নদীতে পড়লে সাঁতার জেনেও খুব লাভ হয় না। এই নোনা জলে কামঠ থাকে, কুচু করে পা কেটে নিয়ে যায়। বিমান বলল, কামঠ কী? কাকাবাবু বললেন, একরকম ছোট হাঙর। খুব হিংস্র রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, কারুরই জলে পড়ার দরকার নেই। ওহে বাপু, তুমি সাবধানে ঠিকঠাক চালাও! নদীর দুধারে অনেক লোক জলে নেমে কী যেন খোঁজাখুঁজি করছে। কারুর কারুর হাতে গাঢ় নীল রঙের ছোট ছোট জাল। বিমান জিজ্ঞেস করল, ওরা কী করছে জলে নেমে! চালক বলল, ওরা বাগদী চিংড়ির পোনা ধরছে। এটাই সিজন কিনা? ওখানে কামঠ যেতে পারে না? ওদের ভয় নেই? কী করবে বলুন, মাছ না ধরলে যে ওরা খেতে পাবে না। ভয় আছে বই কী, মাঝে-মাঝে দুএকজনের পা কাটা যায়। তবে এক জায়গায় বেশি লোক থাকলে কামঠু কাছে আসে না। আর কিছুক্ষণ যাবার পর কাকাবাবু বললেন, ছোট সাধু আমায় দেখে হঠাৎ বলেছিল, আজ রাত্রে আমার বাড়ি ফেরা হবে না। এটাই ভাগ্য, ও নিজেই আজ রাত্রে বাড়িতে ফিরতে পারবে না। বিমান বলল, ব্যাটা ভণ্ড! আচ্ছা রণবীরবাবু, আপনি হঠাৎ ওর জামা খুলতে বললেন কেন? আপনি কী করে বুঝলেন… কী জানি, লোকটির মুখ দেখেই আমার কেমন যেন মনে হল, ও একটু টাকার গরমে কথা বলছে! বুকে বাঁধা অতগুলো টাকা, হা-হা-হা। কাকাবাবু বললেন, ও বেশি সাহস দেখিয়ে আমার সঙ্গে যেচে কথা বলতে এসেছিল। যদি দূরে দূরে থাকত, তাহলে বোধহয় আজ ধরাই পড়ত না। রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, তবে, কাকাবাবু, ও বোধহয় এই কথাটা ঠিকই বলেছে। আজ রাত্তিরে আপনার না-ও ফেরা হতে পারে। কাকাবাবু কিছু বলার আগেই বিমান বলল, সে কী! কেন? জলের ব্যাপার তো! এই সব স্পিডবোট যখন-তখন খারাপ হয়। ধরুন যদি এটা খারাপ হয়ে গেল, তখন কী হবে? দেখছেন তো! দুপাশে জঙ্গল, পাড়ে নামাও যাবে না! তখন কোনও নৌকে ধরতে হবে কিংবা দৈবাৎ কোনও লঞ্চ যদি এদিক দিয়ে যায়- দৈবাৎ কেন? এদিকে লঞ্চ পাওয়া যায় না? খুব কম। ওহে মাস্টার, তুমি আবার স্পিডবোটটাকে খাঁড়ির মধ্যে ঢোকালে কেন? চালক বলল, এদিক দিয়ে শর্টকাট হবে, স্যার! এই যে দু দিকের জঙ্গল, এখানে বাঘ আছে? তোমরা তো টাইগার প্রজেক্টের লোক? হাঁ, স্যার, তা আছে। এই তো বাঁ দিকে সজনেখালির জঙ্গল, ওখানে কয়েকটা বাঘ আছে। বুকুন তা হলে! পাশের জঙ্গলে বাঘ, এর মধ্যে যদি স্পিডবোট খারাপ বিমান বলল, যদি খারাপ নাও হয়, নদী এত সরু, এখানে এমনিতেই তো বাঘ আমাদের ওপরে লাফিয়ে পড়তে পারে। যেন এটা কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারই নয়। এইভাবে হাসতে হাসতে রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, তা তো পারেই! বাঘ এর চেয়ে বেশি দূরেও লাফিয়ে যায়! তবে কথা হচ্ছে, কোনও বাঘ এখন এদিকে আসবে না। বাঘেরাও জেনে গেছে। যে, অ্যাডিশনাল আই. জি. রণবীর ভট্টাচার্য এই পথ দিয়ে যাচ্ছে। বাঘেরাও আমাকে ভয় পায়। হা-হা-হা-হা! কাকাবাবু বললেন, স্পিডবোটে এত শব্দ হচ্ছে, এই জন্যই বাঘ এর কাছে ঘোিষবে না। বাঘেরা শব্দ পছন্দ করে না। মুনি-ঋষিদের মতনই বাঘ খুব নির্জনতাপ্রিয়। রণবীর ভট্টাচাৰ্য আগের মতনই হাসতে হাসতে বললেন, কাকাবাবু, আমি পাইলটসাহেবকে একটু ভয় দেখাচ্ছিলুম। বিমান বলল, ভয় আমি পাইনি। তবে পরশু আমার ডিউটি আছে… কাকাবাবু বললেন, আমি গোসাবা পর্যন্ত এসে ফিরে যাব ভেবেছিলুম। এত দূর আসতে হল— বিমান বলল, আমার কিন্তু খুব ভাল লাগছে কাকাবাবু। কাছাকাছি বাঘ আছে জেনে খুব উত্তেজনা হচ্ছে। এরকম অ্যাডভেঞ্চারে তো কখনও যাইনি! শুধু পরশু যদি ডিউটি না থাকত— রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, আজ না হোক, কালকের মধ্যে ঠিক আপনাকে ক্যানিং পৌঁছে দেব। সেজন্য চিন্তা করবেন না। আমাকেও তো কাল বিকেলের মধ্যে চিফ মিনিস্টারকে রিপোর্ট দিতে হবে? সন্তু অনেকক্ষণ থেকেই চুপ করে আছে আর গভীর মনোযোগ দিয়ে দু পাশের জঙ্গল দেখছে কী গভীর বন! একটুও ফাঁক নেই, মানুষের পায়ে চলার মতনও কোনও পথ নেই। নদীর দুধারে শুধু থকথকে কাদা, তার মধ্যে উঁচু উঁচু হয়ে আছে। শূল। প্রতি মুহূর্তে সন্তুর মনে হচ্ছে, হঠাৎ যেন জঙ্গলের মধ্য থেকে গাঁক করে ডেকে একটা রিয়াল বেঙ্গল টাইগার বেরিয়ে আসবে। আর একটা কথা ভেবেও সন্তুর অদ্ভুত লাগছে। এখন দুপুর তিনটে বাজে। সকাল আটটার সময়েও সন্তু জানত না যে, কয়েক ঘন্টার মধ্যে সে এইরকম একটা গভীর জঙ্গলের মধ্যে চলে আসবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এত কম সময়ের মধ্যে এরকম একটা অ্যাডভেঞ্চারের অভিজ্ঞতা সন্তুর আগে কখনও হয়নি। সরু নদীটি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলেছে। এঁকেবেঁকে। প্ৰত্যেকবার স্পিডবোটটা বাঁক নেবার সময়েই সন্তুর মনে হচ্ছে, এইবারে একটা কিছু ঘটবে। হঠাৎ স্পিডবোটটার স্পিড কমে এল, ইঞ্জিনের আওয়াজও বন্ধ হয়ে গেল। রণবীর ভট্টাচার্যের একটুখানি তন্দ্ৰা এসেছিল, ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী হল, খারাপ হয়ে গেল? কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল চালক। কী হে, কথা বলছি না কেন? খারাপ হয়ে গেছে? কই, না তো! কিসের আওয়াজ? শুনুন ভাল করে। সন্তু, বিমান, কাকাবাবু কেউ-ই এতক্ষণ স্পিডবোটটার মোটরের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ শুনতে পায়নি। এমনকী একটা পাখির ডাকও না। এখন মোটরের আওয়াজ বন্ধ হয়ে যেতে নিস্তব্ধ জঙ্গলটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। শোনা যেতে লাগল নানারকম পাখির ডাক। একটা পাখি ট-ব্ল-র-র, ট-র-র-র করে ডাকছে। মাথার ওপর দিয়ে দু তিনটে বেশ বড় পাখি কাঁক-কাঁক
false
zahir_rayhan
পুলিশ অফিসারগুলো পরস্পরের মুখের দিকে তাকালো। একজন অফিসার আরেকজনের কানে ফিসফিসিয়ে বললো, আমাদের অত কোমল হলে চলবে কেন স্যার, শুনলে কিউ. খান সাহেব বরখাস্ত করে দেবেন আমাদের। কিন্তু কেউ সাহস করলো না এগুতে। মেডিকেলে মেয়েদের হোস্টেলের বাঁ দিককার রুমটায় তিন-চারজন মেয়েকে নিয়ে বসে আলাপ করছিলো সালমা। বাইরে বারান্দায় বসে তখন কয়েকটি মেয়ে গান গাইছিলো, ওদের ভুলিতে পারি না, ভুলি নাই রে- একটু আগে কালো পতাকা তুলেছে ওরা। এখনো সেই পতাকা তোলার বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলো। এমন সময়, হঠাৎ একটা বিরাট শব্দে চমকে উঠলো সালমা। বারান্দা থেকে একটি মেয়ে চিৎকার করে বললো, পুলিশ। কোথায়? সালমা ছিটকে বেরিয়ে এলো বারান্দায়। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দেখালো ওই দেখো। সালমা চেয়ে দেখলো পুলিশ বটে। ছাত্রদের ব্যারাক ঘেরাও করেছে ওরা। সামনে দাড়িয়ে কিউ, খান নিজে। রাতে বড় কর্তার পাল্লায় পড়ে মাত্রাতিরিক্ত টেনেছে। তার আমেজ এখনো যায় নি। মাথাটা এখনো ভার ভার লাগছে। চোখজোড়া জবা ফুলের মত লাল টকটকে। মেডিকেল ব্যারাকের গেটটা পেরুতে কালো কাপড় দিয়ে ঘেরা শহীদ বেদীটা চোখে পড়লে কিউ, খানের। লাল চোখে আগুন ঠিকরে বেরুলো তার। আধধ আলো-অন্ধকারে শহীদ বেদীটার দিকে তাকালে গাটা ছমছম করে ওঠে। আলকাতরার মত কালো কাপড়টা অন্ধকারকে যেন বিভীষিকাময় করে তুলেছে। আর তার ওপর যত্নে সাজিয়ে রাখা অসংখ্য ফুলের মালা হিংস্র পশুর চোখের মত জ্বলছে ধিকিধিকি করে। কিউ. খানের ঈশারা পেয়ে একদল পুলিশ অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লে শহীদ বেদীটার ওপর। কঞ্চির ঘেরাটা দুহাতে উপরে অদূরে নর্দমার দিকে ছুঁড়ে মারতে লাগলো তারা। কালো কাপড়টা টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলো একপাশে। ফুলগুলো পিষে ফেললো বুটের তলায়। হঠাৎ একটা রক্ত গোলাপ মারাতে গিয়ে কিউ, খানের মনে পড়লো, যৌবনে একটি মেয়েকে এমনি একটি ফুল দিয়ে প্রেম নিবেদন করেছিলো সে। এক মুহূর্ত নীরব থেকে পিশাচের মত হেসে উঠলো কিউ, খান। হৃদয়ের কোমলতা তার মরে গেছে বহুদিন আগে। ছেলেরা ইতিমধ্যে ব্যারাক ছেড়ে বেড়িয়ে জমায়েত হয়েছে বাইরে। আর মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে স্লোগান দিচ্ছে উত্তেজিত গলায়। কারো গায়ে গেঞ্জি, কারো লুঙ্গি ছাড়া আর কিছুই নেই পরনে। কেউ কেউ গায়ে কম্বল চাপিয়ে বেরিয়ে পড়েছে বাইরে। সকলে উত্তেজিত। ক্রোধে আর ঘৃণায় হাত-পাগুলো ছিলো। যেন পুলিশগুলোকে হাতের মুঠোয় পেলে এক্ষুণি পিষে ফেলবে ওরা। হঠাৎ কিউ. খানের বন্য গলায় আওয়াজ শোনা গেলো চার্জ। মুহূর্তে পুলিশগুলো ঝাঁপিয়ে পড়লো ছাত্রদের উপর। ওসমান খান সীমান্তের ছেলে। ভয় কাকে বলে জানে না সে। ছাত্রদের বেপরোয়া মারতে দেখে সে আর স্থির থাকতে পারলো না। বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে পুলিশের মাঝখানে। ইয়ে সব কায় হোতা হ্যায়, হামলোগ ইনসান নাহি হ্যায়? দুজন পুলিশকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো ওসমান খান। ছেলেরা সব পালাচ্ছিলো, ওসমান খান চিৎকার করে ডাকলো ওদের, আরে ভাগতা হায় কিউ। ক্যায়া হামলোগ ইনসান নাহি হ্যায়? কিন্তু পরক্ষণে একজন লালমুখে ইন্সপেক্টর ছুটে এসে গলাটা টিপে ধরলো তার। তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দিলো ওসমান খানের মুখের ওপরে। প্রথম কয়েকটা ঘুষি কোন রকমে সয়ে নিয়েছিলো সে। তারপর হুঁশ হারিয়ে টলে পড়লো মাটিতে। রশীদ চৌধুরী এতক্ষণ লেপের তলায় ঘুমোচ্ছিলো। এসব হট্টগোল আর স্লোগান দেয়া ওর ভাল লাগে না। যারা এসব করে তাদের দুচোখে দেখতে পারে না সে ও জানে শুধু দুটো কাজ। এক হলো সিনেমা দেখা আর দুই হলো সারারাত জেগে ফ্লাশ খেলা। এ দুটো নিয়ে মশগুল থাকে সে। বাইরে হট্টগোল শুনে ব্যাপার কি দেখার জন্যে দরজা দিয়ে উঁকি মারছিলো সে। অমনি একটা পুলিশ হাতের ব্যাট দিয়ে তো মারলো ওর মুখের ওপর। অস্ফুট আর্তনাদ করে দরজাটা বন্ধ করে দিতে চাইছিলো রশীদ চৌধুরী। ধাক্কা মেরে দরজাটা খুলেই পুলিশটা ওর গেঞ্জি চেপে ধরলো। ভাগতে হে কাঁহা, চালিয়ে। রশীদ চৌধুরী বলির পাঠার মত কাঁপতে লাগলো, আমি কিছু করি নি। আরে-আরে এ কি হচ্ছে? খামোস–ভয়ঙ্কর স্বরে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো পুলিশটা। রশীদ চৌধুরী আবার তাকে বোঝাতে চাইলে যে, সে নির্দোষ। আমি কিছু করি নি, কসম খোদার বলছি। কিন্তু এতে কোন ফল লাভ হলো না দেখে এবার রীতিমত গরম হয়ে উঠলো রশীদ চৌধুরী। চিৎকার করে সে তার বন্ধুদের ডাকলো। ভাইসব- তারপর স্লোগান দিতে লাগলো উত্তেজিত গলায়। ভোরে আসার কথা ছিলো। আসতে বেলা হয়ে গেলো ওর। ছাইদানের ওপর রাখা সিগারেট থেকে শীর্ণ ধোঁয়ার রেখা সাপের মত এঁকেবেঁকে উঠে বাতাসে মিইয়ে যাচ্ছে। বিছানা শূন্য। কৌচেও কেউ বসে নেই। বাথরুমে ঝাঁপঝপ শব্দ হচ্ছে পানি পড়ার। বজলে চারপাশে তাকিয়ে টেবিলের ওপর থেকে একটি ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে ছবি দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর পানি পড়ার শব্দ বন্ধ হলে, তোয়ালে দিয়ে মাথার পানি মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো মাহমুদ। এই যে তুমি এসে গেছ, তাহলে। ও হেসে বললো, ওই পত্রিকার নিচে সিগারেটের প্যাকেট আছে নিয়ে একটা ধরাও। বজলে শুধালো,সাহানাকে দেখছি না, ও কোথায় গেলো? চুলে তেল মাখছিলো মাহমুদ, মুখ না ঘুরিয়েই বললো, আর বলো না, ওর সঙ্গে কাল রাতে একটা বিশ্রী রকমের ঝগড়া হয়ে গেছে আমার! হঠাৎ? না, ঠিক হঠাৎ নয়। কদিন থেকে সম্পর্কটা বড় ভালো যাচ্ছিলো না। ক্ষণিক বিরতি নিয়ে মাহমুদ আবার বললো,তুমিতো জান, ওর ব্যাপারে কোনদিন কোন কার্পণ্য করি নি আমি। যখন যা চেয়েছেদিয়েছি, কিন্তু কি জানো, মেয়েটা এক নম্বরের নিমকহারাম, বড় নির্লজ্জ, আর ওর
false
shordindu
বরং প্রতিহত করিয়াছে। বিশেষত সে ভট্ট নাগেশ্বরের মুখে চঞ্চরীর জন্মবৃত্তান্ত শুনিয়াছিল, দুবৃত্ত ম্লেচ্ছ রাজার জারজ কন্যা। ইহাতে তাহার মন আরও বিমুখ হইয়াছিল। ময়ূর চাপা তর্জন করিয়া বলিল—তুমি কেন আমার ঘরে এসেছিলে? চঞ্চরী উত্তর দিল না, আঁকিয়া-বাঁকিয়া ময়ূরের হাত ছাড়াইবার চেষ্টা করিল। সে কেন ময়ূরের ঘরে আসিয়াছিল নিজেই বোধ হয় জানে না; সে অনূঢ়া অনভিজ্ঞা, কেবল অন্ধ প্রকৃতির তাড়নায় ময়ূরের সংসর্গ কামনা করিয়াছিল। তাহার বুদ্ধি বেশি নাই, কিন্তু যৌবনের ক্ষুধা-তৃষ্ণা পূর্ণমাত্রায় দেখা দিয়াছে। ময়ূর বলিল—চল, তোমাকে রাজার কাছে নিয়ে যাই। এই সময় পিছন হইতে কণ্ঠস্বর আসিল—ময়ূরভদ্র! ময়ূর ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল অচ্ছাভ চাঁদের আলোয় দুটি নারীমূর্তি অদূরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। একজন রাজকন্যা সোমশুক্লা, অন্যজন দাসী সীমন্তিনী। ময়ূর চঞ্চরীর হাত ছাড়িয়া দিল, চঞ্চরী অধোমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। চঞ্চরী রাত্রে তাহার মাতার কক্ষে শয়ন করে। আজ রাত্রে সীমন্তিনী হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া দেখিল চঞ্চরী শয্যায় নাই। সে ছুটিয়া রাজকুমারীর কক্ষে গিয়াছিল, রাজকুমারীও জাগিয়া উঠিয়াছিলেন। কিন্তু চঞ্চরী সেখানে নাই। তখন দুইজনে চুপি চুপি চঞ্চরীকে খুঁজিতে বাহির হইয়াছিলেন। সীমন্তিনী অগ্রসর হইয়া আসিয়া চঞ্চরীর চুলের মুঠি ধরিল, অনুচ্চস্বরে ময়ূরকে বলিল—ভদ্র, এবার চঞ্চরীকে ক্ষমা করুন। ও আমার কন্যা। আমি ওকে শাসন করব। আর কখনো ও আপনাকে বিরক্ত করবে না। ময়ূর স্থির দৃষ্টিতে রাজকন্যার পানে চাহিয়া ছিল, সেইভাবে থাকিয়াই বিরসকণ্ঠে বলিল—ভাল। সীমন্তিনী চঞ্চরীর চুলের মুঠি ধরিয়া নির্মমভাবে টানিয়া লইয়া গেল। সোমশুক্লা দাঁড়াইয়া রহিলেন। ময়ূর মুখ তুলিয়া চাঁদের পানে চাহিল। চাঁদ হাসিতেছে, চারিদিকে শারদ রাত্রির স্নিগ্ধ শীতলতা। একটি গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া ময়ূর মুখ নামাইল, দেখিল কুমারী তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন, তাঁহার উন্নমিত মুখে বিচিত্র হাসি। তিনি লঘু স্বরে বলিলেন—ময়ূরভদ্র, আপনার জীবনে এরূপ অভিজ্ঞতা বোধ হয় নূতন নয়। ময়ূর চকিত হইয়া বলিল—না। আমার জীবনকথা আপনি জানেন? শুক্লা বলিলেন—ভট্ট নাগেশ্বরের মুখে শুনেছি। ময়ূর প্রশ্ন করিল—সব কথা শুনেছেন? আমি অজ্ঞাতকুলশীল তা জানেন? শুক্লা বলিলেন—জানি। আপনি স্ত্রীজাতির প্রতি বিরূপ, তাও জানি। ময়ূর ব্যস্ত স্বরে বলিল—বিরূপ নয় দেবি! আমি—আমি— স্ত্রীজাতিকে এড়িয়ে চলেন। তা চলুন, কিন্তু কাজটি সহজ নয়। কুমারীর কণ্ঠে অতি মৃদু হাসির মূৰ্ছনা উখিত হইয়াই মিলাইয়া গেল। তাঁহার দেহটিও যেন চন্দ্রকিরণে গলিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল। ময়ূর অনিমেষ চক্ষে চাহিয়া রহিল। পঞ্চমপুরের রাজসংসারে আশ্রয়লাভ করিবার পর ময়ূরের জীবনযাত্রায় একটি মন্দমন্থর ছন্দ আসিয়াছিল, দুই মাস পরে সেই ছন্দের যতিভঙ্গ হইল। রাজা ভূপ সিংহ তাহাকে নিভৃত কক্ষে আহ্বান করিয়া বলিলেন—উপবেশন কর। তোমার প্রকৃত কর্মের সময় উপস্থিত। ময়ূর রাজার সম্মুখে বসিল। ভূপ সিংহ কিয়ৎকাল গম্ভীর দৃষ্টিতে তাহার মুখের পানে চাহিয়া ধীরস্বরে বলিলেন—ময়ূর, গত দুই মাস ধরে আমি তোমাকে শিক্ষা দিয়েছি এবং তোমার গতিবিধি লক্ষ্য করেছি। আমার বিশ্বাস জন্মেছে, যে-কাজের ভার আমি তোমাকে দেব তা তুমি পারবে। ময়ূর জোড়হস্তে বলিল—আজ্ঞা করুন আর্য। রাজা বলিলেন—তোমাকে দিল্লী যেতে হবে। কিন্তু একা নয়, তোমার সঙ্গে একটি স্ত্রীলোক থাকবে। রাজা সপ্রশ্ন নেত্রে ময়ূরের পানে চাহিলেন, ময়ূর তিলমাত্র বিচলিত না হইয়া নিষ্পলকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল—তারপর আজ্ঞা করুন আর্য। রাজা সন্তোষের নিশ্বাস ফেলিলেন—দিল্লী এখান থেকে বহুদূর, পথও অতি দুর্গম। দিল্লী ফ্লেচ্ছ জাতির রাজধানী, সেখানকার ম্লেচ্ছগণ ঘোর দুবৃত্ত এবং দুর্নীতিপরায়ণ, সেখানে হিন্দুর জীবনের কোনো মূল্য নেই। তোমাকে এই শত্ৰুপুরীতে যেতে হবে একটি সুন্দরী নারীকে নিয়ে। তোমার দায়িত্ব কতখানি বুঝতে পারছ? পারছি মহারাজ। তারপর আদেশ করুন। তুমি যাকে নিয়ে যাবে তার নাম চঞ্চরী। তাকে বোধ হয় দেখেছ, সে সুন্দরী। কোনো বিশেষ কারণে আমি তাকে আলাউদ্দিনের কাছে উপঢৌকন পাঠাতে চাই। রাজা ক্ষণেকের জন্য নীরব হইলেন, ময়ূরও চুপ করিয়া রহিল; সে যে ভট্ট নাগেশ্বরের মুখে চঞ্চরীর জন্মবৃত্তান্ত শুনিয়াছে তাহার আভাসমাত্র দিল না। রাজা আবার আরম্ভ করিলেন—কেন আমি চঞ্চরীকে আলাউদ্দিনের কাছে পাঠাচ্ছি তা জানতে চেয়ো না, গূঢ় রাজনৈতিক কারণ কাছে। তুমি কেবল চঞ্চরীকে দিল্লীতে নিয়ে যাবে, সেখানে পৌঁছে চেষ্টা করবে চঞ্চরী যাতে আলাউদ্দিনের দৃষ্টিপথে পড়ে, সুন্দরী নারী দেখলেই সে তাকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে। তুমি প্রতিরোধ করবে না, আলাউদ্দিনকে মারবার চেষ্টা করবে না। তারপর সাতদিন অতীত হলে এই পত্রটি কোনো উপায়ে তার কাছে পৌঁছে দেবে। জতুমুদ্ৰানিবদ্ধ একটি ক্ষুদ্রাকৃতি পত্র তিনি ময়ূরের হাতে দিলেন। সে দেখিল রাজার কপালের শিরা-উপশিরা স্ফীত হইয়া উঠিয়াছে, চক্ষুৰ্ধয় রক্তাভ। কিন্তু তিনি ধীরভাবে বলিলেন—এই তোমার কাজ। তুমি অশ্বপৃষ্ঠে যাবে, চঞ্চরী দোলায় থাকবে। দশজন সশস্ত্র বাহক তোমাদের সঙ্গে থাকবে, তারা দোলা বহন করবে, যদি পথে দস্যু-তস্কর আক্রমণ করে তারা লড়াই করবে। দস্যু-তস্কর সুন্দরী স্ত্রীলোক দেখলে অপহরণের চেষ্টা করতে পারে, তুমি সর্বদা সতর্ক থাকবে। রাজা বক্তব্য শেষ করিলে ময়ূর জিজ্ঞাসা করিল—কবে যাত্রা করতে হবে? রাজা বলিলেন—কাল প্রত্যুষে। সমস্ত উদ্যোগ আয়োজন প্রস্তুত আছে। তুমি আমার আদেশ বর্ণে বর্ণে পালন করবে। ময়ূর শুধু বলিল—হাঁ মহারাজ। রাজা বলিলেন—বৎসরাবধি কাল আমি তোমার জন্য প্রতীক্ষ্ণ করব। যদি কার্যসিদ্ধি করে ফিরে আসতে পারো, তোমাকে অদেয় আমার কিছুই থাকবে না। আশীর্বাদ লও বৎস। সে-রাত্রে ময়ূর ঘুমাইতে পারিল না, শয্যায় শুইয়া আসন্ন যাত্রা সম্বন্ধে নানা কথা চিন্তা করিতে লাগিল। কি করিয়া কোন্ কার্য করিবে, বিপদে পড়িলে কিভাবে আচরণ করিবে, তাহার ধনুর্বিদ্যা কোন্ কাজে লাগিবে, এইসব চিন্তা। চঞ্চরীর ভাগ্যের কথা সে অধিক চিন্তা করিল না, চঞ্চরী এই চতুরঙ্গ খেলার ক্রীড়নক, অদৃষ্ট তাহাকে নিয়ন্ত্রিত পথে লইয়া যাইতেছে। ময়ূর নিমিত্ত মাত্র। এইসব ভাবনার মধ্যে রাত্রি তিন প্রহর কাটিয়া গেল। ঘরের
false
MZI
চট করে থেমে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু ঢাকা শহরের সব মানুষকে যেটি কোনো না কোনোভাবে কষ্ট দিয়েছে সেটি হলো যানজট। (মাত্র কিছুদিন আগে আমি অতিষ্ঠ হয়ে গাড়ি থেকে নেমে টানা চার ঘণ্টা হেঁটে যানজট থেকে বের হয়ে এসেছি।) আমি সিলেটে ক্যাম্পাসে থাকি আর মাত্র পাঁচ মিনিটে হেঁটে হেঁটে আমি ক্লাস নিতে হাজির হই। চারপাশে সবুজ গাছ, ধানক্ষেত, বাতাসে বিশুদ্ধ অক্সিজেন। কিন্তু আমাকে মাঝে মাঝে ঢাকা যেতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে হাজির হতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছি, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে কত সময় লাগতে পারে, আজকাল তার অনুমান করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো জায়গায় যেতে কয়েকঘন্টা সময় লেগে যায়। সময়ের অপচয়ে নিশ্চয়ই আর্থিক ক্ষতি হয়। ঢাকা শহরের সব মানুষের প্রতিদিন যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, কেউ যদি সেটা হিসেব করে তাহলে নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আমার ধারণা সেই টাকা বাঁচানো গেলে প্রতিমাসে একটা করে পদ্মা সেতু বানানো যেত! আজকাল আমার ঢাকা শহরে যেতে ভয় করে। ঢাকা শহরে পৌঁছে আমি আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই গভীর রাতে। যখন পথে-ঘাটে ভিড় কমে যায়। যানজট সমস্যার এটা কোনো সমাধান হতে পারে না। কিন্তু আমার ধারনা খুব সহজেই অন্য এক ধরনের সমাধান দেয়া যায়। সবার জন্যে না হলেও অনেকের জন্য, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্য। ২ কয়েক বছর আগে আমি যখন ডেনমার্কের রাজধানী কেপেনহেগেন গিয়েছি, তখন বিষয়টি প্রথমে আমার চোখে পড়েছে। সেই শহরে সবাই সাইকেলে যাতায়াত করতে পারে তার জন্য ব্যবস্থা করা আছে। ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ সবাই সাইকেলে যাচ্ছে আসছে। আর সাইক্লিস্টরা যেন নিরাপদে যেতে পারে সেজন্যে সব গাড়ি বাস-ট্রাক ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে আছে। হঠাৎ করে দেখলে কারো ধারণা হতে পারে যে, শহরের কিছু মানুষ বুঝি মজা করার জন্য সাইকেলে বের হয়েছে, একটু পরে সবাই বাড়ি পৌঁছে তাদের গাড়ি নিয়ে বের হবে। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। সেই দেশের অনেক মানুষের গাড়ি কেনার এবং গাড়ি চড়ার সামর্থ্য থাকার পরও তারা গাড়ি কেনে না, গাড়ী চালায় না। তারা সাইকেলে যাতায়াত করে। ডেনমার্ক যাওয়ার পর আমি সেটা আবিষ্কার করেছিলাম আমাদের কনভেনশনের সেক্রেটারি মেয়েটির কাছ থেকে। কমবয়সী হালকা ছিপছিপে মেয়ে কিন্তু সে নিজেই কথা প্রসঙ্গে আমাদের জানালো সে সন্তান সম্ভবা। আমি এর মাঝে জেনে গিয়েছি, সে সাইকেলে করে সব জায়গায় যাতায়াত করে। আমি তাকে বললাম- তার একটা শিশু সন্তান জন্ম নেওয়ার পর সে নিশ্চয়ই তার শিশুটিকে নিয়ে সাইকেলে যাতায়াত করতে পারবে না। কিন্তু মেয়েটি মাথা নেড়ে প্রবল বেগে আপত্তি করে আমাকে জানাল, তার শিশু সন্তান জন্ম নেওয়ার পরও সে সাইকেলে যাতায়াত করবে। বাচ্চাটিকে নেওয়ার জন্য সাইকেলের সঙ্গে একটা ক্যারিয়ার লাগিয়ে নেবে। শুধু তাই না, বাচ্চা ডেলিভারির জন্য সে হাসপাতালে যাবে সাইকেলে, বাচ্চা জন্মানোর পর তাকে বাসায় নিয়ে আসবে সাইকেলে! আমি ডেনমার্ক বিশেষজ্ঞ নই, তাই এই মেয়েটিই সেই দেশের স্বাভাবিক চিত্র নাকি ব্যতিক্রম আমি সেটা জানি না। শুধু এটুকু বলতে পারি, ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে একজন মেয়ে তার শিশু সন্তানের জন্ম, বাসায় শিশুটিকে নিয়ে আসা, শহরে ঘুরাঘুরি সবকিছু পরিকল্পনা করতে পারে সাইকেল দিয়ে; সেই শহরটি শহরবাসীর জন্যে সেরকম ব্যবস্থা করে রেখেছে। সেই দেশের মানুষের গাড়ি কেনার ক্ষমতা থাকার পরও গাড়ি কেনে না! সাইকেল দিয়ে সেই শহরের মানুষ সব জায়গাতে যাতায়াত করতে পারে। তাহলে আমাদের ঢাকা শহরে কেন সেটা হতে পারে না? আমি এখানে অনেক ছাত্রকে জানি যারা এখনই ঢাকা শহরে সাইকেল দিয়ে যাতায়াত করার চেষ্টা করে। যেহেতু শহরটিকে সাইকেলে চলাচল করার উপযোগী করে রাখা হয়নি, তাই তাদের অনেকেই নানা রকম এক্সিডেন্ট করে অল্পবিস্তর কষ্ট করেছে। যদি ঢাকা শহরে গাড়ি-বাস-ট্রাক-টেম্পুর পাশাপাশি মূল রাস্তাগুলো দিয়ে সমানভাবে সাইকেলও যেতে পারত, আমার ধারণা তাহলে যানজটের বিরাট একটা অংশ রাতারাতি নিয়ন্ত্রণে আসত। এজন্য হাজার কোটি টাকা খরচ করে ফ্লাইওভার তৈরি করতে হবে না, শুধু রাস্তার পাশে কংক্রিটের ডিভাইডার ফেলে সাইকেল যাওয়ার জন্য সরু একটা রাস্তা করে দিতে হবে। নিয়ম করে দিতে হবে রাস্তার সেই অংশ দিয়ে কেবল সাইকেল যাবে, অন্য কিছু নয়। আমার ধারণা তরুণ প্রজন্ম এটি লুফে নেবে। যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে না থেকে তারা সাইকেল চালিয়ে চোখের পলকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা চলে যাবে। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন আমি সাইকেল করে আসতাম। ঢাকার রাস্তায় তখন গাড়ি-বাস-ট্রাক অনেক কম ছিল। আমি তাদের ফাঁক দিয়ে সাইকেল চালিয়ে কলেজগেট থেকে নিয়মিতভাবে কার্জন হলে যাওয়া আসা করতাম। চল্লিশ বছর আগে আমি বড় বড় রাস্তায় যেটা করতে পেরেছি, এখন সেটি আর সম্ভব নয়। কিন্তু সাইকেলের জন্যে আলাদা লেন করে দিলে অবশ্যই সেটা সম্ভব। কাজেই আমি সরকারের কাছে এই অনুরোধটা করতে চাই, ঢাকা শহরের সব বড় রাস্তার দুই পাশে সাইকেলের আলাদা লেন করে দেয়া হোক। পৃথিবীর অন্য সব দেশে যেভাবে সাইকেলে করে মানুষ যাতায়াত করে রাস্তাঘাটের উপর থেকে চাপ কমিয়ে এনেছে, আমাদের ঢাকা শহরেও সেটা করা হোক। এর জন্য সরকারের সত্যিকার অর্থে কোনো বাজেট লাগবে না। কিন্তু যদি করে দেওয়া হয়, তাহলে মানুষের যে সময় বাঁচবে, তার আর্থিক মূল নিশ্চয়ই মোটেও হেলাফেলার বিষয় নয়। আমি মনে মনে কল্পনা করতে পারি- ঢাকা শহরের রাস্তার
false
toslima_nasrin
করল না। এখনও কি আর বিপদ কেটে গেছে? বাড়ির সবার নির্লিপ্তি দেখে মায়াও অনেকটা নির্লিপ্ত হয়ে গেছে। সেও ভাবতে চাচ্ছে যা হয় হোক আমার কী। সুরঞ্জনই যদি না ভাবে মায়া একা ভেবে কী করবে!! তার তো এমন কোনও বন্ধু নেই। যেখানে সবাই মিলে উঠতে পারে। পারুলের বাড়িতেই তার অস্বত্তি হচ্ছিল। এমনিতে পারুল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন, দিন রাত ওবাড়িতে কেটেছে তার আড্ডা দিয়ে, কেউ কখনও প্রশ্ন করেনি ও কেন এসেছে। কিন্তু সেদিন, মায়া এত চেনা ওবাড়িতে, তবু ওরা অচেনা চোখে তাকাল তার দিকে, এত যায় সে ওবাড়িতে, তবু চোখে চোখে প্রশ্ন ছিল কেন এসেছে। পারুল অবশ্য বারবারই বলেছে-এ সময় ওর বাড়িতে থাকা নিরাপদ না। নিরাপদ অনিরাপদের কথা কেবল মায়াকে নিয়ে ওঠে, কই পারুলকে নিয়ে তো ওঠে। না! পারুলকে কি কখনও বাড়ি ছেড়ে মায়ার বাড়িতে উঠতে হবে? মায়া কুষ্ঠিত হয়, কুঞ্চিত হয়, তবু বেঁচে থাকবার প্রয়োজনে সে পারুলের বাড়িতেই অবাঞ্ছিত অতিথির মত পড়ে থেকেছে। পারুল আতিথেয়তা কম করেনি তবু তার আত্মীয়রা বেড়াতে এসে অনেকেই যখন জিজ্ঞেস করেছে–কী নাম তোমার? —মায়া। -পুরো নাম কি? পারুল মায়াকে পুরো নাম বলতে না দিয়ে নিজে বলেছে–ওর নাম জাকিয়া সুলতানা। মায়া চমকেছে নাম শুনে। পরে আত্মীয়রা বিদেয় হলে পারুল বলেছে—তোর নাম মিথ্যে বলতে হল, কারণ এরা আবার অন্যরকম, মুন্সি টাইপের। বলে বেড়াবে আমরা হিন্দুদের শেল্টার দিচ্ছি। –ও। মায়া বুঝেছে। কিন্তু মনে খুব কষ্ট হয়েছে তার। হিন্দুকে শেল্টার দেওয়া বুঝি অন্যায় কাজ? আর আরেকটি প্রশ্নও তাকে প্রায় রাতেই ঘুমোতে দেয়নি যে হিন্দুকে কেন শেল্টার দিতে হয়? মায়া ইন্টারমিডিয়েট স্টার পাওয়া মেয়ে, আর পারুল সাধারণ দ্বিতীয় বিভাগ। তবু প্রায়ই মনে হয় পারুল বুঝি তাকে করুণা করছে। –বাবা, আঙুলগুলোকে মুঠি কর তো। হাত একটু ভুলতে চেষ্টা করে তো। মায়ার কথা লক্ষ্মী ছেলের মত শোনেন সুধাময়। মায়ার মনে হয় একটু একটু জোর ফিরছে। সুধাময়ের আঙুলে। –দাদা কি খাবে না? —কি জানি, ঘুমোচ্ছে দেখলাম। কিরণময়ী বিরস মুখে বলেন। কিরণময়ী নিজে খান না। মায়ার জন্য ভাত বেড়ে রাখেন। দরজা জানোলা বন্ধ করা ঘর, আঁধার আঁধার লাগে। মায়ারও ঘুম ঘুম লাগে। হঠাৎ আধা-স্কুমেই চমকে ওঠে মিছিলের শব্দ শুনে। মিছিল যায়-হিন্দু যদি বাঁচতে চাও, এ দেশ ছেড়ে চলে যাও। ‘ সুধাময়ও শোনেন, মায়ার হাতে ধরা ছিল সুধাময়ের হাত, হাতটি তার কেঁপে ওঠে, সে টের পায়। ৪ঘ. সুরঞ্জনের পেট মোচড় দিয়ে ওঠে ক্ষিদেয়। আগে তো খাক না খাক টেবিলে তার ভাত বাড়া থাকত। সে আজ কারও কাছেই বলবে না ক্ষিদের কথা। পাকা উঠোনের কলতলায় গিয়ে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে তারে ঝোলানো তোয়ালে দিয়ে মুখ মেছে। ঘরে এসে শার্ট পাল্টে বেরিয়ে যায় বাইরে। বাইরে যে বেরোয় সে ভেবে পায় না যাবে কোথায়? হায়দারের বাড়িতে? হায়দারের তো এ সময় বাড়ি থাকবার কথা নয়। তবে কি বেলাল, কামাল কারও বাড়িতে? সুরঞ্জন এদের বাড়িতে গেলে ওরা যদি ভাবে বিপদে পড়েছে বলে এসেছে আশ্রয় বা অনুকম্প চাইতে? না সুরঞ্জন যাবে না। সে সারা শহর ঘুরে বেড়াবে একা একা। শহরটি তো তার নিজেরই। একসময় সে ময়মনসিংহ ছেড়ে আসতে চায়নি, আনন্দমোহনে বন্ধুবান্ধব ছিল প্রচুর, ওদের ছেড়ে হঠাৎ করে নতুন একটি শহরে কেন আসতে চাইবে সে। কিন্তু কোনও এক গভীর রাতে রইসউদ্দিনের কাছে বাড়ি যখন বিক্রি করে এলেন সুধাময়, তার পরদিন ভোরে সুরঞ্জন জানত না তার জন্মের এই বাড়িটি, কামিনী ফুলের গন্ধ ভরা, স্বচ্ছ পুকুরে সাঁতার কাটা দত্ত বাড়িটি আর তাদের নেই। সুরঞ্জন যখন শুনল এ বাড়ি তাদের ছেড়ে দিতে হবে সাত দিনের মধ্যে, অভিমানে সে বাড়িই ফেরেনি দুদিন। সুরঞ্জন বুঝে পায় না। এত অভিমান কেন তার। বাড়ির সবার ওপর তা ছাড়া নিজের ওপরও মাঝে মধ্যেই তার তীব্র অভিমান হয়। পারভিনের ওপরও অভিমান হত তার। মেয়েটি তাকে ভালবাসত, লুকিয়ে চলে আসত তার ঘরে, বলত–চল পালাই। –পালিয়ে যাবে কোথায়? —দুরে কোনও পাহাড়ের কাছে। —পাহাড় পাবে কোথায়? পাহাড় পেতে হলে সিলেট নয় চট্টগ্রাম যেতে হয়। –তাই যাব। পাহাড়ের ওপর ঘর বানিয়ে থাকব। —খাবে কি? লতাপাতা? পারভিন হেসে গড়িয়ে পড়ত সুরঞ্জনের গায়ে। বলত—তোমাকে ছাড়া আমি মরেই যাব। –এরকম কথা মেয়েরা বলে, আসলে কিন্তু মরে না। ঠিকই তো বলেছিল সুরঞ্জন। পারভিন মরেনি। বরং বাধ্য মেয়ের মত বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল। বিয়ের দুদিন আগে জানিয়েছিল, বাড়িতে বলছে তোমাকে মুসলমান হতে হবে। সুরঞ্জন হেসে বলেছিল–আমি নিজে ধর্ম টর্ম মানি না। সে তো তুমি জানোই। —না তোমাকে মুসলমান হতে হবে। —আমি মুসলমান হতে চাই না। –তার মানে তুমি আমাকে চাও না? –নিশ্চয়ই চাই। কিন্তু সেজন্য আমাকে মুসলমান হতে হবে এ কেমন কথা? পারভিনের ফর্সা মুখ মুহুর্তে লাল হয়ে উঠেছিল অপমানে। সুরঞ্জন জানত তাকে ত্যাগ করবার জন্য পরিবার থেকে পারভিনের ওপর চাপ আসছে। তার খুব জানতে ইচ্ছে করে হায়দার তখন কোন পক্ষে ছিল। হায়দার পারভিনের ভাই, এদিকে আবার সুরঞ্জনের বন্ধু। সে সব সময় নীরব থেকেছে৷ তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে। নীরব থাকাটা সুরঞ্জনের তখন একদমই পছন্দ ছিল না। যে কোনও একটি পক্ষ তো নেওয়া উচিত। হায়দারের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডাগু হত তখন, পারভিন প্রসঙ্গে কোনও কথা হত না। হায়দার যেহেতু প্রসঙ্গ তুলত না, সুরঞ্জনও তুলত না। পারভিনের একদিন বিয়ে হয়ে গেল এক মুসলমান ব্যবসায়ীর সঙ্গে।
false
shomresh
জয়িতা গোল হয়ে বসে তাস খেলছে। জয়িতাই বলল, ওই যে, এসে গেছে! উঃ, কি চিন্তা হচ্ছিল। চুপ কর। মা-মা ভাব করিস না। ওই বস্তুটি আবার আমদানি করলি কেন? সময় কাটানোর পক্ষে দারুণ জিনিস। তুই শালা নাইনটিন সেঞ্চুরির বিধবা। সিগারেট খাস না, মদ তো প্রশ্নই ওঠে না, কোন মেয়ের সঙ্গে আজ পর্যন্ত প্রেম করলি না, আবার তাসেও অ্যালার্জি! সুদীপ নাটক করে কথাগুলো বলছিল। কল্যাণ এক হাতে তাস খেলছিল। সেটা অবশ্যই মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। আনন্দ বলল, কি ব্যাপার, খুব ফুর্তিতে আছিস মনে হচ্ছে! তাস নামিয়ে রেখে সুদীপ বলল, দারুণ রি-অ্যাকশন। রেসকোর্সের সামনে গিয়ে দেখি গেটের বাইরে পাবলিক দাঁড়িয়ে আছে। এখানে ওখানে ভিড়। কিন্তু কেউ ঢুকছে না। ওপাশে যে মেম্বার্স এনক্লোজারটার সামনে গাড়ির লাইন লাগতো সেখানটা আবও ফাঁকা। আমি একদম নেকু সেজে একটা রেসের বই বিক্রি করা ছোকরাকে কি ব্যাপার জিজ্ঞাসা করতে সে বলল রেসকোর্সে নাকি বোমা পড়বে সেই ভয়ে কেউ ঢুকছে না। পাবলিকের প্যানিক যদি দেখতিস: শেষ পর্যন্ত ভেতর থেকে অ্যানাউন্স করল অনিবার্য কারণে আজ রেস বন্ধ থাকল। পুলিশে পুলিশে রেসকোর্স ভরতি ছিল। হেস্টিংসের স্টেবল থেকে ঘোড়াগুলো নাকি মালিকেরা আনতে চায়নি। এক একটা ঘোড়ার দাম নাকি লাখ দু লাখ। হেভি লস হয়ে গেল গভর্নমেন্টের। তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে পার্ক স্ট্রীটে চলে গেলাম। একটা পাবলিক টেলিফোনে সবকটা কাগজকে যা তুই বলেছিল তাই বলেছি। লোকগুলো প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি। বলেছে, আপনি যে ওদের দলে তার প্রমাণ দিন। সুদীপ হাসতে লাগল। খবরটা খুব পছন্দ হল কল্যাণের। সে আনন্দকে বলল, ব্যাপারটা বেশ, না? ধর, তোর কাছে কাগজপত্র নেই। কিছু লোক তোকে ধরে পরিচয় চাইল। তুই বললি। তারা প্রমাণ দেখাতে বলল। কোন প্রমাণ নেই। তোর পরিচয় সঠিক কিনা সেটা প্রমাণ করবে তোর পারিপার্শ্বিক। তোর আত্মীয় বন্ধু স্কুল কলেজ। কিন্তু তুই না। আনন্দ কোন জবাব দিল না। তার ভাল লাগছিল। সে এই রকমটাই হবে ভেবেছিল। কাগজে ওই হুমকির খবরটা পড়ে লোকে ভয় পাবে। তারা নিজেদের প্রাণের মায়ায় আজ রেসকোর্সে যাবে না। কিন্তু সেটা আজ অথবা পরের দিন। কিন্তু কোন দুর্ঘটনা না ঘটলে আবার পিলপিল করে টুকবে তারা। কিন্তু মেম্বার্স এনক্লোজার, সুদীপ যা বলছে, অমন ফাঁকা হবে সে আশা করেনি। তাহলে কলকাতার উচ্চবিত্তরাই বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছে? কিছু একটা করা দরকার। হুমকিটা যে অহেতুক নয় এটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। আজ যে লোকটা সংসারকে বঞ্চিত করে রেস খেলতে টাকা নিয়ে এসেছিল সে নিশ্চয়ই হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে তার কিছু টাকা সংসারের পেছনে খরচ করেছে। কিন্তু এইটুকু তো তাদের পরিকল্পনায় ছিল না। জয়িতা আনন্দকে লক্ষ্য করছিল। জিজ্ঞাসা করল, তোর কি খবর? আনন্দ ওদের বিশদ বলল। একটা কাগজে যতটা সম্ভব জায়গাটা এঁকে দেখাল সে। তারপর বলল, নানুভাই লোকটার হাতের পুতুল হল এই মন্ত্রী। দেখলে মনে হবে আচরণে রবিনহুড, চেহারায় গব্বর সিং। কিন্তু ওকে প্রচণ্ড ভয় পায় এলাকার লোক। মানুষ যার কাছে উপকার পায় তাকে ভয় করে না। তাছাড়া ওখানে নানুভাই-এর চর ছড়ানো রয়েছে। একা একা বস্তির ভেতরে ঢোকা বেশ বিপজ্জনক হবে। অতএব নানুভাই-এর মুখোশটার নিচে যে মুখটা রয়েছে তা বীভৎস হতেই হবে। আমি সাহস পাইনি বেশি ঘাঁটানোর। ওখানে যদি আমাকে পুঁতেও রাখতো তাহলে পৃথিবীর কেউ টের পেত না। আমি ভয় পেয়েছিলাম, হয়তো নানুভাই আমার কাছে রিপোর্টারের আইডেন্টিটি কার্ড চাইবে। কিন্তু লোকটার অশিক্ষা এবং রিপোর্টার শব্দটা শোনার পরে এমন কিছু প্রতিক্রিয়া হয়েছিল যার জন্যে ওটা ওর মাথায় আসেনি। ওই এলাকায় পুরো স্মাগলিং-চেনটা কন্ট্রোল করে নানুভাই। শুধু বাংলাদেশ থেকে নয়, পাকিস্তান থেকেও এখানে লোক আসছে বলে আমার ধারণা। একবার এলাকায় ঢুকে পড়লে রেশন কার্ড এমন কি ভোটিং রাইট পর্যন্ত পেতে অসুবিধে নেই। এম এল এ, মন্ত্রী হাতের মুঠোয়। তাদের নির্বাচন নানুভাই দেখাশোনা করে। অদ্ভুত জোট। লোকটা দাঙ্গা তৈরি করতে পারে প্রয়োজন হলে। আর পুলিশের সঙ্গে ওর সম্পর্কের চেহারা তো আসবার সময় দেখলাম। সুতরাং আমার মনে হয় আগামী পরশু আমাদের যাওয়া উচিত। কল্যাণ চট করে বলে বসল, এত তাড়াতাড়ি? সুদীপ বলল, মানে? এখানে অনন্তকাল বসে থাকতে তোর ভাল লাগছে। আমি তবু মাঝে মাঝে বেরুচ্ছি, তোদের তো দম বন্ধ হবার কথা। পুলিশের ভয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কোন মানে হয় না। তাছাড়া এই লোকটাকে মিট করতে খুব ইচ্ছে করছে। জয়িতা বলল, মিনিস্টারটার কথা ভাব। খবরের কাগজ খুললেই ওর জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেখা যাবে। ওর দলের লোকেরাই ওকে বলেছে বেশি কথা না বলতে। অথচ এই লোকটাই! আনন্দ বলল, আমাকে একটু ভাবতে দে কিভাবে এগোবো। লোকটা হঠাৎ আমাকে মন্ত্রীর বাড়িতে যেতে বলল। এটা কোন ট্রাপ কিনা কে জানে। আমাকে দেখে ওর কোন সন্দেহ হয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না। তবে খবরের কাগজের ছবির সঙ্গে মেলাতে পারেনি। পারলে আমাকে ছাড়তো না। ওহো, উনি আমাদের খেতে ডেকেছেন। আজ ওপরে খাওয়া চলবে না। তোরা রুটি মাংস খেয়ে নে। সুদীপ চল, নিচে যাই, ওকে ছেড়ে দেওয়া উচিত। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তুই রুটি মাংস এনেছিস? ফার্স্ট ক্লাস! সুদীপ উঠল, বেশ আছিস! আমরা খাচ্ছি নিরামিষ আর তোরা মাংস সাঁটাচ্ছিস! কিছু মাল রেখে দিবি, আমি এসে খাব। চল আনন্দ। বৃদ্ধা সামনে বসে ওদের খাওয়ালেন। আনন্দর খুব ভাল লাগছিল। মাটিতে বসে খেতে খেতে সে দেখছিল বৃদ্ধা সামনে বসে ওদের
false
humayun_ahmed
কর্নেল তাহের। এই দুজনই মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্যে ‘বীর উত্তম’ খেতাবধারী। বলা হয়ে থাকে, জেনারেল মঞ্জুর তার রূপবতী স্ত্রী দ্বারা পরিচালিত ছিলেন। এই স্ত্রী মঞ্জুরের শেষ দিন পর্যন্ত তার সঙ্গী ছিলেন। সেনা অভ্যুত্থান ঘটানো এবং জিয়া হত্যার পেছনে প্রলয়ংকরী স্ত্রী বুদ্ধি কাজ করে থাকতে পারে। গ্রন্থপঞ্জি ১. বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা : প্রাথমিক তথ্যবিবরণী থেকে চূড়ান্ত রায়, স্বপন দাশগুপ্ত সম্পাদিত, মাওলা ব্রাদার্স। ২. বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, অ্যাডভোকেট সাহিদা বেগম, তাম্রলিপি। ৩. বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ফ্যাক্টস এণ্ড ডকুমেন্টস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ; চারুলিপি। ৪. বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচারের ইতিহাস, ড, মোহাম্মদ হাননান, আগামী প্রকাশনী। ৫. রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫, নির্মলেন্দু গুণ, বিভাস প্রকাশনা। ৬. উত্তরাধিকার, শ্রাবণ সংখ্যা ১৪১৭, বাংলা একাডেমী। ৭. , . . , , ৮. : , , , . ৯. : , , , . ১০. ক্রাচের কর্নেল, শাহাদুজ্জামান, মাওলা ব্রাদার্স। ১১. বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, অ্যান্থনি মাসকারেনহাস; হাক্কানী পাবলিশার্স। ১২. অসমাপ্ত বিপ্লব : তাহেরের শেষ কথা, লরেন্স লিফসুলৎস; নওরোজ কিতাবিস্তান। ১৩. পঁচাত্তরের রক্তক্ষরণ, মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম; আফসার ব্রাদার্স। ১৪. বাংলাদেশের রাজনীতি : ১৯৭২-৭৫, হালিম দাদ খান; আগামী প্রকাশনী। ১৫. ১৫ই আগস্ট-মমদ মৃত্যুচিন্তা, সম্পাদনা : আহমেদ ফিরোজ; মিজান পাবলিশার্স। ১৬. মুক্তিযুদ্ধের দলিল লণ্ডভণ্ড এবং অতঃপর, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, সুচীপত্র। ১৭. বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১, ব্রি. জে. এম সাখাওয়াত হোসেন, পালক প্রকাশনী। ১৮. এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য স্বাধীনতার প্রথম দশক, মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম, মাওলা ব্রাদার্স। ১৯. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীরবিক্রম, সাহিত্যপ্রকাশ। ২০. মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর একটি নির্দলীয় ইতিহাস, গোলাম মুরশিদ, প্রথমা। ২১. শতাব্দী পেরিয়ে, হায়দার আকবর খান রনো; তরফদার প্রকাশনী। ২২. সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা : ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১, আনোয়ার কবির, সাহিত্যপ্রকাশ। ২৩. তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে. কর্নেল এম. এ. হামিদ; মোহনা প্রকাশনী। ২৪. মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন, প্রথমা। ২৫. স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর, কামরুদ্দীন আহমদ, আগামী প্রকাশনী। ২৬. ফাঁসির মঞ্চে তেরোজন মুক্তিযোদ্ধা, আনোয়ার কবীর, মাওলা ব্রাদার্স। ২৭. বাংলাদেশের রাজনীতির চার দশক, সম্পাদনা : তারেক শামসুর রহমান, শোভা প্রকাশ। ২৮. মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের, ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন, আগামী প্রকাশনী। ২৯. তাহেরের স্বপ্ন, ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন, মাওলা ব্রাদার্স। ৩০. জিয়া হত্যা : নেপথ্যে কারা, কাউসার ইকবাল, বিদ্যাপ্রকাশ। আকাশে মেঘ করেছে। ঘন কালো মেঘ। ক্রমেই ফুলে ফোঁপে উঠছে। ওসমান সাহেব আকাশের দিকে তাকালেন। তার কেন জানি মনে হল এই মেঘে বৃষ্টি হবে না। প্রিকগনিশন নাকি? ভবিষ্যতের কথা আগে ভাগে বলে ফেলা। তিনি হাঁটছেন অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে। উদ্দেশ্যহীন মানুষের হাঁটা। গন্তব্যহীন যাত্ৰা। অথচ তার একটি গন্তব্য আছে। বি.ডি.আর-এর তিন নম্বর গেট পার হয়ে তিনি ঢুকে যাবেন নিউ পল্টন লাইনের গলিতে। গোরস্থানের দেয়াল ঘেঁষে এগুতে থাকেন। স্নামালিকুম। ওসমান সাহেব চমকে তাকালেন। সালামটা কী তাকেই দেয়া হয়েছে? দু-একজন কী চিনতে শুরু করেছে? চেনার কথা নয়। তিনি মাসের দুবারের বেশি আসেন না। এদিকে। সালাম দেয়া ছেলেটির বয়স অল্প। চোখে চশমা। সে তাকাচ্ছে কৌতূহলী হয়ে। ওসমান সাহেব প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন। এবং মৃদু স্বরে বললেন–ভাল তো? আপনি কী এই পাড়াতে থাকেন? না। তবে মাঝে মাঝে আসি। আমি আগেও একবার দেখেছি। তখন চিনতে পারিনি। তিনি মৃদু হেসে হাঁটতে শুরু করলেন। পেছন না ফিরেও বুঝতে পারছেন ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে। তার হয়ত আরও কিছু কথা বলবার ছিল। ওসমান সাহেব ঘড়ি দেখলেন–পাঁচটা দশ। তিনি সব সময় চারটার মধ্যে এসে পড়েন। আজ অনেকখানি দেরি করলেন। তার চরিত্রের সঙ্গে এটা খাপ খায় না। রানুকে পাওয়া যাবে কী? দেরি দেখে কোথাও চলে যায়নি তো? রানুরা থাকে তিন তলার শেষ মাথায়। ছোট্ট এক চিলতে বারান্দা আছে তাদের। সে সেখানে দু’টি টবে মরিচ গাছ লাগিয়েছে। গোলাপ-টোলাপ না লাগিয়ে মরিচ গাছ লাগানোটা উদ্দেশ্যমূলক। উদ্দেশ্যটা কী? তিনি বারান্দায় কাউকে দেখলেন না। সাধারণত টগর রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা কী নেই আজ? টগরের জন্যে এক প্যাকেট মিমি-এনেছেন। তিনি মিমির প্যাকেট হাতে নিয়ে নিলেন। আজ যেন গতবারের মত না হয়। গতবার পেয়ারা নিয়ে গিয়েছিলেন মনের ভুলে দেয়া হয়নি। ওরা কী সত্যি সত্যি নেই? সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তার মনে আশা ভঙ্গের বেদনা জাগতে লাগল। সিঁড়ি অন্ধকার। কে যেন জায়গায় জায়গায় পানি ফেলে রেখেছে। রানুকে বলতে হবে এ বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ভাল একটা জায়গায় বাড়ি নিতে। কলিং বেলে হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। যেন দরজার পাশেই রানু অপেক্ষা করছিল। ওসমান সাহেব মৃদু গলায় বললেন–একটু দেরি করে ফেললাম। রানু কিছু বলল না। টগর কী বাসায় নেই? না। কোথায় গিয়েছে? খালার বাসায় গেছে। এসে পড়বে। তিনি ইতস্তত করে বললেন–আমি কী ওর জন্যে অপেক্ষা করব? ইচ্ছা করলে কর। তিনি বসতে বসতে বললেন–তুমি ভাল আছ তো? রানু জবাব দিল না। ওসমান সাহেব বললেন–ঘরে কী মাথা ধরার টেবলেট আছে? রানু হ্যাঁ না কিছুই বলল না। পাশের ঘরে চলে গেল। তাঁর মনে হল রানু অনেক রোগা হয়ে গেছে। অসুখ-বিসুখ হয়েছে কী? রোগা হবার জন্যেই বোধ হয় তাকে উনিশ-কুড়ি বছরের তরুণীর মত লাগছে। তিনি মনে মনে রানুর বয়স হিসেব করতে চেষ্টা করলেন। বিয়ে হয়েছিল। ষোল বছর বয়সে। সেও তো পাঁচ বছর হল।
false
humayun_ahmed
তখন তিনি খুবই অবাক হলেন। আমি বললাম, ভাই রোগ আপনি কীভাবে সারান? রউফ মিয়া বললেন, রোগ ভক্ষণ করে ফেলি। কী করে ফেলেন? ভাই সাহেব, খেয়ে ফেলি। ভক্ষণ। আমি বললাম, কীভাবে খেয়ে ফেলেন? চেটে খেয়ে ফেলি। আমি বললাম, কীভাবে চেটে খান? ভালোমতো ব্যাখ্যা করুন। রউফ বললেন, রোগীর কপাল চেটে রোগ খেয়ে ফেলতে পারি। হাতের তালু, পায়ের তালু চেটেও খাওয়া যায়। ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে ঘাড় চেটে রোগ খাওয়া আমার জন্য সহজ। ও আচ্ছা। রউফ দুঃখিত গলায় বললেন, আপনি মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করেন নাই। অনেকেই করে না। বাংলাদেশে বিশ্বাসী লোক পাওয়া কঠিন। সবাই অবিশ্বাসী। আমার কাছে দুটা সার্টিফিকেট আছে, দেখতে পারেন। আমি ইচ্ছা! করলে ব্যাগভর্তি সাটিফিকেট রাখতে পারতাম। রাখি নাই। কারণ আমি সাটিফিকেটের কাঙালি না। আপনি কিসের কাঙালি? ভালোবাসার কাঙালী। যে যার কাঙালা হয়। সে সেই জিনিস পায় না। আপনি পান নাই? জি না। তবে আপনি ভালোবাসা দেখায়েছেন। আদর করে পাশে নিয়ে ভাত খেয়েছেন। নিজের হাতে প্লেটে তিন বার ভাত তুলে দিয়েছেন। ছোট মাছের সালুন দিয়েছেন দুই বার। সালুনের বাটিতে একটা বড় চাপিলা মাছ ছিল, সেটা আপনি নিজে না নিয়ে আমার পাতে তুলে দিয়েছেন। এমন ভালোবাসা আমারে কেউ দেখায় নাই। ভাই সাহেব, সার্টিফিকেট দুটা পড়লে খুশি হব। আমি সার্টিফিকেট দুটা পড়লাম। একটি দিয়েছেন নান্দিনা হাইস্কুলের অ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার। তিনি লিখেছেন– যার জন্য প্রযোজ্য এই মৰ্মে প্রত্যয়ন করা যাইতেছে যে, ব্যতিক্রমী চিকিৎসক মোঃ রউফ মিয়ার চিকিৎসায় নান্দিনা হাইস্কুলের দপ্তরি শ্রীরামের কন্যা সুধা সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করিয়াছে। সে দীর্ঘদিন জটিল জণ্ডিস রোগে আক্রান্ত ছিল। আমি মোঃ রউফ মিয়ার উন্নতি কামনা করি। সে রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয়। তাহার নৈতিক চরিত্র উত্তম। মোঃ আজিজুর রহমান খান সহকারী প্রধান শিক্ষক নান্দিনা হাইস্কুল দ্বিতীয় প্রশংসাপত্ৰটি উকিল আশরাফ আলি খাঁ দিয়েছেন। এই প্ৰশংসাপত্ৰটি ইংরেজিতে লেখা। . . . রউফ মিয়া বললেন, ইংরেজি লেখাটার জোর বেশি। কী বলেন ভাই সাহেব? আমি বললাম, হ্যাঁ। রউফ মিয়া বললেন, উকিল মানুষ তো! অনেক চিন্তাভাবনা করে লিখেছেন। আমি বললাম, আপনার খবর স্থানীয় কোনো কাগজে আসে নি। এই জাতীয় খবর তো লোকাল কাগজগুলি আগ্রহ করে ছাপায়। রউফ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, নেত্রকোনা বার্তায় একবার খবর উঠেছিল। পেপার কাটিং হারায়ে ফেলেছি। তবে হারায়ে লাভ হয়েছে। ওরা আমার নাম ভুল করে ছেপেছে। লিখেছে রুব মিয়া। রব আর রউফ কি এক? ফাজিল পুলাপান সাংবাদিক হয়ে বসেছে। আর লিখেছেও ভুল। লিখেছে রব মিয়া অন্যের রোগ খেয়ে জীবনধারণ করেন। তিনি কোনো খাদ্য গ্ৰহণ করেন না। খাদ্য গ্ৰহণ না করলে মানুষ বাঁচে? আমি বললাম, আপনি বিয়ে করেছেন? যৌবনকালে বিবাহ করেছিলাম। স্ত্রী মারা গোল কলেরায়। ছেলে একটা ছিল, নাম রেখেছিলাম রাজা মিয়া। সুন্দর চেহারা ছবি ছিল- এই জন্যে রাজা মিয়া নাম। ছেলেটা মারা গেল টাইফয়েডে। রোগ খাওয়া তখন জানতাম না। এইজন্যে চোখের সামনে মারা গেল। রোগ খাওয়া জানলে টাইফয়েড কোনো বিষয় না। চোটে ভক্ষণ করে ফেলতাম। রোগ খাওয়ার কৌশল কীভাবে শিখলেন? রউফ মিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমার ছেলে রাজা মিয়া আমারে শিখায়েছে। একদিন ভোর রাতে রাজা মিয়াকে স্বপ্নে দেখলাম। আমি বললাম, বাবা কেমন আছ? সে বলল, ভালো আছি। আমি বললাম, তোমার কি বেহেশতে নাসিব হয়েছে? সে বলল, জানি না। আমি বললাম, তোমার মা কই? তার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হয় না? সে বলল, না। তারপরেই সে আমারে রোগ খাওয়ার কৌশল শিখায়ে দিল। আমি স্বপ্নের মধ্যেই ছেলেকে কোলে নিয়া কিছুক্ষণ কাদলাম। ঘুম ভাঙার পর দেখি চউখের পানিতে বালিশ ভিজে গেছে। রউফ মিয়া চোখ মুছতে লাগলেন। একসময় বললেন, আপনার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছি। আপনি যদি চান রোগ খাওয়ার কৌশল শিখায়ে দিব। তবে আপনারা ভদ্রসমাজ। আপনারা পারবেন না। চট্টাচাটির বিষয় আছে। রউফ মিয়া দুদিন থেকে ভোলায় রোগী দেখতে গেলেন। ছয় মাস পর তার কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। এইবারের চিঠি ছাপানো না, হাতে লেখা। তিনি লিখেছেন– বিরাট আর্থিক সমস্যায় পতিত হইয়াছি। যদি সম্ভব হয় আমাকে দুইশত টাকা কৰ্জ দিবেন। আমি যত দ্রুত সম্ভব কর্জ পরিশোধ করিব। ইতি আপনার অনুগত রউফ মিয়া (র, ভ)। পুনশ্চতে লেখা- আমি নামের শেষে র, ভ টাইটেল নিজেই চিন্তা করিয়া বাহির করিয়াছি। র, ভ-র অর্থ রোগ ভক্ষক। আমি দুশ টাকা মানিঅৰ্ডার করে পাঠিয়ে দিলাম। এই ধরনের কর্জের টাকা কখনো ফেরত আসে না। তাতে কি। মানুষটার প্রতি আমার এক ধরনের মমতা তৈরি হয়েছে। অবোধ শিশুদের প্রতি যে মমতা তৈরি হয় আমার মমতার ধরনটা সে রকম। রউফ মিয়া তিন মাসের মাথায় টাকা নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন। দু’দিন থাকলেন। দেখলাম তার স্বাস্থ্য আরো ভেঙেছে। জীবন্ত কঙ্কাল ভাব চলে এসেছে। আমি বললাম, শরীরের এই অবস্থা কেন ভাই? রউফ মিয়া বললেন, অন্যের রোগ খেয়ে খেয়ে এই অবস্থা হয়েছে। রোগ খাওয়ার পর বেশি করে দুধ খেতে হয়। দুধ কই পাব বলেন? পনেরো টাকা কেজি দুধ। আমি বললাম, আসুন আপনাকে ডাক্তার দেখাই। রউফ মিয়া আঁতকে উঠে বললেন, অসম্ভব কথা বললেন। আমি বিখ্যাত রোগভক্ষক। এখন আমি যদি ডাক্তারের কাছে। যাই, লোকে কী বলবে? কেউ তো জানছে না। কেউ না জানুক আপনি তো জানলেন। একজন জানা আর এক লক্ষ জন জানা একই কথা। রউফ মিয়া শীতের সময় এসেছিলেন। বাজারে
false
shunil_gongopaddhay
কাকাবাবু বললেন, তোমার ওই কাকদ্বীপ থানার ওপর ভরসা করে কতদিন বসে থাকব? আমার নিজেরই খুব লজ্জা লাগছে। ছেলেটা আমার সঙ্গে গেল, অথচ আমি তাকে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না! আজই একটা কিছু করা দরকার। অসীম, তোমার কার্ডে দেখলাম, তুমি এখন আই জি ক্রাইম, তার মানে সারা পশ্চিমবাংলা জুড়ে তোমার কাজ। তুমি আমার সঙ্গে চলো কাকদ্বীপ। ওই সার্কাসে গিয়ে আবার খোঁজ নিতে হবে। অসীম দত্ত প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, কালই ওদিক থেকে ফিরেছি, আবার আজ যাব? অত ঘাবড়াচ্ছ কেন, দেখবে হয়তো বিকেলের মধ্যেই ছেলেটা বাড়ি ফিরে আসবে! শোনো, রাজা, আজ পার্ক সার্কাস থেকে ভাল খাসির মাংস কিনে এনেছি। আমার রান্নার শখ আছে জানো তো? নিজে আজ বিরিয়ানি রান্না করব। দুপুরে এখানে খাওয়াদাওয়া করো, বিশ্রাম নাও, তারপর বিকেলবেলা ফোন-টোন করে— কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চল, সন্তু! অসীম দত্ত বললেন, এ কী, তুমি রাগ করলে নাকি? কাকাবাবু বললেন, তোমার বিরিয়ানি তুমি খাও। যত ইচ্ছে খাও! আমি আর সন্তু এক্ষুনি কাকদ্বীপের দিকে রওনা হব। অসীম দত্ত বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? ঠিক আছে, যদি যেতেই চাও, আমি ডায়মন্ড হারবারের মহকুমা অফিসারকে ফোন করে দিচ্ছি। ওর নাম অর্ক মজুমদার, খুব ভাল ছেলে। যেমন বুদ্ধিমান, তেমনই স্মার্ট। সে তোমাদের সাহায্য করবে। অসীম দত্ত টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন। এই সময় একজন কাজের লোক একটা ট্রে-তে করে একগাদা কচুরি-আলুর দম আর মিষ্টি নিয়ে এল, তার পেছনে-পেছনে এল অলি। তার মুখে একটা চাপা উত্তেজনার ভাব। অলি জিজ্ঞেস করল, জোজো হারিয়ে গেছে? কাকাবাবু আস্তে-আস্তে মাথা নাড়লেন। অলি বলল, জোজোকে হাত-পা বেঁধে রেখেছে। মুখও বেঁধেছে। কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? কে বেঁধে রেখেছে? অলি বলল, তা জানি না। যেই শুনলাম যে জোজোকে পাওয়া যাচ্ছে না, অমনই আমি দেখতে পেলাম, একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে জোজো শুয়ে আছে। হাত-পা-মুখ সব বাঁধা! অসীম দত্ত অলির মাথায় হাত রেখে বললেন, জানো তো রাজা, আমার মেয়ের এই একটা রোগ আছে। দিনের বেলা জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখে। কত কী-ই যে বলে, তার দু-একটা মিলেও যায়। মেয়েটা একটু-একটু পাগলি! কাকাবাবু কৌতূহলী হয়ে অলির দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, ওর কথা কীরকম মিলে গেছে শুনি? একটা উদাহরণ দাও! অসীম দত্ত বললেন, ও বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বলে, বেশিরভাগই মেলে না। তবে, কয়েকদিন আগে হঠাৎ বলল, আজ পিসিমণি আসবে, খুব মজা হবে! ওর পিসিমণি মানে আমার বোন মণিকা। সে দিল্লিতে থাকে, কলকাতায় আসার কোনও কথাই নেই, আমাদের কিছু জানায়নি। সেইজন্য আমরা অলির কথা বিশ্বাস করিনি। ও মা, সন্ধের সময় হঠাৎ মণিকা তার দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে হাজির। ওরা প্লেনে কাঠমণ্ডু যাচ্ছিল, সেখানে এমন কুয়াশা আর বৃষ্টি যে, প্লেন নামতেই পারল না, চলে এল কলকাতায়। আবার পরদিন ছাড়বে। সেইজন্য মণিকাও রাতটা কাটাতে চলে এল এখানে। আমার পাগল মেয়েটা কী করে আগে থেকে টের পেয়ে গেল বলো তো? কাকাবাবু বললেন, এটা রোগও নয়, পাগলামিও নয়। কোনও-কোনও মানুষের এই ক্ষমতা থাকে। তারা দূরের জিনিস দেখতে পায়। দশ লক্ষ কুড়ি লক্ষ মানুষের মধ্যে একজনের থাকে এই ক্ষমতা। সাধারণ মানুষের চেয়ে এদের অনুভূতি অনেক তীব্র হয়। একে বলে ই এস পি। তারপর তিনি অলিকে জিজ্ঞেস করলেন, সেই অন্ধকার ঘরটা কোথায় বলতে পারো? দুদিকে মাথা নেড়ে অলি বলল, তা জানি না। কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, আর দেরি করতে পারছি না। এইসব কিছু আমরা খাব না! অসীম দত্ত বললেন, একটা করে মিষ্টি অন্তত খাও। সন্তু, তুমি খাও। ততক্ষণে আমি অর্ককে টেলিফোন করে জানিয়ে দিই। অলি কাকাবাবুকে বলল, আমি আপনাদের সঙ্গে যাব। অসীম দত্ত সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, তুই কোথায় যাবি? সামনের সপ্তাহে তোর গানের পরীক্ষা। আমরা যখন গেলাম, তখন তুই গেলি না! অলি বলল, আমি জোজোকে খুঁজতে যাব! অসীম দত্ত বললেন, তুই এই কাকাবাবুটাকে ঠিক চিনিস না। জোজো যদি সত্যিই হারিয়ে গিয়ে থাকে, কিংবা কেউ জোর করে ধরে রাখে, তা হলে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে যেখানেই হোক, কাকাবাবু ঠিক খুঁজে বার করবে। তাই না রাজা? অলি ঘাড় নিচু করে বলল, আমি কাকাবাবুর সঙ্গে থাকব! অসীম দত্ত দু হাত ছড়িয়ে বললেন, এই রে! এ মেয়ে যদি একবার জেদ ধরে, তা হলে কিছুতেই তো একে বোঝানো যাবে না! যদি জোর করে যেতে না দিই, তা হলে কাঁদবে, অনবরত কাঁদবে, ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে, কিছু খাবে না, কোনও কথা শুনবে না। কী মুশকিলে ফেললে বলো তো রাজা! কাকাবাবু বললেন, তা হলে অলি চলুক আমাদের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে অলির মুখোনা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অসীম দত্ত একটা বড় নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, তার মানে, আজ আর কপালে বিরিয়ানি নেই। মাংসটা ফ্রিজে তুলে রাখতে হবে। আমাকেও যেতে হবে, না হলে ওর মা কিছুতেই ছাড়বে না। একটু অপেক্ষা করো, আমি ভেতর থেকে তৈরি হয়ে আসছি। আজ আর জিপ নয়, অসীম দত্ত নিলেন একটা কালো রঙের অ্যাম্বাসাডার গাড়ি। এইরকম বড়বড় পুলিশ অফিসারের সঙ্গে সবসময় একজন বডিগার্ড থাকে। সেই বডিগার্ড আর অসীম দত্ত বসলেন সামনে, পেছনে কাকাবাবু, সন্তু আর অলি। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর গাড়ি যখন বেহালা পার হয়ে গিয়ে অনেকটা ফাঁকা রাস্তায় পড়ল, তখন অসীম দত্ত বললেন, সবাই এত গোমড়ামুখে রয়েছ। কেন? কাকদ্বীপ পৌঁছবার পরে কাজ শুরু হবে, তার
false
shorotchandra
ঢোঁক গিলিয়া কহিল, আমি নিজের চোখে দেখে গেছি। সতীশ চুপ করিয়া শুনিতে লাগিল। বেহারী বলিল, আমরা যেদিন বাসা বদল করি, তার পরদিন দুপুরবেলায় আমি আসি। তখন বিপিনবাবু সাবিত্রীর বিছানায় ঘুমুচ্ছিলেন। সতীশ ভয়ানক ধমক দিয়া উঠিল, মিথ্যে কথা! বেহারী চমকাইয়া উঠিয়া বলিল, না বাবু, সত্যি কথাই বলচি। সতীশ তাহার মুখের দিকে তীব্র দৃষ্টি করিয়া মুহূর্তকাল চুপ করিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিল, সাবিত্রী নিজে কোথায় ছিল? সাবিত্রী সেই ঘরেই ছিল। বাইরে এসে আমাকে মাদুর পেতে বসালে। জিজ্ঞাসা করতে লাগল, বাবুরা রাগ করেছেন কিনা, আমরা বাসা বদলালুম কেন এই-সব। তার পরে? আমি রেগে চলে এলুম। সেইদিন থেকেই সে বাবুর সঙ্গে চলে গেছে। এতদিন বলিস নি কেন? বেহারী চুপ করিয়া রহিল। সতীশ জিজ্ঞাসা করিল, তুই নিজের চোখে দেখেছিস না শুনেছিস? না বাবু, আমার স্বচক্ষে দেখা! একেবারে নিরীক্ষণ করে দেখা! আমার পা ছুঁয়ে দিব্যি কর্‌—তোর চোখে দেখা! বামুনের পায়ে হাত দিচ্ছিস, মনে থাকে যেন! বেহারী তৎক্ষণাৎ নত হইয়া সতীশের পায়ে হাত দিয়া বলিল, সে কথা আমার দিবা রাত্রই মনে থাকে বাবু! আমার স্বচক্ষে দেখা। সতীশ আবার একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, আচ্ছা বাসায় যা। উপেনদাকে বলিস, আজ রাত্রে আমি ভবানীপুরে যাব, ফিরব না। বেহারী বিশ্বাস করিল না, কাঁদিয়া ফেলিল। সতীশ বিস্মিত হইয়া বলিল, ও কি রে, কাঁদিস কেন? বেহারী চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল, বাবু, আমি আপনার ছেলের মত, আমাকে লুকোবেন না। আমিও সঙ্গে যাব। সতীশ জিজ্ঞাসা করিল, কেন? বেহারী বলিল, বুড়ো হয়েছি সত্যি, কিন্তু জাতে গোয়ালা। একগাছা হাতে পেলে এখনো পাঁচ-ছ’জনের মোয়াড়া রাখতে পারি। আমরা দাঙ্গা করতেও জানি, দরকার হলে মরতেও জানি। সতীশ শান্তভাবে বলিল, আমি কি দাঙ্গা করতে যাচ্চি? আহাম্মক কোথাকার! বলিয়াই চলিয়া গেল। বেহারী এবার বোধ হয় বুঝিল কথাটা মিথ্যা নয়। তখন চোখটা মুছিয়া ফেলিয়া সেও প্রস্থান করিল। সতীশ ময়দানের দিকে দ্রুতপদে চলিয়াছিল। কোথায় যাইবে, স্থির করে নাই—কিন্তু কোথাও তাহাকে যেন শীঘ্র যাইতেই হইবে। তাহার প্রধান কারণ সে নিঃসংশয়ে অনুভব করিতেছিল, একমুহূর্তেই তাহার মুখের চেহারায় এমন একটা বিশ্রী পরিবর্তন ঘটিয়াছে যাহা লইয়া কাহারও সম্মুখে দাঁড়ানো চলে না। ময়দানের একটা নিভৃত অংশে গাছতলায় বেঞ্চ পাতা ছিল। সতীশ তাহার উপরে গিয়া বসিল এবং নির্জন দেখিয়া স্বস্তি বোধ করিল। অন্ধকার বৃক্ষতলে বসিয়া প্রথমেই তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল, কি করা যায়! প্রশ্নটা কিছুক্ষণ ধরিয়া তাহার দুই কানের মধ্যে অর্থহীন প্রলাপের মত ঘুরিতে লাগিল। শেষে উত্তর পাইল, কিছুই করা যায় না। প্রশ্ন করিল, সাবিত্রী এমন কাজ করিল কেন? উত্তর পাইল, এমন কিছুই করে নাই, যাহাতে নূতন করিয়া তাহাকে দোষ দেওয়া যায়। প্রশ্ন করিল, এতবড় অবিশ্বাসের কাজ করিল কি জন্য? উত্তর পাইল, কোন্‌ বিশ্বাস তোমাকে সে দিয়াছিল, তাই আগে বল? সতীশ কিছুই বলিতে পারিল না। বস্তুতঃ সে ত কোন মিথ্যা আশাই দেয় নাই। একদিনের জন্যও ছলনা করে নাই। বরং, পুনঃ পুনঃ সতর্ক করিয়াছে, শুভ কামনা করিয়াছে, ভগিনীর অধিক স্নেহ-যত্ন করিয়াছে। সেই রাত্রির কথা সে স্মরণ করিল। সেদিন নিষ্ঠুর হইয়া তাহাকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দিয়া রক্ষা করিয়াছিল। কে এমন করিতে পারিত! কে নিজের বুকে শেল পাতিয়া লইয়া তাহাকে অক্ষত রাখিত? সতীশের চোখের পাতা ভিজিয়া উঠিল, কিন্তু, এ সংশয় তাহার কিছুতেই ঘুচিতে চাহিল না, যে, এই প্রশ্নোত্তরমালায় কোথায় যেন একটা ভুল থাকিয়া যাইতেছে। সে আবার প্রশ্ন করিল, কিন্তু, তাকে যে ভালবাসিয়াছি। উত্তর পাইল, কেন বাসিলে? কেন জানিয়া বুঝিয়া পঙ্কের মধ্যে নামিলে? প্রশ্ন করিল, তা জানিনে। পদ্ম তুলিতে গেলেও ত পাঁক লাগে। . উত্তর পাইল, ওটা পুরাতন উপমা—কাজে লাগে না। মানুষ ঘরে আসিবার সময় পাঁক ধুইয়া পদ্ম লইয়া আসে। তোমার পদ্মই বা কি, আর এ পাঁক কোথায় ধুইয়াই বা ঘরে আসিতে? প্রশ্ন করিল, না হয়, নাই ঘরে আসিতাম। উত্তর পাইল, ছিঃ! ও-কথা মুখেও আনিও না। তাহার পরে কিছুক্ষণ পর্যন্ত সে স্তব্ধ হইয়া নক্ষত্র-খচিত কালো আকাশের পানে চাহিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিল, আমি ত তার আশা ছাড়িয়াই ছিলাম। তাহাকে পাইতেও চাহি না, কিন্তু আমাকে সে এমন করিয়া অপমান করিল কেন? একবার জিজ্ঞাসা করিল না কেন? কি দুঃখে সে এ কাজ করিতে গেল? টাকার লোভে করিয়াছে, এ কথা যে কোনমতেই ভাবিতে পারি না? বিপিনের মত অনাচারী মদ্যপকে সে মনে মনে ভালবাসিয়াছিল, এ কথা বিশ্বাস করিব কি করিয়া? তবে কেন? গঙ্গার শীতল বাতাসে তাহার শীত করিতে লাগিল। সে র্যা পারটা আগাগোড়া মুড়িয়া দিয়া চোখ বুজিয়া বেঞ্চের উপর শুইয়া পড়িতেই সাবিত্রীর মুখ উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়া উঠিল। পতিতার কোন কালিমাই ত সে মুখে নাই! গর্বে দীপ্ত, বুদ্ধিতে স্থির, স্নেহে স্নিগ্ধ, পরিণত যৌবনের ভারে গভীর অথচ রসে, লীলায় চঞ্চল—সেই মুখ, সেই হাসি, সেই দৃষ্টি, সেই সংযত পরিহাস, সর্বোপরি তাহার সেই অকৃত্রিম সেবা! এমন সে তাহার এতখানি বয়সে কোথায় কবে পাইয়াছিল! ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির মত তাহার আবরণটা লইয়া খেলা করিতে গিয়া যে আগুন বাহির হইয়া পড়িয়াছে, ইহার দাহ হইতে কেমন করিয়া কোন্‌ পথে পলাইয়া আজ সে নিষ্কৃতি লাভ করিবে! নিষ্কৃতি লাভ করিয়াই বা কি হইবে! তাহার দুই চোখ দিয়া অশ্রু ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। এ অশ্রু সে দমন করিতে চাহিল না—এ অশ্রু সে মুছিয়া ফেলিতে ইচ্ছা করিল না। অশ্রু যে এত মধুর, অশ্রুতে যে এত রস আছে, আজ সে তাহার পরম
false
humayun_ahmed
এসে উঠলেন। হইচই চিৎকার করার কোনোই মানে হয় না। পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কাজেই তার যা করণীয় তা হল বিছানায় চলে যাওয়া। ঘুমিয়ে পড়া এবং ঘুম ভাঙার জন্যে অপেক্ষা করা। মিসির আলি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। শীত শীত লাগছে। পায়ের কাছে রাখা চাঁদ র বুক পর্যন্ত টেনে দিলেন। একটা হাত রাখলেন কোলবালিশের উপর। তিনি চোখ বন্ধ করে আছেন। মাথার ভেতরে সমুদ্র গর্জনের মতো শব্দ হচ্ছে। এ রকম শব্দ কেন হচ্ছে কে জানে? প্রচণ্ড ভয় পাবার পরে কি মানুষের শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ড খানিকটা এলোমেলো হয়ে যায়? তাঁর ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। ঘর ভর্তি আলো। পাখপাখালি চারদিকে কিচকিচ করছে। খাটের পাশে লিলি দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে চায়ের কাপ। আজ মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স কিছুতেই সতের আঠার বছরের বেশি হবে না। লিলি হাসিমুখে বলল, চাচাজী আপনি দরজার ছিটিকিনি না লাগিয়েই ঘুমিয়েছেন? মিসির আলি উঠে বসতে বসতে বললেন, ছিটিকিনি লাগাতে পারি নি। লিলি বলল, আমি তো আর সেটা জানি না। এর আগেও দুবার এসে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেছি। এইবার কী মনে করে দরজা ধাক্কা দিলাম। ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। চাচাজী রাতে ঘুম কেমন হয়েছে? ভালো। নিন চা নিন। আমি বইয়ে পড়েছি আপনি বাসিমুখে দিনের প্রথম চা খান। নাশতা তৈরি আছে! হাত মুখ ধুয়ে নিচে নামলেই নাশতা দিয়ে দেব। তোমার শরীর এখন ভালো? শরীর খুব ভালো। কাল রাতেও ভালো ছিল। ওর সঙ্গে রাগারণি করে বিছানায় শুয়ে পড়েছিলাম। ও আপনাকে কী বলেছে? আমার মাথা খারাপ? আমার চিকিৎসা দরকার? এই ধরনেরই কিছু। লিলি হাসতে হাসতে বলল, ওর কোনো দোষ নেই। রাগারগির এক পর্যায়ে আমি মাথা খারাপের অভিনয় করেছি। ও আমার অভিনয় ধরতে পারে না। চাচাজী আমার চা কেমন হয়েছে? ভালো হয়েছে। কাল রাতের খাবারটা কেমন ছিল? ভালো ছিল। আমি খুব তৃপ্তি করে খেয়েছি। আজ। আপনাকে কই মাছের পাতুড়ি খাওয়াব। পুঁই শাকের পাতা আনতে পাঠিয়েছি। পাওয়া গেলে হয়। এমন জংলা জায়গায় বাস করি। আশপাশের দুতিন মাইলের মধ্যে হাটবাজার নেই। মিসির আলি কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, লিলি একটা কাজ কর তো–টেবিলের উপর দেখ আমার ডায়েরিটা উল্টো করে রাখা আছে। পাতাটা খুলে দেখা কী লেখা। লিলি টেবিলের কাছে গেল। ডায়েরি উলটো করে রাখা নেই। বইগুলির উপর রাখা। লিলি বলল, চাচাজী টেবিলের উপর কোনো ডায়েরি উল্টো করে রাখা নেই। লাল মলাটের বইটি ডায়েরি। সাত তারিখ বের করে দেখ তো কিছু লেখা আছে কি না। লিলি অবাক হয়ে বলল, কিছু লেখা নেই। কী লেখা থাকবে? মিসির আলি হালকা গলায় বললেন, রেখে দাও। কিছু লেখা থাকবে না। তোমার স্বামীর ঘুম কি ভেঙেছে? ওর ঘুম একটার আগে ভাঙবে না। সারা রাত জেগে তারা দেখেছে। আপনাকে কী কী দেখাবে সব ঠিকঠাক করেছে। আজ। আপনাকে কী দেখানো হবে জানেন? না। শনির বলয়। এইসব দেখে কী হয় কে জানে! আমার খুবই ফালতু লাগে। চাচাজী আমি নিচে যাচ্ছি। হাতমুখ ধুয়ে আপনি নেমে আসুন। আজ আপনি নাশতা থাবোন চুলার পাশে বসে। গরম গরম লুচি ভেজে পাতে তুলে দেব। তোমার লুচিগুলিও কি স্পেশাল? অবশ্যই। অর্ধেক ময়দা আর অর্ধেক সুজিদানা মিশিয়ে কাই তৈরি করা হয়। দশ বারো ঘণ্টা এই কাই ভেজা ন্যাকড়ায় জড়িয়ে রেখে দিতে হয়। লুচির কাই আমি কাল রাতেই তৈরি করে রেখেছি। ভালো। শুধু ভালো বললে হবে না। আপনি চলে যাবার আগে আমাকে একটা সার্টিফিকেট দিয়ে যাবেন। রান্নার সার্টিফিকেট। সেই সার্টিফিকেট আমি বাঁধিয়ে রাখব। অবশ্যই দিয়ে যাব। তুমি চাইলে এখনি দিয়ে দিতে পারি। ওমা এখন কেন দেবেন? আমি তো এখনো আপনার জন্যে রান্নাই করি নি। চাচাজী যাই। লিলি চলে যাবার পর মিসির আলি টেবিলের কাছে গেলেন। ডায়েরি হাতে নিলেন। সেখানে স্বপ্নের কথা লেখা নেই। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালা? গত রাতে যা দেখেছেন সবই স্বপ্ন? গাঢ় স্বপ্ন? মিসির আঁলি হাত মুখ ধুয়ে নিচে নামলেন। লুচি বেগুনভাজা খেলেন। চা খেলেন। লিলি বলল, চাচাজী আপনি ঘুরে ফিরে বাড়ি দেখুন। বাগান দেখুন। লাইব্রেরি ঘর খুলে রেখেছি। লাইব্রেরির বইপত্র দেখতে পারেন। তোমার কুকুরগুলি কি বাঁধা আছে? হ্যাঁ কুকুর বাঁধা। বরকতকে পুঁই পাতার খোঁজে পাঠিয়েছি। বড় বড় পুঁই পাতা ছাড়া পাতুড়ি হয় না। বরকত এলেই কুকুরগুলির সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব। তখন আপনার কুকুরভীতি থাকবে না। নীল ফুল ফোটে ঐ গাছটা কোথায়? পেছনের বাগানে। বিশাল গাছ আপনি দেখলেই চিনতে পারবেন। গাছের গুঁড়িটা বাঁধানো। পেছনের বাগানে একটা ভাঙা মন্দির আছে। মন্দিরে ঢুকবেন না। সাপের আড্ডা। কী মন্দির? কালী মন্দির। হিন্দু বাড়ি ছিল। বাড়ির মালিক অশ্বিনী রায় শাক্ত মতের মানুষ ছিলেন। স্বপ্নে দেখে তিনি কালী প্রতিষ্ঠা করেন। খুবই ইস্টারেস্টিং গল্প। আমি ভাসা ভাসা জানি। সুলতানকে জিজ্ঞেস করলেই আপনাকে বলবে। আচ্ছা তাঁকে জিজ্ঞেস করব। লিলি বলল, আমি ঐ দিনের মতো এক্সপ্রেসো কফি বানিয়ে আপনার জন্যে নিয়ে আসছি। ঠিক আছে চাচাজী? ঠিক আছে। মিসির আলি বাড়ি দেখতে বের হলেন। রাতে বাড়িটা যত প্ৰকাণ্ড মনে হয়েছিল। দিনের আলোয় মনে হচ্ছে তার চেয়েও প্ৰকাণ্ড। তবে প্ৰকাণ্ড হলেও ধ্বংসস্তুপ। বাড়িটা যেন অপেক্ষা করছে কখন হুমড়ি খেয়ে পড়বে। বাড়িটার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না! ভয় ভয় করে। মনে হয় বাড়িটাও কৌতূহলী চোখে তাঁকে দেখছে।
false
tarashonkor
ব্যাপারটা বুঝতে কষ্ট হয় নাই লোকের। এলোচুলে লঙ্কা নুন পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত খেতে বসেছিল সে আজই ভরা দুপুরবেলায়, সেই সময়। আজ শনিবার অমাবস্যে। ক্ষণের মুখে এই লোভনীয় খাদ্য খেতে বসায় এঁটো হাতের সুযোগ এবং এলোচুলের অপরাধে তাকে পেয়েছে কোনো অশান্ত প্রেতলোকবাসী। এবং সে প্রেতলোকবাসী যে কে, বাবাঠাকুরের কৃপায়, হাঁসুলী বাঁকের উপকথার শিক্ষায় তাও কাহারদের জানতে বাকি নাই, সে আর কেউ নয়, সে হল কালোশশীর প্রেতাত্মা। অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে তার ‘অঙের খেলার সাধ। মেটে নাই তার, অঙের খেলায় লঘু-গুরু জ্ঞান হারিয়ে নিজের স্পর্শে ‘বাম্ভন’ তুল্য ছত্রী জাতের ভূপসিং মহাশয়ের জাতিপাত করার পাপ নিয়ে সে মরেছে, সে ওই দশা পাবে বৈকি! পানা তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে সে আজও পুত্ৰশোক ভুলতে পারে না। সে যোগ দিচ্ছে। বাবার থানের ধূপ পিদিম অপবিত্ত করে দিয়েছে। হবে না। আমি সাজা পেয়েছি, আরও কত জনকে পেতে হবে। ওদিকে মৃত কালোশশীর সম্বন্ধে এই সকল তথ্যের প্রতিবাদ করেছে তার বোনঝি সুবাসী। সে ঘরে এসে কাঁদতে বসেছিল। কান্নার মধ্যে সে মাসির প্রেতাত্মাকে ডেকে বলেছিল—তুমি যদি তাই হয়ে থাক, তবে নাও-লাও; শত্তুদিগে লাও। এই কান্নার প্রতিবাদ করেছিল বনওয়ারীর বড়বউ। বলেছিল-ভরাভর্তি বেলায় এমন করে কেঁদো না তুমি। এই প্রতিবাদে সুবাসী কেঁদে বলেছিল মৃত মাসিকে উদ্দেশ করেওগো, কত ভালবাসতে গো আমাকে তুমি, আমার রুপকার কর। লাও লাও, আমার শত্তুকে লাও, তোমার শত্তুকে লাও। আমার কাঁটা তুলে দাও। ‘কাঁটা’ মানে সতীন-কাঁটা। সতীন মানেও শত্রু। সতীনের চেয়ে বড় শক্ৰ কে? এই লেগেছে ঝগড়া গোপালীবালা এবং সুবাসীর মধ্যে। পাড়ার সকলেই গিয়েছে দেখতে। এর মধ্যে সুবাসীর সঙ্গে পাখীর ভাব আছে বলে এবং কালোশশী বনওয়ারীর প্রিয়তমা বলে নয়ানের মা গোপালীর পক্ষ নিয়েছে। ঠিক সেই কারণেই সুচাঁদ নিয়েছে সুবাসীর পক্ষ। করালী এবং পাখীর উপর আর সুষ্ঠাদের রাগ নাই। করালী তাকে পাকী মদ খাইয়েছে, কাপড় দিয়েছে, পায়ে ধরেছে, কোলে করে নেটেছে। নয়ানের মা সুবাসীকে বলেছে—মরলে যদি ভূত হয়, আর ভূত যদি কথা শুনত, তবে স্বামী-পুতু, শ্বশুর-শাশুড়ি একঘর ভূত থাকত আমার। আর যার ঘাড় ভাঙতে বলতাম তারই ঘাড় ভাঙত। মরণ! তার প্রতিবাদ সঙ্গে সঙ্গে করেছে সুচাঁদ—মরলে ভূত হয় না? তোর ঘাড়ে যখন চাপবে তখন বুঝবি। এই আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। সুবাসী প্রতিবাদ করতে গিয়েছে তার মাসি কালোশশীর প্রেতত্ব বা পেত্নীত্ব প্রাপ্তির। কিন্তু তারই পক্ষ নিয়ে সুচাঁদ তীব্র প্রতিবাদে প্রমাণ করতে আরম্ভ করেছে। কালোশশী নিশ্চয় পেত্নী হয়েছে এবং সুবাসীর শত্রুদের সে নিপাত করবে। বনওয়ারীর নিজের বাড়ি অবশ্য এখন স্তব্ধ। গোপালীবালা, সুবাসী দুজনেই চুপচাপ শুয়ে আছে আপন আপন ঘরের দাওয়ায়। ভাত পর্যন্ত হয় নাই। বনওয়ারীর সমস্ত আক্রোশ গিয়ে পড়ল নিজের স্ত্রীদের উপর। সুবাসীর উপরেই রাগটা বেশি হল। আজ সে জানতে পারলে, সুবাসীর সঙ্গে পাখীর নাকি ভাব আছে; তার উপর কালোশশীর প্রেতাত্মাকে ডেকেছে। একটা লাঠি টেনে নিয়ে তার চুলের মুঠো ধরে সে তাকে ঠেঙাতে আরম্ভ করলে। তাকে ঠেঙিয়ে সে ঠেঙালে গোপালীবালাকে। তাকেও দিলে অল্প কয়েক ঘা। তারপর সে লাঠি হাতে এসে দাঁড়াল সুচাঁদ এবং নয়ানের মায়ের মাঝখানে। সঙ্গে সঙ্গে সুচাঁদ পিছু হঠতে লাগল। কয়েক পা পিছু হঠে সে হনহন করে চলে গেল মাঠের দিকে। সেখানে কোথাও বসে সে গাল দেবে, পরিশেষে সে কাঁদবে মৃত বাপকে স্মরণ করে, কারণ বনওয়ারী ভাইপো হয়ে তাকে লাঠি দেখিয়েছে। নয়ানের মা কিন্তু পালাল না। সে বিড়ালীর মত স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পানার উদ্দেশ নাই। সে ঘরে খিল দিয়েছে। তার বউ বললে—জ্বর হয়েছে, শুয়েছে। –দাদা! ঠিক এই সময় কে পিছন থেকে ডাকল। –কে? –আমি বসন। হ্যাঁ, বসন। বসনের কোনো অপরাধ নাই; তবুও করালী-পাখীর কারণে তাকে দেখে বনওয়ারী প্রসন্ন হতে পারলে না। গম্ভীর মুখে বনওয়ারী বললে–কি? একখানা কাগজ তার হাতে দিয়ে বসন বললে–তোমার কাড। —কাড? –হ্যাঁ। কেরাচিনি, চিনি—এই সবের ছাড়। নেওনাইন বোড থেকে দিয়েছে, নসু দিয়ে গেল আমাকে। সেকেটারি করালীকে দিয়েছিল। জাঙলের হেদো মণ্ডলের ছেলে আইছিল, সে সবারই দেখে সবাইকে দিয়েছে, এইটি তোমার। কাৰ্ডখানা নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিল বনওয়ারী। তারপর সে বার হল পাড়ায়। নিউনাইন-বোডে এমন কথা বলতে করালীকে কোন্ কাহার বলেছে? কেউ বলে নাই। সকলে চুপ করে রইল। —ফেলে দাও কাড। প্ৰহ্লাদ বললে-ব্যানোভাই! –না। —না লয়।একটু শক্ত হয়েই সে বললে—সে ভাই অল্যায় হবে। ভেবে দেখ তুমি? কাড দিয়েছে নিউনাইন-বোড। আমরা বেগার দি। আমাদের কাড কেন ফেলে দেব? —হুঁ। কিন্তু যদি কেউ শুধায়, ঘোষ মশায় তোমাদের কেরাচিনি মেরে দিত কি না? –তা কেন বলব? সে বলব কেন? –করালীকেও বলতে তোমরা বল নাই? –না, কেউ বলে নাই। মুখ থাকতে নাকে ভাত কেউ খায় নাকি? বললে তোমাকে বলতাম আমরা। বাস্। বাস্। প্রহ্লাদ বনওয়ারীর ঘেঁড়া কাৰ্ডখানি এনে জুড়তে বসল। বনওয়ারী বাড়ি এসে বিছানায় শুয়ে মনে মনে বাবাঠাকুরকে ডাকতে লাগল। ঝমঝম করে জল নেমেছে আকাশ ভেঙে। আবার হাতি নামবে নাকি? কে ডাকছে এর মধ্যে! কে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে! সুবাসী দরজা খুলতে গেল, কিন্তু ধমক। দিয়ে বনওয়ারী বললে–অ্যা-ই! কে জানে কে! মানুষ কি না তাই বা কে জানে! কালোশশী নয়, কে বলবে! আজ আবার কালোশশী সাড়া দিয়েছে। —কে—কে তুমি? কাঙাল, কাঙাল আমি। অমনকাকার বউ মারা গেল, খবর দিতে এসেছি। মারলে তবে কালোশশী! বনওয়ারী বাবার নাম করে বেরিয়ে এল। জয় বাবাঠাকুর! শাঙন পার হল। চাষ ভাল।
false
shordindu
ঊষাপতিবাবু দ্বিধাভরে বলিলেন‌, ‘কী জানি‌, আগে লক্ষ্য করেছি বলে মনে হচ্ছে না।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সম্প্রতি কেউ সেঁটেছে। বাড়িতে ছোট ছেলেপিলে থাকলে বোঝা যেত। কিন্তু–আপনি একবার খোঁজ নেবেন?’ ঊষাপতিবাবু সহদেবকে ডাকিলেন‌, সে যথারীতি বলিল‌, ‘আমি কিছু জানিনে বাবু।’চুমকিও কিছু বলিতে পারিল না। শীতাংশু বলিল‌, ‘আমি কাল সন্ধের সময় যখন বাড়ি এসেছি তখন ওটা ছিল না।’ আমার মাথায় নানা চিন্তা আসিতে লাগিল। সত্যকামকে যে খুন করিয়াছে সে কি নিজের পরিচয়ের ইঙ্গিত এইভাবে রাখিয়া গিয়াছে? হরতনের টেক্কা! লোমহর্ষণ উপন্যাসে এই ধরনের জিনিস দেখা যায় বটে। কিন্তু– কোনও হদিস পাওয়া গেল না। আমরা চলিয়া আসিলাম। রাস্তায় বাহির হইয়া ব্যোমকেশ হাতের ঘড়ি দেখিয়া বলিল‌, ‘এখনও দশটা বাজেনি। চল, থানাটা ঘুরে যাওয়া যাক।’ থানার দিকে চলিতে চলিতে ব্যোমকেশ এক সময় জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘বাড়ির লোকের এজেহার শুনলে। কী মনে হল?’ এই কথাটাই আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাইতেছিল। বলিলাম‌, ‘কাউকেই খুব বেশি শোকার্ত মনে হল না।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘প্রবাদ আছে‌, অল্প শোকে কাতর‌, বেশি শোকে পাথর।’ বলিলাম‌, ‘প্রবাদ থাকতে পারে‌, কিন্তু ঊষাপতিবাবু এবং তাঁর স্ত্রীর আচরণ খুব স্বাভাবিক নয়। সত্যকাম ভাল ছেলে ছিল না‌, নিজের উচ্ছঙ্খলতায় বাপমা’কে অতিষ্ঠা করে তুলেছিল‌, সবই সতি্যু হতে পারে। তবু ছেলে তো। একমাত্র ছেলে। আমার বিশ্বাস এই পরিবারের মধ্যে কোথাও একটা মস্ত গলদ আছে।’ ‘অবশ্য। সত্যকামই তো একটা মস্ত গলদ। সে যাক‌, দরজায় রাংতার চাকতির অর্থ কিছু বুঝলে?’ ‘না। তুমি বুঝেছি?’ ‘সম্পূর্ণ আকস্মিক হতে পারে। কিন্তু তা যদি না হয়—’ থানায় পৌঁছিয়া দেখিলাম‌, দারোগা ভবানীবাবু আমাদের পরিচিত লোক। বয়স্থ ব্যক্তি; ক্বশ-বেল্ট টেবিলের উপর খুলিয়া রাখিয়া কাজ করিতেছেন। আমাদের দেখিয়া খুব খুশি হইয়াছেন মনে হইল না। তবু যথোচিত শিষ্টতা দেখাইয়া শেষে খাটো গলায় বলিলেন‌, ‘আপনি আবার এর মধ্যে কেন?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পকেচক্ৰে জড়িয়ে পড়েছি।’ ভবানীবাবু পূর্ববৎ নিম্নস্বরে বলিলেন‌, ‘ছোঁড়া পাকা শয়তান ছিল। যে তাকে খুন করেছে সে সংসারের উপকার করেছে। এমন লোককে মেডেল দেওয়া উচিত।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তা বটে। আপনারা যা করছেন করুন‌, আমি তার মধ্যে নাক গলাতে চাই না। আমি শুধু জানতে চাই–’ ভবানীবাবু তাহাকে দৃষ্টি-শিলাকায় বিদ্ধ করিয়া বলিলেন‌, ‘সত্যান্বেষণ? কী জানতে চান বলুন।’ ‘পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট এখনও বোধহয় আসেনি?’ ‘না। সন্ধ্যে নাগাদ পাওয়া যেতে পারে।’ ‘সন্ধ্যোর পর আমি আপনাকে ফোন করব-বন্দুকের গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে?’ ‘বড় বন্দুক নয়‌, পিস্তল কিম্বা রিভলবার। গুলিটা পিঠের বা দিকে ঢুকেছে‌, সামনে কিন্তু বেরোয়নি। শরীরের ভিতরেই আছে। পিঠে যে ফুটো হয়েছে সেটা খুব ছোট‌, তাই মনে হয় পিস্তল কিম্বা রিভলবার।’ ‘পিঠের দিকে ফুটো হয়েছে‌, তার মানে যে গুলি করেছে সে সত্যকমের পিছনে ছিল।’ ‘হ্যাঁ। হয়তো ফটকের ভিতর দিকে ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে বসে ছিল‌, যেই সত্যকাম সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে অমনি গুলি করেছে‌, তারপর ফটক দিয়ে বেরিয়ে গেছে।’ ‘হুঁ। এ-পাড়ায় একটা ব্যায়াম সমিতি আছে আপনি জানেন? ‘জানি। তাদের কাজ নয়। তারা দু-চার ঘা প্রহার দিতে পারে‌, খুন করবে না‌, সবাই ভদ্রলোকের ছেলে।’ ভদ্রলোকের ছেলে খুন করে না‌, পুলিসের মুখে একথা নুতন বটে। কিন্তু ব্যোমকেশ সেদিক দিয়া গেল না‌, বলিল ‘ভদ্রলোকের ছেলের কথায় মনে পড়ল। সত্যকমের এক পিসতুতো ভাই বাড়িতে থাকে‌, তাকে দেখেছেন?’ ভবানীবাবু একটু হাসিলেন‌, ‘দেখেছি। পুলিসে তার নাম আছে।’ ‘তাই নাকি! কী করেছে। সে?’ ‘ছেলেটা ভালই ছিল‌, তারপর গত দাঙ্গার সময় ওর বোপকে মুসলমানেরা খুন করে। সেই থেকে ওর স্বভাব বদলে গেছে। আমাদের সন্দেহ ও কম-সে-কম গোটা তিনেক খুন করেছে। অবশ্য পাকা প্রমাণ কিছু নেই।’ ‘ওর চোখের চাউনি দেখে আমারও সেই রকম সন্দেহ হয়েছিল। আপনার কি মনে হয় এ-ব্যাপারে তার হাত আছে?’ ‘কিছুই বলা যায় না‌, ব্যোমকেশবাবু। সত্যকমের মত পাঁঠা যেখানে আছে সেখানে সবই সম্ভব। তবে যতদূর জানতে পারলাম যখন খুন হয় তখন সে বাড়ির মধ্যে ছিল। সহদেবের চীৎকার শুনে ওর মামা আর ও একসঙ্গে সদর দরজায় পৌঁচেছিল। সত্যকামকে পিছন থেকে যে গুলি করেছে তার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।’ ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘ছাতের ওপর থেকে গুলি করা কি সম্ভব?’ ভবানীবাবু বলিলেন‌, ‘ছাতের ওপর গুলি করলে গুলিটা শরীরের ওপর দিক থেকে নীচের দিকে যেত। গুলিটা গেছে। পিছন দিক থেকে সামনের দিকে। সুতরাং—’ এই সময় টেলিফোন বাজিল। ভবানীবাবু টেলিফোনের মধ্যে দু’চার কথা বলিয়া আমাদের কহিলেন‌, ‘আমাকে এখনি বেরুতে হবে। জোর তলব–’ ‘আমরাও উঠি।’ ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল‌, ‘ভাল কথা‌, মৃত্যুকালে সত্যকমের সঙ্গে কী কী জিনিস ছিল–’ ‘ঐ যে পাশের ঘরে রয়েছে‌, দেখুন না গিয়ে।’ বলিয়া ভবানীবাবু কোমরে কেল্ট বাঁধিতে লাগিলেন। পাশের ঘরে একটি টেবিলের উপর কয়েকটি জিনিস রাখা রহিয়াছে। সোনার সিগারেট-কেসটি দেখিয়াই চিনিতে পারিলাম। তাছাড়া হুইস্কির ফ্ল্যাসিক‌, চামড়ার মনিব্যাগ‌, একটি ছোট বৈদ্যুতিক টর্চ প্রভৃতি রহিয়াছে। ব্যোমকেশ সেগুলির উপর একবার চোখ বুলাইয়া ফিরিয়া আসিল। ভবানীবাবু এতক্ষণে কেল্ট বাঁধা শেষ করিয়াছেন‌, দেরাজ হইতে পিস্তল লইয়া কোমরের খাপে পুরিতেছেন। বলিলেন‌, ‘দেখলেন? আর কিছু দেখবার নেই তো? আচ্ছা‌, চলি।’ ভবানীবাবু চলিয়া গেলেন। তাঁহার ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইল‌, তিনি আসামীকে ধরিবার কোনও চেষ্টাই করিবেন না। শেষ পর্যন্ত সত্যকমের মৃত্যু-রহস্য অমীমাংসিত থাকিয়া যাইবে। আমরাও বাহির হইলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এতদূর যখন এসেছি‌, চল বাগের আখড়া দেখে যাই।’ ‘এখন কি কারুর দেখা পাবে?’ ‘দেখাই যাক না। আর কেউ না থাক বাগ মশাই নিশ্চয় গুহায় আছেন।’ বাঘ কিন্তু গুহায়
false
shunil_gongopaddhay
এভারেস্ট দেখা যায়। সন্তুর দিকে তাকিয়ে মিংমা বলল, সন্তু সাব, গ্লাভস কাঁহা? গ্লাভস পরে আসুন। সনঝে হলেই বহুত শীত লাগবে? সত্যিই তো, সন্তু মনের ভুলে খালি হাতে চলে এসেছিল। শীত তো লাগবেই। তা ছাড়া, মাঝে-মাঝেই আছোড় খেয়ে পড়তে হয়, বরফে হাত লাগে। কাকাবাবু আগেই সাবধান করে দিয়েছেন, বেশি ঠাণ্ডার মধ্যে খালি হাতে বরফ ছুলে ফ্রস্ট বাইট হতে পারে। বরফ কামড়ায়। তাতে অনেক সময় হয়তো আঙুল কেটে বাদ দিতে হয়। সন্তু গম্বুজে ফিরে গিয়ে গ্লাভস পরে এল। চতুর্দিকে বরফে সাদা হয়ে গেছে। মিংমা আর কাকাবাবু এগিয়ে গেছেন অনেকখানি। বরফের ওপর দিয়ে দৌড়েবার উপায় নেই। সন্তু বকের মতন লম্বা-লম্বা পা ফেলে পৌঁছে গেল ওদের কাছে। কাকাবাবু শেরপা মিংমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মিংমা, তুমি কেইন শিপটনের নাম শুনেছ? মিংমা বলল, হাঁ সাব, সবকেই জানে শিপটন সাবের কথা। হাম দেখা হায় উনকো। ইতনা তাগড়া জোয়ান, মুখমে দাড়ি আর মোচু। আহা বেচারা মর গিয়া। তুমি শিপটন সাহেবের দলের সঙ্গে এসেছিলে নাকি? না, সাব। উস্ টাইম আমার বুখার হয়েছিল। পেট মে বহুত দরদ! তোমার চেনা কেউ এসেছিল শিপটনের সঙ্গে? নোরবু এসেছিল? না, সাব, নরবুভি আসেনি। লেকিন আমার দোস্তু শেরিং আয়া থা! শিপটন কী করে মারা গেলেন, তুমি শুনেছ? হাঁ, সাব। সবাই জানে। এহি তো জায়গামে ছিল উনাদের বেস ক্যাম্প। শিপটন সাবকে দেখে সবাই ভেবেছিল, এ সব ঠিক এভারেস্ট পীক-এ উঠে যাবে। ইতনা থা উনকা তন্দুরাস্তি। মারা গেলেন কী ভাবে? ব্যস, বিলকুল বন্দ নাসিব। বহুত হিম্মত আর সাহস ছিল তো, তাই একেলা একেলা ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। পাহাড়মে এহি কানুন হায় সাব, কোথাও কেউ একেলা যাবে না। একেলা যানেসেই ভয়। দু-জন যাও, কুছু না হোবে। শিপটন সাব সে-কথা মানেননি। একেলা গেলেন, তারপর কোথায় বরফ তাঁকে টেনে নিল। তার দেহটাও তো পাওয়া যায়নি। নেহি মিলা। গরমিন্টের লোক এসে কত টুড়িল। আমরিকা থেকে ভি আউর বহুত সাহাবলোক এসে টুড়ল। তবু মিলল না। শিপটন সাব সির্ক বরফকা অন্দর গায়েব হো গিয়া। কিন্তু মিংমা, এই বেস ক্যাম্প থেকে একজন লোক এক-একা হেঁটে আর কত দূর যেতে পারে? বেশি দূর তো যাবে না। এর মধ্যে কেউ কোনও খাদে পড়ে গেলে তার দেহ পাওয়া যাবে না কেন? খুব বড় খাদ তো এখানে নেই। কভি কভি এইসা হোতা হ্যায়, সাব, বরফ মানুষকো অন্দর টান লেতা হ্যায়। হাঁ সাব, বরফ মানুষকে টেনে নেয়। সন্তু বলল, ক্রিভাস! কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকালেন। সন্তুকে তিনি যতটা ছোট মনে করেন, সে তো ততটা ছোট নয়, সে অনেক কিছু জানে। সন্তু অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়ে কথাটা শিখেছে। সে বলল, বরফের মধ্যে মাঝে-মাঝে ক্রিভাস গর্ত থাকে, তার মধ্যে পা ফস্কে পড়ে গেলেই একেবারে মৃত্যু। কাকাবাবু বললেন, ঠিকই বলেছিস, কিন্তু কথাটা ক্রিভাস নয়। ফরাসিতে বলে ক্ৰভাস, আর ইংরেজিতে বলে ক্রেভিস। তুই দুটো মিলিয়ে একটা বাঙালি উচ্চারণ করে ফেলেছিস। মিংমাও ক্রেভিস কথাটা জানে। সাহেবদের কাছ থেকে শুনে শুনে শিখেছে। সে বলল, না সাব, ইধার ক্ৰোভিস নেহি হ্যায়। আরও দূরে আছে। লেকিন বরফ মানুষকে টেনে নেয়, ইয়ে, সাচ বাত হায়। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এ-রকমভাবে আরও লোক মরেছে? যাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়নি? হর এক্সপিডিশানেই তো একজন দুজন আদমি মরে। কখনও লাশ পাওয়া যায়, কখনও পাওয়া যায় না! শেরপা মরে, কুলি মরে, সাহাব লোকভি মরে! গত বরষমে। আমিও তো একবার মরতে মরতে বাঁচ গিয়া। সন্তু বলল, এত বিপদ, তবু তোমরা এখানে আসো কেন? মিংমা গর্বের সঙ্গে বলল, আমরা পাহাড়ি মানুষ। আমরা বিছানায় শুয়ে মরতে চাই না। বিছানায় শুয়ে মরে ডরপুক আর জেনানারা। আমরা পাহাড়মে, নেহি তো বরফের মধ্যে মরতে চাই। বরফমে মরো, শান্তি, বহুত শান্তি! মিংমা বুকের ওপর আড়াআড়িভাবে দুটো হাত রাখল, যেন এর মধ্যেই সে মরে গেছে। কাকাবাবু হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করে বললেন, আমরা যেমন বিকেলবেলা বেরিয়েছি, কেইন শিপটনও বেরিয়েছিল বিকেলে। বিকেলবেলা বেস ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে সে আর কতদূর যাবে? যতই সাহসী হোক অভিযাত্রী হিসেবে শিপটন নিশ্চয়ই এটুকু জানত যে, রাত্তিরবেলা তাঁবুর বাইরে থাকতে নেই। সুতরাং সে সন্ধের আগেই ফিরে আসবার কথা চিন্তা করেছিল নিশ্চয়। শিপটনের সঙ্গের লোকেরা বলেছে যে, পর পর তিন দিন শিপটন এইরকম বিকেলবেলা একা একা বেরিয়েছিল। এর মধ্যে একদিন সে তাঁবুতে ফিরে একটা অদ্ভুত কথা বলেছিল তার দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। তারা কেউ বিশ্বাস করেনি। শিপটনের এমনি বানিয়ে-বানিয়ে মজার কথা বলার অভ্যোস ছিল। মিংমা বলল, হয়, শিপটন সাব বহুত জলি আদমি থা। আমার দোস্ত শেরিং বলে যে, শিপটন সাব এমুন কথা বলতেন যে, হাঁসতে হাঁসতে পেটমে বেথা। হয়ে যেত! কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, শিপটনের একটা ডায়েরি পাওয়া গেছে। তাতেও সে বানিয়ে-বানিয়ে ঐ রকম কোনও মজার কথা লিখেছে কি না সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। ডায়েরিতে সাধারণত কেউ মিথ্যে কথা লেখে না। অথচ সে যা লিখেছে, তাও বিশ্বাস করা যায় না। শিপটন কী লিখেছিলেন, কাকাবাবু? কাকাবাবু তক্ষুনি সন্তুর কথার উত্তর না দিয়ে মিংমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কতবার এক্সপিডিশানে এসেছ, মিংমা? মিংমা মুচকি হেসে বলল, সওয়া সাতবার আংকল সাব। সওয়া সাতবার মানে? এহি বার তো আধা ভি নেহি হুয়া, সিকি হুয়া। ও, বুঝেছি। তা এতবার যে তুমি এসেছ, কখনও এইদিকে অস্বাভাবিক
false
shomresh
এই তো আমার ছেলে। হ্যাঁ রে, তোকে কেউ মারধোর করেনি তো? বিশ্বনাথ জবাব দিল না। দ্বিতীয় লোকটি বলল, দারোগাবাবু, আমি ওর উকিল। আমার মক্কেলকে কোন চার্জে ধরে নিয়ে এসেছেন জানতে পারি? কোর্টে গিয়ে জানবেন। না। আপনাকেই বলতে হবে। কারণ আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে কোনও স্পেসিফিক চার্জ আপনার নেই। কাল রাত্রে দুটো লোক ওদের গ্রামে গিয়ে রটিয়ে দিয়েছে যে ওরা ট্রেন-ডাকাত, সঙ্গে সঙ্গে ওকে আপনারা অ্যারেস্ট করে নিয়ে এলেন? উকিল ভদ্রলোক বেশ উত্তেজিত। সুদর্শন চুপচাপ শুনছিলেন। বললেন, মাননীয় উকিলবাবু, ওর বিরুদ্ধে আর একটি অভিযোগ আছে। গতরাতে দলবল নিয়ে ও আমার এলাকায় একটি বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। গৃহকর্তাকে না পেয়ে তার কাজের লোককে জখম করেছে। আর এইসব ঘটনার সাক্ষী আমাদের হাতে আছে। আপনি জামিন চাইলে কোর্টে আবেদন করতে পারেন। কাল রাত্রে? হ্যাঁ। অদ্ভুত ব্যাপার। কাল সারারাত ও শিলিগুড়ি হাসপাতালে জেগে বসে ছিল। ওর বন্ধুর বাবা মৃত্যুশয্যায়। ও যে সেখানে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত ছিল তার সাক্ষী অনেকেই। ডাক্তার নার্সদের সঙ্গে কথা বললেই জানা যাবে বিশ্বনাথ সেখানে ছিল কিনা। তা হলে নিশ্চয়ই ওর পক্ষে আপনার এলাকায় গিয়ে একই রাত্রে ওইসব কাজ করা সম্ভব নয়। তাই না? উকিল খুব দৃঢ়তার সঙ্গে প্রশ্ন করলেন। স্থানীয় দারোগা বললেন, তা হলে তো ব্যাপারটা জটিল হয়ে গেল। কোনও জটিল ব্যাপার নয়। একজন নিরপরাধ লোককে আপনারা জোর করে থানায় ধরে রাখতে পারেন না। উকিল জানালেন। সুদর্শন বললেন, পারি। সন্দেহজনক যে-কোনও মানুষকে আমরা থানায় ধরে আনতে পারি। আমরা ওকে আজই কোর্টে প্রোডিউস করে বিচারকের অনুমতি চাইব আরও কিছুদিন তদন্তের জন্যে পুলিশ হেপাজতে রাখতে। আপনারা বিরোধিতা করে যদি জামিন পেয়ে যান, ভাল কথা। ওর বিরুদ্ধে এফ আই আর আছে? আছে। জলপাইগুড়ির কোর্টে আসুন। স্থানীয় দারোগা বিশ্বনাথকে সুদর্শনের হাতে ছেড়ে দিয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। হাতকড়ি পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে সেপাইদের সঙ্গে জিপে বসিয়ে ওকে জলপাইগুড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন সুদর্শন। তাঁর পাশে বসে ছিল অর্জুন। কেউ কোনও কথা বলছে না। ফাটাপুকুরের কাছে আসতেই অর্জুন স্পষ্ট শুনতে পেল, বদমাশটা নিশ্চয়ই খবর পেয়ে গেছে। ও যদি রেল গেটে এসে দাঁড়ায়। অর্জুন চমকে তাকাতেই বিশ্বনাথের সঙ্গে চোখাচোখি হল। একটু বাদেই জিপ চলে এল রেলগেটের সামনে। এখন ট্রেনের সময় নয় বলে গেট খোলা। অর্জুন সুদর্শনকে বলল, জিপ থামাতে বলুন তো। ড্রাইভার জিপ থামাতেই অর্জুন নীচে নেমে দাঁড়াল। এখানে কেউ নেই। দূরে দোকানগুলোর সামনে কয়েকজন অলসভাবে রয়েছে। অর্জুন জিপের ভেতর মুখ ঢুকিয়ে বলল, হারাধন তো আসেনি। খবর পায়নি বোধ হয়। শোনামাত্র বিশ্বনাথ যে অবাক হয়েছে তা বোঝা গেল। সুদর্শন জিজ্ঞেস করলেন, কে হারাধন? বিশ্বনাথকে জিজ্ঞেস করুন। বিশ্বনাথ মুখ ফিরিয়ে নিতেই অর্জুন শুনতে পেল, এই লোকটা আমার মনের কথা জানল কী করে? ম্যাজিক জানে নাকি? বিশ্বনাথ, হারাধন কে? সুদর্শন গম্ভীর। আমি জানি না। পুলিশের জিপকে দাঁড়াতে দেখে দু-তিনজন কৌতূহলী এগিয়ে এসেছিল। অর্জুন তাদের সামনে গিয়ে বলল, ভাই, একটু হারাধনকে খবর দেবেন। খুব দরকার। একজন বলল, হারু তো ওই চায়ের দোকানের সামনে বসে আছে। অর্জুন চেঁচিয়ে ডাকল, সুদর্শনবাবু, চলে আসুন। সুদর্শন গাড়ি থেকে নেমে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, এই বদমাশ লোকটাকে আপনি কী করে জোগাড় করলেন? পরে বলব। একটু সাবধানে চলুন। আপনার সঙ্গে অস্ত্র আছে তো? ওটা না থাকলে অস্বস্তি হয়। চায়ের দোকানের সামনে পৌঁছে ওরা দেখল, গোটা তিনেক ছেলে গল্প করছে। কাউকে দেখতে অপরাধীর মতো নয়। সুদর্শন সাদা পোশাকে ছিলেন। ওরা কথা থামিয়ে তাকাল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, হারাধন কে? আমি, কেন? তোমার বন্ধু বিশ্বনাথ গাড়িতে বসে আছে, ডাকছে। কোন বিশ্বনাথ? মণ্ডলপাড়ার বিশ্বনাথ। আমি চিনি না। ওই নামে আমার কোনও বন্ধু নেই। এখানে তুমি ছাড়া আর কেউ আছে যার নাম হারাধন? খোঁজ নিন, আমি জানি না। ওর পাশের ছেলেটি বলল, আর কোনও হারাধন এখানে নেই। না থাকলে আমি কী করব? আমি বিশ্বনাথ বলে কাউকে চিনি না। সুদর্শন অর্জুনের দিকে তাকালেন। অর্জুন আরও দুপা এগিয়ে যেতেই শুনতে পেল, এরা নিশ্চয়ই পুলিশ। ভোলানাথ নিশ্চয়ই ধরা পড়ে নাম বলে দিয়েছে। কী করে পালানো যায়। অর্জুন বলল, ভোলানাথের নামই তো বিশ্বনাথ, তাই না? শোনামাত্র ছেলেটির চোয়াল ঝুলে গেল। অর্জুন বলল, বুঝতেই পারছ আমাদের কোনও ভুল হয়নি। জোর জবরদস্তি করলে সবাই জেনে যাবে। তার চেয়ে ভদ্রভাবে চলো, ওই জিপে তোমার বন্ধু বসে আছে। আমরা কোনও ঝামেলা করতে চাই না। ছেলেটি বাধ্য হল উঠে দাঁড়াতে। সুদর্শন বললেন, দৌড়ে পালাবার চেষ্টা কোরো না। পেছন থেকে গুলি ছুড়লে মাথায় লাগতে পারে। বলতে বলতে তিনি অস্ত্রটা বের করে দেখালেন। একটা কথাও না বলে হারাধন রাস্তাটা হেঁটে এসে জিপে উঠতেই সুদর্শনের নির্দেশে সেপাইরা তাকে হাতকড়া পরিয়ে দিল। বিশ্বনাথের পাশে বসেই হারাধন চাপা নিষ্ঠুর গলায় বলে উঠল, তুই আমাকে ধরিয়ে দিলি, এর শাস্তি তুই কল্পনাও করতে পারবি না। ইতিমধ্যে পিলপিল করে মানুষ ছুটে আসছে। স্থানীয় ছেলে হারাধনকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে এই খবরটা দ্রুত চাউর হয়ে যাচ্ছে। অর্জুন বলল, হারাধনের বাড়িতে চলুন, ডাকাতির জিনিসগুলো ওখানে থাকলেও থাকতে পারে। মাথা নেড়ে ড্রাইভারকে সোজা জোরে চালাতে বলে সুদর্শন গলা নামালেন, খেপেছেন? এই ক্রাউড পেছন পেছন যাবে। কেউ যদি খেপিয়ে দেয় তা হলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের ছিনিয়ে নেবে, আমার সঙ্গে ফোর্স নেই। ওদিকে পেছনের সিটে বন্দি অবস্থায়
false
shomresh
বড় বিচিত্র অনুভূতি। ধরাবাঁধা ব্যাখ্যায় তাকে ধরা যায় না। মেয়েটির শেষকৃত্য হবে সূর্য ওঠার মুহূর্তে। সেই অনুষ্ঠানে আমরা অংশ নেব। তুই সুদীপকে ডাক। কথাটা শেষ করে জয়িতা আবার ভেতরে ঢুকে গেল। আনন্দ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ তার নিজেকে একজন টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত বলে মনে হল। অতিক্রম করতে চায় সে কিন্তু এক একটা শেকড় এমনভাবে জড়িয়ে থাকে যে—। কাকে দোষ দেবে সে এ জন্যে? এখানে আসার পর জয়িতা যতটা সহজ এবং ভোলা মনে এগোচ্ছে ততটা সে কেন পারছে না? আনন্দ হাঁটতে শুরু করল। শিক্ষাই মানুষকে শিক্ষিত করে। একটু একটু করে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টাই তো আসল কথা। আস্তানায় ফিরে সুদীপকে সে বাইরে দেখতে পেল না। আনন্দ একটু বিস্মিত হল। তারপর ঘরের দরজা খুলে অন্ধকারে মুখ বাড়াল, সুদীপ? সুদীপের গলা ভেসে এল, বল্‌। ও তুই শুয়ে পড়েছিস! ওঠ। আবার উঠতে হবে কেন? সারাটা রাত এভাবে জেগে থাকা যায়? মেয়েটাকে সূর্যোদয়ের সময় সৎকার করা হবে। আমাদের তিনজনের সেখানে থাকা উচিত। আমাকে দেখলে ওরা খেপে যাবে না? যেতে পারে, আবার নাও পারে। তাহলে? রিস্ক নিতে হবে। আমি সঙ্গে মাল নিয়ে যাব। না। সেটা আরও শত্রুতা বাড়াবে। মেয়েটা কোথায়? ও-পাশে শুয়ে আছে। অ্যাঁ, এই ঘরে? তাছাড়া ঠাণ্ডায় যাবে কোথায়? ও একটু বেশি বকে, কিন্তু মনটা ভাল। এর মধ্যে মনের খবর নিয়ে ফেলেছিস। বাজে বকিস না। প্রেমট্রেম আমার দ্বারা হবে না। সুদীপ উঠে একটা মোমবাতি জ্বালাল, মোমবাতির স্টক শেষ হয়ে আসছে। অনেক কিছুই শেষ হয়ে আসছে। আনন্দ, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার যদির দলের স্বার্থের ক্ষতি না করে তাহলে তোদের কিছু বলার নেই। শুধু উটকো মন্তব্য করিস না। সুদীপ আবার পোশাক চড়িয়ে নিচ্ছিল। আনন্দ দেখল মেয়েটা খানিকটা দূরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। এই ঠাণ্ডায় কোন মানুষ ওইভাবে শুয়ে থাকতে পারে বিছানা ছাড়া? সে মেয়েটির কাছে গিয়ে বলল, ওঠো। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, ওকে তুলছিস কেন? এই ঘরে ওকে একা রেখে যেতে পারি না। মেয়েটি থতমত হয়ে উঠে বসল। সুদীপ তাকে ইশারায় ডাকল বেরিয়ে আসতে। কোন প্রতিবাদ না করে মেয়েটি ওদের সঙ্গে বেরিয়ে এল। আনন্দ লক্ষ্য করল মেয়েটি সুদীপের পেছন পেছন হাঁটছে। ব্যাপারটা তার ভাল লাগল না কিন্তু কোন মন্তব্য করল না সে। ভোর হতে আর দেরি নেই। আকাশে স্বর্গীয় রঙের খেলা শুরু হয়েছে। পাহাড়ের চুড়ায় বরফ আরও নিচে নেমে এসেছে। এই সময় ওরা চিকারটা শুনতে পেল। ওপাশের পাহাড় থেকে চিৎকার করতে করতে মানুষটা নেমে আসছে। আনন্দরা তখন গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। দৌড়তে দৌড়তে মানুষটা কাছে আসতে প্রথমে চিনতে পারেনি আনন্দ। ছেলেটা একটি অগ্নিকুণ্ডের সামনে পেীছে হাটু গেড়ে বসে পড়ল। ভিড়ের মধ্যে থেকে পালদেম ছুটে এল তার কাছে। ছেলেটা হাঁপাচ্ছে। প্রায় সাদা হয়ে গেছে ওর মুখ। আগুনের কাছে ওকে নিয়ে গিয়ে শুক্রষা চলল কিছুক্ষণ। কেউ যেন একটা পাত্রে খানিকটা তরল পদার্থ এনে ওর মুখে ঢেলে দিল। একটু ধাতস্থ হয়ে ছেলেটা কথা বলতে শুরু করল জড়িয়ে জড়িয়ে। খানিকটা শোনার পর পালদেম চমকে আনন্দের দিকে এগিয়ে গেল। ছেলেটির এক হাতে তখনও বিরাট ঝোলাটা ধরা। পালদেম সেটাকে ছাড়িয়ে নিল আস্তে আস্তে। পালদেমের দৃষ্টি অনুসরণ করে আনন্দ কাছে যাওয়ামাত্র ছেলেটি আচমকা কাদল। পালদেম মুখ নিচু করল। তারপর বলল, তোমাদের বন্ধুকে পুলিশ মেরে ফেলেছে। বুকের মধ্যে ধক্ করে লাগল আনন্দর। তার সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে গেল। কল্যাণ নেই? কল্যাণ। সে কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। পেছন থেকে সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে? পালদেম কি বলল? পালদেম বলল, তোমাদের বন্ধু আমাদের বন্ধু। না হলে সে আমাদের জন্যে ওষুধ আনতে যেত না। ওষুধ এনে এই ছেলেটির হাতে পৌঁছে দিতে পারত না। হঠাৎ ছুটে এল সুদীপ ছেলেটির সামনে। দুহাতে তাকে খামচে ধরে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে? কল্যাণের কি হয়েছে? ছেলেটি কোন কথা বলতে পারল না। কোনরকমে ঝোলাটাকে আঙুল দিয়ে দেখাল। সুদীপ সেখানে চাপ চাপ রক্ত দেখতে পেলার তকিয়ে কালচে হয়ে আছে। সে পাগলের মত ঝোলা খুলতেই প্রচুর ওষুধ এবং সিগারেটের প্যাকেট দেখতে পেল। সব কিছুই রক্তের হেয়ামাখা। হঠাৎ বউ হাউ করে কেঁদে উঠল সুদীপ। গ্রামের মানুষগুলো পাথরের মত মাথা নিচু করে চারপাশে দাঁড়িয়ে। আনন্দ কোন কথা বলতে পারছে না। তার চিন্তাশক্তি অসাড় হয়ে গিয়েছিল। সে কল্যাণের মুখটাকেই কনা করতে পারছিল না। এই সময় জয়িতার গলা পাওয়া গেল, পালদেম, কাহন বলছেন আর দেরি করা যাবে না। পালনে তার দিকে তাকাল। সুদীপ চিৎকার করে কেঁদে উঠল, জয়ী, কল্যাণ মরে গেছে। আমি–আমি ওকে–। জয়িতার মুখ অগ্নিকুণ্ডের আলোয় ঈশ্বরীর মত মনে হচ্ছিল। সে আন্দর দিকে তাকাল। তারপর গ্রামের মানুষদের বলল, আমাদের এক বন্ধুর কথা তোমরা শুনলে। এসো, এই সূর্যোদয়ের মুহূর্তে বাচ্চা মেয়েটির শরীর সৎকারের জন্যে নিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের বন্ধুর আত্মাকেও নিয়ে যাই। ও তোমাদের জন্যে একটা কাজ করতে গিয়েছিল। তোমাদের আপত্তি আছে? সবাই মাথা নাড়ল, না। না। না। শব্দটা ছড়িয়ে পড়ল হিমালয় পর্যন্ত। হঠাৎ সুদীপ বিড় বিড় করল, জয়ী, তুই মানুষ? হ্যাঁ, মানুষ। জয়িতা কান্নাটা সামলালো, কল্যাণ এখানে আমাদের পায়ের তলায় মাটি দিয়ে গেল। শহীদের জন্যে কাঁদব কেন? আমি গর্বিত। এখন দুপুর। কিন্তু আকাশে সূর্য আছে কিনা চোখ তুললে বোঝা যাচ্ছে না। হাওয়া বইছে। তার দাঁতের ধার
false
humayun_ahmed
থাকবে। নকল পিস্তল নিয়ে ফলাফলি করলে নেতা হওয়া যায় না। আতর বলল, চুপ! আরেকটা শব্দ করলে গুল্লি। এই দেখা পিস্তল। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখ আসল। আমি নকলের কারবার করি না। গুলি করবেন? অবশ্যই করব। আমার চোখের দিকে তাকা। তাহলেই বুঝবি আমি যা বলি স্বতা-ই করি; যা বলি না। তাও করি। রুস্তম সমর্থন আদায়ের জন্যে এদিক-ওদিক তাকাল। সবাই খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। সমর্থন পাওয়া গেল না। রুস্তম বলল, আপনি আপনার মতো কাজ করেন। আমি লঞ্চের ডেকে আছি। তেমন কোনো প্রয়োজন হলে ডাকবেন। আতর বলল, কানো ধর। কানে ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যা। আর আসবি কানো ধরব? কানে ধরব। অবশ্যই কালে ধরবি। যাত্রীদের একজন বলল, কানো ধরতে বলছে কানে ধরে চলে যান। ঝামেলা করেন কী জন্য? আছি বিপদে এর মধ্যে শুরু করেছেন ঝামেলা। যাত্রীদের একটা বড় অংশ বলল, কানো ধরা। কানো ধর। রুস্তম কানে ধরতেই হো হো হাসির শব্দ উঠল। বিপদের সময় ছোটখাটো মজাও অনেক মজাদার মনে হয়। কানে ধরে লিডারশ্ৰেণীর একজন মানুষ যাচ্ছে। দেখতেই ভালো লাগছে। একজন হাততালি দিল। তার দেখাদেখি অন্যরাও হাততালি দিতে লাগল। আতর মিয়া হুঙ্কার দিল, হাততালি দেওয়ার মতো কিছু হয় নাই। বলেন, আল্লাহু আকবার। গলার ব্লগ ফাটায়ে চিৎকার দিবেন। বিকট চিৎকার শোনা গেল, আল্লাহু আকবার! আতর বলল, এই লঞ্চে কিছু দুষ্ট লোক আছে। এইসব দুষ্ট লোকের কারণে আল্লাহপাক আমাদের উপর নারাজ হয়েছেন। দুষ্টরা সবাই এক এক করে আসবে। জীবনে বড় পাপ কী করেছে নিজের মুখে বলবে। তারপর তওবা করবে। রাজি? বিকট আওয়াজ উঠল, রাজি। সবার আগে আমরা প্রফেসর সাহেবকে দিয়ে শুরু করব। প্রফেসর সাহেব চার নম্বর কেবিনে আছেন। তাকে ধরে নিয়ে আসেন। কেবিনের সব যাত্রী এখানে চলে আসবে। আজি সব এক। কেবিনের যাত্রী ডেকের যাত্রী বলে কিছু নাই। পূর্ণ সমাজতন্ত্র। বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। সবাই বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আতর বলল, মহা বিপদে লিড়ার লাগে। একজন। দুই-তিনজন লিডার মানে দুই-তিন রকম চিন্তাভাবনা। মহা বিপদে আমাদের একটাই চিন্তা—বাঁচতে হবে। ] চিৎকার দিয়ে বলেন, বাঁচতে হবে। লঞ্চ কঁপিয়ে চিৎকার, বাঁচতে হবে! চিৎকারের কারণেই হয়তো লঞ্চ ডানদিক থেকে বাঁ দিকে কত হলো। অধ্যাপক ডক্টর জিলুর খান পিএইচডি (গ্লাসগো) হতাশ চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। তাঁর ফ্রেঞ্চকািট আগেই খানিকটা ঝুলে ছিল, এখন আরও স্কুলে পড়ল। দুজন তাঁকে দুপাশ থেকে ধরে ফাঁকা জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিল। জিলুর খান বললেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনারা আমার কাছে কী চান। আতর মিয়া বলল, বড় বড় পাপ কী করেছেন সেটা বলবেন। তারপর তওবা করবেন। ? সমাজের এইটাই সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত না মানলে লিখি দিয়ে পানিতে ফেলে। দেওয়া হবে। এইটাও সমাজের সিদ্ধান্ত। সমাজটা কী? আমরাই সমাজ। দেরি করবেন না। তাড়াতাড়ি বলেন। আমি অপরাধ করার মানুষ না। টুকটাক মিথ্যা হয়তো বলেছি, এর বেশি কিছু না। এর বেশি কিছু না? অবশ্যই না। তাহলে স্যার কিছু মনে করবেন না। আপনাকে এখন আমি লাখি দিয়ে পানিতে ফেলব। কেউ যেন মনে না করে সমাজ একজন নির্দোষ মানুষকে শাস্তি দিচ্ছে। এই জ্ঞানী প্রফেসর অসামাজিক কার্যের জন্য তার এক ছাত্রী নিয়ে এসেছে। ছাত্রী নিজের মুখে কী ঘটনা ঘটেছে বলবে, তারপর সমাজ সিদ্ধান্ত নিবে। ছাত্রীর নাম সীমা। সীমা সিস্টার উপস্থিত আছেন। সিস্টার আসেন কিছু বলেন। সীমা আতরের কাছে এগিয়ে গেল। আতর বলল, আপনার ভয়ের কিছু নাই। আপনি আপনার স্যারের ফান্দে পড়েছেন। ভুল করেছেন। এখন বলেন। আপনি কি ভুল করেছেন? সীমা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। আমরা যদি প্রফেসর সাহেবকে পানিতে ফেলে দেই আপনার আপত্তি আছে? সীমা চুপ করে রইল। আতর বলল, সিস্টার, আমরা আপনার স্যারকে দুদিক থেকে ধরে রাখব। আপনি ধাক্কা দিয়ে আপনার স্যারকে পানিতে ফেলবেন। পারবেন না? সীমা ভীত চোখে তাকিয়ে রইল। জবাব দিল না। আতর বলল, চোখ বন্ধ করে পীর বদরের নামে এক ধাক্কা। যাত্রীরা মহা উৎসাহে বলা শুরু করল, ধাক্কা ধাক্কা ধাক্কা। ডক্টর জিল্লুর বললেন, এটা কোনো মগের মুলুক না। এখানে বিচার-আচার আছে। ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেওয়া কোনো বিচার না। আতর বলল, সাঁতার জানেন না। স্যার? না। পানিতে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার। আপনি পানিতে নেমে সাঁতার শিখবেন। মাইনাস টু ফর্মুলা আপনাআপনি হয়েছে। আপনাকে দিয়ে হবে মাইন্যাস থ্রি ফর্মুলা। যাত্রীরা মহা উৎসাহে চিৎকার শুরু করল, মাইনাস থ্রি। মাইনাস থ্রি। ডক্টর জিলুর বললেন, এখানে বিচক্ষণ কেউ আছেন যিনি মাস হিস্টরিয়া বন্ধ করতে পারেন? প্লিজ হেলপ। প্লিজ। তৃষ্ণা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যাও। আতর মিয়া তোমার কথা শুনবে। আমি বললাম, এখনো সময় হয় নি। তৃষ্ণা বলল, সময় কখন হবে? পানিতে ফেলে দেওয়ার পর? হতে পারে। মানুষ ধরে ধরে পানিতে ফেলবে। আর তুমি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে? আমি বললাম, মানুষের একটাই ভূমিকা। দর্শকের ভূমিকা। প্রকৃতি মানুষকে তৈরি করেছে শুধুই দেখার জন্যে। আশেপাশে নানা ঘটনা ঘটবে, সে দেখবে। তৃষ্ণা বলল, মানুষ ঘটনায় অংশগ্রহণ করবে না? না করাই বাঞ্ছনীয়। কোঁকর কোঁ করে মোরগ ডেকে উঠল। আমরা চমকে তাকালাম। রশীদ খানকে ধরে আনা হয়েছে। তার পকেটের মোরগ ডেকেই যাচ্ছে। রশীদ বুদ্ধিমান মানুষ। কী ঘটনা আঁচ করতে পারছে। ধনবান মানুষরা নিজের ধন রক্ষা করার প্রবণতাতেই সর্ব সমস্যায় আপোষে চলে যায়। রশীদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে কী জন্যে ডেকেছেন বলুন। আতর বলল, আপনি
false
shunil_gongopaddhay
আর বিমানের কথাবার্তা শুনে চোরের সজাগ হয়ে যাওয়ার কথা। সে যদি সিঁড়ি দিয়ে নেমে পালাতে চায়, কাকাবাবুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাবে। সে ইচ্ছে করেও কাকাবাবুকে ঠেলে দিতে পারে। কাকাবাবু এবার রিভলভারটা বার করে তৈরি রাখলেন। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন আস্তে-আস্তে। সামান্য একটা চোর ধরার জন্য এতটা ঝুঁকি নেওয়ার কোনও মানে হয় না। কিন্তু এই ধরনের উত্তেজনা বোধ করতে কাকাবাবুর ভাল লাগে। ছাদের দরজাটা একেবারে হাট করে খোলা। যদি দরজার পাশেই কেউ লুকিয়ে থাকে, সেইজন্য কাকাবাবু টর্চ দিয়ে দেখে নিলেন ভাল করে। একটা ক্রাচ বাড়িয়ে দিলেন প্রথমে। কেউ কিছু করল না। এবার কাকাবাবু ঢুকে পড়লেন ছাদে। কেউ কোথাও নেই। শব্দটা থেমে গেছে অনেক আগেই। এত বড় ছাদ যে, অন্য দিক দিয়ে পাঁচিল টপকে কারও পক্ষে পালিয়ে যাওয়া খুবই সহজ। ছাদের ঘর সাধারণত সিঁড়ির পাশেই থাকে। এটা কিন্তু তা নয়। সিঁড়ি থেকে অনেকটা দূরে, মাঝামাঝি জায়গায় বেশ বড় একটা ঘর। এক সময় যত্ন করে তৈরি করা হয়েছিল। চার-পাঁচখানা শ্বেতপাথরের সিঁড়ি, তারপর দরজা। কাকাবাবু সেদিকে এগিয়ে যেতে-যেতে আন্দাজ করলেন যে, এই ঘরটার প্রায় নীচেই দোতলায় তাঁর ঘর। এ-ঘরের দরজাটা বেশ শক্তপোক্ত রয়েছে এখনও। আগেকার দিনের কায়দা অনুযায়ী সেই দরজার তলার দিকে একটা শিকল, ওপর দিকে একটা শিকল। দুটো শিকলেই তালা দেওয়া। পেতলের বেশ বড় তালা। কেউ একজন এই শিকল খোলার ও তালা ভাঙার চেষ্টা করেছিল। কাকাবাবু টর্চ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে সিঁড়ির নীচটা ভাল করে দেখলেন। বৃষ্টিতে ছাদে জল জমেনি বটে, তবে অনেক দিনের পুরু ধুলো ভিজে দইয়ের মতন হয়ে আছে। তার ওপর পায়ের ছাপ। কাকাবাবু যদি শার্লক হোমসের মতন গোয়েন্দা হতেন, তা হলে সেই পায়ের ছাপ মাপবার চেষ্টা করতেন বসে পড়ে। কিন্তু ওসব তাঁর ধাতে পোষায় না। তিনি শুধু লক্ষ করলেন, আসা ও যাওয়ার দুরকমের ছাপ। যে এসেছিল, সে এসেছিল পা টিপেটিপে, গোড়ালির ছাপ পড়েনি। আর যাওয়ার সময় গেছে দৌড়ে। একটু দূরে গিয়েই মিলিয়ে গেছে, সেখানটায় শ্যাওলা। কাকাবাবু মনে-মনে বললেন, বিমানের পাগলাদাদু বেশ ভালই থাকবার জায়গা পেয়েছিল। এই ঘরটাই এ-বাড়ির শ্রেষ্ঠ ঘর বলা যায়। চতুর্দিক খোলা। আজ যদি জ্যোৎস্না থাকত, তা হলে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যেত। কাকাবাবু নীচে নেমে আসার পরই বিমানের গলা শোনা গেল। সে দরজার কাছেই ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছিল। সে জিজ্ঞেস করল, কী হল কাকাবাবু? কাকাবাবু হালকা গলায় বললেন, ভূত দেখা আমার ভাগ্যে নেই। তোমার পাগলাদাদুকে দেখা গেল না। ওখানে কেউ নেই। সকালবেলা চায়ের পাট শেষ করার পর বিমান বলল, চলুন, এবার আপনাদের সারা বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখানো যাক। প্রথমে কোনদিকে যাবেন? নীচের তলা থেকে শুরু করব? অসিত বলল, না, না, আগে ছাদের ঘরটা দেখব। ওই ঘরটা সম্পর্কে এমন গল্প বলেছেন যে, কৌতূহলে ছটপট করছি। দীপা বলল, সেই ভাল। আগে ছাদটা ঘুরে আসা যাক। বিমান তার ব্যাগ থেকে একটা চাবির তোড়া বার করল। তাতে অন্তত পঞ্চাশ-ষাটটা চাবি। অসিত ভুরু তুলে বলল, এত চাবি? বিমান বলল, আগে তো সব ঘরের জন্যই তালা-চাবি লাগত। এখন অবশ্য অনেক চাবিই কাজে লাগে না। দীপা বলল, কাল রাত্তিরে চোর এসেছিল। ছাদে তো তালা লাগাতে পারোনি! বিমান বলল, ছাদের দরজার একটা পাল্লা যে ভাঙা! অসিত বলল, অ্যা! কাল চোর এসেছিল? কখন? কাকাবাবু বললেন, তখন রাত প্রায় দুটো। অসিত বলল, আমি কিছু টের পাইনি তো! একবার ঘুমিয়ে পড়লে আমার আর ঘুম ভাঙে না। সবাই মিলে চলে এল ছাদে। আগের দিন অনেকক্ষণ বৃষ্টি হলে পরের দিনের সকালটা বেশি ফরসা দেখায়। ঝকঝক করছে রোদ। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। একদিকের ছাদের কার্নিসে একটা বেশ বড়, খয়েরি রঙের ল্যাজ-ঝোলা পাখি বসে আছে চুপটি করে। দীপা জিজ্ঞেস করল, ওটা কী পাখি? কাকাবাবু বললেন, ইষ্টকুটুম। দীপা বলল, কী সুন্দর পাখিটা! ইষ্টকুটুমের নামই শুনেছি, দেখিনি কখনও। ওর একটা ছবি তুলে রাখব, ক্যামেরাটা নিয়ে আসি। দেখবেন যেন পাখিটা উড়ে না যায়! কাকাবাবু হেসে বললেন, সে-দায়িত্ব কিন্তু আমরা নিতে পারব না। দীপা ক্যামেরা আনবার জন্য নীচে ছুটে যেতেই পাখিটা উড়ে চলে গেল! বিমান বলল, যাঃ— অসিত পাখির দিকে মনোযোগ দেয়নি। সে এগিয়ে গেল ঘরটার দিকে। কাকাবাবু তার পাশে-পাশে হাঁটতে-হাঁটতে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি যে অ্যান্টিকের ব্যবসা করেন, আপনার কি কলকাতায় কোনও দোকান আছে? অসিত বলল, না। দোকান-টোকানে বসা আমার পোষায় না। লন্ডনের এক অ্যান্টিক ডিলারের সঙ্গে আমার পার্টনারশিপ আছে। আমি নানা দেশ ঘুরে-ঘুরে খাঁটি জিনিস জোগাড় করি। সে বিক্রি করে। অস্ট্রেলিয়াতেও একটা দোকানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে, ওরা খুব কেনে। বিমান চাবির তোড়া থেকে এই পাগলাদাদুর ঘরের তালার চাবি খুঁজছে। কাকাবাবু বললেন, এই ঘরটায় এত বড় আর শক্ত পেতলের তালা কেন? অন্য ঘরে তো দেখিনি! বিমান বলল, কী জানি! অনেকদিন ধরে এখানে এ-তালাই ছিল, তাই রয়ে গেছে। এ-ঘরটায় দামি জিনিস কিছু না থাকলেও একটা খাট আছে, একটা অনেকগুলি ড্রয়ারওয়ালা টেবিল আছে। কাকাবাবু বললেন, খাট আছে? বাঃ, তা হলে আজ রাত্তিরে আমি এ-ঘরেই থাকব। বিমান বলল, না, না, তা হয় নাকি? ছাদের ওপর আপনি একা-একা থাকবেন? কাকাবাবু বললেন, এটাই তো এবাড়ির সবচেয়ে সুন্দর ঘর। আমার এখানেই থাকতে ভাল লাগবে। খাট যখন আছে, একটা তোশক আর বালিশ এনে দিলেই চলবে। অসিত বলল, থাকার পক্ষে এই ঘরটা কিন্তু সত্যিই আইডিয়াল! কাকাবাবু মাথা নেড়ে বললেন,
false
shordindu
করেই চাকর রাখিনি। প্রত্যেক শনিবার দুপুরবেলা সুকুমারী নিজের বাসা থেকে ভাড়াটে বাসায় চলে আসে‌, ঘরদের পরিষ্কার করে রাখে। আমি বিকেলবেলা যাই। তারপর সোমবারে আমি অফিসে চলে যাবার পর‌, সে বাড়িতে তালা দিয়ে নিজের বাসায় ফিরে যায়। হাপ্তার বাকি দিন বাড়ি বন্ধ থাকে।’ প্রশ্ন : টেলিফোন রেখেছেন কেন? উত্তর : নিজের জন্য নয়‌, সুকুমারীর জন্যে। সে যে-সময় ভাড়াটে বাড়িতে থাকে‌, সে-সময় নিজের বাসার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায়। কিন্তু প্ৰাইভেট নম্বর‌, ডিরেকটরিতে পাবেন না। প্রশ্ন : সেক্রেটারিকে নম্বর বলেননি? উত্তর : না। প্রশ্ন : কার জানা সম্ভব? উত্তর : কারুর জানা সম্ভব নয়। আমি কাউকে বলিনি‌, সুকুমারীও কাউকে বলবে না। প্রশ্ন : তাঁকে আপনি বিশ্বাস করেন? উত্তর : করি। আমি তাকে মাসে হাজার টাকা দিই। সে নির্বোধ নয়‌, নিজের পায়ে কুডুল মারবে না। প্রশ্ন; আজ যখন টেলিফোন পেলেন‌, তখন আপনি কি করছিলেন? উত্তর : কীর্তন শুনছিলাম। সুকুমারী চণ্ডীদাসের পদ গাইছিল। এ কে রে ব্যোমকেশের পানে চক্ষু ফিরাইলেন; ব্যোমকেশ নিঃশব্দে মাথা নাড়িল‌, অর্থাৎ‌, আর কোন প্রশ্ন নাই। তখন এ কে রে গাত্ৰোত্থান করিয়া বলিলেন‌, ‘আজ এই পর্যন্ত থাক। কষ্ট দিলাম‌, কিছু মনে করবেন না। আজ কি আপনি আবার–?’ ‘না‌, ফিরে যাব না‌, বাড়িতেই থাকব।’ সন্তোষবাবুর গভীর চোখে কৌতুকের কটাক্ষ খেলিয়া গেল‌, তিনি বলিলেন‌, ‘আমার পিছনে গুপ্তচর লাগিয়ে আমার বাসার সন্ধান পাবেন না।’ এ কে রে জিভ কাটিয়া বলিলেন‌, ‘না না‌, সে কি কথা! আপনার গুপ্ত বাসা সম্বন্ধে আমার তিলমাত্র কৌতূহল নেই। আপনি যা বললেন‌, আমাদের তদন্তের পক্ষে তাই যথেষ্ট। কেবল-শ্ৰীমতী সুকুমারীর সঙ্গে একবার দেখা করতে পারলে ভাল হত।’ ‘তাকে তার বাসার ঠিকানায় পাবেন।’ সন্তোষবাবু সুকুমারীর ঠিকানা দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন‌, ‘দশটা বাজে। আপনার কাজ বোধহয় এখনো শেষ হয়নি‌, যতক্ষণ দরকার থাকুন।। ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি আমার পক্ষ থেকে ইন্সপেক্টরের সঙ্গে থাকবেন তো?’ ‘নিশ্চয়’ বলিয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল। সন্তোষবাবু বলিলেন‌, ‘আচ্ছা‌, আমি তাহলে বিশ্রাম করি গিয়ে। একটু ক্লান্তি বোধ হচ্ছে।’ তিনি দৃঢ়পদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। তাঁহার শরীরে ক্লান্তির কোন লক্ষণ চোখে পড়িল না। বোধহয় মনের ক্লান্তি। বাড়িতে এতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়া যাইবার পর– সন্তোষবাবু যেভাবে তাঁহার গুপ্তকথা প্রকাশ করিলেন তাহাতে ঢাকাঢাকা গুড়গুড় নাই‌, নিজের সম্বন্ধে সাফাই গাঁহিবার চেষ্টা নাই—জীবনের গৃঢ় সত্য কথা যখন বলিতেই হইবে তখন স্পষ্টভাবে বলাই ভাল। তবু তাঁহার নির্মম সত্যবাদিতা আমার মনকে পীড়া না দিয়া পারিল না। তিনি পাকা ব্যবসায়ী এবং ঝানু রাজনীতিজ্ঞ‌, তাঁহার চরিত্রে এই কালো দাগটা না থাকিলেই বোধহয় ভাল হইত। এ কে রে ব্যোমকেশকে প্রশ্ন করিলেন‌, ‘অতঃপর?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চল‌, হেনার ঘরটা একবার দেখে যাই।’ ‘চল।–ছাদে যাবে নাকি?’ ‘যাব। এসেছি। যখন‌, যা-যা দ্রষ্টব্য আছে সবই দেখে যাই।’ হল-ঘরের গোল টেবিলের কাছে বসিয়া পুলিসের বাকি কর্মচারীরা নিম্নস্বরে বাক্যালাপ করিতেছিলেন‌, রবিবর্মা ছাড়া বাড়ির লোক আর কেহ উপস্থিত ছিল না। হেনীর ঘর ডাইনিং-রুম হইতে কোনাকুনিভাবে হল-ঘরের অপর প্রান্তে। [প্ল্যান পশ্য]। হেনার ঘরের দ্বার ঈষৎ উন্মুক্ত‌, আলো জ্বলিতেছে। আমরা তিনজনে ঘরে প্রবেশ করিলাম। রবিবর্মা আমাদের পিছন পিছন আসিল। ঘরটি বেশ বড়। সদরের দিকে ধনুরাকৃতি বড় জানালা‌, পূর্বদিকের দেয়ালেও একটি সাধারণ জানালা আছে। এই জানালার সামনে টেবিল ও চেয়ার‌, পাশে বইয়ের শেলফ। ঘরের অন্য পাশে সংকীর্ণ একহারা খাটের উপর বিছানা পাতা; খাটের নীচে বড় বড় দু’টি সুটকেস দেখা যাইতেছে। উত্তরদিকের দেয়ালের কোণে একটি সরু দরজা সংলগ্ন বাথরুমের সহিত সংযোগ স্থাপন করিয়াছে। ঘরে আসবাবের বাহুল্য নাই‌, তাই ঘরটি বেশ পরিচ্ছন্ন দেখাইতেছে। সম্ভবত হেনাও পরিচ্ছন্ন স্বভাবের মেয়ে ছিল। ঘরের মাঝখানে দাঁড়াইয়া চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিতে করিতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঘরের দরজা কি খোলা ছিল?’ এ কে রে বলিলেন‌, ‘না‌, তালা লাগানো ছিল। মৃতদেহের হাতে একটা চামড়ার হ্যান্ড-ব্যাগ ছিল‌, তার মধ্যে চাবির রিঙ পাওয়া গেছে। এই যে।’ তিনি পকেট হইতে একটি চাবির গোছা বাহির করিয়া দিলেন। চাবি হাতে লইয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হেনা তাহলে ঘরে তালা দিয়ে ছাদে গিয়েছিল।’ এ কে রে বলিলেন‌, ‘তাই তো দেখা যাচ্ছে।’ রবিবর্মা মুখের সামনে মুষ্টি রাখিয়া কাশির মত একটা শব্দ করিল। ব্যোমকেশ তাহার দিকে চক্ষু ফিরাইলে সে বলিল‌, ‘হেনা দোর খুলে রেখে ঘর থেকে কখনো এক পা বেরুতো না‌, যখনি বেরুতে দোরে তালা দিয়ে বেরুতো।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাই নাকি? গোড়া থেকেই এই রকম‌, না‌, কোন উপলক্ষ হয়েছিল?’ ‘গোড়া থেকেই এই রকম।’ ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না‌, চাবির রিঙ পর্যবেক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘পাঁচটা চাবি রয়েছে দেখছি। একটা তো দোরের তালার চাবি। আর অন্যগুলো?’ এ কে রে বলিলেন‌, ‘বাকিগুলোর মধ্যে দুটো হচ্ছে সুটকেসের চাবি। অন্য দুটো কোথাকার চাবি জানা গেল না।’ ব্যোমকেশ চাবিগুলি একে একে পরীক্ষা করিয়া বলিল‌, ‘একটা চাবিতে নম্বর খোদাই করা রয়েছে-৭ নম্বর। দেখ তো‌, এ চাবিটা কোথাও লাগে কি না।’ এ কে রে চাবিটি দেখিয়া বলিলেন‌, ‘না। যে চাবি দুটোর তালা পাওয়া যাচ্ছে না‌, এটা তারই একটা।’ ‘টেবিলের দেরাজে। গা-তালা নেই?’ ‘আছে। কিন্তু দেরাজগুলো সব খোলা। চাবি নেই।’ ‘হুঁ।–কি মনে হয়?’ দু’জনে চোখে চোখে ক্ষণেক চাহিয়া রহিল‌, শেষে এ কে রে বলিলেন‌, ‘বলা শক্ত। অনেক সময় দেখা যায়। তালা হারিয়ে গেছে‌, কিন্তু চাবিটা রিঙে রয়ে গেছে।’ ব্যোমকেশ রবিবর্মার দিকে চাহিয়া বলিল‌, ‘আপনি কিছু বলতে পারেন?’ রবিবাম ঘাড় নাড়িল‌, ‘এ-ঘরের ভিতরের কথা আমি কিছু
false
MZI
যা দেখেছ সেটার কোনো মাথা মুণ্ডু আছে? আমার কাছে তো মনে হচ্ছে পরিষ্কার নরক। কেন খামোকা ভয় দেখাচ্ছ লোকজনদের, লু একটু বিরক্ত হয়ে বলল, এটা যদি সেনাবাহিনীর মহাকাশযান হত, তাহলে এতক্ষণে তোমার কোর্ট মার্শাল হয়ে যেত। সুশান, তোমার এত ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, আমাদের এই মহাকাশযান গবেষণার জন্যে হতে পারে, কিন্তু দরকার হলে আমাদের হাজার মাইলের ভিতর যা কিছু আসে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি। কাজেই যতবড় বুদ্ধিমান প্রাণীই আসুক, তোমার কোনো ভয় নেই। লু মোটেই বাজে কথার মানুষ না, তা ছাড়া একটা অবস্থার গুরুত্ত্ব তার মতো ভালো করে কেউ বুঝতে পারে না, খামোকা তাকে এরকম একটা মহাকাশযানের দলপতি বানানো হয় নি। তাই লুয়ের কথা শুনে সত্যি সত্যি সুশানের চাপা ভয়টা কমে কেমন একটা সাহসের ভাব এসে যায়। সে একটু এগিয়ে মহাকাশযানটাকে কক্ষপথে আটকে ফেলার কাজে লুকে সাহায্য করতে গেল। মহাকাশযানটিকে তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে আবর্তন শুরু করাতে দু’জনের প্রায় দশ মিনিট সময় লেগে যায়। কাজটা খুব যে সুচারুভাবে করা হল সেরকম বলা যায় না, প্রথমত কক্ষপথ পুরোপুরি বৃত্তাকার না হয়ে খানিকটা উপবৃত্তাকার হয়ে গেল, দ্বিতীয়ত গ্রহ থেকে দূরত্ব পুরোপুরি এক হাজার কিলোমিটার না হয়ে প্রায় এক শ’ কিলোমিটার বেশি হয়ে থাকল। কম্পিউটার সিডিসিকে ব্যবহার না করে নিজে নিজে চেষ্টা করলে এর থেকে ভালো অবশ্যি কেউ আশা করে না। তবে আজ একটু বাড়তি মজা হল, যখন সুশান কৃত্রিম মহাকর্ষ তৈরি করতে ভুলে যাওয়ায় মিনিট দুয়েক সবাই খানিকক্ষণ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। পল কুম তার ভেসে বেড়ানো গরম কফিটাকে মর্গে ঢোকানোর চেষ্টা করছে। দৃশ্যটি এত হাস্যকর যে, এই নিয়ে হাসাহাসি হৈচৈ করে সবার ভিতরের চাপা অশান্তিটা বেশ একটু কমে আসে। সিসিয়ানকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে এলে সবাই রুটিনবাঁধা কাজে লেগে যায়, নিজেদের দায়িত্ব কম, সিডিসি নিজেই সব করতে পারে; তবু কেউ-না-কেউ সেটা নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হয়ে নেয়। ছয় মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে মহাকাশকেন্দ্রে যোগাযোগ করে সংবাদের আদান-প্রদান হতে থাকে, সিডিসি নতুন পরিবেশের উপযোগী প্রয়োজনীয় খবরাখবর নিয়ে আসতে থাকে। দেখা গেল কাছাকাছি একটা পালসার রয়েছে, সেটিতে ছয় ঘন্টা পরপর একবার করে বিস্ফোরণ ঘটে। তাদের নতুন অবস্থান এই পালসারটিকে কেন্দ্র করে দেয়া হল। নির্দিষ্ট সময় পরপর পালসারের বিস্ফোরণ ঘটে বলে সেগুলি কেন্দ্রীয় মহাকাশকেন্দ্রে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। প্রয়োজনীয় কাজকর্ম গুছিয়ে নিতে নিতেই লু তাদের প্রথম আলোচনাসভা ডেকে বসে। কোনো আলোচনা শুরু করার আগে তার সবসময়েই একটা ছোটখাটো বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস, এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। সে এভাবে শুরু করে, সিসিয়ান সময় সকাল সাড়ে নয়টা, আমাদের আলোচনা শুরু হচ্ছে। আলোচনায় দলের সবাই ছাড়াও অংশ নিচ্ছে সিসিয়ানের মূল কম্পিউটার সিডিসি। আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ-কর্মপন্থা। তোমরা সবাই জান যে, আমরা একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় এসে পড়েছি। ট্রাইটন নামের যে-গ্রহটাকে সিসিয়ান এখন পাক খাচ্ছে, সেটার কোনো বিশেষ দোষ আছে, যার জন্যে আমাদের সবার, বিশেষ করে যারা জৈবিক প্রাণী, তাদের ভিতরে একটা আশ্চর্য অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে। অকারণ অস্বস্তি জিনিসটা ভালো না, আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না, কিন্তু কিছু করার নেই। আমাদের দায়িত্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এখানে থাকতে হবে। কারো কিছু বলার আছে? সবারই কিছু-না-কিছু বলার আছে, তবে বিষয়বস্তু মোটামুটি এক। শুরু করল পল কুম, জিজ্ঞেস করল, আমাদের দায়িত্বটা কি? যদি গ্ৰহটাতে কোনো প্রাণের বিকাশ না হয়ে থাকে, তা হলে আমাদের দায়িত্ব খুবই কম, সব রুটিনবাঁধা কাজ। ট্রাইটনের আকার, আকৃতি, ভর, তাপমাত্রা, বায়ুমণ্ডল, ঘনত্ব এইসব জিনিস জেনে যেতে হবে। আমাদের তা হলে কিছু করতে হবে না, সিডিসি এক দিনে শেষ করে ফেলতে পারবে। সিডিসি, ঠিক বলেছি কি না? সিডিসি বিপবিপজাতীয় একটা শব্দ করল, যার অর্থ অনেক কিছু হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে সবাই জানে এটা সিডিসির সম্মতিসূচক উত্তর। আর গ্রহটিতে যদি প্রাণের বিকাশ হয়ে থাকে? লু তার কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে বলল, তা হলে আমাদের কাজ একটু জটিল। প্রথমে প্রাণীটি বুদ্ধিমত্তার কোন স্তরে সেটা বের করতে হবে। বুদ্ধিমত্তায় নিনিষ স্কেলে যদি আটের কম হয়, তা হলে আমাদের দায়িত্ব মোটামুটি সহজ, সেটিও রুটিনবাঁধা কাজ, সিডিসিকে নিয়ে আমরা এক দিনে শেষ করে দিতে পারব বলে মনে হয়। কিন্তু বুদ্ধিমত্তা যদি নিনিষ স্কেল আটের বেশি কিন্তু দশের নিচে হয়, যার অর্থ প্রাণীটি মানুষের সমপর্যায়ের, তা হলে আমাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি, গরুর মতো খেটেও কয়েক সপ্তাহে শেষ করতে পারব কি না সন্দেহ। কারণ তা হলে আমাদের প্রথম পর্যায়ের যোগাযোগ শেষ করে দ্বিতীয় পর্যায়ের যোগাযোগ শুরু করতে হবে। তৃতীয় পর্যায়ের যোগাযোগের দায়িত্ব আমাদের নয়, কেন্দ্রীয় মহাকাশকেন্দ্রের, তবে আমাদের তাদের সাথে সহযোগিতা করতে হবে— কিম জিবান বাধা দিয়ে বলল, প্রথম পর্যায় দ্বিতীয় পর্যায় ব্যাপারগুলি একটু বুঝিয়ে দেবে? লু পল কুমের দিকে তাকিয়ে বলল, পল, তুমি তো এসব ভালো জান, বুঝিয়ে দেবে সবাইকে? পল কুম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, এগুলি হচ্ছে ধোঁকাবাজি, বড় বড় হর্তাকর্তাদের কোনো কাজকর্ম নেই বলে এরা বসে বসে নানারকম নিয়মকানুন তৈরি করে। সিডিসি বিবি শব্দ করে আপত্তি করায় সবাই বুঝতে পারে পল কুমের কথাটি অন্তত পঞ্চম মাত্রার অপরাধ। সেটা নিয়ে পল কুমের কোনো মাথাব্যথা দেখা গেল না, সে বলে চলল, সাদা কথায় বলা যায় মানুষের সমপর্যায়ের কোনো প্রাণী পাওয়া গেলে আমাদের দায়িত্ব তাদের
false
shottojit_roy
মড়ক লেগে সব কিছু মরেটরে ভূত হয়ে গেছে। তবে তারমধ্যেও দেখলুম। আপনার পায়ের ছাপ ঠিকই রয়েছে; আর দেখলে মনে হয়—অন্তত ক্যাবলা তাই বললে—যে আপনি যেন যাকে বলে দৃপ্ত পদক্ষেপেই এগিয়ে চলেছেন। আরও দশ মিনিট চলার পরেই কী সব যেন শব্দ কানে আসতে লাগল—দুমদাম ধুপ ধাপ খচখচ—নানারকম শব্দ। ক্যাবলা দেখি তার বন্দুকটাকে বাগিয়ে ধরেছে। আমার কিছুই ধরার নেই—এমনকী লাঠিখানাও ছাই তাঁবুতে ফেলে এসেছি—তাই ক্যাবলার কাঁধখানাই খাবলে ধরলুম। কিছুটা পথ চলার পর এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলুম, আর সেই সঙ্গে শব্দের কারণও বুঝতে পারলুম। আমার তো এমনিতে মৃত্যুভয় নেই, কারণ জানি সেভেনটি এইটের আগে মরব না, কিন্তু তাও যা দেখলুম। তাতে গলা শুকিয়ে রক্ত জল হয়ে গেল। দেখি কী-বনের মধ্যিখানে একটা খোলা জায়গা। আগে খোলা ছিল না-আশেপাশের সব গাছফাছ কেটে জায়গাটাকে পরিষ্কার করা হয়েছে। সেই খোলা জায়গার মধ্যিখানে রয়েছে। কাঠের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা কাঠের তৈরি একটা বেশ বড় রকমের বাড়ি। পাঁচিলের মধ্যিখানে আমরা যেদিক দিয়ে আসছি সেদিকে রয়েছে একটা ফটক। আর সেই ফটক আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক প্রহরী। কিন্তু সে প্রহরী মানুষ নয়, সে এক সাক্ষাৎ দানবতুল্য গেরিলা। আমাদেরই দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটা, অথচ দেখে মনে হয় সেটা যেন আমাদের দেখতেই পাচ্ছে না। ফটকের ফাঁক দিয়ে ভেতরের কম্পাউন্ডটা দেখা যাচ্ছিল; সেখানে দেখি-কী অন্তত পক্ষে শদুয়েক গেরিলা। তাদের কেউ টহল ফিরছে, কেউ মোট বইছে, কেউ কাঠ কাটছে, আর আরও কত কী যে করছে যা বাইরে থেকে ভাল বোঝাও যায় না। আপনার পায়ের ছাপ বলছে যে আপনি সটান ওই ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছেন। কোথায় গেছেন, বেঁচে আছেন কি মরে গেছেন, তা মা গঙ্গাই জানেন। আমি তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়, কিন্তু ক্যাবলা দেখলুম। আদপেই ঘাবড়ায়নি। বললে, ভেতরে যাওয়া দরকার, কিন্তু বুঝতেই পারছি—ফটিক দিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ, আর বন্দুকটা থেকেও না থাকার সামিল। আমি বললুম, দেন হোয়াট ইউ ড়ুইং? ক্যা বলা, উত্তর দিলে না। সে মাথা তুলে এদিক ওদিক গাছের দিকে চেয়ে দেখতে লাগল। তারপর একটা প্রায় মনুমেন্টের মতো গাছের উপরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললে, ওই যে দেখছ ঝুলন্ত লতাটা গাছের ডালের সঙ্গে পাকিয়ে রয়েছে, মনে হচ্ছে ওইটের প্যাঁচ খুলে ঝুলে পড়লে ওই কাঠের বাড়ির চালে পৌঁছানো যাবে। আমি বললুম, হু গো? ক্যাবলা বললে, আমি তো যাবই, কিন্তু তুমি বাইরে একা থেকে কী করবে? আর তোমার বন্ধু তো ভিতরে। আমার মতে দুজনেরই যাওয়া উচিত। বললুম, বাট গেরিলা? ক্যাবলা বললে, আমার ধারণা গেরিলারা ম্যাসিংহামের আদেশ ছাড়া কিছু করবে না। ম্যাসিংহাম কিছু জানতে না পারলেই হল। চলো—সময় বেশি নেই—আর গ্রেগরি শঙ্কু দুজনেই বিপন্ন। বলব কী মশাই-ছেলেবেলায় টাজনের বই দেখে কত আমোদ হয়েছে, কিন্তু সেই আফ্রিকার জঙ্গলে এসে কোনওদিন যে আবার আমাকেইটাজনের ভূমিকা নিতে হবে সে তো আর কস্মিনকালেও ভাবতে পারিনি। ক্যাবলা দেখলুম চোখের নিমেষে ওই রামঢ্যাঙা গাছটা বেয়ে তরতরিয়ে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ হাত উপরে উঠে গেল। তারপর লতাটার নাগাল পেয়ে সেটার প্যাঁচ খুলতে শুরু করল। খোলা হলে পর সেটা ছেড়ে দিতেই সেটা মাটিতে পৌঁছে গেল। ক্যাবলা প্রথমে সেই লতা বেয়ে মাটিতে নেমে চোখের একটা আন্দাজ করে নিলে। তারপর লতার মুখটা হাতে ধরে গুড়ি বেয়ে গাছের আরেকটা ডালে গিয়ে উঠলে। সেখান থেকে সে আমায় ইশারা করে বুঝিয়ে দিলে যে সে লতাটা ধরে ঝুলে পড়ে দোল খেয়ে কাঠের বাড়ির ছাতে গিয়ে নামছে; নেমেই সে লতাটাকে আবার ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। আমি যেন ঠিক সেই ভাবেই দোল খেয়ে চলে যাই; একবার সেখেনে পৌছেলে সে নিজেই আমাকে ধরে নামিয়ে নেবে। আমি ইষ্টনাম জপ করতে শুরু করলুম। আপত্তির সব কারণগুলো বলতে হলে অনেক ইংরেজি বলতে হয়, আবার যদি শুধু নে বলি তো ভাববে। কাওয়ার্ড—তাতে বাঙালির বদনাম হয়। তাই চোখ বুজে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে বলে দিলুম—ইয়েস, ভেরি গুড। তিন মিনিটের মধ্যে টাজনের খেল দেখিয়ে ক্যাবলা কাঠের বাড়ির ছাদে পৌঁছে গেল। তারপর লতাটাকে ছেড়ে দিতেই সেটা আবার সাঁই করে দুলে ফিরে এল, আর আমিও সেটাকে খপ করে ধরে নিয়ে গাছে চড়তে শুরু করলুম। কীভাবে চড়িচি সে আর বলে কাজ নেই; হাঁটুর আর কনুইয়ের অবস্থা তো আপনি নিজের চোখেই দেখতে পাচ্চেন। ডালের উপর পৌঁছে লতোটাকে নিজের কোমরের চারপাশটায় বেশ করে পেচিয়ে নিলুম। তারপর দুগগা বলে চোখ কান বুজে, ডাল থেকে দিলুম ঝাঁপ। একটা যেন প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া, আর তার সঙ্গে কানের মধ্যে সনসন, পেটের মধ্যে গুড়গুড়, আর হাত পা যেন ঝিমঝিম—কিন্তু পরীক্ষণেই দেখলুম। আমি একেবারে ক্যাবলার খপ্পরে। সে আমাকে জাপটে ধরে আমার কোমর থেকে লতার প্যাঁচ খুলে দিলে, আর আমিও হাঁপ ছাড়লুম। ঠাকুরমার দেওয়া অবিনাশ নামটা যে কত সার্থক সেটাও তখনই বুঝলুম। এবার ক্যাবলা ইশারা করে ছাদের মধ্যিখানে একটা উচু মতো চৌখুপির দিকে দেখালে। বুঝলুম সেটা একটা স্কাইলাইট-যেমন আমাদের গিরিডিতে রাইটসাহেবের বাংলোর উপরে রয়েচে। এবার দুজনে হামাগুড়ি দিয়ে সেই স্কাইলাইটের কাছে গিয়ে তার দুটো জানালার মধ্যে দিয়ে মাথা গলিয়ে দিলুম। যা দেখলুম। সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। যে ঘরটা দেখা গেল সেটা মাঝের ঘর—আর মনে হল বেশ বড়। যে অংশটা দেখলুম। তাতে একটা বেশ বড় কাঠের টেবিল রাখা রয়েচে। সেই টেবিলের উপর আপনি আর গ্রেগরি সাহেব চিত হয়ে শুয়ে আছেন—দুজনেরই মাথায় আটকানো সেই চকচকে বাটি।
false
humayun_ahmed
সামনের মাসের ছাব্বিশ তারিখ। টেনশান লাগছে? যতটা টেনশান লাগা উচিত ছিল— ততটা লাগছে না। প্রিপারেশন কেমন? খুবই খারাপ। মন লাগিয়ে পড়তে পারছি না। পীর সাহেবের দোয়া বা তাবিজ লাগলে আমাকে বলবে। আমি জোগাড় করে দেব। আমাদের পাড়ায় একজন পীরসাহেব থাকেন, তিনি পরীক্ষাপাসের তাবিজ দেন। পঞ্চাশ টাকা করে হাদিয়া নেন। আমি একশো টাকা দিয়ে ডাবল একশানের একটা তাবিজ নিয়ে আসতে পারি। আপনাকে তাবিজ আনতে হবে না। আপনি নিজে প্রতি সপ্তাহে দুবার করে আসবেন। টুকটাক কিছু কাজ করে দেবেন। এতেই আমার উপকার হবে। ফিরোজ ভাই, কাল কী হয়েছে শুনুন— রাত নটার সময় মা বলে কী ঘরে লবণ নেই, মুদির দোকান থেকে লবণ এনে দিবি? চিন্তা করেন অবস্থা। আমার গ্রামের বাড়ি থেকে একটা কাজের ছেলে আমি এক সপ্তাহের মধ্যে আনিয়ে দেব। থ্যাংক য়্যু ফিরোজ ভাই। ফিরোজ বলল, তোমার জন্যে বিরাট একটা দুঃসংবাদ আছে। দুঃসংবাদটা দেব? বীনা চিন্তিতমুখে বলল, কী দুঃসংবাদ? তোমার দুদিনের পড়া নষ্ট হবার মতো দুঃসংবাদ। কী সর্বনাশ! দুঃসংবাদটা হল— আমি সামনের মাসের ২১ তারিখ শুক্রবার বাদ জুম্মা বিয়ে করছি। ধানমণ্ডিতে উল্লাস নামের একটা কম্যুনিটি সেন্টারে বিয়েটা হবে। তোমার দুদিনের পড়া নষ্ট হবে। বিয়ের দিনের পড়া আর বিয়ের আগে তোমার আপার গায়ে হলুদ যেদিন হবে, সেদিনের পড়া। নিজের বোনের বিয়ে— এই ক্ষতিটা তো তোমাকে সহ্য করতেই হবে। তাই না? বীনা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এই আনন্দের খবরটা কি আপা জানে? ফিরোজ বলল, জানে না। আমি আগামীকাল জয়দেবপুর যাব। তাকে খবরটা দিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে আসব। বীনা বলল, ফিরোজ ভাই আমি আপনাকে লিখে দিতে পারি, বিয়ের পর আপা হবে এই পৃথিবীর সুখী মেয়েদের একজন। ফিরোজ ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমার কথা ঠিক না বীনা। আমি প্রতিভাশূন্য সাধারণ একজন মানুষ। আমার জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যে কোনো ড্রামা নেই। কোনো একসাইটমেন্ট নেই। আমি আদর্শ স্বামীর মতো দশটা-পাঁচটা অফিস করব। বাজার করব। ছেলেমেয়ে বড় হলে তাদেরকে রোজ সন্ধ্যায় পড়াতে বসব। খুবই সরল জীবনযাপন। কোনো মেয়ের জন্যেই এই জীবন আদর্শ জীবন না। সাধারণ মানুষ হতেও প্রতিভা লাগে। সাধারণ হওয়াও কিন্তু খুব কঠিন কাজ। তোমার কথা শুনে ভালো লাগল বীনা। তোমার কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে। যাই হোক তুমি কি আমার জন্যে ছোট্ট একটা কাজ করবে? কি কাজ?। বলতে খুব সংকোচবোধ করছি কিন্তু না বলে পারছি না। তুমি কি লীনার স্যার হাসান সাহেবকে একটা চিঠি লিখে দেবে। আমি চিঠিটা তাঁকে দিতাম। চিঠিতে কি লিখতে হবে? চিঠিতে কি লিখতে হবে তুমি জান। জান না? হ্যাঁ জানি। ফিরোজ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চিঠিটা লিখবে খুব গুছিয়ে, যেন চিঠি পড়েই উনি লীনাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। টানেলের স্ল্যাভ বসানো হচ্ছে। বিশাল ক্রেন এসেছে। লোহার শিকলে বাঁধা দৈত্যাকৃতি স্ল্যাভ নামানো হচ্ছে। চারদিকে সীমাহীন ব্যস্ততা। লোকজনের হৈ চৈ, ডাকাডাকি। ক্রেনের শব্দের সঙ্গে মিশেছে জেনারেটরের শব্দ। দুটা বড় জেনারেটরই একসঙ্গে চলছে। একটির শব্দেই কানে তালা ধরে যায়, সেখানে দুটা পাওয়ারফুল ইনজিন। লীনা মুগ্ধচোখে দেখছে। এখানে তার কোনো কাজ নেই। তার দায়িত্ব বেতনের স্টেটমেন্ট তৈরি করা। সেসব ফেলে সকাল থেকেই এখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচে আনন্দময় কাজটা ক্রেনের চালক করছে। কত উঁচুতে আকাশের কাছাকাছি মানুষটা বসে আছে। সুইচ টিপছে, অমনি সে উপরে উঠছে, নিচে নামছে। বিশাল সব স্লাভ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। কে যেন লীনার কাধে হাত রাখল। লীনা চমকে উঠে পেছনে তাকাল। হাসিমুখে ফিরোজ দাঁড়িয়ে আছে। সে কী যেন বলল, কিছুই বোঝা গেল না। মনে হচ্ছে ফিরোজ শুধু ঠোঁট নাড়ছে। লীনা বলল, তুমি কখন এসেছ? ফিরোজ হাতের ইশারায় বুঝল সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। লীনার মনে হল— বাহ্, বেশ মজা তো! কথা হচ্ছে, কেউ কথা বুঝতে পারছে না। এরকম অবস্থায় যা ইচ্ছা বলা যায়। লীনা বলল, কাজের সময় তুমি এসেছ কেন? তোমাকে দেখে আমার মোটেই ভালো লাগছে না। আমার খুব বিরক্তি লাগছে। ফিরোজ আবারও ইশারা করল সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। ফিরোজ বলল, চলে দূরে যাই। বলেই ইশারায় তবু দেখাল। লীনার এক পা যেতে ইচ্ছা করছে না। এখানে বিরাট কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। সব ফেলে দিয়ে সে তাঁবুতে চলে যাবে? গুটুর গুটুর করে গল্প করবে? গল্প করার সময় তো শেষ হয়ে যায়নি। সারাজীবনে অনেক গল্প করা যাবে। এখন কাজ দেখা যাক। এই কাজ সারাজীবন থাকবে না। কাজ শেষ হয়ে যাবে। তারপরেও লীনা রওনা হল। তাঁবুর কাছ থেকেও জেনারেটারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তবে এখানে কথা বললে শোনা যায়। লীনা উৎসাহের সঙ্গে বলল, জান আমাদের সূর্যঘর কমপ্লিট হয়েছে। আমরা অবিকল মরুভূমির মতো তৈরি করে ফেলেছি। ঘরগুলি যে কী সুন্দর হয়েছে। দেখলে ধড়াম করে শব্দ হবে। ধড়াম করে শব্দ হবে কেন? ঘরগুলি এতই অদ্ভুত যে দেখে তুমি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যাবে, তখন ধড়াম করে শব্দ। ফিরোজ হেসে ফেলল। লীনা বলল, হাসবে না। আমি সিরিয়াস। দেখে তুমি যদি অজ্ঞান না হও, আমি ভ্যানগগের মতো কান কেটে তোমাকে দিয়ে দেব। তোমাদের প্রজেক্ট কি কমপ্লিট নাকি? আরে না। অনেক বাকি। আমরা টার্গেট থেকে সামান্য পিছিয়েও পড়েছি। রাতদিন কাজ হচ্ছে। আমাদের কারোরই নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। আমি এসে মনে হয় তোমাদের কাজের ক্ষতি করলাম।
false
humayun_ahmed
থাকবে। আমি আমার বাসায়। আনিকা বলল, তুমি আমার বাসায় উঠে আসবে। আমি একটা আলাদা ঘর নিয়ে থাকি তুমি আমার ঘরে থাকবে। কিছুদিন পর মিতুর বিয়ে হয়ে যাবে। তখন মিতুর ঘরটায় তুমি তোমার ছবি আঁকার জিনিসপত্র রাখবে। ঘরজামাই হবো? আমরা মেয়েরা যদি ঘরবউ হতে পারি, তোমাদের ঘরজামাই হতে অসুবিধা কী? কোনো অসুবিধা নেই। সিগারেট তো শেষ হয়ে গেছে, হাতে নিয়ে বসে আছ কেন? শওকত সিগারেট ফেলে দিতে দিতে বলল, তোমাকে একটা খবর দিতে চাচ্ছি। কী খবর দেবে? আমার ছেলে এসেছে ঢাকায়। সে কয়েক দিন আমার সঙ্গে থাকবে। আমার সঙ্গে জন্মদিন করবে। ছেলে নিশ্চয়ই একা আসে নি। ছেলের মাও এসেছেন। তিনিও কি ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে তোমার সঙ্গে থাকবেন? ছেলের মা অন্য একজনের স্ত্রী। তাতে কী হয়েছে? পাকা রঙ এত সহজে যায় না। বাবা-মা দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছেলে জন্মদিনের কেক কাটবে। বাবা-মা একসঙ্গে সুর করে গাইবে— হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। তারপর তারা নিজেদের দিকে তাকিয়ে লজ্জা লজ্জা ভঙ্গিতে হাসবে। সেই হাসির ছবি তোলা হবে। ট্যাক্সি মগবাজার কাজি অফিসের সামনে থামল। ড্রাইভার জানাল সে ছয়শ টাকাতে রাজি আছে। শুধু বখশিশের পরিমাণ যেন বাড়িয়ে দেয়া হয়। আনিকা বলল, বখশিশ নির্ভর করবে ভালো ব্যবহারের উপর। আপনি মাই ডিয়ার ব্যবহার করবেন, আমি আপনার বখশিশ বাড়িয়ে দেব। এখন আপনি যান, এককাপ চা খেয়ে আসুন। গাড়ি চালু রেখে যান। আপনার ঠাণ্ডা গাড়িতে বসে এই লোকের সঙ্গে কিছুক্ষণ ঝগড়া করব। আমাদের ঝগড়া আপনাকে শোনাতে চাই না। শওকত গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিতে দিতে বলল, করো ঝগড়া করো। আনিকা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, থাক ঝগড়া করব না। তোমার কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে আজ থেকে আমি একজন সেকেন্ডহ্যান্ড হাজবেন্ডের সন্ধানে বের হবো। সেকেন্ডহ্যান্ড? আনিকা বলল, অবশ্যই সেকেন্ডহ্যান্ড। আমার কপাল হলো সেকেন্ডহ্যান্ডের। আমার যখন সতেরো বছর বয়স, তখন বিয়ের যে প্রপোজল এলো সেই পাত্র সেকেন্ডহ্যান্ড। স্ত্রী মারা গেছে। বিরাট বড়লোক। তুমি চিন্তাই করতে পারবে না সেই সেকেন্ডহ্যান্ডওয়ালার সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্যে সবার সে কী চাপাচাপি! তারপর আরেকটা প্রপোজল এলো। ছেলে ইতালিতে থাকে। বিয়ে যখন প্রায় হয় হয় অবস্থা, তখন জানা গেল ছেলে কাগজপত্রের জন্যে জার্মান এক মেয়েকে বিয়ে করেছিল। এক বছর তারা ছিল এক সঙ্গে। সেই পাত্রও বাবার পছন্দ। বাবা বললেন, প্রয়োজনে সে জার্মান বিয়ে করেছে। শখের বিয়ে তো না। সমস্যা কী? শেষমেষ সেকেন্ডহ্যান্ড আধবুড়ো তুমি উদয় হলে। আমি বুড়োর প্রেমে হাবুড়ুবু ও আমার জানরে, ও আমার পাখিরে অবস্থা। শওকত বলল, আনিকা তোমার কি জ্বর না-কি? আনিকা বলল, আমার কথাবার্তা কি জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকার মতো শোনাচ্ছে? চোখ লাল, এই জন্যে বলছি। গায়ে হাত দিয়ে দেখ জ্বর কি-না। তোমার সঙ্গে আমি যে আচরণ করি, তা মোটামুটি বেশ্যামেয়েদের মতোই। বেশ্যামেয়ের গায়ে যে-কোনো সময় হাত দেয়া যায়। শওকত বলল, তোমার জ্বর। বেশ ভালো জ্বর। বাসায় যাও। বাসায় গিয়ে শুয়ে থাক। আনিকা বলল, আমি দুটা পর্যন্ত ক্যাব ভাড়া করেছি। ছটা পর্যন্ত ক্যাব নিয়ে ঘুরব। একা একা ঘুরব। একা একা? দোকা কোথায় পাব? একা একাই ঘুরব। বাসায় আমি ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারি না। মাঝে মাঝে বাইরে বের হই নিঃশ্বাস নেবার জন্যে। এখন তুমি যদি কিছু মনে না কর, তোমাকে একটা অনুরোধ করব। করো অনুরোধ। গাড়ি থেকে নেমে যাও। আমি চাচ্ছি না তুমি আমার সঙ্গে থাক। ছটা পর্যন্ত তোমার সঙ্গে থাকতে আমার কোনো সমস্যা নেই। তুমি জানো আমি এমন কোনো ব্যস্ত মানুষ না। আনিকা বলল, তোমার সমস্যা না থাকলেও আমার আছে। প্লিজ নেমে যাও। শওকত গাড়ি থেকে নেমে গেল। ড্রাইভার বলল, আপা কোথায় যাব? আনিকা বলল, আমার শরীরটা প্রচণ্ড খারাপ। আমাকে বারবার প্রশ্ন করে বিরক্ত করবেন না। আপনাকে তো বলেছি সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত আমাকে নিয়ে ঘুরবেন। শহরের বাইরে যাব আপা? বাইরে মানে কোথায়? গাজীপুর শালবন। কিংবা বিশ্বরোড ধরে কুমিল্লার দিকে যেতে পারি। শহরের ভেতর ঘুরতে আপনার অসুবিধা কী? কোনো অসুবিধা নেই। শহরের ভেতরে যানজট। গাড়ি নিয়ে বসে থাকতে আপনার যেখানে ইচ্ছা যান। ছটার সময় বাসায় পৌছলেই হবে। আমার বাসা কলাবাগানে। আনিকা চোখ বন্ধ করল। তার শরীর হঠাৎ করেই বেশ খারাপ করছে। বুকের ভেতর ধ্বক ধ্বক শব্দ। নিঃশ্বাসে কষ্ট। নিঃশ্বাসের এই কষ্ট যখন হয়, তখন খুব পানির তৃষ্ণা হয় অথচ পানি খেতে গেলে বমির মতো আসে। আনিকার ধারণা তার বড় ধরনের কোনো হার্টের অসুখ হয়েছে। মেয়েদের জন্যে হার্টের অসুখ খুব খারাপ। হার্ট দুর্বল মেয়েরা বাচ্চা নিতে পারে না। আনিকার এক বান্ধবীর (শারমিন) হার্টের অসুখ ছিল। ডাক্তাররা তাকে বাচ্চা নিতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। শারমিন এখন অস্ট্রেলিয়াতে। সেখানে তার বাচ্চা হয়েছে কি-না কে জানে! হবার কথা। অস্ট্রেলিয়ায় বড় বড় ডাক্তার আছে। তারা নিশ্চয়ই শারমিনের হার্ট ঠিক করে ফেলেছে। আনিকার খুব বাচ্চার শখ। শখটা বাড়াবাড়ি রকমের বলেই তার ধারণা এই শখ কোনোদিন মিটবে না। এই পর্যন্ত তার একটি শখও মিটে নি। বড় বড় শখ তো অনেক পরের ব্যাপার, ছোটখাটো শখও মিটে নি। স্কুল থেকে একবার ঠিক করা হলো সবাই মিলে ময়নামতিতে যাবে। বেশি দূর তো না। ঢাকা থেকে দুঘণ্টা মাত্র লাগে। সে সত্তর টাকা চাদাও দিয়েছিল। যেদিন যাবার কথা, তার আগের রাতে উত্তেজনায় সে ঘুমাতে পর্যন্ত পারে নি। সারারাত ধরে উল্টাপাল্টা
false
shunil_gongopaddhay
লাফ দিয়ে যেন পিলে চমকায়! কাকাবাবু হেসে বললেন, খুব সোজা মিল পেয়ে যাচ্ছিস, তাই না? দাঁড়া, এবার একটা শক্ত দিচ্ছি। ভুরু কুঁচকে মিনিটখানেক চিন্তা করার পর কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এটার সঙ্গে মিলিয়ে দে তো দেখি। মেঘ ডাকে গুরু-গুরু কাঁপে সারা অম্বর সন্তু এবার কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই পেছন থেকে কে যেন বলল, এই তো স্বয়ং অম্বর এখানে হাজির। কাকাবাবু ও সন্তু একসঙ্গে পেছনদিকে মুখ ফেরাল। পাঞ্জাবি ও পাজামা পরা, কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ নিয়ে, একগাল হেসে দাঁড়িয়ে আছে পীতাম্বর পাহাড়ী! দু হাত তুলে সে বলল, নমস্কার, কাকাবাবু, দেখুন, আমি এখানেও এসে গেছি! বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন, তাই না? নিশ্চয়ই আমাকে দেখে খুব : অবাক হয়েছেন! কাকাবাবু যে আগেই জানতেন ওর আসবার কথা, তা প্রকাশ করলেন না। হেসে বললেন, আরে, পীতাম্বর, কী খবর? হঠাৎ তুমি এখানে? সে বলল, পীতাম্বর না সার, শুধু অম্বর বলুন। আপনারা চলে আসার পর আমার মন কেমন করতে লাগল। ভাবলুম, কোনও জায়গা থেকে ঘুরে আসি। কথায় আছে না, উঠল বাই তো কটক যাই! তাই দেখুন কটক না হোক গোপালপুর এসে গেছি! বালির ওপর ধপাস করে বসে পড়ে সন্তুর কাঁধে চাপড় মেরে সে আবার বলল, কী খবর, সন্তুবাবু? পা একেবারে ফিট হয়ে গেছে? প্রথম দিন জঙ্গলের মধ্যে সাপ-ধরা পীতাম্বর পাহাড়ীকে দেখে সন্তুর বেশ ভাল লেগেছিল। কিন্তু সেই লোকটির হঠাৎ গোপালপুর চলে আসা সত্যি বেশ সন্দেহজনক। সন্তু খানিকটা আড়ষ্টভাবে বলল, হ্যাঁ, ভাল হয়ে গেছে। আপনি ভাল আছেন? অম্বর বলল, আমি ফার্স্ট ক্লাস আছি। আমি কক্ষনো খারাপ থাকি না। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এখানেও সাপ ধরতে এলে নাকি? সমুদ্রের ধারে বিষাক্ত সাপ পাওয়া যায় বলে তো শুনিনি! অম্বর বলল, না, না, এখানে সাপ ধরতে আসিনি। এসেছি বেড়াতে। টাকা রোজগারের জন্য বনে-জঙ্গলে সাপ ধরে বেড়াই, তা বলে কি আমাদেরও মাঝে-মাঝে ছুটি নিতে ইচ্ছে হয় না? কুঁজোরও তো চিৎ হয়ে শুতে সাধ জাগে মাঝে-মাঝে! শেষের কথাটা সন্তু ঠিক বুঝতে পারেনি, তার মুখ দেখেই সেটা ধরা যায়। তার দিকে চেয়ে অম্বর বলল, কুঁজো মানে বুঝলে? জলের কুঁজো নয়, যে-লোকের পিঠে কুঁজ আছে, ইংরেজিতে যাকে বলে হাঞ্চ ব্যাক। সন্তু বলল, আসামের জঙ্গলটাই তো একটা বেড়াবার জায়গা। সেখান থেকেও লোকে অন্য জায়গায় বেড়াতে যায়। অম্বর বলল, পাহাড় আর জঙ্গল দেখতে-দেখতে একঘেয়ে হয়ে গেলে, তখন সমুদ্র দেখতে ইচ্ছে করে। তা ছাড়া আমার কেন যেন ধারণা হয়েছিল, এখানে এলে আপনাদের দেখতে পাব। দেখুন, কেমন মিলে গেল! সন্তু বলল, এ জায়গাটা খুব ভাল। অম্বর বলল, কাল রাত্তিরে হোটেলে এসেই শুনলাম, এখানে একজন বৈজ্ঞানিক রহস্যময়ভাবে উধাও হয়েছে। তোমরা সেই গেস্ট হাউসেই আছ। কাকাবাবু যখন এসে পড়েছেন, তখন নিশ্চয়ই রহস্যের সমাধান হবে। আমি তোমাদের কোনও কাজে লাগতে পারি? কাকাবাবু, আপনার একটা অ্যাডভেঞ্চারে আমি সঙ্গে থাকতে চাই। আমি কিছুদিন বক্সিং শিখেছিলাম। কাকাবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, আমরা এখানে ওসব কোনও ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চাই না। দুজনেরই শরীর ভাল না, এখানে বিশ্রাম নেব শুধু। একটা মোটরবোট গোঁ-গোঁ শব্দ করতে করতে ছুটে গেল সামনে দিয়ে। জেলে নৌকোগুলোর পাশ দিয়ে সেটা বেশ সুন্দরভাবে এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে। জলে যারা সাঁতার কাটতে নেমেছে, তাদের মধ্যে দুজন চলে গেছে অনেকটা দূরে। আগে মনে হচ্ছিল সেখানে খুব গভীর জল, কিন্তু লোক দুটি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। সেখানে তাদের মোটে বুক-জল। আবার বড় ঢেউ উঠতেই তারা সামনে ঝাঁপ দিয়ে এগিয়ে গেল। কাকাবাবু মুখ ফিরিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, অম্বর, সেদিন ভোরবেলা গাছের নীচে তুমি যখন আমায় দেখতে পেলে, তখন আমার হাত বাঁধা ছিল। মুখটাও কি বাঁধা ছিল? অম্বর অবাক হয়ে বলল, না তো! কাকাবাবু বললেন, আমার মুখের বাঁধনটা নিজে নিজেই খুলে গিয়েছিল। তুমি আসবার আগেই। তোমাকে কি আমি বলেছিলাম যে, আমার মুখটাও বাঁধা ছিল আগে? অম্বর বলল, না, তাও বলেননি। এই প্রথম শুনলাম। ফেলে দেওয়ার সময় আপনার মুখটাও ওরা বেঁধে দিয়েছিল বুঝি? সন্তুর বাঁধেনি? কাকাবাবু বললেন, সন্তুকে তো ওরা ধরবার আগে নিজেই লাফ দিয়েছে! যাকগে, থাক ওসব কথা। অম্বর বলল, হঠাৎ এ-কথাটা জিজ্ঞেস করলেন কেন? কাকাবাবু বললেন, এমনিই মনে পড়ল। অম্বর জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আপনাদের কলকাতার বাড়ির ঠিকানাটা বলবেন? কলকাতায় গেলে দেখা করব। দাঁড়ান, লিখে নিচ্ছি। নিজের পকেট ও কাঁধের ঝোলাটা হাতড়েও সে কলম খুঁজে পেল না। কাকাবাবু নিজের বুকপকেট থেকে কলমটা দিয়ে বললেন, এটাতে লিখে নাও! ঠিকানা লেখার পর ফেরত দেওয়ার জন্য সে বাড়িয়ে দিতেই কাকাবাবু বললেন, ওটা তোমার কাছেই থাক। তোমার কলম নেই। অম্বর বলল, না, না, আমার আছে। হোটেলে ফেলে এসেছি। আপনার কলম নেব কেন? এত দামি কলম। কাকাবাবু বললেন, এমন কিছু দামি নয়। তুমি আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছ। তোমাকে এই সামান্য একটা জিনিস আমি দিতে চাই। অম্বর বলল, আমি এমন কিছুই করিনি। হঠাৎ সেখানে গিয়ে পড়েছিলাম। এ তো সবাই করে। কাকাবাবু বললেন, তুমি এই কলমটা নিলে আমি খুশি হব। অম্বর বলল, তা হলে ঠিক আছে, নিচ্ছি। আপনার ব্যবহার করা কলম। এটার দাম আমার কাছে অনেক? কাকাবাবু আবার সমুদ্রের দিকে মুখ ফেরালেন। অম্বর সন্তুকে রলল, তোমরা ছড়া মেলাবার খেলা খেলছিলে। আমার সঙ্গে খেলবে? আমিও খেলতে পারি। অম্বরের সঙ্গে কী মিলবে জানো? শম্বর! সন্তু জিজ্ঞেস করল, তার মানে কী?
false
shordindu
কালিমাবেষ্টিত লোক দুইটিতে মন্থর কুটিলতা। মুখ দেখিয়া চরিত্র অধ্যয়ন যদি সম্ভব হইত বলিতাম লোকটি মাহাপাপিষ্ঠ। মণীশবাবু খুব খাতির করিয়া আগস্তুককে ঘরে আনিলেন, আমাদের সহিত পরিচয় করাইয়া দিলেন, ‘ইনি শ্রীগোবিন্দ হালদার, এখানকার একটি কয়লাখনির মালিক। এঁরা হচ্ছেন শ্ৰীগগন মিত্র এবং সুজিত কন্দ্যোপাধ্যায় ; আমার বন্ধু, কলকাতায় থাকল। বেড়াতে এসেছেন।’ গোবিন্দবাবু তাঁহার শনৈশ্চর চক্ষু দিয়া আমাদের সমীক্ষণ করিতে করিতে মণীশবাবুকে বলিলেন, ‘খবর নিতে এলাম। খনিতে আর কোনো গণ্ডগোল হয়েছে নাকি?’ মণীশবাবু গম্ভীর মুখে বলিলেন, ‘গণ্ডগোল তো লেগেই আছে। পরশু রাত্রে এক কাণ্ড। হঠাৎ পাঁচ নম্বর পিট্‌-এর পাম্প বন্ধ হয়ে গেল। ভাগ্যে পাহারাওয়ালার সজাগ ছিল তাই বিশেষ অনিষ্ট হয়নি। নইলে—’ গোবিন্দবাবু মুখে চুকচুক শব্দ করিলেন। মণীশবাবু বলিলেন, ‘আপনারা তো বেশ আছেন, যত উৎপাত আমার খনিতে। কেন যে হতভাগাদের আমার দিকেই নজর তা বুঝতে পারি না।’ গোবিন্দবাবু বলিলেন, ‘আমার খনিতেও মাস ছয়েক আগে গোলমাল শুরু হয়েছিল। আমি জানি পুলিসের দ্বারা কিছু হবে না, আমি সরাসরি চুর লংগালাম। আটজন লোককে গুপ্তচর লাগিয়েছিলাম, দিন অষ্টেকের মধ্যে তারা খবর এনে দিল কার্য শয়তানি করছে; পাঁচটা লোক ছিল পালের গোদা, তাদের একদিন ধরে এনে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিলাম। তাদের বরখাস্ত করতে হল না, নিজে থেকেই পালিয়ে গেল। সেই থেকে সব ঠাণ্ডা আছে।’ বলিয়া তিনি দস্তুর গেরিলা-হাস্য হাসিলেন। মণীশবাবু বলিলেন, ‘আমিও গুপ্তচর লাগিয়েছিলাম কিন্তু কিছু হল না। যাকগে——’ তিনি অন্য কথা পাড়িলেন। সাধারণভাবে কথাবার্তা চলিতে লাগিল। গোবিন্দবাবুর জন্য চা-জলখাবার আসিল, তিনি তাহা সেবন করিলেন। তাঁহার চক্ষু দুইটি কিন্তু আমাদের আশেপাশেই ঘুরিতে লাগিল। আমরা নিছক বেড়ানোর উদ্দেশ্যে এখানে আসিয়াছি একথা বোধহয় তিনি বিশ্বাস করেন নাই। ঘণ্টাখানেক পরে তিনি উঠিলেন। মণীশবাবু তাঁর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি-বারান্দা পর্যন্ত গেলেন‌, আমরাও গেলাম। ড্রাইভার মোটরের দরজা খুলিয়া দিল। গোবিন্দবাবু মোটরে উঠিবার উপক্রম করিয়া ব্যোমকেশের দিকে ঘাড় ফিরাইয়া হাসি-হাসি মুখে বলিলেন, ‘দেখুন চেষ্টা করে।’ তিনি মোটরে উঠিয়া বসিলেন‌, মোটর চলিয়া গেল। মণীশবাবু এবং আমরা কিছুক্ষণ দৃষ্টি-বিনিময় করিলাম‌, তারপর তিনি বিষণ্ণ সুরে বলিলেন‌, ‘গোবিন্দ হালদার লোকটা ভারি সেয়ানা‌, ওর চোখে ধুলো দেওয়া সহজ নয়।’ রাত্রির খাওয়া-দাওয়া সারিয়া শয়ন করিতে এগারোটা বাজিল। শরীরে ট্রেনের ক্লান্তি ছিল‌, মাথার উপর পাখা চালাইয়া দিয়া শয়ন করিবার সঙ্গে সঙ্গে গভীর ঘুমে ডুবিয়া গেলাম। পরদিন যখন ঘুম ভাঙ্গিল তখন বেলা আটটা বাজিয়া গিয়াছে। একজন ভৃত্য জানাইল‌, বড়কর্তা এবং ছোটকত ভোরবেলা কোলিয়ারিতে চলিয়া গিয়াছেন। আমরা তাড়াতাড়ি প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া বাহিরের ঘরে আসিয়া দেখি আমাদের চা ও জলখাবার টেবিলের উপর সাজাইয়া একটি যুবতী দাঁড়াইয়া আছে। বাড়ির মেয়েদের দেখি নাই‌, আমরা একটু থতমত খাইয়া গেলাম। ব্যোমকেশের সুস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে মেয়েটি নীচু হইয়া ঈষৎ জড়িতম্বরে বলিল‌, ‘আমি ইন্দিরা‌, এবাড়ির বৌ। আপনারা খেতে বসুন।’ ফণীশের বৌ। শ্যামবর্ণা অনুদীর্ঘাঙ্গী মেয়ে‌, মুখখানি তর্‌তরে; বয়স আঠারো-উনিশ। দেখিলেই বোঝা যায় ইন্দিরা লাজুক মেয়ে‌, অপরিচিত বয়স্থ ব্যক্তির সহিত সহজভাবে আলাপ করার অভ্যাসও তাহার নাই। নেহাত বাড়িতে পুরুষ নাই‌, তাই বেচারী বাধ্য হইয়া অতিথি সৎকার করিতে আসিয়াছে। আমরা আহারে বসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বোসো না‌, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?’ ইন্দিরা একটি সোফার কিনারায় বসিল। ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালায় একটু চুমুক দিয়া গলা ভিজাইয়া লইল‌, তারপর জলখাবারের রেকবি টানিয়া লইল‌, ‘আজ আমাদের উঠতে দেরি হয়ে গেল। কত কি ভোরবেলাই কাজে বেরিয়ে যান?’ ‘হ্যাঁ‌, বাবা সাতটার সময় বেরিয়ে যান।’ ‘আর তোমার কর্তা?’ ইন্দিরার ঘাড় অমনি নত হইয়া পড়িল। সে চোখ না তুলিয়াই অস্ফুটস্বরে বলিল‌, ‘উনিও।’ তারপর জোর করিয়া লজা সরাইয়া বলিল‌, ‘ওঁরা বারোটার সময় ফিরে খাওয়া-দাওয়া করেন‌, আবার তিনটের সময় যান।’ ব্যোমকেশ তাহার পানে চাহিয়া মিটমিটি হাসিল‌, আর কিছু বলিল না। আহার করিতে করিতে আমি ইন্দিরাকে লক্ষ্য করিলাম। সে চুপটি করিয়া বসিয়া আছে এবং মাঝে মাঝে ব্যোমকেশের প্রতি চকিত কটাক্ষপাত করিতেছে। মনে হইল অতিথি সৎকার ছাড়াও অন্য কোনও অভিসন্ধি আছে। ব্যোমকেশ কে তাহা সে জানে‌, ফণীশ স্ত্রীকে নিশ্চয় বলিয়াছে‌, তাই ব্যোমকেশকে কিছু বলিতে চায়। সে মনে মনে কিছু সংকল্প করিয়াছে কিন্তু সংকোচবশত বলিতে পারিতেছে না। কাল রাত্রে ফণীশের মুখেও এইরূপ দ্বিধার ভাব দেখিয়ছিলাম। প্রাতরাশ শেষ করিয়া চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়া ব্যোমকেশ রুমালে মুখ মুছিল‌, তারপর প্রসন্নস্বরে বলিল‌, ‘কি বলবে এবার বল।’ আমি ইন্দিরার মুখে সংকল্প ও সংকোচের টানাটানি লক্ষ্য করিতেছিলাম‌, দেখিলাম সে চমকিয়া উঠিল‌, বিস্ফোরিত চোখে চাহিয়া নিজের অজ্ঞাতসারেই উঠিয়া দাঁড়াইল। তারপর তাহার সব উদ্বেগ এক নিশ্বাসে বাহির হইয়া আসিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আমার স্বামীকে রক্ষে করুন। তাঁর বড় বিপদ।’ ব্যোমকেশ উঠিয়ে গিয়া সোফায় বসিল, ইন্দিরাকে পাশে বসিবার ইঙ্গিত করিয়া বলিল, ‘বোসো। কি বিপদ তোমার স্বামীর আমাকে বলো।’ ইন্দিরা তেরছাভাবে সোফার কিনারায় বসিল‌, শীর্ণ সংহত স্বরে বলিল‌, ‘আমি-আমি সব কথা গুছিয়ে বলতে পারব না। আপনি যদি সাহায্য করেন‌, উনি নিজেই বলবেন।’ ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘খনি সম্বন্ধে কোনো কথা কি?’ ইন্দিরা বলিল‌, ‘না‌, অন্য কথা। আপনারা বাবাকে যেন কিছু বলবেন না। বাবা কিছু জানেন না।’ ব্যোমকেশ শান্ত আশ্বাসের সুরে বলিল‌, ‘আমি কাউকে কিছু বলব না‌, তুমি ভয় পেও না।’ ‘ওঁকে সাহায্য করবেন?’ ‘কি হয়েছে কিছুই জানি না। তবু তোমার স্বামী যদি নির্দোষ হন নিশ্চয় সাহায্য করব।’ ‘আমার স্বামী নির্দোষ।’ ‘তবে নিৰ্ভয়ে থাকো।’ বাড়ির পাশের দিকে বাগানের কিনারায় একসারি ঘর। ইন্দিরার মুখে হাসি ফুটিবার পর আমরা সিগারেট টানিতে টানিতে সেইদিকে গেলাম।
false
humayun_ahmed
অবাক হবে কেউ আমার সঙ্গে কথাও বলে না। অফিস থেকে এসে ইজিচেয়ারে বসে থাকি। যে যার মতো ঘুরে বেড়ায়। আমার সঙ্গে দুটা কথা বলার সময় কারোর নাই। ইয়াকুবের গলা ধরে এসেছে। তার চোখে সত্যি সত্যি পানি। তিনি শার্টের হাতায় চোখ মুছলেন। মৃন্ময়ী বলল, চাচা আমি কি আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি? ইয়াকুব বললেন, অবশ্যই পার। তোমাকে আমি মেয়ের মতো বিবেচনা করেই মা ডাকি। মেয়ে বাবাকে অনুরোধ করবে না, করবে আদেশ। বল মা তোমার আদেশ কী? মৃন্ময়ী বলল, ছন্দার এই বিয়েটা ভেঙ্গে দিন। তার পছন্দ হয় এমন একটা ছেলের সঙ্গে আমি বিয়ের ব্যবস্থা করব। পরীক্ষার মাঝখানে বিয়ের যন্ত্রণায় ও পরীক্ষায় খারাপ করবে। ছন্দার ভালো রেজাল্ট করা দরকার। ইয়াকুব বললেন, মা তুমি যখন দায়িত্ব নিয়েছ তখন আমার কোনো কথা নাই। বিন্তি রাতের শেষ চা নিয়ে এসেছে। মৃন্ময়ী বলল, চা খাব না। বিন্তি বলল, আপনার চুলে তেল দিয়ে দিব আপা? মৃন্ময়ী বলল, না। আমি চুলে তেল দেই না। একদিন দিয়া দেখেন খুব আরাম পাইবেন। খুব আরামের কি দরকার আছে? অবশ্যই আছে। আরামের জন্যই তো দুনিয়া। মৃন্ময়ী বলল, যাও তেল নিয়ে আসো। দেখি কী রকম আরাম! ঘরের বাতি কমিয়ে দেয়া হয়েছে। একটা টেবিল ল্যাম্প ছাড়া সব বাতি নেভানো। মৃন্ময়ী বিছানায় শুয়ে আছে। বিন্তি চুলে তেল দিয়ে চুল টেনে দিচ্ছে। বিন্তি বলল, আপা একটা গফ শুনবেন? মৃন্ময়ী বলল, গফ না গল্প। যদি ভাষা শুদ্ধ করে বলতে পার তা হলে শুনব। বিন্তি বলল, আমার গ্রামে আপনের মতো সুন্দরী একটা মেয়ে ছিল। বারো–তেরো বছর বয়স হইতেই এই মেয়ের জন্য ভালো ভালো সম্বন্ধ আসা শুরু হইল। এর মধ্যে একজনের সঙ্গে বিবাহ ঠিক হয়ে গেল। তখন মেয়েটারে ধরল জিনে। জিনে ধরল মানে কী? সুন্দরী মেয়েদের জীনে ধরে। তারার শরীরে জীনের ভর হয়। আমিও তো সুন্দর। আমার সঙ্গে জীন আছে? বিন্তি বলল, অবশ্যই আছে। আপনে যে উল্টা-পাল্টা কাজ-কাম করেন জিনের কারণে করেন। উল্টা-পাল্টা কাজ কী করলাম? আপনের নাক ফুল দিয়া কী করলেন আপনার মনে নাই? মৃন্ময়ীর টেলিফোন বেজে উঠেছে। সে ঘড়ি দেখল। সাড়ে এগারোটা বাজে। মৃন্ময়ী টেলিফোন কানে নিয়ে দুবার হ্যালো বলতেই ও পাশ থেকে লাইন কেটে দিল। মীনা বলল, ভাইয়া তুমি কি দুপুরে খাবে? জহির বলল, না। রাতে কখন ফিরবে? দেরি হবে? দশটার মধ্যে ফিরব। মীনা বলল, ভাইয়া একটা ফ্রিজ কিনতে পার না। ফ্রিজ থাকলে খাবার নষ্ট হতো না। গরমের সময় ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি খেতে কত ভালো লাগে। জহির কিছু বলল না। মীনার অতি স্বাভাবিক আচরণ মাঝে মাঝে তার কাছে বিস্ময়কর লাগে। সবুজের প্রসঙ্গ একবারও সে তুলে না! যেন সবুজ নামের কেউ তার জীবনে আসে নি। ভাইয়া টুনটুনি আজ কী করেছে শোন! আঙুল কেটে ফেলেছে। টুনটুনি মামাকে কাটা আঙুল দেখাও। টুনটুনি ভয়ে-ভয়ে একটা আঙুল উঁচু করে দেখাল। মীনা বলল, এখন মামার কাছে নিয়ে যাও মামা আঙুলে উম্মা দিয়ে দিবে। জহির বলল, উম্মা কী? মীনা বলল, উম্মা হলো চুমু। টুনটুনি নিজে নিজে অনেক অদ্ভুত শব্দ বানিয়েছে। যেমন তুলতা। তুলতা শব্দটার মানে কী ভাইয়া আন্দাজ করতো। আন্দাজ করতে পারছি না। মীনা বলল, তুলতা হলো বিড়াল। দুটা শব্দের মধ্যে কোনো মিল আছে বল? কোথায় তুলতা আর কোথায় বিড়াল। টুনটুনি যাও মামার কাছে। মামা তোমাকে উম্মা দিবে। মামাকে ভয় পাও কেন? যাও যাও। জহির বলল, জোর করে পাঠাতে হবে না। ভয় আস্তে আস্তে ভাঙাই ভালো। তোর বাজার-টাজার কিছু লাগবে? মীনা বলল, বাজার আছে। ভাইয়া একটা টেলিভিন কিনে দাও না। সারদিন ঘরে থাকি। টেলিভিশন থাকলে সময় কাটত। কতদিন নাটক দেখি না। জহির বের হয়ে গেল। প্রথমে গেল হাসপাতাল, ফজলুর সঙ্গে কিছু সময় কাটালো। সেখান থেকে সাভারে আলিমুর রহমান সাহেবের খামারবাড়ি। পোট্রেটের কাজ প্রায় শেষপর্যায়ে দু-একদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। ফজলুর অবস্থা কয়েক দিনে আরো খারাপ হয়েছে। সে এখন একনাগারে বেশিক্ষণ তাকিয়েও থাকতে পারে না। আপনাতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তবে গলার স্বর এখনও সতেজ। সে পাশ ফিরে শুয়েছে। জহিরের দিকে তাকিয়ে আগ্রহের সঙ্গে গল্প করছে। এক লোক লটারিতে জিতে ফাস্ট প্রাইজ পেয়েছে। ফার্স্ট প্রাইজ হচ্ছে সারা পৃথিবী ভ্রমণের প্লেনের টিকিট। ফ্রী হোটেল। ফ্রী খাওয়া-দাওয়া। এত বড় লটারি জিতেও লোকটার মুখে হাসি নেই। একজন জিজ্ঞেস করল, কী হলো ভাই খুশি হন নাই? লোকটি মাথা চুলকে বলল, খুশি হয়েছি তবে অন্য কোথাও যেতে পারলে ভালো হতো। প্রশ্নকর্তা বললেন, অন্য কোথাও মানে কী? সেই লোক ব্ৰিত ভঙ্গিতে বলল, মানে গ্রামের কোনো বাঁশবন। মেঠোপথ। এইসব আর কি…? জহির বলল, এই গল্পের মানে কী? ফজলু বলল, মানে হচ্ছে এই মুহূর্তে আমার গ্রামের বাঁশবন, মেঠোপথ এই সব দেখতে ইচ্ছা করছে। দশ বছরের বেশি হয়েছে গ্রাম দেখি না। জহির বলল, শরীর ঠিক হোক গ্রাম দেখিয়ে আনব। শরীর ঠিক হবে না। সস্তা দেশী মদ খেয়ে লিভার তো আগেই নষ্ট ছিল, এখন ধরেছে ভাইরাস বাবাজি। শক্ত জিনিস। জহির বলল, তোর শরীর একটু সারলেই তোকে আমি আমার কাছে এনে রাখব। আমার বোন আছে সে যত্ন করবে। ফজলু বলল, এই দফায় টিকে গেলে বাঁশবনের ছবি আঁকব। বাঁশবনের ভিতর দিয়ে রোদে এসে পড়েছে। শুধুই আলোছায়ার খেলা। লেমন ইয়োলো আর কোবাল্ট ব্লু। তোর পোট্রেট আঁকা কেমন
false
manik_bandhopaddhay
ধার থেকে এগোতে পারবে না? ওসমান বলে, না না, রেলগাড়ি আটকানো ঠিক হবে না। লাল ইটের লম্বা প্রাচীরের পাশে নোংরা ফাঁকা স্থানটিতে একে একে বহু লোক এসে জড়ো হয়। গায়ে মাথায় দুফেঁটা জল ঢেলে তার টিনের পাত্রটি ভরে একটু জল আনতে কলতলায় গিয়ে ধন্না দেবার জন্য গুটি গুটি চলতে চলতে বয়সের ভারে বাকা নানিও খানিক দাঁড়িয়ে যায়। মেয়েরা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করে, খুঁটিনাটি আরো বিবরণ জানতে চায়, ঝাঝালো গলায় ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র মন্তব্য প্রকাশ করে। অদম্য ক্রোধ ও ক্ষোভের চাপে অপূর্ব গাম্ভীর্য ও ধৈর্যের ছাপ পড়ে মুখগুলি যেন বদলে গিয়েছে মেয়ে-পুরুষের। প্রতিটি কথা, প্রতিটি সেঁক গেলা, প্রতিটি নিশ্বাস, প্রতিটি দৃষ্টিপাত শুধু প্রতিবাদ। কালকের ঘটনায় আছে যুগ-যুগান্তরের অমানুষিকতা, যুগ-যুগান্তরের সঞ্চিত ক্ষোভ তাদের করে দিয়েছে প্রতিবাদের বিস্ফোরণ। এতে আশ্চর্য কি যে, শান্ত শীতল শীতের সকালে কাপড়ের সামান্য আবরণে ঠাণ্ডায় কেঁপেও কেউ কেউ ভেতরের তাপে পাঁতে দাঁত ঘষবে। তখন তাদের মধ্যে এসে দাঁড়ায় হানিফ। কথা বলে সে উত্তেজনাকর মারাত্মক। ক্ষুব্ধ মানুষগুলিকে সে যেন ক্ষেপিয়ে দিতে চায়। বলতে বলতে নিজেও সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে ভয়ানক রকম। চল যাই সব। আজ হাঙ্গামা হবে ভীষণ। মোরা চুপ করে থাকব? চল যাই সবাই মিলে। বহুত আদমি জড়ো হবে। দোকানপাট ভেঙে সব চুরমার করে ফেলব। মোরা শুরু করে দিলে কাণ্ডটা যা বাঁধবে একচোট– হানিফের সঙ্গে এসেছিল বুধুলাল, সে বলে ওঠে, শাবাশ! শাবাশ! কয়েকটি অল্পবয়সী ছোকরা চঞ্চল হয়ে ওঠে কিন্তু অন্য সকলে আরো যেন শান্ত হয়ে গিয়েছে। মনে হয়। এমন কি যারা দতে দাঁত ঘষছিল তাদের চোয়াল টিল হয়ে যায়। কি বলছ মিঞা? মাথা খারাপ নাকি? ওসমান বলে। হানিফ ক্রুদ্ধ হয়ে বলে, কেন? আমরা গিয়ে দোকানপাট ভাঙব, গুণ্ডাদের লুটপাটের সুবিধা হবে। ও কি একটা কথা হল? ওসমান জোর গলায় পেঁচিয়ে সবাইকে শুনিয়ে বলে, দোকানপাট ভাঙার কথা ওঠে কিসে? সভা কর, মিছিল কর, হরতাল কর। দোকান বন্ধ থাক। ব্য। গুণ্ডা বলছ কাকে? সামনে এগিয়ে রুখে ওঠে হানিফ। হানিফ বাড়াবাড়ি করলে তাকে রুখবার জন্য উপস্থিত কয়েকজন ওসমানের কাছে ঘেঁষে আসে। কাকে বলব? শহরে গুণ্ডা নেই? আমরা দোকানে হানা দিলে তাদের মজা, এ তো জানা কথা। বড় বড় বেড়েছে তোমার। হানিফ শাসায়। হাঙ্গামা কোরো না হানিফ। সিদ্দিক বলে একপা আরো এগিয়ে হানিফের সামনে গিয়ে। আরো কয়েকজন ওসমানের কাছে ঘেঁষে আসে। সেদিকে চেয়ে একটু ইতস্তত করে হানিফ চলে যায় সঙ্গী কজনকে নিয়ে। বুধুলাল দুবার মুখ ফিরিয়ে ওসমানের দিকে তাকিয়ে যায়। সে দৃষ্টির অর্থ খুব পরিষ্কার, আচ্ছা দেখে নেব। বুধুলাল এ অঞ্চলের বিখ্যাত গুণ্ডা নেতা। হানিফের চেয়েও তার খ্যাতি ও প্রতিপত্তি বেশি। আধঘণ্টার মধ্যে ওসমান পথে বেরিয়ে পড়ে। গণেশের সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে আর একটু বেলা করেই হাসপাতালে যাবে, এত সকালে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। আগে একবার রসুলের বাড়ি যাবে। রসুলের সঙ্গে দেখা করে কথাবার্তা বলার জন্য মনটা ছটফট করছিল ওসমানের। রসুল তার ছেলের মতো, সাহসে তেজে বুদ্ধি-বিবেচনায় ভুলভ্রান্তি বোকামিতে, সব দিক দিয়ে টান একটা বরাবর ছিল রসুলের দিকে তার, কিন্তু আজকের মতো সে টানে কখন টান পড়ে নি এত জোরে, আগে শুধু ছিল এই পর্যন্ত। কত ভাবে মনটা আজ তার নাড়া খাচ্ছে, তবু তারি মধ্যে ভেসে ভেসে আসছে পারিবারিক একটা ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার আবছা চিন্তা। পরীবানু সেয়ানা হয়ে উঠেছে অনেক দিন, এবার তার সাদির ভাবনাটা রীতিমতো গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গা থেকে প্রতি পত্রে তাগিদ আসছে পরীবানুর মার। এদিক-ওদিক ছেলে খুঁজছে ওসমান, আত্মীয়-বন্ধুর কাছ থেকে সন্ধানও আসছে মাঝে মাঝে। কিন্তু পছন্দ যেন তার হচ্ছে না একজনকেও। হবু জামায়ের কতগুলি রকমারি বৈশিষ্ট্যের মাপকাঠি যেন আগে থেকে মনের মধ্যে তৈরি হয়ে আছে, সেই মাপে খাপ খাচ্ছিল না একজনও পুরোপুরি। যে ছেলে তার নেই, জামাই খুঁজছিল সে সেই ছেলের মতো যতদূর সম্ভব সেই ছেলের মতো। এ ধারণা তার কাছে পরিষ্কার নয়, মনের এই খামখেয়ালি আবদার। টের পেলে নিজেকে সে সংযত করে ফেলত সঙ্গে সঙ্গেই। আজো সে বুঝতে পারে নি কিসে কি ঘটেছে মনে। রসুলের সঙ্গে পরীবানুর সাদি হলে তো মন্দ হয় না, এই কথাটা মনে পড়ছে ঘুরেফিরে মনের গভীর তলানো ইচ্ছার ভাসা-ভাসা ইঙ্গিতের মতো। রসুলের বাড়ি বেশি দূরে নয়। এইটুকু পথ যেতে অনেকটা সময় লাগে ওসমানের। ইতিমধ্যেই মানুষ জড়ো হতে আরম্ভ করে দিয়েছে রাস্তায়, বিক্ষোভ প্রকাশ করতে আরম্ভ করে দিয়েছে মৃদুভাবে। সমবেত কোলাহলের বিশিষ্ট সুরটাই বিক্ষোভের। উৎসব-পার্বণে আরো বড় জনতার কলরব ওসমান শুনেছে, তার সুর একেবারে অন্য রকম। কোনো রকম গাড়ি-ঘোড়াই এক রকম চলছে না রাস্তায়। মোড়ে ওসমানের সামনে একটি মোটর গাড়িকে আটকে জবরদস্তি ফিরিয়ে। দেওয়া হল। পরক্ষণে আর একটি গাড়িকে দাঁড় করানো হল, কিন্তু আরোহীর সঙ্গে দু-একটি কি কথা হবার পর সকলে সরে দাঁড়িয়ে পথ ছেড়ে দিল, দুজন যুবক দুপাশে হেঁটে মোড়ের ভিড়টা পার করে এগিয়ে দিয়ে এল গাড়িটাকে। ডাক্তারের গাড়ি। একজন বলল ওসমানের জিজ্ঞাসার জবাবে! শহরের অন্যান্য জায়গাতেও কি এই রকম শুরু হয়ে গেছে?–ওসমান ভাবে। রাইফেলধারী পুলিশ-বোঝাই গাড়ি চলে যায়। ধ্বনি ওঠে জয় হিন্দ! ইনক্লাব জিন্দাবাদ। সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক। ওসমান আবার ভাবে, কর্তারা যদি ফের বোকামি করে, লাঠি আর বন্দুক দিয়ে ঠেকাতে চেষ্টা করে এই রাগ-দুঃখের প্রকাশ, কি হবে তা হলে? আমিনা নিজেই দরজা খুলে দেন।
false
shottojit_roy
ছাড়া কেউ থাকতে পারে না ভেবেই ফেলুদা মুখ খুলল; তবে গলা তুলল না। এটা ছড়িয়ে দিন তো একটু আশেপাশে। ফেলুদা ঝোলা থেকে একটা ছিপি-আঁটা বোতল বার করে লালমোহনবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়েছে। ছোছ্‌-ছড়িয়ে? কার্বলিক অ্যাসিড। সাপ আসবে না। চারদিকে হাত চারেক দূর অবধি ছিটিয়ে দিলেই হবে। লালমোহনবাবু আজ্ঞা পালন করে এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে বললেন, যাক নিশ্চিস্ত হওয়া গেল। সাপের ভয়াটা মশাই নাৰ্ভ-পিলেও যায় না। ভূতের ভয় গেছে? টোট্যালি। ব্যাঙ ডাকছে। ঝিঁঝি ডাকছে। একটা ঝিঁঝি বোধহয় আমাদের পাশের কবরেই আস্তানা গেড়েছে। চলন্ত মেঘের এক-একটা খণ্ড বোধহয় একটু বেশি ঘন বলেই অন্ধকারটা হঠাৎ হঠাৎ গাঢ় হয়ে উঠছে। তার ফলে সমাধিগুলো তালগোল পাকিয়ে চোখের সামনে একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আবার যেই চাঁদ বেরোচ্ছে আমনি সমাধিগুলোর এক পাশে আলো পড়ে সেগুলো পরস্পর থেকে আলগা হয়ে যাচ্ছে। ফেলুদা পকেট থেকে চিকলেট বার করে আমাদের দিয়ে নিজে দুটো মুখে পুরল। গাড়ির শব্দ ক্রমেই কমে আসছে। এক দুই তিন করে সেকেন্ড গুনে হিসাব করে দেখলাম একটানা প্রায় আধ মিনিট ধরে ব্যাঙ ঝিঝি আর দমকা হাওয়ায় পাতার সরসর ছাড়া আর কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না। মিডনাইট, চাপা স্বরে লালমোহনবাবু বললেন। মিডনাইট কেন বললেন? আমি দু মিনিট আগে হাত বাড়িয়ে আমার রিস্টওয়াচে চাঁদের আলো ফেলিয়ে দেখেছি বেজেছে এগারোটা পাঁচিশ। জিজ্ঞেস করাতে বললেন, না, এমনি বলছি। মিডনাইটের একটা বিশেষ ইয়ে আছে তো! কী ইয়ে? গোরস্থানে মিডনাইট তো!—তাঁর একটা বিশেষ ইয়ে আছে। কোথায় যেন পড়িচি। তখনই ভূত বেরোয়? লালমোহনবাবু কয়েকবার এক্স এক্স বলে শেষের বার এক্স-এর সটাকে সাপের মতো কিছুক্ষণ টেনে রেখে চুপ মেরে গেলেন। আমার পাশে একটা প্রায়-শোনা-যায়-না খচ শব্দ থেকে বুঝলাম ফেলুদা হাতের আড়ালে দেশলাই জ্বালাল। তারপর হাতের আড়ালেই একটা চারমিনার ধরিয়ে হাতের আড়ালেই টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। আকাশে মেঘ বাড়ছে। গাড়ির আওয়াজ হাওয়া। হাওয়ার আওয়াজ হাওয়া। সব সাড়া, সব শব্দ শেষ। কাছের বিপ্লবি ঠাণ্ডা! আমার শরীর ঠাণ্ডা, গলা শুকনো। ঠোঁট চোটে ঠোঁট ভিজাল না। চী-এর পরে একগাদা ঋ-ফলা দিয়ে একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। এক সঙ্গে দুটো থাপ্নড়ের আওয়াজে বুঝলাম। লালমোহনবাবু হাত দিয়ে হাইম্পিডে কানি ঢাকলেন। ফেলুদা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। একটা গাড়ি থেমেছে। কতদূরে, সেটা এত রাত্রে বোঝা যাবে না। দরজা বন্ধর শব্দ। মন বলছে শব্দটা উত্তরে পার্ক স্ট্রিট থেকে নয়, পশ্চিমের রীড়ন স্ট্রিট থেকে। ওদিকে গেট নেই, পাঁচিল আছে; পাচিলের উপর কাচ বসানো। আমাদের চোখ তবু লোহার গেটের দিকে। লালমোহনবাবু মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন, ফেলুদা আমার কাঁধের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে ওঁর কাঁধে চাপ দিয়ে থামিয়ে দিল। কিন্তু কেউ তো আসছে না গেটের দিকে। হয়তো গাড়ি অন্য কোথাও অন্য কারণে থেমেছে! কত বাড়ি তো রয়েছে চারপাশে। হয়তো কেউ নাইট-শো দেখে ফিরল। আশা করি তাই, তা হলে আর এ-গাড়িটা নিয়ে ভাববার কিছু থাকে না। ফেলুদা কিন্তু সটান দাঁড়িয়ে আছে, পিছনের দেয়ালের সঙ্গে সেঁধিয়ে। তার সামনেই একটা থাম। চারিদিকে বাদুড়ে অন্ধকার। কেউ দেখতে পাবে না। আমাদের। কিন্তু আমরা তাদের দেখব কী করে? যদি তারা এসে থাকে? দেখবার দরকার নেই। একটু পরেই সেটা বুঝতে পারলাম। চোখের দরকার নেই। কাজ করবে। কাম। ঝুপ…ঝুপ…ঝুপ…ঝুপ… মাটি খোঁড়ার শব্দ। কিছুক্ষণ চলল শব্দ। আমরা রুদ্ধশ্বাসে শুনছি। ঝুপ…কুপ… শব্দ থেমে গেল। একটা আলো! দুরে দুটো ওবেলিস্কের ফাঁক দিয়ে ঘাসের উপর ক্ষীণ আলো। প্রতিফলিত আলো। আলোটা স্থির নয়-দুলছে, নড়ছে, খেলছে। টর্চের আলো। এবার নিভে গেল। পাঁচিল টপকে এসেছে দাঁত চিপে মন্তব্য করল ফেলুদা। তারপর বলল, ফিলো করব। বুঝলাম আবার গাড়ির আওয়াজের অপেক্ষা করছে ফেলুদা। এক মিনিট। দু মিনিট, তিন মিনিট, চার মিনিট। ষ্ট্রেঞ্জ! বলল ফেলুদা! কোনও শব্দ আসছে না। আর পার্ক স্ট্রিট থেকে। রাড়ন স্ট্রিট থেকেও না। যে গাড়িটা এসেছিল। সেটা থেমেই আছে। তা হলে? আরও দু মিনিট গেল। আবার মেঘে ফাটল। চাঁদ বেরোল। কেউ কোথাও নেই। ধর এটা– ফেলুদা তার ঝোলাটা আমায় দিয়ে ঘাসে নামল। যেদিকে আলোটা দেখেছিলাম সেদিকে এগিয়ে গেল। ভয় নেই-ওর পকেটে কোল্ট ৩২। মন বলছে। শিগগিরই তার গর্জনে এই গোরস্থানের জমাট নিস্তব্ধতা খান-খান হতে চলেছে। কিন্তু -পা যে খোঁড়া ওর! সামান্য হলেও খোঁড়া। কেন যে সর্দারি করে নিজে জুতো সারাতে গেল জানি না। কিন্তু কই? কোল্টের গর্জন? ভুল করলেন, ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন জটায়ু। তোমার দাদা ভুল করলেন। আর যেন কথা না বলেন। তাই আমি জিভে দিয়ে সাপের শব্দ করে ওকে থামিয়ে দিলাম! ফেলুদা কয়েক পা এগিয়ে গিয়েই অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। কী ঘটছে ওই সমাধিস্তম্ভগুলোর মধ্যে কিছুই বুঝতে পারছি না। একটা শব্দ পাওয়া গেল কি? কানের ভুল নিশ্চয়ই। মিডনাইট? এটা কোন ঘড়ি? সেন্ট পলস? হাওয়া ওদিক থেকেই। পশ্চিমে হাওয়া হলে রাত্তিরে আলিপুরের চিড়িয়াখানার সিংহের গর্জন শোনা যায় আমাদের বালিগঞ্জের বাড়ি থেকে। ওই যে গাড়ির শব্দ। দরজা বন্ধ হল। স্টার্ট নিল। তারপর হুস। আর বসে থাকা যায় না! ভয় করছে না; শুধু ভাবনা। উঠে পড়লাম দুজনেই। লালমোহনবাবুর বিড়বিড়ানিতে কান দেব না; সময় নেই। এগিয়ে গেলাম দ্রুত পায়ে। মেরি এলিসের কবর। কবরের দেয়ালে হাত ঘষে ঘষে এগোচ্ছি। জটায়ু আমার শার্ট খামচে আছেন পিছন থেকে। পায়ের তলায় ঘাস এখনও ভিজে, এখনও ঠাণ্ডা। জন মাটিনের কবর। সিনথিয়া কোলেট। ক্যাপ্টেন এভানস। এবার একটা
false
manik_bandhopaddhay
বোধহয় শ্যামার একখানা হাত তুলিয়া একটি কোমল স্পন্দনের উপর রাখিয়াছিল। জাগিয়া থাকিবার শক্তিটুকু শ্যামার তখন ঝিমাইয়া আসিয়াছে। সে অতিকষ্টে একটু পাশ ফিরিয়াছিল। দেখবি বৌ? এই দ্যাখ– এবার স্বর চিনিতে পারিয়া কম্পিতকণ্ঠে শ্যামা বলিয়াছিল–ঠাকুরঝি? মন্দাকিনী আলোটা উঁচু করিয়া ধরিয়া বলিয়াছিল আর ভাবনা কি বৌ? ভালোয় ভালোয় সব উতরে গিয়েছে। খোকা লো, ঘর আলো করা খোকা হয়েছে তোর। মাথা তুলিয়া একবার মাত্র খানিকটা রক্তিম আভা ও দুটি নিমীলিত চোখ দেখিয়া শ্যামা বালিশে মাথা নামাইয়া চোখ বুজিয়াছিল। শ্যামার যে সব বিষয়েই বাড়াবাড়ি ছিল তাহা নিঃসন্দেহ। পরদিন সকালেই সে তাহার প্রথম ছেলেকে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছে। অনেক বেলায় ঘুম ভাঙিয়া নিজেকে শ্যামার অনেকটা সুস্থ মনে হইয়াছিল। ঘরে তখন কেহ ছিল না। কাত হইয়া শুইয়া পাশে শায়িত শিশুর মুখের দিকে এক মিনিট চাহিয়া থাকিয়াই তাহার মনে হইয়াছিল, ভিতরে একটা অদ্ভুত প্রক্রিয়া ঘটিয়া চলিবার সঙ্গে সঙ্গে ছেলের মুখখানা তাহার চোখে অভিনব হইয়া উঠিতেছে। কতটুকু মুখ, কী পেলবতা মুখের! মাথা ও ভুরুতে চুলের শুধু আভাস আছে। বেদনার জমানো রসের মতো তুলতুলে আশ্চর্য দুটি ঠোট। এ কি তার ছেলে? এই ছেলে তার? গভীর ঔৎসুক্যে সন্তৰ্পণে শ্যামা হাত বাড়াইয়া ছেলের চিবুক ও গাল চুঁইয়াছিল, বুকের স্পন্দন অনুভব করিয়াছিল। এই বিচ্ছিন্ন ক্ষীণ প্ৰাণস্পন্দন কোথা হইতে আসিল? শ্যামা কাঁপিয়াছিল, শ্যামার হইয়াছিল রোমাঞ্চ স্নেহ নয়, তাহার হৃদয় যেন। ফুলিয়া ফাঁপিয়া উঠিয়া তাহার কণ্ঠরোধ করিয়া দিতে চাহিয়াছিল। প্রসবের পর নাড়িসংযোগ বিচ্ছিন্ন সন্তানের জন্য একি কাণ্ড ঘটিতে থাকে মানুষের মধ্যে? আশ্বিনের প্রভাতটি ছিল উজ্জ্বল। দুদিন দুরাত্রির মরণাধিক যন্ত্রণা শ্যামা দুঃস্বপ্নের মতো ভুলিয়া গিয়াছিল। আজ সকালে তাহার আনন্দের সীমা নাই। তখন ঘটিয়াছিল এক কাণ্ড। ঘুম ভাঙিয়া হঠাৎ শিশু যেন কি রকম করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। টানিয়া টানিয়া শ্বাস নেয়, চঞ্চলভাবে হাত-পা নাড়ে, চোখ কপালে তুলিয়া দেয়। ভয়ে শ্যামা বিবর্ণ হইয়া গিয়াছিল। ডাকিয়াছিল–ঠাকুরঝি গো, ও ঠাকুরঝি। রান্না ফেলিয়া ছুটিয়া আসিয়া ব্যাপার দেখিয়া মন্দা হইয়াছিল রাগিয়া আগুন। চোখ নেই বৌ? সরো তুমি, সরো। গলা শুকিয়ে এমন করছে গো, আহা! মধুর বাটি গেল কোথা? মিছরির জল? দিয়েছ উলটে? আশ্চর্যি! তাকের উপর শিশিতে মধু ছিল। ছোট একটি বাটিতে মধু ঢালিয়া আঙুলে করিয়া ছেলের মুখ ভিজাইয়া চোখের পলকে মন্দা তাহাকে শান্ত করিয়া ফেলিয়াছিল। বিড়বিড় করিয়া বলিয়াছিল–আনাড়ি বলে আনাড়ি, এমন আনাড়ি জন্মেও চোখে দেখি নি মা! কচি ছেলে, পলকে পলকে গলা শুকোবে, তাও যদি না টের পাও, তবে মা হওয়া কেন? দাইমাগীও মানুষ কেমন? তামাকপাতা আনতে গিয়ে বুড়ি হল? এই তুচ্ছ ঘটনাটি শ্যামার মনে গাঁথা হইয়া আছে, প্রথম সন্তানকে সে যে বার দিনের বেশি বচাইতে পারে নাই, তার সবটুকু অপরাধ চিরকাল শ্যামা নিজের বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছে, সন্তান পরিচর্যার কিছুই সে যে তখন জানি না, এই ঘটনাটি শ্যামার কাছে হইয়া আছে তাহার আদিম প্রমাণের মতো। তখন অবশ্য সে জানি না, বার দিন পরে পেট ফুলিয়া ছেলে তাহার মরিয়া যাইবে। মন্দা চলিয়া গেলে ছেলের দিকে চোখ রাখিয়া সে শান্তভাবেই শুইয়াছিল, গলা শুকানোর লক্ষণ দেখা গেলে মুখে মধু দিবে। অন্যমনে সে অনেক কথা ভাবিয়াছিল। দরজা দিয়া দুটি চড়াই পাখি ঘরে ঢুকিয়া খানিক এদিক ওদিক ফড়ফড় করিয়া উড়িয়া জানালা দিয়া বাহির হইয়া গিয়াছিল, জানালা দিয়াই রোদ আসিয়া পড়িয়াছিল শ্যামার শিয়রে। জীবন-মৃত্যুর কথা। শ্যামার তখন মনে পড়ে নাই, ভগবানের কাণ্ডকারখানা বুঝিতে না পারিয়া সে অবাক হইয়া গিয়াছিল। বুকে তাহার দুদিন দুধ আসিবে না। নবজাত শিশুর জন্য ভগবান দুদিনের উপবাস ব্যবস্থা করিয়াছেন। মন্দার হুকুম স্মরণ করিয়া মাঝে মাঝে ছেলের মুখে সে শুষ্ক স্তন দিয়াছিল। সন্তানের ক্ষুধার আকর্ষণ অনুভব করিয়া ভাবিছিল, হয়তো এ ব্যবস্থা ভগবানের নয়। বুকে তাহার যথেষ্ট মমতার সঞ্চার হয় নাই, তা হওয়ার আগে দুধ আসিবে না। তবু, কোন মা সন্তানের জীবনকে অস্থায়ী মনে না করিয়া পারে? বেলা বাড়িলে পাড়ার কয়েক বাড়ির মেয়েরা শ্যামার ছেলেকে দেখিতে আসিয়া যখন উচ্ছসিত প্রশংসা করিয়াছিল, শ্যামার তখন যেমন গর্ব হইয়াছিল, তেমনি হইয়াছিল ভয়। ভয় হইয়াছিল এইজন্য, দেবতারা গোপনে শোনেন। গোপনে শুনিয়া কোন দেবতার হাসিবার সাধ হয়, কে বলিতে পারে? তাই বিনয় প্রকাশের জন্য নয়, দেবতার গোপন কানকে ফাঁকি দিবার জন্য শ্যামা বলিয়াছিল–কানাখোড়া যে হয় নি মাসিমা, তাই ঢের। বলিয়া তাহার এমনি আবেগ আসিয়াছিল যে ঘর খালি হওয়ামাত্র ছেলেকে সে চুম্বনে চুম্বনে আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছিল। ছেলের গলা শুকানোর স্মৃতি মনে পুষিয়া রাখিবার আরেকটি কারণ ঘটিয়াছিল সেদিন রাত্রে। গভীর রাত্রে। সারাদুপুর ঘুমানোর মতো স্বাভাবিক কারণেও নিশীথ জাগরণ মানুষের মনে অস্বাভাবিক। উত্তেজনা আনিয়া দেয়। দূরে কোথায় পেটা ঘড়িতে তখন বারটা বাজিয়াছে। শ্যামার কল্পনা একটু উদ্ভ্রান্ত হইয়া আসিয়াছিল। ঘরের একদিকে বুড়ি দাই অঘোরে ঘুমাইতেছিল। কোণে জ্বলিতেছিল প্ৰদীপ। এগারটি দিবারাত্রি এই প্রদীপ অনির্বাণ জ্বলিবে, জাতকের এই প্রদীপ্ত প্রহরী। শিয়রের কাছে মেঝেতে খড়ি দিয়া মন্দা দুর্গা-নাম লিখিয়া রাখিয়াছে। সকালে আঁচল দিয়া মুছিয়া ফেলিবে, কেহ না মাড়াইয়া দেয়। সন্ধ্যায় আবার দুর্গা-নামের রক্ষাকবচ লিখিয়া রাখিবে, আঁতুড়ের রহস্য ভয়ে পরিপূর্ণ। এমনি কত তাহার প্রতিবিধান। হঠাৎ শ্যামার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হইয়াছিল। একটা অদৃশ্য জনতা যেন তাহাকে ঘিরিয়া রহিয়াছে। চারিপাশে যেন তাহার অলক্ষ্য উপস্থিতি, অশ্ৰুত কলরব। সকলেই যেন খুশি, সকলের অনুচ্চারিত আশীর্বাদে ঘর যেন ভরিয়া গিয়াছিল। শ্যামার বুঝিতে বাকি থাকে নাই, এঁরা তাহার সন্তানেরই পূর্বপুরুষ, ভিড় করিয়া সকলে বংশধরকে দেখিতে আসিয়াছেন। কিন্তু একি?
false
toslima_nasrin
লেহাপড়া কি আমগোর কপালে আছে! জিজ্ঞেস করি–তুমার বাপ নাই!কবে মরছে! কেমনে? ফুলবাহারি চোখ না তুলে বলে–বাতাস লাইগা মরছে। –বাতাস? বাতাস লাগলে মাইনষে মরে নাকি? বকের মত গলা লম্বা হয়ে ওঠে বিস্ময়ে। –জিনের বাতাস খালা। বাপে হাতপাও লুলা অইয়া বিছনাত পড়ল। পড়ল ত পড়লই। আর উঠল না। চৌকাঠ মুছে বড় একটি শ্বাস ছেড়ে বলে ফুলবাহারি। ওর পরনের মোটা বাইনের শাড়িটি হাঁটুর কাছে ছেঁড়া। ফুলবাহারির এটি ছাড়া আর একটি সবুজ রঙের শাড়ি আছে। ওটি আরও ছেঁড়া। ওর জন্য আমার আবারও বড় মায়া হতে থাকে। ফুলবাহারি ঘর মুছে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। ওর প্রস্থানের দিকে নিষ্প্রাণ তাকিয়ে থাকি। ভেতরে তোলপাড় করে জিনের বাতাস রেগে মানুষ মরার খবর। মা’কে জিজ্ঞেস করে পরে উত্তর পেয়েছি, জিনের বাতাস লাগলে হাত পা অবশ হইয়া যায়, কথাডা সত্য। জিন ভূত ব্যাপারগুলো কেমন যেন অদ্ভুত ব্যাপার! কেবল শরাফ মামাই ভূত দেখে বাড়ি ফেরেন, আমার কখনও দেখা হয়নি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় পেত্নির বিজলি দেখতে, সেও দেখা হয়নি, সারাদিন জানালার ফুটো দিয়ে বাইরে বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে তাকিয়ে থেকেও। সেদিনের পর সপ্তাহ পার হয়নি, জিনের বাতাস লাগল গেঁতুর ওপর। গেঁতুর ডান পাখানা হঠাৎ অবশ হয়ে গেল। গেঁতুর মা ছেলের শোকে পাগল, নানির বাড়ি এসে সে গেঁতুর জন্য বিলাপ পেড়ে কাঁদে, দেখতে যাওয়ার তার অনুমতি মেলে না। গিয়েওছিল বাড়ির উঠোন অবদি, ঝাঁটা মেরে তাড়িয়েছে গেতুঁর বাবা। বাইন তালাকের পর গেঁতুর মা’র আর অধিকার নেই গেঁতুর ছায়া মাড়ানো, পেটের ছেলে, তা হোক। গেতুঁর মা’র বিলাপ নানির বাড়ির লোকেরা কেউ খাটে বসে, কেউ দরজায়, আমগাছতলায়, কলতলায় দাঁড়িয়ে দেখেন, ঝুনু খালা আহা আহা করে বেণি দুলিয়ে চলে যান ঘরের ভেতর। নানি পান সাজতে থাকেন নিশ্চুপ। হঠাৎ বিষম এক হুংকার ছুঁড়ে গেঁতুর মা’কে দূরে সরতে বলেন টুটু মামা। মেয়েমানুষের কান্নাকাটি তাঁর নাকি অসহ্য লাগে। মুখে আঁচল পুরে কান্না থামিয়ে চলে যেতে হয় গেঁতুর মাকে, আমাকে কেউ লক্ষ করে না যে আমিও যাচ্ছি তার পেছন পেছন। বাঁশঝাড়ের তলে আমার ভয় পাওয়ার কথা, পাই না। জিনের বাতাস লেগে আমারও যে হাত পা অবশ হয়ে যেতে পারে, ভুলে যাই। আমি বেখেয়ালি বেহিশেবি বেত্তমিজ বেয়াদ্দপ মেয়ে। গেঁতুর মা রেললাইনের দিকে হাঁটে, ছায়ার মত আমিও। লাইনের ওপর বসে গেঁতুর মা কাঁদে, আমি পাথর কুড়িয়ে ছুঁড়তে থাকি লোহার পাতে। ঠং ঠং, ঠং ঠং। গেঁতুর মা কান্না থামিয়ে দেখেন পেছনে দাঁড়িয়ে আছি আমি, আমার না আঁচড়ানো চূল, ধুলো মাখা পা, না মাজা দাঁত। বলি–কাইন্দ না গেঁতুর মা। সইরা বও, রেলগাড়ি আইয়া পড়ব। গেঁতু দেইখ্যা ওর বাপেরে বটি দিয়া কুপাইয়া মাইরা তুমার কাছে চইলা আইব একদিন। বটি দিয়ে কুপিয়ে, মা বলেছিলেন ফুলবাহারিকে মারবেন, যেদিন শিংমাছের তরকারি চুলোয় রেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, ওদিকে তরকারি পুড়ে ছাই; আর বাবার বুক পকেট থেকে গোপন চিঠিটি পাওয়ার পর মা রাজিয়া বেগমকেও চেয়েছিলেন। বটি দিয়ে কুপিয়ে মা ফুলবাহারিকে মেরে ফেলছেন বা রাজিয়া বেগমকে, ভেবে, যদিও রাজিয়া বেগম মানুষটিকে দেখিনি কখনও, মনে হত দেখতে বোধহয় ঝুনু খালার মত, মায়া হত। গেঁতু হাতে বটি নিয়ে গেঁতুর বাবাকে মেরে ফেলছে দৃশ্যটি আমি খুব সহজে কল্পনা করতে পারি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গেঁতুদের বাড়ির উঠোন ভাবতে আমার গা কাঁপে না, বাঁশঝাড়ের তল দিয়ে সন্ধেয় আসার মত গেঁতুর মার পেছন পেছন, যেমন গা কাঁপেনি। গেঁতু মরে যাওয়ার দিন পাঁচেক পর আবার জিনের বাতাস লাগল ঠান্ডার বাপের ওপর। জিলিপির দোকান বন্ধ করে ঠান্ডার বাপ পড়ে রইলেন বিছানায়। কাশির সঙ্গে বেরোতে লাগল দলা দলা রক্ত। মৌলবি এসে মাঝে সাঝে ফুঁ দিয়ে যায়, শর্ষিনার পীরের কাছ থেকে পড়া পানি এনে খাওয়ানো হল ঠান্ডার বাপকে। রক্ত ঝরা থামেনি তবুও। জিনের বাতাস লাগলে লোক বাঁচে না, তাই বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়ে ঠান্ডা হয়ে বসে রইল ঠান্ডার বাপের আত্মীয়রা। খবর পেয়ে বাবা একদিন নিজে বস্তিতে গিয়ে হাজির, কি ব্যাপার দেখি কী হইছে বলে ঠান্ডার বাপের নাড়ি টিপে, চোখের পাতা টেনে নামিয়ে, জিভ বের করতে বলে কী সব দেখলেন, এরপর ঠান্ডাকে বললেন দোকান থেকে যক্ষার ওষুধ কিনে আনতে। ওষুধ খেয়ে সেরে গেলেন ঠান্ডার বাপ। এ কী কান্ড, জিনের বাতাস লাগা লোক দেখি দিব্যি তাজা। সপ্তাহও পেরোল না, ঠান্ডার বাপ আবার জিলিপির দোকান খুলে বিক্রিবাটা শুরু করলেন। চোখের সামনে এই ব্যাপারটি ঘটে যাওয়ার পর আমার জিনের বাতাসকে মোটেও মারাত্মক কিছু বলে মনে হল না। বাবাকেও দেখি ঠান্ডার বাপ বেঁচে উঠল বলে মোটে অবাক হলেন না, যেন তাঁর বাঁচারই কথা ছিল। বাবা, আমার বিশ্বাস হয়, চাইলে গেঁতুকেও বাঁচাতে পারতেন। সম্পর্কে ফুলবাহারির লতায় পাতায় মামা হন ঠান্ডার বাপ। অবশ্য ফুলবাহারি বা তার মা সম্পর্কের দাবি করলে ঠান্ডার বাপ স্বীকার করেন না যে তিনি আদৌ এদের আত্মীয়। ফুলবাহারি নিজে বিড়ি খেতে খেতে আমাকে বলল একদিন–দুহান আছে তার, পইসা অইছে। অহন আর স্বীকার যায় না আমরা যে হের আত্মীয়, মাইনষের বাড়িত বান্দিগিরি করি যে, হেইলিগা। গরিবের মধ্যেও উচা নিচা আছে। ঠান্ডার মা পাড়ায় বলে বেড়িয়েছে যে শর্ষিনার পীরের পড়া পানি খেয়ে জ্বিনের বাতাস ছেড়েছে তার খসমের। অবশ্য ফুলবাহারির বিশ্বাস–নানার ওষুধেই বালা হইছে মামু। মাইনষে কয়, বাতাস লাগলে নাহি বাচে না। কই বাচল ত। ফুলবাহারি মানুষের কথায় তেমন আস্থা
false
shordindu
হইয়াছিল। তাহার স্ত্রী এক মৃত কন্যা প্রসব করিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তাহার পর সে আর বিবাহ করে নাই। “পুলিস-তদন্তে বাহির হইয়াছে যে, হত ব্যক্তি গোয়া হইতে নবাগত একজন পোর্তুগীজ ফিরিঙ্গী, ব্যবসায় উপলক্ষে কয়েকদিন পূর্বে কলিকাতায় আসিয়া এক ক্ষুদ্র হোটেলে বাস করিতেছিল। তাহার নাম গেব্রিয়েল ডিরোজা। “গোলাম কাদের এখন হাজতে আছে। ডিরোজার লাস পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে প্রেরিত হইয়াছে।” ঘটনাস্থলের খুব কাছেই আমার বাড়ি এবং অনেকদিন হইতে এই গোলাম কাদের লোকটার সহিত আমার মুখ-চেন্নাচিনি ছিল বলিয়াই ব্যাপারটা বেশি করিয়া আমাকে আকৃষ্ট করিয়াছিল। তাহা ছাড়া আর একটি জিনিস আমার কৌতূহল উদ্রিক্ত করিয়াছিল, সেটি ভাস্কো-ডা-গামার নাম। ছেলেবেলা হইতেই আমি ইতিহাসের ভক্ত, তাই হঠাৎ কসাইখানার হত্যাকাণ্ডের মধ্যে এই ইতিহাস-প্ৰসিদ্ধ নামটা উঠিয়া পড়ায় আমার মন সচকিত ও উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছিল। ‘ভাস্কো-ডা-গামা’ সাধারণ প্রচলিত নাম নহে; একজন অশিক্ষিত মুসলমান কসাইয়ের মুখে এ নাম এমন অবস্থায় উচ্চারিত হইতে দেখিয়া কোন এক গুপ্ত রোমান্সের গন্ধে আমার মনটা ভরিয়া উঠিয়াছিল। কি অদ্ভূত রহস্য এই বিশ্ৰী হত্যাকাণ্ডের অন্তরালে প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে? কে এই গেব্ৰিয়েল ডিরোজা—যাহাকে হত্যাকারী ভাস্কো-ডা-গামা বলিয়া সম্বোধন করিল? সত্যই কি ইহা কেবলমাত্ৰ এক বাতুলের দায়িত্বহীন প্ৰলাপ? তা সে যাহাই হউক, কৌতুহল আমার এতই বাড়িয়া গিয়াছিল যে, যেদিন এই মোকদ্দমা করোনারের কোর্টে উঠিল, সেদিন আমি একটু সকাল সকাল আদালতে গিয়া হাজির হইলাম। করোনার তখনও উপস্থিত হন নাই, কিন্তু আসামীকে আনা হইয়াছে। চারিদিকে পুলিস গিসগিস করিতেছে। আসামীর হাতে হাতকড়া—একটি টুলের উপর চুপ করিয়া বসিয়া আছে। আমাকে দেখিয়া সে চিনিতে পারিল এবং হাত তুলিয়া সেলাম করিল। পাগলের লক্ষণ কিছুই দেখিলাম না, নিতান্ত সহজ মানুষের মতো চেহারা। মুখে ভয় বা উৎকণ্ঠার কোনও চিহ্নই নাই। দেখিয়া কে বলিবে, এই লোকটাই দুই দিন আগে এমন নির্দয়ভাবে আর একটা লোককে হত্যা করিয়াছে। করোনার আসিয়া পড়িলেন। তখন কাজ আরম্ভ হইল। প্রথমেই ডাক্তার আসিয়া এজাহার দিলেন। তিনি বলিলেন, লাসের গায়ে সর্বসুদ্ধ সাতাশ্নটি ছুরিকাঘাত পাওয়া গিয়াছে। এই সাতান্নটির মধ্যে কোনটি মৃত্যুর কারণ, বলা শক্ত। কারণ, সবগুলিই সমান সাংঘাতিক। ডাক্তারের জবানবন্দি শেষ হইলে জর্জ ম্যাথুস নামক একজন দেশী খ্রীস্টানকে সাক্ষী ডাকা হইল। অন্যান্য সওয়াল জবাবের পর সাক্ষী কহিল, “আমি গত দশ বৎসর প্রায় প্রত্যহ গোলাম কাদোরের দোকানে মাংস কিনিয়াছি; কিন্তু কোনও দিন তাহার এরূপ ভাব দেখি নাই। সে স্বভাবত বেশ শাস্তশিষ্ট লোক।” প্রশ্ন——আপনার কি মনে হয়, সে যে-সময় হত ব্যক্তিকে আক্রমণ করে, সে সময় সে স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না? উত্তর—হত ব্যক্তি দোকানে প্ৰবেশ করিবার আগে পর্যন্ত সে স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল—আমাদের সঙ্গে সহজভাবে কথাবার্তা কহিতেছিল; কিন্তু ডিরোজাকে দেখিয়াই একেবারে যেন পাগল হইয়া গেল। প্রশ্ন—আপনার কি বোধ হয়, আসামী হত ব্যক্তিকে পূর্ব হইতে চিনিত? উত্তর-হাঁ। কিন্তু তাহার আসল নাম না বলিয়া ভাস্কো-ডা-গামা বলিয়া ডাকিয়াছিল। প্রশ্ন—ডিরোজা আক্রান্ত হইয়া কোনও কথা বলিয়াছিল? উত্তর-না। প্রশ্ন—আসামী মদ বা অন্য কোনও নেশা করে, আপনি জানেন? উত্তর-আমি কখনও তাহাকে নেশা করিতে বা মাতাল হইতে দেখি নাই। প্রশ্ন—আসামীর ভাবে ইঙ্গিতে কি আপনার বোধ হইয়াছিল যে, সে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিবার জন্য ডিরোজাকে খুন করিতেছে? উত্তর—হাঁ। তাহার কথায় ও মুখের ভাবে আমার মনে হইয়াছিল যে, ডিরোজা পূর্বে তাহার স্ত্রী, কন্যা ও বৃদ্ধ পিতার উপর কোনও অত্যাচার করিয়া থাকিবে। জর্জ ম্যাথুসের পরে আরও কয়েকজন সাক্ষী প্রায় ওই মর্মে এজাহার দিবার পর পুলিসের ডেপুটি কমিশনার এজাহার দিতে উঠিলেন। তিনি বলিলেন যে, গোয়া হইতে খবর পাইয়াছেন যে, ভিরোজা সেখানকার একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, জাতিতে ফিরিঙ্গী পোর্তুগীজ—বয়স বিয়াল্লিশ বৎসর। সে পূর্বে কখনও গোয়া ছাড়িয়া অন্যত্র যায় নাই—জীবনে এই প্রথম কলিকাতায় পদার্পণ করিয়াছিল। আসামী সম্বন্ধে ডেপুটি কমিশনার বলিলেন, ‘আসামীর আত্মীয়-স্বজন স্ত্রী পুত্র পরিবার কেহ নাই। অনুসন্ধানে জানা গিয়াছে যে, গত ত্ৰিশ বৎসরের মধ্যে সে কলিকাতা ছাড়িয়া কোথাও যায় নাই। তাহার বয়স অনুমান সাতচল্লিশ বৎসর। সুতরাং ডিরোজার সহিত তাহার যে পূর্বে কখনও দেখা-সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তাহা সম্ভব বলিয়া বোধ হইতেছে না।’ আসামী এতক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। এবার সে কথা কহিল, বলিল, “ডা-গামাকে আমি অনেকবার দেখিয়াছি।” মুহুর্তমধ্যে ঘর। একেবারে নিস্তব্ধ হইয়া গেল। করোনার ডেপুটি কমিশনারকে চুপ করিতে ইঙ্গিত করিয়া আসামীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি ডিরোজাকে পূর্ব হইতে জানো?’ আসামী বলিল, ‘ডিরোজাকে আমি কখনও দেখি নাই—আমি ভাস্কো-ডা-গামাকে চিনি। ভাস্কো-ডা-গামা ছদ্মবেশে আমার দোকানে মাংস কিনিতে আসিয়াছিল৷।’ করোনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আসামীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘আচ্ছা, ভাস্কো-ডা-গামাকে তুমি কোথায় দেখিয়াছ?’ আসামী কহিল, ‘প্রথম দেখি কালিকটের বন্দরে–শেষ দেখি সমুদ্রের বুকের উপর–এই পর্যন্ত বলিয়া আসামী হঠাৎ থামিয়া গেল। দেখিলাম, তাহার মুখ-চোখ লাল হইয়া উঠিয়াছে, মুখ দিয়া কথা বাহির হইতেছে না। সে অবরুদ্ধকণ্ঠে একবার ‘ইয়া খোদা?’—বলিয়া দুই হাতে মুখ গুজিয়া বসিয়া পড়িল—আর কোনও কথা বলিল না। তারপর করোনার যথাসময়ে রায় দিলেন যে, ক্ষণিক উন্মত্ততার বশে গোলাম কাদের ডিরোজাকে খুন করিয়াছে। কোর্ট হইতে যখন বাহিরে রাস্তায় আসিয়া দাঁড়াইলাম, তখন আমার মাথার ভিতর ঝাঁ-ঝাঁ করিতেছে। ‘কালিকট’, ‘সমুদ্রের বুকের উপর’—আসামী এ সব কি বলিল? আরও কত কথা, না জানি কোন অপূর্ব কাহিনী এই মুখ নিরক্ষর কসাই গোলাম কন্দেরের বুকের মধ্যে লুকানো আছে। কারণ, সে যে পাগলামির ভান করিতেছে না, তাহা নিঃসন্দেহ। কোনও কথা বা কাজই তাহার’ পাগলের মতো নহে। অথচ দুই-একটা অসংলগ্ন কথার ভিতর দিয়া অতীতের পর্দার একটা কোণ তুলিয়া ধরিয়া এ কি এক আশ্চর্য রূপকথার ইঙ্গিত দিয়া গেল! ইহার
false
shirshendu
গেছে। কষ্ট হচ্ছিল দীপনাথের। বলল, চলুন না বাকি পথটা হেঁটে যাই? দরকার কী! প্রায় এসে গেছি। রিকশাওয়ালাটার জন্য মায়া হচ্ছে। মায়া করবেন না। ওরা খুব হার্ডি। আমাদের মতো নয়। এই নিষ্ঠুরতা ভাল লাগল না দীপনাথের। চুপ করে রইল। রিকশাকে অবশেষে থামালেন সুখেন। সামনে একটা এঁদো বাড়ি। সেটা কত উঁচু তা এই সরু গলিতে সন্ধের আবছা আলোয় ঠাহর করা মুশকিল। সুখেন নেমে ভাড়া দিতে গিয়ে রিকশাওয়ালার সঙ্গে একটু বচসা বাধালেন। তারপর দীপনাথকে বললেন, আসুন। এখানে কি কোনও রেস্টুরেন্ট আছে?— দীপনাথ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল। বলতে কী বাড়িটার চেহারা দেখে সে একটু হতাশও হয়েছে। একেবারে অবাঙালি পাড়া। নর্দমা আর রোদহীন বাতাসের ভ্যাপসা গন্ধ আসছে। কম আলোর ভুতুড়ে গলি। আমি ফুড ইন্সপেক্টর। সব ঘাঁটি চিনি। নিশ্চিন্তে আসুন। সরু সিঁড়ি বেয়ে বাড়ির দোতলায় সুখেনের পিছু পিছু উঠে এল দীপনাথ। সুখেন একটা ফ্ল্যাটের দরজার পর্দা সরিয়ে গট গট করে ঢুকলেন। কোনও রেস্টুরেন্ট বলে মনেই হয় না। সামনের ঘরটা ঠিক যেন কারও বাড়ির খাওয়ার ঘর। একটা মাত্র ডাইনিং টেবিল ঘিরে গোটাছয়েক চেয়ার। স্টিক লাইট জ্বলছে। চারিদিকে ফানুসের মতো আকৃতির আরও কয়েকটা ঘর-সাজানোর বাতি ঝুলছে সিলিং থেকে। দেয়ালে মুখোশ, তির-ধনুক, বিদ্ধ এবং মরা প্রজাপতি সাজানো। বাড়িটা চুপচাপ। শুধু ভিতরের কোনও ঘর থেকে ক্ষীণ রেডিয়োয় বিবিধ ভারতীর শব্দ আসছে! কেউ তাদের রিসিভ করল না। সুখেন গিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বললেন, বসুন। ওই কৈাণে বেসিন আছে, হাত ধুয়ে আসতে পারেন। এটা তো কারও বাড়ি বলে মনে হচ্ছে। বাড়িই তো। কিন্তু কাম রেস্টুরেন্ট। পাবলিকের জন্য নয়। বাঁধা খদ্দের। যারা চেনে তারাই আসে। লোক কই? আসবে। খেতে হলে এসব জায়গাই ভাল। এরা ঠিক প্রফেশনাল নয়, তাই যত্ন করে খাওয়ায়। পুরনো বাড়ি বলেই বোধহয় ঘরটায় তেমন গরম নেই। একটা আদ্যিকালের ডি সি পাখা ঘুরছে ওপরে। একটু ধূপকাঠির গন্ধও রয়েছে। দীপনাথ জিজ্ঞেস করল, এরা কি চিনে? দো-আঁশলা। খাঁটি চিনেম্যান এখানে পাবেন কোথায়? কথা বলতে বলতেই এক বয়স্কা চিনে মহিলা এসে নিঃশব্দে দাঁড়ায়। মোটাসোটা, হাসিখুশি, স্তনহীন, স্বর্ণদন্তী। পরনে কামিজ আর ঢোলা পাজামা। পায়ে রবারসেলের খড়ম! সুখেন অল্প কথায় অর্ডার দিলেন। মহিলা চলে গেলে দীপনাথকে জিজ্ঞেস করলেন, শুয়োরের মাংস খান তো? দীপনাথ খায়। একটু ঘেন্না হলেও খায়। হেসে মাথা নাড়ল। সুখেন বলেন, এর ওইটে ভাল করে। খাবার এল একটু বাদেই। প্ৰন-চাউমিন আর পর্ক চপ। পরিমাণে প্রচুর এবং অত্যন্ত সুন্দর গন্ধ। ও স্বাদ। সঙ্গে দু’ বোতল বিয়ার। কাঁচা পেঁয়াজ এবং স্যালাড। দীপনাথ খেয়ে বুঝল, বহুকাল সে এত ভাল খাবার খায়নি। সুখেন ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করেন, ভাল নয়? দারুণ। ভাল খেতে চাইলে আমাকে বলবেন। এরকম আরও বহু খাওয়ার জায়গা আছে কলকাতায়। আমার জানা ছিল না। অনেকেই জানে না। দীপনাথ হাসল। সুখেন খেতে খেতেই বলেন, আমার বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন না? তখন আপনাকে সত্যি কথাটা বলিনি। কী কথা? আমার একজন মহিলা আছেন। দীপনাথ ভ্র তুলে বলে, মহিলা? বিবাহিতা। ছেলেমেয়েও আছে। সে কী? সুখেন একটু হাসলেন। ঠোঁট চাউমিনের তেলে মাখা। চকচক করছে। চোখে বিয়ারের উজ্জ্বলতা। এতক্ষণে লোকটাকে হঠাৎ বদমাশের মতো দেখাল। শান্ত লাজুক নিরেট মুখ-চোখে একটা পাপবোধের আবিলতাও ফুটে উঠল। বললেন, বিয়েতে একটু আটকাচ্ছে। সামাজিকতাই বাধা। দীপনাথ অল্প ভড়কে গিয়ে বলে, বিবাহিতা মহিলা মানে তো স্বামী আছে। সে ব্যাটা এক নম্বরের পাজি। বদমাশ দি গ্রেট। এখন জেল খাটছে। বউটাকে দেখার কেউ নেই। ছেলেমেয়েগুলো একেবারে অনাথ। ছেলেমেয়ে ক’জন? তিনটে। ভদ্রমহিলার বয়স? বয়স আছে। এ ব্যাপারটা সুখেন ভাঙতে চান না বুঝে দীপনাথ আর প্রশ্ন করে না। শুধু বলে, ও। আপনার সঙ্গে এ ব্যাপারে একটু পরামর্শ করতে চাই। দীপনাথ সতর্ক হয়ে বলে, ওটা আপনার পার্সোনাল ব্যাপার। থাক না। আরে গোপনীয়তা কিছু নেই। আপনি তো আমার বন্ধু, আপনাকে বলতে বাধা কী? বিয়ে কি ঠিক হয়ে গেছে? ঠিক কিছুই নয়। আমি তেমন ইন্টারেস্টেডও নই। তবে একটু ফেঁসে গেছি। ওই মহিলার কাছে আমি ইনডেটেড। অসময়ে আমার অনেক উপকার করেছে। এখন ওর একটা পার্মানেন্ট আশ্রয় দরকার। তা হলে আর আমি কী বলব বলুন! চলুন না একবার মহিলাটির কাছে নিয়ে যাই আপনাকে এখন। এখন!—বলে দীপনাথ ভড়কায়। একদিনে এত ঘনিষ্ঠতায় হাঁফ ধরে যাচ্ছে তার। বলল, আজ থাক। বেশি দূর নয়। রিকশায় মিনিট দশেক। আবার রিকশা!—আঁতকে ওঠে দীপনাথ। সুখেন হেসে বলেন, আপনার টানা রিকশা ভাল লাগে না, না? আমার কিন্তু বেশ লাগে। মনে হয়, কলকাতার ভিড়ের ওপর দিয়ে যেন নৌকোয় ভেসে ভেসে চলেছি। সে তো বুঝলাম। কিন্তু আমি গিয়ে করবটা কী? কিছুই নয়। একটু বসবেন, চা-টা খাবেন। বীথি খুশি হবে। ভারী অস্বস্তি বোধ করে দীপনাথ। রবি ঠাকুর জীবনে জীবন যোগ করার কথা বলেছেন বটে, কিন্তু বেমক্কা এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়তে তার একদম ইচ্ছে করছিল না। ভয়-ভয় করছিল। সে বলল, কোথায় বাড়ি? গড়পাড়। আমাদের বোর্ডিং থেকে বেশি দূরও নয়। খাওয়া হতেই টক করে উঠে পড়লেন সুখেন। চিনে মহিলার সঙ্গে পাশের রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গুনগুন করে কী একটু কথা বলে এলেন। চলুন। দীপনাথ জড়তা কাটিয়ে উঠল। লোকটা খাইয়েছে, বন্ধু হতে চেয়েছে, একটু রিটার্ন সার্ভিস দেওয়া উচিত। তবে সে মনে মনে স্থির করে ফেলল এরপর থেকে সুখেনকে আর বেশি পাত্তা দেবে না। রিকশায় উঠে আবার দীর্ঘ রাস্তা পেরিয়ে নিজেদের বোর্ডিং-এর
false
nihar_ronjon_gupta
ব্যাপারটা আমার কাছে আর গোপন নেই। –কি গোপন নেই। —তুমি যে বেশ কিছুকাল ধরেই দীপ্তেন ভৌমিকের সঙ্গে মাতামাতি করছ—আমি সেটা জানি। হঠাৎ সোজা ঋজু হয়ে দাঁড়াল মালঞ্চ। বলল, হ্যাঁ, এসেছিল। -কেন, কেন সে এখানে আসে? –কৈফিয়ৎ চাইছ? —চাওয়াটা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়। —কিন্তু ভুলো না সুরজিৎ, আমি তোমার বিয়ে করা স্ত্রী নই। –জানি, তুমি আমার রক্ষিতা। –ভদ্রভাবে কথা বল সুরজিৎ। –ভদ্রভাবে কথা বলব কার সঙ্গে, তোমার সঙ্গে—একটা হার্লটের সঙ্গে? — ! —হারামজাদী, তুই আমারই খাবি, আমারই ঘরে থাকবি, আর– —বের হয়ে যাও—মালঞ্চ চিৎকার করে ওঠে, এই মুহূর্তে এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও সুরজিৎ-এটা আমার বাড়ি। সুরজিতের বোধহয় মনে পড়ে যায় যে বৎসর খানেক পূর্বে পাকাপোক্তভাবে বাড়িটার দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়ে গিয়েছে মালঞ্চর নামে। তাই বলে, ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। কিন্তু তোকেও আমি ছেড়ে দেব না হারামজাদী, গলা টিপে তোকে আমি শেষ করে দেব—মুহূর্তে সুরজিৎ ঘর থেকে হনহন করে বের হয়ে গেল। রাগে মালঞ্চ তখন ফুসছে। একটু পরেই মানদা এসে ঘরে ঢুকল।—কি হয়েছে মা, বাবু চলে গেলেন? —নীচের দরজায় তালা দিয়ে চাবিটা আমায় এনে দে মানদা! —কিন্তু নীচের বাবু যদি ফিরে আসেন? -–ঠিক আছে, হ্যাঁ। আর হ্যাঁ, শোন, ঐ নীচের বাবু এলে আমাকে জানাবি। ব্যাপারটা পরে জানা যায়-আগের দিন অর্থাৎ শুক্রবারের সন্ধ্যার ঘটনা। পরের দিন শনিবার, মানদা সকাল পৌনে সাতটা নাগাদ চা নিয়ে এসে দরজা ঠেলে দেখে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। প্রথমে ডাকাডাকি করে মানদা, পরে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে, কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে মালঞ্চর কোন সাড়া পাওয়া যায় না। মানদা ভয় পেয়ে রতনকে ডেকে আনে। দুজনে তখন আরো জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দেয় আর চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করে, তবু কোন সাড়া নেই মানদা ভয় পেয়ে গিয়েছে তখন রীতিমত। কাঁপা কাঁপা গলায় রতনকে বলল, ব্যাপার কি বল তো রতন?। ঠিক ঐ সময় সিঁড়িতে স্যান্ডেলের শব্দ পাওয়া গেল। মানদা বলল, এ সময় কে এলো আবার? মালঞ্চর স্বামী সুশান্ত সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এলো। মাথার চুল রুক্ষ, একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনের প্যান্ট আর শার্টটা আরো ময়লা হয়ে গিয়েছে। মানদা সুশান্তকে দেখে বলে, বাবু, মা ঘরের দরজা খুলছে না। —খুলবেও না আর কোন দিন— —সে কি বাবু! কি বলছেন আপনি। —আমি জানি, শেষ হয়ে গেছে—আমি চললাম-থানায় খবর দাও—তারাই এসে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকবে—বলে যেমন একটু আগে এসেছিল সুশান্ত, তেমনি ভাবেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। সুশান্ত কিন্তু বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল না, সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচের তলায় নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। ঘণ্টা দুই পরে থানার অফিসার নীচের ঘরে ঢুকে দেখতে পেয়েছিলেন তজোপোষের ওপর সুশান্ত গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। সুশান্ত কথাগুলো বলে যাবার পর রতন কিছুক্ষণ ঘরের সামনে বারান্দাতে দাঁড়িয়েই থাকে, তারপর মানদার দিকে কেমন যেন বিহুল বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মানদাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে, তারও মুখে কোন কথা নেই। কিছুক্ষণ পর রতনের যেন বিহুলতাটা কাটে। সে বলে, তুই কোথাও যাস নে মানদা, আমি থানাতে চললাম —থানায়, কেন রে? –কি বোকা রে তুই। সত্যিই যদি মা মারা পড়ে থাকেন তাহলে ঘরের দরজা ভেঙে কি আমরা খুনের দায়ে পড়ব? —খুন! অস্ফুট কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে মানদা। –কে জানে! হতেও তো পারে! কাল এগোরাটা পর্যন্ত যে মানুষটা বেঁচে ছিল হঠাৎ সে যদি রাত্রে ঘরের মধ্যে মরে পড়ে থাকে। উঁহু বাবা, আমার ভাল ঠেকছে না। নিশ্চয়ই কোন গোলমাল আছে—আমি চললাম থানায় খবর দিতে—বলতে বলতে রতন সিঁড়ির দিকে এগুলো। —এই রতন, আমাকেও তাহলে তোর সঙ্গে নিয়ে চ-মানদা চেঁচিয়ে ওঠে। –আমাকে সঙ্গে নে! মানদাকে খিচিয়ে উঠল রতন, তুই কচি খুকীটি নাকি! —মাইরি বলছি কতন, আমি এর কিছু জানি না। –জানিস না তো থানার লোক এসে যখন জিজ্ঞাসা করবে তখন তাই বলবি। —আমি কাল রাত এগারোটার সময় যখন নীচে চলে যাই মা তখন চেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিল। জলজ্যান্ত মানুষটা –তাহলে তাই বলবি, আমি আসছি—বলে রতন সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল। স্থানীয় থানার দারোগা সুশীল চক্রবর্তীর বয়স খুব বেশী নয়, বছর চল্লিশেক হবে। রতনের মুখে সংবাদটা পেয়েই জনা-দুই সেপাই সঙ্গে নিয়ে তিনি হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে চলে এলেন। মানদা তখনও বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখমুখ ফ্যাকাশে। একটা অজ্ঞাত ভয় যেন মানদাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সুশীল চক্রবর্তী মানদাকে দেখিয়ে রতনকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ কে? —আজ্ঞে বাবু, ও এই বাড়িব ঝি, মানা। —হুঁ। কোন্ দরজা? –ঐ যে দেখুন না– —সুশীল চক্রবর্তী দরজাটা একবার ঠেললেন—দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। জোরে জোরে দরজার গায়ে কয়েকবার ধাক্কা দিলেন—ভিতর থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। —বিক্রম সিং! —জি হুজুর! –দরজা ভেঙে ফেল। কিন্তু ঘরের দরজা ভাঙা অত সহজ হল না। মজবুজ কাঠের দরজা, দরজার গায়ে ইয়েল লক সিস্টেম। অনেক কষ্টে প্রায় আধ-ঘণ্টা ধরে চেষ্টার পর বিক্রম সিং আর হরদয়াল উপাধ্যায় দরজাটা ভেঙে ফেলল। ঘরের মধ্যে ঢুকেই সুশীল চক্রবর্তী থমকে দাঁড়ালেন। ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে তখনো, সব জানলা বন্ধ। মালঞ্চ চেয়ারের ওপর বসে—মাথাটা ঈষৎ বুকের ওপর ঝুঁকে আছে, আর হাত-পাঁচেক দূর থেকেই সুশীল চক্রবর্তী স্পষ্ট দেখতে পেলেন, একটা পাকানো রুমাল মহিলাটির গলায় চেপে বসে আছে। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে উপবিষ্ট ঐ দেহটার দিকে তাকিয়ে থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন সুশীলবাবু। চোখ দুটো বিস্ফারিত,
false
humayun_ahmed
জোহরের নামাজ আদায় করব। বিশেষ বিশেষ অবস্থায় ইশারায় নামাজ পড়ার বিধান আছে। আপনার এখন সেই অবস্থা। আমি ক্ষুধার্ত। আমার জন্যে দুপুরের খাবারের কী ব্যবস্থা? সাদ মুহম্মদ জবাব দিল না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইল। কামরান বললেন, তুমি ব্যাঙাচির কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে আসো, আমাকে দুপুরের খাবার দেওয়া হবে কি না। কাকে ব্যাঙচি বলছেন? বৈরাম খাঁকে। ব্যাঙচি তার যথার্থ পরিচয়। আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার হুকুম নেই। সম্রাটের সামনে আমাকে কখন হাজির করা হবে? জানি না। শুনেছি আসরের পর। আমি আমার ভাইকে চিনি। আমার ভাই যখন শুনবেন আমাকে না। খাইয়ে রাখা হয়েছে তিনি রাগ করবেন। তুমি যাও, আমার খাবারের ব্যবস্থা করো। আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্যে হাতি এবং পাথর প্রস্তুত করা হয়েছে। আমার উপদেশ, আপনি আহারের কথা চিন্তা না করে আসন্ন মৃত্যুর কথা চিন্তা করুন। এবং আল্লাহপাকের নাম নিতে থাকুন। আমি তৃষ্ণার্তা। পানি খাব। আপনার সামনে থেকে উঠে যাওয়ার হুকুম আমার নেই। বাদ মুহম্মদ, তোর ধৃষ্টতা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার মনে থাকবে। হুমায়ূন আচার্য হরিশংকরকে ডাকে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁর সঙ্গে দুপুরের খাদ্য গ্ৰহণ করবেন। হরিশংকর নিরামিশাষী। তাঁর জন্যে ত্রিশ পদের নিরামিষের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি ছোওয়া বাঁচিয়ে রেশমের আসনে আলাদা বসেছেন। সম্রাট বললেন, আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। হরিশংকর বললেন, আমার জীবন আমি আপনাকে নিবেদন করেছি। কাজেই আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার কিছু নেই। আপনি কীভাবে জানলেন, কামরান মীর্জা শের শাহ’র কাছে পত্র পাঠিয়েছে? সম্রাটের স্বার্থেই আমি কামরান মীর্জার আস্থাভাজন হয়েছি। আমি এই পত্রের বিষয়ে সরাসরি তার কাছ থেকে জানতে পারি। আপনি একজনের বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন। আমি যা করেছি সম্রাটের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে করেছি। সম্রাটের জন্যে যদি আরও হাজারজনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে হয়, আমি করব। আপনি খাদ্য গ্রহণ করছেন না। খাবার নাড়াচাড়া করছেন। কারণ জানতে পারি? আমি একটি বিষয় নিয়ে কঠিন উদ্বেগের মধ্যে আছি বলেই আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণা লোপ পেয়েছে। উদ্বেগের কারণ জানতে পারি? শের শাহ বিশাল বাহিনী নিয়ে লাহোরের দিকে ছুটে আসছেন। এই বিশাল বাহিনীকে পরাস্ত করা এই মুহুর্তে সম্রাটের পক্ষে সম্ভব না। এমন পরিস্থিতিতে আপনার পরামর্শ কী? আমি অতি ক্ষুদ্র একজন। সম্রাটকে পরামর্শ দেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। তারপরও বলব সম্রাট যেন কান্দাহারের দিকে চলে যান। পালিয়ে যেতে বলছেন? হ্যাঁ। য পলায়তি স্ব জীবতি। এর অর্থ কী? এর অর্থ, যে পলায়ন করে সে বেঁচে থাকে। মীর্জা কামরানকে সম্রাটের সামনে উপস্থিত করা হয়েছে। তাঁর কোমরের তরবারি গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুই হাত শক্ত করে পেছন দিকে বাঁধা। সম্রাটের সামনে বন্দিদের এইভাবেই উপস্থিত করানোর রীতি। কামরান কুর্নিশ করার চেষ্টায় সামান্য নিচু হলেন। হুমায়ূন বললেন, আমার ভাইকে কেন তোমরা এভাবে আমার সামনে উপস্থিত করেছ? এক্ষুনি হাতের বাঁধন খুলে দাও। গলা থেকে তরবারি নামাও। তা-ই করা হলো। সম্রাট উঠে এসে ভাইকে আলিঙ্গন করলেন। সম্রাট বললেন, আমার মহান পিতা মৃত্যুর আগে আমাকে বলেছেন, তুমি সবসময় ভাইদের দেখবে ক্ষমাসুন্দর চোখে। আমি তা-ই করছি। ভাই কামরান, এসো তুমি আমার ডানপাশে এসে বসো। কামরান মীর্জা তা-ই করলেন। অসময়ের একটি তরমুজ এসেছিল। খোরাসান থেকে। সম্রাট নিজের হাতে সেই তরমুজের খণ্ড ভাইয়ের মুখে তুলে দিলেন। এমন আবেগঘন মুহূর্তে দরবারে ‘মারহাবা’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়। কেউ মারহাবা ধ্বনি দিল না। সম্রাট ভাইকে বিশ্রাম নিতে পাঠালেন। মধ্যরাতে বৈরাম খাঁ সম্রাটকে ডেকে তুললেন। দুটি দুঃসংবাদ আছে, সম্রাটকে জানানো প্রয়োজন। প্রথম দুঃসংবাদ, শের শাহ লাহোরের কাছাকাছি চলে এসেছেন। দ্বিতীয় দুঃসংবাদ, মীর্জা কামরান কিছুক্ষণ আগেই তার সেনাবাহিনী নিয়ে কান্দাহার রওনা হয়েছেন। সম্রাট হুমায়ূনের সেনাবাহিনীর বেশির ভাগ সৈন্য কামরানের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। তিনজন ছাড়া বাকি আমীররাও তাই করেছেন। হুমায়ূন বললেন, বৈরাম খাঁ, এর কারণ কী? বৈরাম খাঁ বললেন, বিচারসভায় আপনার কর্মকাণ্ড দেখা হয়েছে আপনার দুর্বলতা হিসেবে। সবাই থাকে সবলের পক্ষে। আমি কি দুর্বল? আপনি অনেক বেশি সবল। এটা ধরার ক্ষমতা তাদের নেই। হুমায়ূন বললেন, সবকিছুই তিনবার করে ঘটে। সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য আসে পরপর তিনবার। তুমি আমাকে দুটি দুঃসংবাদ দিয়েছ। এখন তৃতীয়টি দাও। বৈরাম খাঁ বললেন, সম্রাট যদি কামরান মীর্জকে মৃত্যুদণ্ড দিতেন তাহলে সেই আদেশ দ্রুত কার্যকর করার ব্যবস্থা নেওয়া ছিল। হাতি এবং হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করার জন্যে পাথর ছিল। কামরান মীর্জা সেই পাথরে সাদ মুহম্মদকে হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করেছেন। সাদ মুহম্মদ কে? সম্রাটের এবং আমার অতি অনুগত একজন। তার হাতেই কামরান মীর্জা বন্দি হয়েছিলেন। বৈরাম খাঁ, আপনি কি নিয়তি বিশ্বাস করেন? করি না। কিন্তু আপনি বললে করব। সম্রাট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি বলছি না। স্বয়ং আল্লাহপাক নিয়তির কথা বলেছেন। সূরা বনি ইসরাইলে বলা আছে, আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি। নিয়তির হাতে সম্রাট নিজেকেই সমৰ্পণ করলেন। স্ত্রী হামিদা বানু এবং অল্পকিছু অনুগতজন নিয়ে শুরু হলো তাঁর পথেপ্ৰান্তরে পালিয়ে থাকার দিন। তাকে তাড়া করে ফিরল। আরেক নিয়তির সন্তান শের খাঁ। ভুল বললাম, খাঁ না। তিনি এখন শের শাহ। এশার নামাজ শেষ হয়েছে। মীর্জা কামরান নামাজ শেষ করে নৈশকালীন মদের আসরে বসেছেন। আসরে ছয়জন আমীর উপস্থিত। তাদের হাতে রুপার পানিপাত্ৰ। মীর্জা কামরানের হাতে সোনার পানপত্র। মীর্জা কামরান ক্ষুব্ধ চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। তাঁর মেজাজ। সপ্তমে। তবে মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছেন। তার মেজাজ খারাপের প্রধান কারণ, স্বর্ণের পানিপাত্রে তাকে ছাড়াও আরেকজনকে মদ পরিবেশন
false
humayun_ahmed
ইচ্ছা বান্ধবীর সঙ্গে গল্প করুন।আবার যখন দরকার হবে চলে আসবেন। স্লিপ ছিঁড়ে ফেলে দিন। আমার সামনেই ছিঁড়ুন। আমি স্লিপ ছিঁড়লাম। ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন,গুড। নিন, কথা বলুন।যা ইচ্ছা বলতে পারেন।আমি শুনব না।আমি একটু দূরে যাচ্ছি।ভদ্রলোক সরে গেলেন। রূপাকে দ্বিতীয়বার টেলিফোন করার কোনো অর্থ হয় না। আমার আর কোনোও বান্ধবীও নেই। টেলিফোন করলাম বড়খালার বাসায়। খালু ধরলেন, মিহি গলায় বললেন, কে হিমু? খালু, আপনি অফিসে যান নি? আর অফিসে যাওয়া-যাওয়ি, যে যন্ত্রণা বাসায়! কী হয়েছে? তোমার খালা যা শুরু করেছে এতে আমার পালিয়ে যাওয়া ছাড়া পথ নেই। খালা এখন কী করছেন? জিনিসপত্র ভাঙছে।আর কী করবে! আমাকে যে সব কুৎসিত ভাষায় গালাগালি দিচ্ছে তা শুনলে বস্তির মেয়েরাও কানে হাত দিবে। অবস্থা মনে হয় সিরিয়াস। আর অবস্থা! তুমি টেলিফোন করেছ কেন? জরুরি একটা খবর দেবার জন্যে টেলিফোন করেছিলাম।এখন আপনার কথাবার্তা শুনে ভুলে গেছি। বাসায় আসো না কেন? চলে আসব। এখন কয়েকদিন একটু ব্যস্ত।ব্যস্ততা কমলেই চলে আস। তোমার আবার কিসের ব্যস্ততা? নিষ্পাপ মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছি খালুজান। কী খুঁজে বেড়াচ্ছ? নিষ্পাপ মানুষ। টেলিফোনেই শুনলাম ঝনঝন শব্দে কী যেন ভাঙল। খালুজান খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন।আমার মনে হয় পালিয়ে গেলেন। দুপুরে খাবার খাচ্ছি ছাপড়া হোটেলে। রুটি ডাল গোশত। গরম গরম রুটি ভেজে দিচ্ছে। ডাল গোশত ভয়াবহ ধরনের ঝাল।জিহবা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু খেতে হয়েছে চমৎকার। আমাকে খাওয়াচ্ছে একলেমুর মিয়া।সে আজ বড়ই চুপচাপ। অন্য সময় নিচু গলায় সারাক্ষণ কথা বলত। উচ্চশ্রেণীর কথাবার্তা। আজ কিছুই বলছে না। কারণ তার মেয়েটাকে সে দুদিন ধরে খুঁজে পাচ্ছে না। এটা কোনো ব্যাপার না। মেয়েটা পাগলা টাইপের।প্রায়ই উধাও হয়ে যায়।আবার ফিরে আসে। একলেমুর মিয়া আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি করল না।খাওয়ার শেষে মিষ্টি পান এনে দিল, সিগ্রেট এনে নিজেই ধরিয়ে দিল। একলেমুর মিয়া। জি। ভিক্ষা করতে কেমন লাগে বলো দেখি? ভালো লাগে। কত নতুন নতুন মাইনষের সাথে পরিচয় হয়। এক এক মানুষ এক এক কিসিমের। বড় ভালো লাগে। একলেমুর মিয়া খিকখিক করে হাসছে।আমি বললাম, হাসছ কেন? একবার কী হইছে হুনেন ভাইসাব, গাড়ির মইধ্যে এক ভদ্রলোক বহা আছে।আমি হাতটা বাড়াইয়া বললাম, ভিক্ষা দেন আল্লাহর নামে। সাথে সাথে হেই লোক হাত বাড়াইয়া দিছে আমার গালে এক চড়। কেন? এইটাই তো কথা।কী কইলাম আফনেরে—নানান কিসিমের মানুষ এই দুনিয়ায়।এরার সাথে পরিচয় একটা ভাগ্যের কথা। ঠিক কইলাম না? ঠিক না বেঠিক বুঝতে পারছি না। এই এক সারকথা বলেছেন ভাইজান। ঠিক-বেঠিক বুঝা দায়।ক্ষণে মনে লয় এইটা ঠিক।ক্ষণে মনে লয় উঁহুঁ এইটা ঠিক না। চড় দেয়ার পর ঐ লোক কী করল? গাড়ি করে চলে গেলে? সাথে সাথে যায় নাই। লাল বাত্তি জ্বলতেছিল। যাইব ক্যামনে? সবুজ বাত্তির জন্যে অপেক্ষা করতেছিল। তোমাকে কিছু বলে নি? জে না।অনেকক্ষণ তাকাইয়াছিল।কিছু বলে নাই। তুমি কি করলে? আমি হাসছি। সিগারেট শেষ টান দিতে দিতে আমি বললাম, ঐ লোকের সঙ্গে তোমার তো আবার দেখা হয়েছিল, তাই না? বুঝলেন ক্যামনে? আমার সেই রকমই মনে হচ্ছে। ধরছেন ঠিক। উনার সঙ্গে দেখা হইছে।ঠিক আগের জায়গাতেই দেখা হইছে।আমি বললাম, স্যার আমারে চিনছেন? ঐ যে চড় মারছিলেন। লোকটা কী বলল? কিছু বলে নাই, তাকাইয়াছিল।তবে আমারে চিনতে পারছে।বড়ই মজার এই দুনিয়া ভাইসাব! লোকে দুনিয়ার মজাটা বুঝে না।মজা বুঝলে—দুঃখ কম পাইত। উঠি একলেমুর মিয়া। আমি উঠলাম।একলেমুর ফার্মগেটের ওভারব্রিজে গামছা বিছিয়ে বসে পড়ল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একজন ময়লা এক টাকার নোট ছুড়ে ফেলল গামছায়। একলেমুর নিচু গলায় বলল, অচল নোট।টেপ মারা,ছিঁড়া।কেউ নেয় না।ফকিরের দিয়া দেয়।এক কামে দুই কাম হয়—সোয়াব হয়, আবার অচল নোট বিদায় হয়।মানুষ খালি সোয়াব চায়, সোয়াব।অত সোয়াব দিয়া হইব কী? দুপুরে আমার ঘুমের জন্যে নির্দিষ্ট জায়গা আছে—পার্ক।কখনো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, কখনো চন্দ্রিমা উদ্যান, কখনো সস্তাদরের কোনো মিউনিসিপ্যালটি পার্ক।যখন যেটা হাতের কাছে পাই। ফার্মগেট থেকে চন্দ্রিমা উদ্যান এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দুটাই সমান দূরত্বে।তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আমার প্রিয়।সেখানকার বেঞ্চগুলো ঘুমানোর জন্যে ভালো।তাছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ড্রামা অনেক বেশি।দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে মজার মজার সব দৃশ্য দেখা যায়।ক’দিন ধরেই দেখছি স্কুলের ড্রেসপরা একমেয়ে মাঝবয়সী এক লোকের সঙ্গে পার্কে ঘোরাঘুরি করছে।লোকটার হাবভাবেই বোঝা যায় মতলব ভালো না।সুযোগমতো লোকটাকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। আরাম করে শুয়ে আছি। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ফিল্টার হয়ে রোদ এসে গায়ে পড়েছে।আরাম লাগছে—স্কুলের ওই মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে।আচার খাচ্ছে।সঙ্গে মিচকা শয়তানটা আছে।মিচকা শয়তানটা বসার জায়গা পাচ্ছে না।ভালো ভালো সব জায়গা দখল হয়ে আছে। মিচকাটা হতাশ গলায় বলল, পলিন, কোথায় বসি বলো তো? পলিন মেয়েটা মুখভর্তি আচার নিয়ে বলল, বসব না।হাঁটব। লোকটা মেয়েটার বগলের কাছে মুখ দিয়ে কী যেন বলল।পলিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, কেন শুধু অসভ্য কথা বলেন? লোকটা হে-হে করে হাসছে।লোকটার কথা শুধু যে অসভ্য তাই নয়—হাসিটাও অসভ্য।ঠাস করে এর গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে আবার নির্বিকার ভঙ্গিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লে কেমন হয়? সভ্য সমাজে আজগুবি কিছু করা যায় না।আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। কাল সারারাত ঘুম হয় নি। ঘুম না হবার কোনো কারণ ছিল না। কারণ ছাড়াই এই পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটে। দিনের আলো ফোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ঘুমোতে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে চোখভর্তি ঘুম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। ঘুম ভাঙল স্বপ্ন দেখে। আমার বাবাকে স্বপ্নে দেখলাম। তিনি আমার গা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, এই হিমু, হিমু,
false
zahir_rayhan
মত ব্যবহার করছে? তবু কিছু বললো না মরিয়ম। ডাগর চোখজোড়া ধীরেধীরে জলে ভরে এলো তার। কান্না চেপে মৃদু গলায় বললো, আগের মত হলে ভালোই ছিলো লিলি। আজকাল সে কি আর মানুষ আছে, অমানুষ হয়ে গেছে। বলতে গিয়ে চোখ উপচে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। ওকি, কাঁদছো কেন? হাত ধরে বিছানায় এনে ওকে বসালো লিলি। কেঁদে কি হবে। জানি কেঁদে কিছু হবে না। মরিয়ম ধীরে ধীরে বললো, জীবনটা আমার এমন হলো কেন লিলি? এমনটি হোক, তাতো আমি চাই নি কোনদিন। নিজহাতে তুমি নিজের সুখ নষ্ট করেছো ম্যারি। কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো লিলি। মরিয়ম নীরবে মাটির দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, গত দুদিন সে বাসায় আসে নি। ওর কণ্ঠস্বরে ক্লান্তি আর হতাশা ৷ লিলি ওর মুখের দিকে চেয়ে শুধালো, একেবারেই আসে নি? মরিয়ম সংক্ষেপে বললো না। স্টোভের ওপর থেকে কেটলি নামিয়ে আগুনটা নিভিয়ে দিলো লিলি। তারপর তাকের ওপর থেকে দুটো চায়ের পেয়ালা আর চিনির কৌটোটা মেঝেতে নাবিয়ে রাখলো সে। মরিয়ম বললো, আমি চা খাবো না লিলি। লিলি অবাক হয়ে শুধালো, কেন? খানিকক্ষণ কি যেন ভাবলো মরিয়ম। তারপর মান গলায় বললো, আজ দু-দিন সে বাসায় আসে নি। তুমি কি ভাবছো এ দু-দিন কিছু মুখে দিতে পেরেছি আমি? বলতে গিয়ে কান্নায় গলাটা ভেঙ্গে এলো তার। লিলি কী বলে ওকে সান্তুনা দেবে ভেবে পেলো না। পাশে এসে বসে বিব্রত গলায় বললো, ওর জন্যে নিজেকে এমন করে কষ্ট দিচ্ছো কেন ম্যারি? মরিয়ম কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে লিলির কোলে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ কাঁদলো। জড়ানো স্বরে বললো, আমি কি পাপ করেছিলাম বলতে পারো লিলি? বলতে পারো আমার কপালটা এমন হলো কেন? কেটলিটা ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। ওর কারো চা খাওয়া হলো না। বাসায় ফেরার কিছুক্ষণ পরেই, দোরগোড়ায় মনসুরের পায়ের শব্দে চমকে উঠলো মরিয়ম। আনন্দ ও আতঙ্ক দুটোই এসে এক সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ওকে দেখে মনসুর বিস্ময়ের ভান করলো, তুমি এখনো আছো? অদ্ভুত ভাবে ভ্রুজোড়া বাঁকালো সে। না থাকলেই কি তুমি খুশি হতে? গলাটা কাঁপছিলো মরিয়মের। ঘরের মাঝখানে টিপয়টার চারপাশে সাজানো সোফার উপর বসে অকম্পিত স্বরে মনসুর জবাব দিলো, এ সহজ কথাটা কি আর বোঝ না তুমি? ওর প্রতিটি কথা তীরের ফলার মত এসে বিঁধলো তার বুকে। ওর মুখের উপর থেকে জোর করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো মরিয়ম। যে মুখে অত বড় কথা উচ্চারণ করেছে মনসুর, সে মুখের দিকে একটিবারও আর ফিরে তাকাবে না সে। তবু তাকাতে হলো। তবু ওর পাশে এসে দাঁড়ালো মরিয়ম। হাঁটু গেড়ে বসে আশ্চর্য কোমল গলায় শুধালো আমি চলে গেলে সত্যি খুশি হবে তুমি? মনসুর উঠে দাঁড়িয়ে অন্য সোফায় গিয়ে বসলো। তারপর জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে বিকৃত কণ্ঠে বললো, সত্যি তোমার লজ্জা-শরম বলতে কিছু নেই? অকস্মাৎ কোন জবাব দিতে পারলো না মরিয়ম। সারা মুখ আরো স্নান হয়ে এলো তার। নীরবে, মেঝেতে বিছানা কাপেটের ওপর হিজিবিজি কাটতে কাটতে অবশেষে আস্তে করে বললো, তাহলে তাই হবে, তুমি যা চাও তাই করবো আমি। ওর কথাগুলো মনসুর শুনতে পেলো কিনা বোঝা গেলো না। কদিন ধরে শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। মাঝে মাঝে একটু থামে, হয়তো ঘণ্টাখানেকের জন্যে, তারপর আবার আকাশ কালো করে নেমে আসে ঝপ ঝপ শব্দে। একটানা বৃষ্টি হলে ফাটলগুলো চুঁইয়ে ঘরে টপটপ পানি পড়ে। এ ঘরে সে ঘরে হেঁটে সালেহা বিবি দেখছিলেন কোথায় পানি পড়ছে। সেখানে একটি করে মাটির পাত্র বসিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি। হাসিনা বললো, বাড়িওয়ালাকে ডেকে ঘরটা মেরামত করে দিতে বলো না কেন? সালেহা বিবি বললেন, তোর দুলাভাই বলেছে এ মাসের মধ্যে একটা বাড়ি দেখে নিয়ে যাবে আমাদের। তাই তোর বাবা আর মেরামতের জন্যে গা লাগান নি। হাসিনা বললো, কবে যে এ বাড়ি থেকে যাবো, একটু ছাতেও উঠতে পারি নে। সালেহা বিবি পানি পড়ার জায়গাগুলো লক্ষ্য করতে করতে বললো, মাহমুদটার জন্যে, নইলে এতদিনে তোর দুলাভাই এখান থেকে নিয়ে যেতো আমাদের। হাসিন ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, ভাইয়াটা যে কী? কথাটা কানে গেলে নিশ্চয় একটা কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিতো মাহমুদ। এমনিতে কম হৈ চৈ করে নি সে। মাকে ডেকে নিয়ে বলেছে, দেখো মা, তোমার জামাইকে বড় বেশি কৃপা দেখাতে নিষেধ করো। আমরা গরিব হতে পারি, কৃপার পাত্র নই। এ পাড়ার আরো পাঁচশো পরিবার এমনি ভাঙ্গাচোরা বাড়িতে থাকে। তোমার জামাই পারবে তাদের সবার জন্য নতুন বাড়ির বন্দোবস্ত করে দিতে? আমাদের ওপর অত বদান্যতা কেন? মেয়ে বিয়ে দিয়েছ বলে? দেখ মাহমুদ, সব কাজে তোর এই বেয়াড়াপনা ভালো লাগে না আমার, বুঝলি? তীব্র গলায় ওকে আক্রমণ করেছে মা–এক পয়সার মুরোদ নেই, মুখে শুধু বড় বড় কথা। আরো অনেকক্ষণ কথা কাটাকাটি করেছে ওরা। কিন্তু এ-ধরনের তর্কের সহজে মীমাংসা হয় না। হয়ও নি। মাহমুদের ঘরে পানি পড়ছিলো। ওর বইপত্রগুলো আর বিছানাটা এক পাশে টেনে রেখে যেখানে যেখানে পানি পড়ছিলো সেখানে একটা করে মাটির পাত্র বসিয়ে দিলেন সালেহা বিবি। একরাশ সুরকির গুঁড়ো ঝরে পড়লো ওঁর সামনে। সালেহা বিবি উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন কোথেকে পড়লো। তারপর চিন্তিত মুখে চলে গেলেন সেখান থেকে। সারা সকাল বৃষ্টি হলো। সারা দুপুর। বিকেলের দিকে মেঘ সরে গিয়ে আকাশে সূর্য উঁকি দিলো। সোনালি রোদ ছড়িয়ে পড়লো দিগন্তে। তসলিম এসেছিলো।
false
humayun_ahmed
নোংরা? নোংরা সব জিনিসপত্র! ক্রিস বলল, এই নোংরা জিনিসপত্র দিয়ে কি হয় ওখানে, ফাদার? আমি ঠিক জানি না। ফাদার কারাস জানেন কিছু-কিছু। ফাদার কারাস? যাঁর মা মারা গেছেন? হ্যাঁ। উনি জানেন? জানেন। উনি কিছুদিন আগে সাইকোলজিস্টদের এক সেমিনারে এ বিষয়ে একটা পেপার পড়েছিলেন। উনি কি সাইকোলজিস্ট? হ্যাঁ। শয়তানের উপাসনাটা কি রকম, ফাদার? ফাদার ডাইয়ার কিছু বলার আগেই মিসেস জো বললেন, ক্রিস, দেখুন কে এসেছে। ক্রিস তাকিয়েই স্তম্ভিত হয়ে গেল। কেমন ঘোরলাগা অবস্থায় রেগান দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের পাতলা নাইট গাউন ভেজা। কার্পেটের অনেকটাও ভিজে গেছে। ক্রিসের মুখে রক্ত উঠে গেল। রেগান কি এইখানে এসে প্রস্রাব করলো? হ্যাঁ, ঈশ্বর। কি হচ্ছে এসব! ক্রিস দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মেয়েকে। কি হয়েছে, মা-মণি তোমার? আসো, আমার সঙ্গে আসো। অতিথিদের কারো মুখেই কথা নেই। ক্রিস ধরা গলায় বলল, আমার মেয়েটি অসুস্থ, দয়া করে কিছু মনে করবেন। রেগান হঠাৎ একজনকে লক্ষ্য করে তীব্র গলায় চেঁচিয়ে উঠল, তুমি মরবে, তুমি মারা যাবে আকাশে! যাকে বলা হল তিনি অ্যাপোলো মিশনের একজন নভোচারী। খুব শিগগিরই তিনি একটা মিশনে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের মুখ ছাইবর্ণ হয়ে গেল। ক্রিস মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, এই কথা তুমি কেন বললে, রেগান? কেন এই কথা বললে? উত্তরে রেগান বিড় বিড় করে কি যেন বলল। তারপর মনে হল সে ঘুমিয়ে পড়ছে। ক্রিস তাকে নিয়ে উপরে উঠে গেল। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল রেগানের ঘরে। তারপর একসময় নিচে ফিরে এসে দেখে, অনেকেই বিদায় না জানিয়েই চলে গেছে। যারা আছে তারা ক্রিসকে সমবেদনা জানাতে রয়ে গেছে। রেগান যে এমন অসুস্থ তা তারা জানতো না। রেগানের কি ঘুমের মধ্যে হাঁটার অভ্যাস আছে, মিসেস ম্যাকনীল? না, কখনোই না। আজই প্রথম দেখলাম। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এ-বয়সটায় এরকম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। মিসেস জো কিন্তু কোন কথা বললেন না। তিনি ফায়ারপ্লেসের সামনে চুপচাপ বসে রইলেন। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন আগুনের মধ্যে কোন এক আলৌকিক দৃশ্য দেখছেন। নভোচারী ভদ্রলোক এক সময় বিদায় নিলেন। তাঁকে যেতে দেখে অনেকেই উঠে দাঁড়ালেন যাওয়ার জন্যে। পার্টির সুর কোথায় যেন কেটে গেছে। সবার মুখ গম্ভীর। একমাত্র হাসিমুখ ফাদার ডাইয়ারের। তিনি বিদায় নেয়ার আগে রহস্যময় ভঙ্গিতে বললেন, আপনার কোন ছবিতে যদি এমন কোন পাত্রীর দরকার হয় যে খুব খাটো আর পিয়ানো বাজাতে পারে, তাহলে দয়া করে কিন্তু আমাকে জানাবেন! সবার শেষে উঠলেন মেরি জো পেরিন। ক্রিসের মনে হল তিনি যেন কি একটা বলতে চান। কিন্তু বলতে ইতস্তত করছেন খুব। ক্রিস এক সময় বলল, রেগান যে প্রায়ই প্ল্যানচেট নিয়ে মেতে থাকে ওতে কি কোন ক্ষতি হতে পারে ওর? মিসেস মেরি দৃঢ় স্বরে বললেন, রেগানের কাছ থেকে ওইজা বোর্ডটা অবশ্যই নিয়ে নেবেন। ছেলেকে গাড়ির চাবি দিয়ে মিসেস জে গাড়ি স্টার্ট দিতে বললেন। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গরম করা প্রয়োজন। চাবি নিয়ে ছেলেটা চলে যেতেই মেরি জো বললেন, ক্রিস, আমার সম্পর্কে আপনি কি ভাবেন জানি না, তবে অনেকেই মনে করে আমার কিছু অলৌকিক ক্ষমতা আছে। কথাটা হয়ত সত্যি। আমার মনে হয়, মাঝে মাঝে আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি। আমি কখনো পরকাল নিয়ে চর্চা করি না। ওটা খুব বিপদজনক। প্ল্যানচেটও কিন্তু এক ধরনের পরকাল বিষয়ক সাধনা। ক্রিস সহজ স্বরে বলল, মিসেস জে, প্ল্যানচেট একটা ছেলেমানুষী খেলা। মানুষের অবচেতন মনের কাণ্ড কারখানা। হয়ত তাই, মিসেস ম্যাকনীল। পরকালের সব চর্চাই হয়ত আসলে অবচেতন মনেরই একটা কিছু, তবু কিছু একটা হয়–কিছু একটা আছে এর মধ্যে। হয়ত এই খেলা থেকেই অবচেতন মনের একটা নিষিদ্ধ দরজা খুলে যায়। অনেক অদ্ভুত ব্যাপার হয় তখন। আপনি আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন। ছি ছি, ভয় পাবেন কেন? আমি আজ আসি। খুব চমৎকার পার্টি হয়েছে আপনার। আর রেগান কেমন থাকে জানাবেন। ক্রিস ক্লান্ত হয়ে ঘুমুতে গেল অনেক রাতে। বসার ঘরে কার্ল তখন কার্পেটের ভেজা জায়গাটা ভিনেগার দিয়ে ঘষছে। উইলি দাঁড়িয়ে আছে পাশে। সে বলল, কার্ল, থাক আজকের মতো। রাত হয়েছে, চলো ঘুমুতে যাই। কার্ল ঘষতেই থাকল। ক্রিস নাইট গাউন পরে বিছানায় এলিয়ে পড়ার আগে রেগানের ঘরে উকি দিলো। অকাতরে ঘুমাচ্ছে রেগান। ওইজা বোর্ডটি পাশের টেবিলে পড়ে আছে। ওটা সরিয়ে ফেলা কি উচিত হবে? মেরি জো পেরিন ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। ক্রিস ইতস্তত করতে লাগল। বোধহয় এখন না নেয়াই উচিত। ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার। হঠাৎ করে সরিয়ে ফেললে রেগানের মনের ওপর চাপ পড়তে পারে। বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ক্রিস নিজের ঘরে ফিরে গেল। ঘুমিয়েও পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু ধরফড় করে জেগে উঠতে হল পরমুহূর্তেই। পাশের ঘর থেকে আর্তস্বর ভেসে আসছে। অদ্ভুত জান্তব স্বরে রেগান চিৎকার করে চলেছে। ভয়ংকর চিৎকার। ক্রিস প্রায় অন্ধের মত ছুটে গেল। রেগানের ঘরে আবছা অন্ধকার। প্রথমে ক্রিস ভাল করে কিছু দেখতেই পেল না। কি হয়েছে মা-মণি? কি হয়েছে? ক্রিস কাছে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দেখল, উপুড় হয়ে রেগান বিছানায় শুয়ে সমানে কাঁপছে। মাকে দেখে সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, বিছানাটা কাঁপছে। থামাও মা, থামাও। প্লীজ। রেগানের ছোট্ট বিছানাটা সত্যিই ভয়ংকর ভাবে কাঁপছে। প্রান্ত–স্পর্শ ২.১ তাঁর কবর হল একটা ঘিঞ্জি গোরস্থানে। সারাটা জীবনই তিনি নিঃসঙ্গ কাটিয়েছেন, মরণের পর তিনি অনেক সঙ্গী-সাথী পেলেন। সারি সারি কবর চারদিকে।
false
tarashonkor
তো লিখিয়াছে! যে যাহা সাহায্য করিবেন, বিধাতার আশীর্বাদের মতই তাহা লওয়া হইবে। তিনকড়ি বলিল-আসবে না? নিশ্চয় আসবে। নইলে গেজেটে নিখলে ক্যান?… তিনকড়ির সে বিষয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রহিল না। সে ওই কথাটা প্রচার করিবার জন্য তখনই ভল্লা পাড়ায় চলিয়া গেল। রামা, ও রামা! … তেরে! গোবিন্দে! ছিদ্মে! কোথা রে সব? দেবু তখনও ভাবিতেছিল। এ কে করি? বিশু-ভাই নয় তো? কিন্তু বিশু বিদেশে থাকিয়া এ সব জানিবে কেমন করিয়া? ঠাকুরমহাশয় লিখিয়া জানাইলেন? হয়ত তাই। তাই সম্ভব। কিন্তু এ কি করিল বিশু-ভাই? এ বোঝা আর সহিতে পারিবে না! সে মুক্তি চায়। জীবন তাহার হাঁপাইয়া উঠিয়াছে। ক্লান্তি, অরুচি, তিক্ততায় তাহার অন্তর ভরিয়া উঠিয়াছে। আর দু-তিনটা দিন গেলেই সে তিনকড়ি-কাকার বাড়ি হইতে চলিয়া যাইবে। তিনকড়ির ঋণ তাহার জীবনে শোধ হইবার কথা নয়। রাম ভল্লা তাহাকে বন্যার স্রেত হইতে টানিয়া তুলিয়াছে। কুসুমপুরের ও-মাথা হইতে তিনখানা গ্রাম পার হইয়া দেখুড়িয়ার ধার পর্যন্ত সে ভাসিয়া আসিয়াছিল। তাহার পর হইতে তিনকড়ি তাহাকে নিজের ঘরে আনিয়া গোষ্ঠীসুদ্ধ মিলিয়া যে সেবাটা করিয়াছে তাহার তুলনা হয় না। তিনকড়ির স্ত্রী ও স্বর্ণ, নিজের মা-বোনের মত সেবা করিয়াছে; গৌরও সেবা করিয়াছে সহোদর ভাইয়ের মত। তিনকড়ি তাহাকে আপনার খুড়ার মত যত্ন করিয়াছে। কিন্তু এও তাহার সহ্য হইতেছে না, কোনোরকমে আপনার পা দুইটার উপর সোজা হইয়া দাঁড়াইবার বল পাইলেই সে চলিয়া যাইবে। এই অকৃত্রিম স্নেহের সেবাযত্ন তাহাকে অস্বচ্ছন্দ করিয়া তুলিয়াছে। এও তাহার ভাল লাগিতেছে না। ভোলা জানালা দিয়া দেখা যাইতেছে লোকের ভাঙা ঘর, বন্যার জলে হাজিয়া-যাওয়া শাক-পাতার ক্ষেত, পথের দুধারে পলি-লিপ্ত ঝোপঝাড়, গাছপালা, গ্রাম্য পথখানি যেখানে গ্রাম হইতে বাহির হইয়া মাঠে পড়িয়াছে সেইখান দিয়া পঞ্চগ্রামের মাঠের লম্বা একটা ফালি অংশ কাদায় জলে ভরা-শস্যহীন মাঠ। কিন্তু এসবের কোনো প্রতিফলন তাহার চিন্তার মধ্যে চাঞ্চল্য তুলিতেছে না। সে আর পারিতেছে না। সে আর পারিবে না। –দেবু-দা! গৌর আসিয়া প্রবেশ করিল, তাহার হাতে সেই কাগজখানা। দেবু তাহার দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিলবল! —এটা কেন লিখেছে দেবু-দা? এই যে? —কি? —এই যে, এইখানটা। খবরের কাগজটা দেবুর বিছানার উপর রাখিয়া গৌর বলিল—এই যে! দেবু হাসিয়া বুলিল—কি কঠিন যে বুঝতে পারলে না? কই দেখি! গৌর অপ্রস্তুত হইয়া বলিল—আমি না। আমিও তো বললাম–ও আবার কঠিন কি? স্বন্ন। বলছে! —কোন জায়গাটা? –এই যে এই সমস্ত বিপন্ন নরনারীকে রক্ষার দায়িত্ব দেশবাসীর উপর ন্যস্ত। সে দায়িত্বভার গ্রহণ করিতে সকলকে আহ্বান জানাইতেছি। তা স্বন্ন বলছেওই যে সুন্ন দাঁড়িয়ে আছে। আয় না, স্বন্ন, আয় না এখানে! দেবুও সস্নেহে আহ্বান করিল—এস স্বর্ণ, এস! স্বর্ণ আসিয়া কাছে দাঁড়াইল। দেবু বলিল—এর মানে তো কিছু কঠিন নয়! স্বর্ণ মৃৎস্বরে বলিল দায়িত্ব লিখেছে কেন তাই শুধোলাম দাদাকে। এ তো লোকের কাছে ভিক্ষা চাওয়া! যার দয়া হবে দেবে না হয় দেবে না। সে তো দায়িত্ব নয়! কথাগুলি দেবুর মস্তিষ্কে গিয়া অদ্ভুতভাবে আঘাত করিল। তাই তো! স্বর্ণ বলিল—আর আমাদের এখানে বান হয়েছে, তাতে অন্য জায়গার লোকের দায়িত্ব হতে যাবে কেন? দেবু অবাক হইয়া গেল। সে বুদ্ধিমতী মেয়েটির অর্থবোধের সূক্ষ্ম তারতম্যজ্ঞানের পরিচয় পাইয়া সবিস্ময়ে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। দেবুর সে দৃষ্টি দেখিয়া স্বর্ণ কিন্তু একটু অপ্রতিভ হইল। বলিল—আমি বুঝতে পারি নাই … সে লজ্জিত হইয়াই চলিয়া গেল।… দেবু তখন অবাক হইয়া ভাবিতেছিল, এ কথাটা তো সে ভাবিয়া দেখে নাই! সত্যই তো—নাম নাজানা এই গ্রাম কয়খানির দুঃখ-দুর্দশার জন্য দেশ-দেশান্তরের মানুষের দয়া হইতে পারে, কিন্তু দায়িত্ব তাহাদের কিসের? দায়িত্ব। ওই কথাটা গুরুত্বে ও ব্যাপ্তিতে তাহার অনুভূতির চেতনায় ক্রমশ বিপুল হইয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার এই পঞ্চগ্রামও পরিধিতে বাড়িয়া বিরাট হইয়া উঠিল। সে ডাকিল—স্বৰ্ণ। গৌর বসিয়া তখনও ওই লাইন কয়টি পড়িতেছিল। তাহার মনেও কথাটা লাগিয়াছে। সে বলিল—সুন্ন চলে গিয়েছে তো! —ও। আচ্ছা, ডাক তো তাকে একবার। ডাকিতে হইল না, স্বর্ণ নিজেই আসিল। গরম দুধের বাটি ও জলের গেলাস হাতে করিয়া আসিয়া বাটিটা নামাইয়া দিয়া বলিল—খান! দেবু বলিল—তুমি ঠিক ধরেছ স্বর্ণ। তোমার ভুল হয় নাই। তোমার বুদ্ধি দেখে আমি খুশি হয়েছি। স্বর্ণ লজ্জিত হইয়া এবার মুখ নামাইল। দেবু বলিল—তুমি রবীন্দ্রনাথের নগরলক্ষ্মী কবিতাটি পড়ে– দুর্ভিক্ষ শ্রাবস্তীপুরে যবে। জাগিয়া উঠিল হাহারবে,– বুদ্ধ নিজ ভক্তগণে শুধালেন জনে জনে ক্ষুধিতেরে অন্নদান-সেবা তোমরা লইবে বলো কেবা? পড়েছ? স্বর্ণ বলিল–না। –গৌর, তুমি পড় নি? —না। –শোন তবে। স্বর্ণ বাধা দিয়া বলিল-আগে আপনি দুধটা খেয়ে নিন। জুড়িয়ে যাবে। দুধ খাইয়া, মুখে জল দিয়া দেবু গোটা কবিতাটা আবৃত্তি করিয়া গেল। স্বর্ণ বলিল-আমাকে লিখে দেবেন কবিতাটি? দেবু বলিল—তোমাকে এই বই একখানা প্রাইজ দেব আমি। স্বর্ণের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। –পণ্ডিত মশায় আছেন। কে বাহির হইতে ডাকিল। গৌর মুখ বাড়াইয়া দেখিয়া বলিল—ডাক-পিওন। দেবু বলিল—এস। চিঠি আছে বুঝি? –চিঠি—মনিঅৰ্ডার! –মনি অর্ডার! –পঞ্চাশ টাকা পাঠাচ্ছেন বিশ্বনাথবাবু। বিশ্বনাথ চিঠিও লিখিয়াছে। তাহা হইলে এ সমস্ত বিশ্বনাথই করিয়াছে। লিখিয়াছে—দাদুর পত্রে সব জানিয়াছি, পঞ্চাশ টাকা পাঠাইলাম, আরও টাকা সংগ্ৰহ করিতেছি। তোমার কাছে অনেক মনিঅৰ্ডার যাইবে, আমরাও কয়েকজন শীঘ্ৰ যাইব। কাজ আরম্ভ করিয়া দাও। টাকাটা লইয়া দেবু চিন্তিত হইয়া পড়িল। বিশ্বনাথ লিখিয়াছে—কাজ আরম্ভ করিয়া দাও। পঞ্চাশ টাকায় সে কী কাজ করিবে? গৌরকে প্রশ্ন করিল-কাকা কোথায় গেলেন দেখ তো গৌর! দশে মিলি করি কাজ–হারি জিতি নাহি লাজ। দেবু অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া দশজনের পরামর্শ লইয়াই কাজ করিল। এই কাজে আজ
false
shorotchandra
পুনশ্চ ডাকিল, এক গেলাস জল দে তো তেওয়ারী। তাহার পাশের টুলের উপরেই খাবার জলের কুঁজা ও গেলাস ছিল, বিছানা পাতিতে পাতিতে তাহা দেখাইয়া দিয়া ভারতী বলিল, ঘুমন্ত মানুষকে আর কেন তুলবেন অপূর্ববাবু, আপনি নিজেই একটু ঢেলে নিন। অপূর্ব হাত বাড়াইয়া কুঁজাটা তুলিতে গিয়া তুলিতে পারিল না; তখন উঠিয়া আসিয়া কোন মতে জল গড়াইয়া লইয়া এক নিঃশ্বাসে তাহা পান করিয়া পুনরায় বসিতে যাইতেছিল, ভারতী মানা করিয়া কহিল, আর ওখানে না, একেবারে বিছানায় শুয়ে পড়ুন। অপূর্ব শান্ত বালকের ন্যায় নিঃশব্দে আসিয়া চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িল। ভারতী মশারি ফেলিয়া ধারগুলা ভাল করিয়া গুঁজিয়া দিতেছিল, অপূর্ব হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কোথায় শোবে? আমি? ভারতী কিছু আশ্চর্য হইল। কারণ, এরূপ ঘটনা নূতনও নয়, এবং এ ঘরের কোথায় কি আছে তাহাও তাহার অবিদিত নয়। এই অনাবশ্যক প্রশ্নের উত্তরে সে শুধু আরামচৌকিটা দেখাইয়া দিয়া বলিল, সকাল হতে আর ঘণ্টা-দুই মাত্র দেরি আছে। ঘুমোন। অপূর্ব হাত বাড়াইয়া তাহার হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, না ওখানে নয়, তুমি আমার কাছে বস। আপনার কাছে? বাস্তবিকই ভারতীর বিস্ময়ের অবধি রহিল না। অপূর্ব আর যাহাই হউক, এ-সকল ব্যাপারে কখনও আত্মবিস্মৃত হইত না। এমন কতদিন কত উপলক্ষেই ত তাহারা একঘরে রাত্রি যাপন করিয়াছে, কিন্তু মর্যাদাহানিকর একটা কথা একটা ইঙ্গিতও কোন দিন তাহার আচরণে প্রকাশ পায় নাই। অপূর্ব কহিল, এই দেখ এরা আমার হাত ভেঙ্গে দিয়েচে। কেন তুমি এদের মধ্যে আমাকে টেনে আনলে? তাহার কথার শেষ দিকটা অকস্মাৎ কান্নায় রুদ্ধ হইয়া গেল। ভারতী মশারির একটা দিক তুলিয়া দিয়া তাহার কাছে বসিল, পরীক্ষা করিয়া দেখিল, বহুক্ষণ ধরিয়া শক্ত বাঁধনের ফলে হাতের স্থানে স্থানে কালশিরা পড়িয়া ফুলিয়া আছে। চোখ দিয়া তাহার জল পড়িতেছিল, ভারতী আঁচল দিয়া তাহা মুছাইয়া লইয়া সাহস দিয়া বলিল, কিচ্ছু ভয় নেই, তোয়ালে ভিজিয়ে আমি ভাল করে জড়িয়ে দিচ্চি, দু-একদিনেই সমস্ত ভাল হয়ে যাবে। এই বলিয়া সে উঠিয়া গিয়া স্নানের ঘর হইতে একটা গামছা ভিজাইয়া আনিল, এবং সমস্ত নীচের হাতটা বাঁধিয়া দিয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিল, একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন, আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্চি। এই বলিয়া সে ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। অপূর্ব অশ্রুবিকৃতস্বরে বলিল, কাল জাহাজ থাকলে আমি কালই চলে যেতুম। ভারতী কহিল, বেশ ত, পরশুই যাবেন। একটা দিনের মধ্যে আপনার কোন অমঙ্গল হবে না। অপূর্ব ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া কহিতে লাগিল, গুরুজনের কথা না শুনলেই এই-সব ঘটে। মা আমাকে পুনঃ পুনঃ নিষেধ করেছিলেন। মা বুঝি আপনাকে আসতে দিতে চাননি? না, এক শ’ বার মানা করেছিলেন, কিন্তু আমি শুনিনি। তার ফল হল এই যে, কতকগুলো ভয়ানক লোকের একেবারে চিরকালের জন্য বিষদৃষ্টিতে পড়ে রইলুম। সে যা হবার হবে, দুর্গা দুর্গা বলে পরশু একবার জাহাজে উঠতে পারলে হয়। এই বলিয়া সে সহসা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিল। কিন্তু সেই সঙ্গে যে ইহা অপেক্ষাও শতগুণ গভীর নিঃশ্বাস আর একজনের হৃদয়ের মূল পর্যন্ত নিঃশব্দে তরঙ্গিত হইয়া উঠিল, তাহা সে জানিতেও পারিল না। আর একটা দিনও যেন না অপূর্বর বিলম্ব ঘটে, দুর্গা দুর্গা বলিয়া একবার সে জাহাজে উঠিতে পারিলে হয়! বর্মায় আসা তাহার সর্বাংশেই বিফল হইয়াছে, বাড়ি গিয়া এ দেশের জন-কয়েকের বিষদৃষ্টির কথাই শুধু তাহার চিরদিন স্মরণে থাকিবে, কিন্তু সকল চক্ষুর অন্তরালে একজনের কুণ্ঠিত দৃষ্টির প্রতিবিন্দু হইতেই যে নীরবে অমৃত ঝরিয়াছে, একটা দিনও হয়ত সে কথা তাহার মনে পড়িবে না। অপূর্ব কহিতে লাগিল, এ বাড়িতে পা দিয়েই তোমার বাবার সঙ্গে ঝগড়া হল, কোর্টে জরিমানা পর্যন্ত হয়ে গেল যা জন্মে কখনো আমার হয়নি। এর থেকেই আমার চৈতন্য হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হল না। ভারতী চুপ করিয়া ছিল, চুপ করিয়াই রহিল। অপূর্ব নিজেও একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া তাহার দুরদৃষ্টের সুত্র ধরিয়া বলিল, তেওয়ারী আমাকে বার বার সাবধান করেছিল,—বাবু, ওরা এক জাত, আমরা এক জাত, এ-সব করবেন না। কিন্তু কপালে দুর্ভোগ থাকলে কে খণ্ডাবে বল? চাকরি সেই গেল,—পাঁচ শ’ টাকা মাইনে এ বয়সে কটা লোকে পায়? তাছাড়া এ হাত আমি লোকের সুমুখে বার করব কি করে? ভারতী আস্তে আস্তে বলিল, ততদিনে হাতের দাগ ভাল হয়ে যাবে। ইহার বেশী কথা মুখ দিয়া তাহার বাহির হইল না। মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেছিল, সে হাত আর চলিতে চাহিল না, এবং এই অত্যন্ত সাধারণ তুচ্ছ লোকটাকে সে মনে মনে ভালবাসিয়াছে মনে করিয়া নিজের কাছেই যেন সে লজ্জায় মরিয়া গেল। এ কথা দলের অনেকেই জানিয়াছে আজ অপূর্বর প্রাণ বাঁচাইতে গিয়া তাহাদের কাছে অপরাধী এবং সুমিত্রার চক্ষে সে ছোট হইয়া গেছে, কিন্তু এই অতি তুচ্ছ মানুষটাকে হত্যা করিবার অসম্মান ও ক্ষুদ্রতা হইতে সে যে তাহাদের রক্ষা করিতে পারিয়াছে ইহাই মনে করিয়া এখন তাহার গর্ব বোধ হইল। অপূর্ব বলিল, দাগ সহজে যাবে না। কেউ জিজ্ঞাসা করলে যে কি জবাব দেব জানিনে। কিন্তু শ্রোতার নিকট হইতে সায় না পাইয়া আপনিই কহিতে লাগিল, সকলে ভাববে কাজ চালাতে আমি পারলুম না। তাইত লোকে বলে, বাঙালীর ছেলেরা বি. এ. এম. এ পাশ করে বটে, কিন্তু বড় চাকরি পেলে রাখতে পারে না। আমার কলেজের ছেলেরা আমাকে ছি ছি করতে থাকবে, আমি উত্তর দিতে পারব না। যাহোক কিছু একটা বানিয়ে বলে দেবেন। আচ্ছা, আপনি ঘুমোন। এই বলিয়া ভারতী উঠিয়া দাঁড়াইল। আর একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও না
false
toslima_nasrin
এবং মূল্য দুটোই আমি ভালো অনুধাবণ করতে পারি। স্বেচ্ছাচারী না হলে, অন্যের ইচ্ছের যূপকাষ্ঠে বলি হলে, আমার বোঝার সাধ্য ছিল না আমি কে, আমি কেন। মানুষ যদি নিজেকেই চিনতে না পারলো, চিনবে তবে কাকে! আজ যদি স্বেচ্ছাচারী না হতাম আমি, হয়তো এই লেখাটি, যে লেখাটি লিখছি, তার একটি বাক্যও আমি লিখতে পারতাম না। অধিকাংশ বাঙালি-হিন্দু, এমনকী যারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করেছে, রাজনীতি অর্থনীতির জ্ঞানও যাদের বেশ প্রখর, মনে করে যে বাঙালি বলতে বাঙালি- হিন্দু বোঝায়। বাঙালি-মুসলমান, বাঙালি-খ্রিস্টান, বাঙালি-বৌদ্ধ, বাঙালি-নাস্তিকও যে ‘বাঙালি’ তা তারা জানে না। বাঙালি হিন্দুর এই অজ্ঞানতা দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। পূর্ববাংলা বা বাংলাদেশের বাঙালিদের ‘বাংলাদেশি’ বলে ডাকার চল এ দেশে খুব। বাংলাদেশি গরু, বাংলাদেশি আইন হতে পারে, কিন্তু মানুষ কী করে বাংলাদেশি হয়! বাঙালি জাতি তো একাণ্ডরে বাংলাদেশ নামের একটি দেশ জন্ম নেওয়ার সময় জন্ম নেয়নি। বাঙালি তার দীর্ঘশতাব্দীর ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বাঙালিই আছে, দেশের নাম শুধু রাজনৈতিক কারণে বারবার বদলে যাচ্ছে। সে বদলে যাওয়ার দায় জাতি নেবে কেন! যে ধর্মবাদীরা সমৃদ্ধ এবং সেকুলার বাঙালি-সংস্কৃতিকে বিনাশ করে ইসলামী-সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দেশের সর্বনাশ করতে চেয়েছিল, তারা সংবিধান বদলে ফেলেছে বাঙালি-জাতীয়তাবাদের জায়গায় বাংলাদেশি-জাতীয়তাবাদ ঢুকিয়ে। এই তারাই একই উদ্দেশ্য নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিদেয় করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছে। বাঙালি-মুসলমানের সংখ্যা বাঙালি-হিন্দুর চেয়ে বেশি, সুতরাং বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতিই শেষ অবধি বাঙালি-সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার বেশি সম্ভাবনা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাঙালি-মুসলমানের সংস্কৃতি অবাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন। এবং অনেক মিল থাকলেও বাঙালি-হিন্দুর সংস্কৃতির সঙ্গেও এর তফাৎ আছে। বাঙালি-মুসলমানের ভাষা ও সংস্কৃতি ঐতিহাসিক কারণে নানা বিদেশি ধর্ম-সংস্কৃতি ও ভাষার প্রভাবে সমৃদ্ধতর। বাঙালি নারী হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ইসলাম যে কোনও ধর্মে বিশ্বাসী হতে পারে, অবিশ্বাসীও হতে পারে। বাঙালি নারী কেমন আছে বাংলায়, কেমন তাদের দিন রাত্তির— এই প্রশ্নটি যখন নিজের কাছে করি আমি, বড় বেদনায় নুয়ে আসি। যেসমাজে ধর্ম জাঁকিয়ে বসা, সে সমাজে কোনও নারী কি মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে? ধর্ম জাঁকিয়ে বসলে পুরুষতন্ত্র জাঁকিয়ে বসে। ধর্ম এবং পুরুষতন্ত্রের যেখানে জয়জয়কার, সেখানে নারীর পরিচয় দাসী বা যৌনবস্তু বা সন্তান-উৎপাদনের যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। বাঙালি নারী এই পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকে, বেঁচে ছিল। অনেকে পরিবর্তনের কথা বলে। গ্রামগুলো মফস্বল হচ্ছে, মফস্বলগুলো শহর, শহরগুলো নগর। নগরে উঁচু উঁচু দালান। ইস্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়। যে বাঙালি-নারীর ঘরবার হওয়া, লেখাপড়া করা নিষিদ্ধ ছিল এই সেদিন, সে আজ ইস্কুল কলেজ পাশ করছে, বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙোচ্ছে, চাকরি বাকরি করছে, অর্থ উপার্জন করছে। শহর নগরের শিক্ষিত এলাকায় বাস করলে মনে হয় পরিবর্তন বুঝি আকাশ-সমান। কিন্তু সুবিধে পাওয়া নারী ক’জন সংখ্যায়? আশি ভাগ নারী এখনও জানে না কী করে লিখতে পড়তে হয়। দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষের অধিকাংশই নারী। নারীরা ভুগছে, কেবল ধর্ম ও পুরুষতন্ত্র তাদের চাবুক মারছে না, দারিদ্র্যও তাদের রক্তাক্ত করছে। কিন্তু যে নারীরা মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত? তারা কি সুখে আছে? না। আসলে নারীর কোনও শ্রেণী নেই, জাত নেই। যে শ্রেণীতেই তাদের বাস, যে বর্ণেই তারা চিহ্নিত, তারা নির্যাতিত। নির্যাতনের কায়দা ভিন্ন, ধরন একই। যারা লেখাপড়া জানে, যারা শিক্ষিত, তারা কি নিজের অধিকার নিয়ে বেঁচে আছে? তারা কি আদৌ স্বাধীন? না। আসলে নারী শিক্ষিত হোক, অশিক্ষিত হোক, নির্যাতিতই। নির্যাতিত, কারণ তারা নারী। নির্যাতিত, কারণ ধর্ম পুরুষতন্ত্র সংস্কৃতি সমাজ সবই নারীবিরোধী। শিক্ষিত মেয়েরা পুরুষতন্ত্রের নিয়মকানুন যত নির্ভুলভাবে শিখতে পারে, অশিক্ষিত মেয়েরা তত পারে না। শিক্ষিত মেয়েরাও স্বামীর আদেশ নির্দেশ মতো চলছে। স্বামী তাকে অনুমতি না দিলে সে চাকরি করতে পারছে না। আর, যে মেয়েরা চাকরি বা ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করছে, তারা অথনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করছে বটে, কিন্তু স্বনির্ভর হতে পারছে না। এখনও পচা পুরোনো সংস্কৃতি নারীকে পুরুষের অধীন করে রাখছে। এখনও নারীকে পরনির্ভর করে রাখার পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র এক তুড়িতে হুররে। সংস্কৃতি, সে যদি মানবতার বিপক্ষে যায়, সে যদি সমতার সামনে বেয়াদপের মতো দাঁড়ায়, তাকে উড়িয়ে না দিয়ে পুড়িয়ে না দিয়ে লালন করার কী অর্থ? সংস্কৃতি যদি বহমান নদী না হয়ে বদ্ধ জলাশয় হয়, ওতে সাঁতার আমরা কাটবো কেন? বাঙালি সংস্কৃতির সংস্কার না হওয়া-তক, একে বৈষম্যহীন না করা-তক এই সংস্কৃতি নিয়ে গৌরব করার কিছু নেই। বিশেষ করে নারীর তো নেইই। সভ্য হতে গিয়ে দেশকে বাধ্য হতে হয়েছে নারীবিরোধী কিছু প্রথার বিলুপ্তি ঘটাতে। কিন্তু অধিকাংশ পুরুষ এবং নারীর মানসিকতা এখনও ভয়াবহরকম পুরুষতান্ত্রিক। নারীর অধিকার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হলে সমাজে নারী পুরুষের প্রচলিত প্রভু দাসীর ভূমিকা বদলের প্রয়োজন প্রচণ্ড। শিশুবয়স থেকে যেমন এই শিক্ষাটি নেওয়া জরুরি, যে, নারী ও পুরুষ উভয়ের অধিকারে কোনও তফাৎ নেই, একই সঙ্গে সমাজে নারী পুরুষের সমানাধিকারের চর্চাও দেখা জরুরি। পড়ে বা শুনে যত না মানুষ শেখে, দেখে তার চেয়ে বেশি শেখে। নারীর অবস্থার উন্নতি যদি সত্যিকার হত, তবে এখনও কনে দেখা, এখনও পণ প্রথা টিকে থাকতো না। মেয়েশিশু হত্যা হত না, যেমন হচ্ছে। কেউ কেউ বলে মেয়েরা নির্যাতিত যদি হয়েই থাকে, গ্রামে হচ্ছে, শহরে নয়। পশ্চিমবঙ্গে মেয়েভ্রুণহত্যা সবচেয়ে বেশি কিন্তু হচ্ছে কলকাতা শহরে। এই শহরে সবার নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে দাঁতাল হাসি হাসছে বীভৎস বেশ্যালয়। যেন পুরুষেরা প্রতিনিয়ত ওখানে ভিড় করতে পারে নারীকে কুৎসিতভাবে অপমান করার জন্য,
false